14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

পঞ্চরত্ন: বাংলা ছবির পাঁচ কমেডিয়ান

12th Apr 2024

বিনোদন

কমলেন্দু সরকার


হাসির ছবি ভাল লাগে না এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছোট-বড় সকলেই পছন্দ করেন হাসির ছবি। একটা সময় ছিল প্রতি বছরই বেশকিছু কমেডি ছবি হত টালিগঞ্জে। সব ছবিই যে ভাল হত, তেমন নয়। কিছু কিছু ছবিতে ছিল পেটে কিল মেরে হাসানোর চেষ্টা। অর্থাৎ জোর করে হাসানো। তবে, বেশিরভাগ হাসির ছবিই হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। সেসব ছবি গেল কোথায়!
হাস্যরসে ভরপুর বাংলা ছবি এখন উধাও। হিন্দিতে  দু'চারটি এখনও দেখা গেলেও বাংলাতে হাসির ছবির  দেখা পাওয়া মুশকিল। অনেকেই বলেন৷ "ভাল কমেডি ছবি নেই, তাই আর সিনেমা দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না। সিনেমা হল-এ গিয়ে ছবি দেখতে বসে প্রাণ খুলে আর হাসতে পারি না। তাই টিভিতে পছন্দের হাসির ছবি হলে দেখি, সময় কাটাই। হাসির ছবি চিরকালই থাকবে। নইলে এখনও চার্লি চ্যাপলিন-এর ছবির এত চাহিদা!" আবার বর্ষীয়ান সিনেমাপ্রেমীদের মত, "সেইসময় কীসব কমেডিয়ানরা ছিলেন! এখন হাসাবেনটা কে? কমেডিয়ান কোথায়?" এখন হাসির ছবি করবেন কে? কিংবা হাসির ছবি কোথায়? এসব তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে দেখে নিই সেকালের কয়েকজন কমেডিয়ানকে যাঁদের বাঙালি ভুলে যেতে বসেছেন। 
ভানু-জহরের কথা ছেড়েই দিই। ওঁদের এখনও পর্যন্ত মনে রেখেছেন বাঙালি দর্শকেরা। কিন্তু ক'জন মনে রেখেছেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার, শ্যাম লাহা, মণি শ্রীমানি, হরিধন মুখোপাধ্যায়কে! 
নবদ্বীপ হালদারের গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন। গ্রাম মানে অজ পাড়াগাঁ। তবে, বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বর্ধমানের সোনপলাশী। নবদ্বীপ হালদার কলকাতা এসে চাকরি করতেন ব্রিটিশদের ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশনে। তিনি কীভাবে জেনেছিলেন দেবকী বসু হলেন বর্ধমানের লোক। দেবকী বসু ৩০ টাকা মাইনেতে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মস-এ। এদের প্রথম ছবি 'কামনার আগুন' (১৯৩০)। কাহিনি, চিত্রনাট্য, পরিচালনার পাশাপাশি ছোট্ট একটি ভূমিকায় দেবকী বসু অভিনয় করেছিলেন। ব্রিটিশ ডোমেনিয়ন ফিল্মসের পঞ্চম ছবি 'পঞ্চশর' (১৯৩০) নিজের কাহিনি, চিত্রনাট্য নিয়ে ছবি করার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন পরিচালক দেবকী বসু। ঠিক এমন সময় একদিন নবদ্বীপ হালদার অফিসে এসে হাজির। শোনা যায়, এ-কথা সে-কথার পর দেবকী বসুকে তিনি নাকি কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, আপনিও বর্ধমানের, আমিও বর্ধমানের। তাহলে আপনি যদি সিনেমা করেন, আমিও কেন পারব না? নবদ্বীপ হালদারের বাচনভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেছিলেন দেবকী বসু। বেশ মজা পেয়েছিলেন তিনি। বললেন, 'নিশ্চয়ই করবেন।' নবদ্বীপ হালদারের কথা বলার ভঙ্গি এবং ধরন পছন্দ করেছিলেন দেবকী বসু। 
'পঞ্চশর' ছবিতে একটি চরিত্র ছিল হোটেলওয়ালার, তার জন্য নির্বাচন করেছিলেন নবদ্বীপ হালদারকে। জানা যায়, চমৎকার অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্মসের ছবিতে আর দেখা যায়নি তাঁকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেবকী বসুর একাধিক ছবি করেন নবদ্বীপ হালদার৷ সাহিত্যিক-পরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় বলতেন, নবদ্বীপ হালদার অসাধারণ অভিনেতা। ওঁর জন্য আমাকে ছবির চিত্রনাট্যও বদল করতে হয়েছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রও ভীষণ পছন্দ করতেন নবদ্বীপ হালদারকে। তিনিও মনে করতেন নবদ্বীপ হালদার বেশ বড় মাপের অভিনেতা। পরিচালক প্রেমেন্দ্র মিত্র 'হানাবাড়ি' (১৯৫২) ছবিতে চমৎকারভাবে ব্যবহার করেছিলেন নবদ্বীপ হালদার-শ্যাম লাহা জুটিকে। দু'জনেই চমৎকার অভিনয় করেন এই ছবিতে। বাগ (শ্যাম লাহা) এবং নাগ (নবদ্বীপ হালদার) এক কোম্পানির দুই অংশীদার। কোম্পানির কাজ বাড়ি কেনা-বেচা করা। ডায়মন্ড হারবার রোডের ওপর এক হানাবাড়ির বেচা-কেনা নিয়ে ওঁদের দু'জনের যত কাণ্ড! এখানেই নবদ্বীপ হালদার-শ্যাম লাহা জুটির অভিনয়। ওঁদের অভিনীত প্রতিটি দৃশ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা ছিল কে কাকে টেক্কা দেন। দু'জনেই দাপিয়ে অভিনয় করেছিলেন। 
সবচেয়ে মজার ছিল অফিসের হাজিরা নিয়ে। বাগ অর্থাৎ শ্যাম লাহা প্রতিদিনই আগে অফিস আসতেন। নিয়ম করে দেরি করতেন নাগ অর্থাৎ নবদ্বীপ হালদার। এসে বাগের টেবিলে থাকা ঘড়ির কাঁটা এগারোটা করে দিতেন। নাগকে হাতেনাতে ধরার জন্য বাগ একদিন এসে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। নাগ যথারীতি দেরি করে ঢুকে ঘড়ির কাঁটা ঘোরাতে যাওয়ার সময় বাগের হাতে ধরা পড়েন। তারপর ওঁদের দু'জনের কাণ্ডকারখানায় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার উপক্রম। হানাবাড়ি বিক্রি করার পর ক্রেতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার দৃশ্যটিও খুবই উপভোগ্য। বাগ এবং নাগের কথোপকথন চমৎকার। দু'জনের সংলাপ বলার মধ্যে প্রচুর মজা পাওয়া যায়। যখন নাগকে বাগ বলেন, 'ভূতে আবার ইংরেজি বলে দেখছি!' এই কথা বলার ধরনটি ভীষণ মজার। ভয়ের সঙ্গে বিস্ময় মিশ্রিত সংলাপ বলা, যা এককথায় অসাধারণ! এত স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপ বলেন নবদ্বীপ হালদার এবং শ্যাম লাহা তা কানখাড়া করে শুনতে হবে। নইলে মজাটাই মারা যাবে মাঠে। নবদ্বীপ হালদার তাঁর অভিনয়ের ভিতর চমৎকারভাবে স্ট্যান্ডআপ কমেডির আদল ব্যবহার করতেন। এ-প্রসঙ্গে সবচেয়ে ভাল উদাহরণ পরিচালক অসীম পালের 'স্বর্গ-মর্ত্ত' (১৯৫৮) ছবিতে নবদ্বীপ হালদার অভিনীত যমদূতের ভূমিকাটির কথা বলা যেতে পারে। সেইসময় ভানু-জহররের মতো জনপ্রিয় জুটি ছিল নবদ্বীপ হালদার এবং শ্যাম লাহা। 'হানাবাড়ি'র পর 'মানিকজোড়'  (১৯৫২), পরিচালক কালীপদ দাশ। একজোড়া ক্যাবলা নবা আর গবা। পরস্পর ভায়রাভাই। ওদের বাড়ি আমড়াগাছি। বিয়ে করেছেন কলকাতায়। শ্বশুরবাড়ি আসতে গিয়ে যত গণ্ডগোল। শ্বশুর বাড়ি পাল্টেছেন কিন্তু নতুন বাড়ির ঠিকানা অজানা নবা-গবার। সেই নিয়েই মজা, হাজারো কাণ্ড! নানান হই-হুল্লোড়ে ছবির সমাপ্তি। 
'মানিকজোড়' ছবির বিজ্ঞাপনেই থাকত-- হাসির হুল্লোড়। যে-ছবিতে মানিকজোড় নবদ্বীপ হালদার আর শ্যাম লাহা আছেন, সেই ছবিতে হাসির হুল্লোড় থাকবে না তো রামগড়ুরের ছানা থাকবে! তাই 'মানিকজোড়' কমেডি ছবি হিসেবে পাতে দেওয়ার না-হলেও, শুধুমাত্র নবদ্বীপ হালদার এবং শ্যাম লাহার সুবাদে বক্স-অফিসের সাফল্য পায়। পঞ্চাশের দশকে এঁরা দু'জন ছিলেন দর্শকের পছন্দের অভিনেতা। এ-প্রসঙ্গে তৎকালীন 'দেশ' সাপ্তাহিকের (২০ ডিসেম্বর, ১৯৫২) 'মানিকজোড়' ছবির সমালোচনার একটি অংশ উল্লেখ করা যাক, 'যাই হোক, গবা-নবার জুড়িটা মিলেছে ভালো-- শ্যাম লাহা ও নবদ্বীপের জনপ্রিয়তা যে আছে, 'মাণিকজোড়ে' দর্শক সমাগম তার প্রমাণ। দেখার পর লোকে খুশির কথা বলতে না পারুক, ওদের দুজনের জন্যেই যে দেখতে ভীড় করছে, সেকথা অনস্বীকার্য'। 
সিনেমার পাশাপাশি পেশাদারি মঞ্চ, যাত্রা, বেতার নাটকেও নিয়মিত অংশ নিতেন নবদ্বীপ হালদার। এছাড়াও মঞ্চে কৌতুক নকশা পরিবেশনে নবদ্বীপ হালদারের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। তাঁর যাত্রার গল্প, ঘটকালি, আদালতের কাণ্ড, বাবার গল্প, পাঠার গরম, রসগোল্লায় ইঁদুর, ইঞ্জেকশন বিভ্রাট ইত্যাদি কৌতুক নকশাগুলি সেকালে ছিল প্রবল জনপ্রিয়। নবদ্বীপ হালদারের সঙ্গে কৌতুক নকশায় অংশ নিতেন তুলসী চক্রবর্তী, হরিধন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইউএসপি ছিল যেমন বাঙাল কথা, তেমনই নবদ্বীপ হালদারের ছিল কণ্ঠস্বর। 
চাঁদ বাদ দিয়ে শ্যাম হয়েছিলেন। পিতৃদত্ত নাম শ্যামচাঁদ লাহা। যে-বছর সাহেবদের হারিয়ে মোহনবাগান আইএফএ শিল্ড জিতেছিল, সেই বছরই জন্ম শ্যাম লাহার। এ-নিয়ে গর্বের অন্ত ছিল না তাঁর। শ্যাম লাহার মানিকজোড় নবদ্বীপ হালদারের জন্মও নাকি ১৯১১। ছোটবেলায় ছিল গান শেখার শখ। তবে বেশি টান ছিল পালোয়ানিতে। নিত্য যেতেন কুস্তির আখড়ায়। লেখাপড়ায় টান ছিল না বিন্দুমাত্র। একসময় তিমিরবরণ-এর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। বাজাতেও জানতেন বিভিন্নরকম বাদ্যযন্ত্র। তিমিরবরণের সঙ্গে ঘুরেওছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তিমিরবরণের সুবাদে পরিচয় পাহাড়ি সান্যালের সঙ্গে। তিনি একবার পাহাড়ি সান্যালের গানের সঙ্গে তবলাও বাজান। 
পাহাড়ি সান্যালের সুবাদে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যোগাযোগ। পাহাড়ি সান্যালের হাতচিঠি নিয়ে নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয় প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে পরিচয়। সেইসময় প্রমথেশ বড়ুয়া করছিলেন 'দেবদাস' (১৯৩৫)। ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন শেষ। তবু্ও পাহাড়ি সান্যালের অনুরোধে মাতালের ছোট্ট একটি চরিত্র দেন শ্যাম লাহাকে। প্রমথেশ বড়ুয়ারও মনে হয়েছিল খারাপ করবেন শ্যাম লাহা। করেওছিলেন চমৎকার অভিনয়। প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবিতে অভিনয়জীবন শুরু। তাই শুরু থেকেই টালিগঞ্জের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শ্যাম লাহার পায়ের তলার মাটি বেশ শক্তপোক্ত ছিল। এই বছরই অর্থাৎ ১৯৩৫-এ পরিচালক ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায় তিন রিলের ছোট্ট একটি কমেডি ছবি করেন। সেই ছবিতে শ্যাম লাহাকে নির্বাচিত করেছিলেন ঘনশ্যামের ভূমিকায়। জানা যায়, শ্যাম লাহার কাজে খুশি হয়েছিলেন পরিচালক। একই সময়ে করছেন পরিচালক নীতিন বসুর 'ভাগ্যচক্র' (১৯৩৫)। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই ছবি থেকেই বাংলায় প্রথম প্লে-ব্যাক শুরু। শ্যাম লাহার ছিল একেবারে ভিন্ন চরিত্র। এখানে তিনি আর ইন্দু মুখোপাধ্যায় ছিলেন গোয়েন্দা জুটি। চমৎকার অভিনয় করেছিলেন তিনি। 
বাবার চাকরির সুবাদে দিল্লিতে ছিলেন অনেকদিন। তাই হিন্দি এবং উর্দু বেশ ভাল জানতেন শ্যাম লাহা। পরবর্তী সময়ে কাজে লাগে তাঁর। সেইসময় টালিগঞ্জে হিন্দি ছবি হত। বহু হিন্দি ছবিও করেছেন শ্যাম লাহা। শ্যাম লাহা কমেডি ছাড়াও নানারকম চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ওঁর মুখ এবং চোখ দু'টি ছিল অভিনয়ের plus point. অভিনয় বা দৃশ্য অনুযায়ী চমৎকার expression দিতেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে দু'টি ছবির নাম নেওয়া যায় 'দেয়া নেয়া' (১৯৬৩) এবং 'বসন্ত বিলাপ' (১৯৭৩)। 'দেয়া নেয়া' ছবিতে পাহাড়ি সান্যালের গাড়ির ড্রাইভার অনুমান। অমন বোকা বোকা চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন তিনি। বহু ছবিতেই এমন বোকা বোকা চরিত্র করেছিলেন। কমেডি তো করেইছেন। করেছেন ভিলেন এবং গোয়েন্দার ভূমিকাও।
অভিনয়, কৌতুক নকশা করা ছাড়াও শ্যাম লাহা করতেন অ্যারেঞ্জার-এর কাজ। কিশোরকুমার যখন 'লুকোচুরি' (১৯৫৮) করছেন তখন কলকাতার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুম্বাই (তৎকালীন বম্বে) নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে ছিলেন শ্যাম লাহা। এই ছবিতে নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছিল একটি ভাল ভূমিকা। কিন্তু নৃপতির ছিল উড়োজাহাজ-ভীতি। তিনি কিছুতেই প্লেনে উঠতে চাইতেন না। ওদিকে কিশোরকুমার বলে দিয়েছেন, নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া ছবি হবে না। ওঁকে রাজি করাতেই হবে। শেষমেশ রাজি হলেন প্লেনে চড়তে। মুম্বাই যাওয়ার দিন নৃপতি চট্টোপাধ্যায় কোটপ্যান্ট পরে হাজির এয়ারপোর্টে। প্লেন ছাড়ার আগে বারবার শ্যাম লাহাকে জিজ্ঞেস করছেন, কোনও ভয় নেই বল। এত লোকে তো যাচ্ছে। তুইও তো মাঝেমধ্যে প্লেনে চড়িস। শ্যাম লাহা বোঝাচ্ছেন, বলছেন বারবার, তোমার এত কিসের ভয়! এত লোক তো যাচ্ছে। রোজই প্লেন ভেঙে পড়ছে!
প্লেনে চড়ার টেনশনে কোথাও চুপচাপ, স্থির হয়ে থাকতে পারছেন না। খালি পায়চারি করছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। প্লেন ছাড়ার প্রায় সময় হয়ে এসেছে, সেই সময় সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে শ্যাম লাহাকে এসে বললেন, প্লেনে চাপব, বম্বে যাব, এতে ভয়ের কি আছে বল। কথাগুলো বলেই লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে চলে গেলেন। প্লেনের ঘোষণা শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেল। তবুও দেখা মিলল না নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের। উনি ছাড়া বাকি সবাই মুম্বাই গেলেন। শ্যাম লাহা বললেন   কিশোরকুমারকে, অন্য কাউকে দিয়ে রোলটা করিয়ে নিন। তখন কিশোরকুমার বললেন, মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের রোল অন্য কেউ করবেন! ওঁর পার্ট কেউ করতেই পারবেন না। শেষপর্যন্ত নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের অংশটি কলকাতায় এসে শুটিং করেছিলেন কিশোরকুমার।

ঢাকার নারায়ণগঞ্জের নৃপতি চট্টোপাধ্যায় কোনওদিন অভিনয় করবেন ভাবেননি। তিনি ছিলেন ভবঘুরে। মন বসত না বাড়িতে। যখন-তখন বেরিয়ে পড়তেন ঘর ছেড়ে বাইরে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন কলকাতা। হঠাৎই এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি বগলদাবা করে নৃপতিকে নিয়ে আসেন তাঁর বাড়িতে। সেই আত্মীয় নাড়িনক্ষত্র জানতেন নৃপতির। একদিন তিনি নৃপতিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন বন্ধুলোক পরিচালক-অভিনেতা সুশীল মজুমদারের কাছে। নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে তিনি বলেন, অভিনয় করতে পারেন? নৃপতি জানান, একেবারেই নয়। কিন্তু ওখানে বেশ জমে গেলেন নৃপতি। তিনি নানারকম গুলগাপ্পি, অঙ্গভঙ্গি, মজা করে মাতিয়ে রেখে ছিলেন। সুশীল মজুমদারের ভাল লাগে নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে। ভাবলেন, এ পারবে। তিনি সহযোগী পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে নেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে।
এই শুরু নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের। দেখে দেখে শিখে ফেলেন অভিনয়। ধীরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তখন করছিলেন 'দ্বীপান্তর' (১৯৩৬), নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে নির্বাচিত করলেন তাঁর ছবিতে। 'দ্বীপান্তর'ই হল নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম ছবি। তাঁর অভিনীত চরিত্রের নাম শুকুল।
পরিচালক সুশীল মজুমদারের 'মুক্তিস্নান' (১৯৩৭), 'রিক্তা' (১৯৩৮) ছবিতে কাজ করলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। এর পরের ছবি 'তটিনীর বিচার' (১৯৪০)-এ পরিচালক সুশীল মজুমদার খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করালেন নৃপতিকে দিয়ে। পরিচালকের মান রেখেছিলেন নৃপতি। প্রশংসিত হয় তাঁর অভিনয়ের। ছবি বেশ ভাল চলেছিল। বক্স-অফিস সাফল্য পেয়েছিল ছবিটি। ভবঘুরে নৃপতি চট্টোপাধ্যায় বাঁধা পড়লেন সিনেমাজগতে। বাংলা ছবিতে ক্রমশ চাহিদা বাড়ল নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের। অভিনয় করতে লাগলেন একের পর এক ছবিতে। খলনায়ক থেকে হয়ে গেলেন কমেডিয়ান। নৃপতি চট্টোপাধ্যায় অভিনয়কে ভালবেসে জড়িয়ে পড়লেন বাংলা সিনেমাজগতে।
পরিচালক তপন সিংহও নৃপতি চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে একবারে অন্যরকম অভিনয় করিয়েছিলেন 'নির্জন সৈকতে' (১৯৬৩) ছবিতে। সত্যজিৎ রায়ের 'সমাপ্তি'র 'পোস্টমাস্টার'-এর অংশে বিশু পাগলের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। 'লেফট' বলে ডান-পা ফেলা এবং 'রাইট' বলে বাঁ-পা ফেলার অভিনয় ছিল অনবদ্য। ছোট্ট ভূমিকা কিন্তু দর্শক-মনে তার ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। এ-সম্পর্কে পরিচালক তপন সিংহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "নৃপতি চট্টোপাধ্যায় 'তিন কন্যা'র 'পোস্টমাস্টার'-এ পাগলের একটা ছোটো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সে রাস্তার ওপর বসে থাকে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা নিয়ে। ভাব তো কী অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ভাবনাটা সত্যজিৎবাবুর, কিন্তু সেটাকে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাটা তো অভিনেতার কৃতিত্ব।" (চিত্রভাষ, তপন সিংহ বিশেষ সংখ্যা, সাক্ষাৎকার: রাজা সেন ও জ্যোতিপ্রকাশ মিত্র, জানুয়ারি,২০০৪)।
এরপরে সত্যজিৎ রায়ের 'চিড়িয়াখানা' (১৯৬৭)-য় মুশকিল মিঞার চরিত্রে অভিনয়। ছোট্ট অভিনয় কিন্তু কি সাবলীল। উত্তমকুমারের চোখে চোখ রেখে অভিনয় করে গেলেন। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৯) ছবিতে কারগারের রক্ষীর ভূমিকায় একটিও সংলাপ না-বলে শুধুমাত্র expression দিয়ে অভিনয় করে গেলেন। দৃশ্যটি ছিল হাল্লার রাজার কারাগারে গুপী আর বাঘা ভূতের রাজার বরে ভাল ভাল খাবার খাচ্ছে। হাড় জিরজিরে ক্ষুধার্ত বয়স্ক  কারারক্ষী লোলুপ চোখে সেই খাবারের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। শেষে গুপী-বাঘার ফেলে যাওয়া খাবার গোগ্রাসে খায় সেই বৃদ্ধ রক্ষীটি। এই চরিত্রটিতে শুধুমাত্র শরীরী অভিনয় করে গেলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। এককথায় অসাধারণ! খুব বড় মাপের অভিনেতা না-হলে এমন সংলাপহীন অভিনয় সম্ভব নয়। এমন বহু ছোট ছোট চরিত্র কিংবা ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। কোনওদিনই ছোট ভূমিকা বলে অবজ্ঞা করেননি। দায়িত্ব নিয়ে করেছিলেন অভিনয়। 
নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের সমসাময়িক ছিলেন মণি শ্রীমানি। ম্যাট্রিক পাশ করার পরই সংসারের ভার পড়ে তাঁর ওপর। কর্নওয়ালিস স্ট্রিট অর্থাৎ বিধান  সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের মোড়ের কাছে পাল পেপার মার্চেন্ট-এর দোকান। সেখানে কাজ করতেন তিনি। আর নেশা ছিল অভিনয়ের। মণি শ্রীমানির অভিনয়জীবনের শুরু অন্য আর পাঁচজনের মতো ছিল না। কিন্তু তাঁর অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ এবং নিষ্ঠা দেখে কাছে টেনে নিয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। অত্যন্ত স্নেহ করতেন মণি শ্রীমানিকে। 
সময়টা ১৯৩৬। শিশির ভাদুড়ি মঞ্চস্থ করছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'যোগাযোগ'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এসেছিলেন সেই নাটক দেখতে। তাঁর নবনাট্যের 'যোগাযোগ' মঞ্চস্থ হয়েছিল স্টার থিয়েটারে। মণি শ্রীমানির অভিনয় দেখে খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি ছিল মণি শ্রীমানির অভিনয়জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। 
শিশিরকুমার ভাদুড়ি ১৯৩৭-এ কালী ফিল্মসের ব্যানারে করলেন 'দস্তুরমতো টকি'। এই ছবিতে ছোট একটি চরিত্রে নির্বাচন করলেন মণি শ্রীমানিকে। মঞ্চ থেকে ফিল্মে এলেন তিনি। এখানেও বেশ সাবলীল মণি শ্রীমানি। এই শুরু হল সিনেমাজগতে তাঁর যাতায়াত। মণি শ্রীমানির মুখ, কথা বলার ধরন এবং চলাফেরার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যাপার ছিল। তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় পছন্দ করতেন বহু পরিচালকই। সত্যজিৎ রায়, তপন সিংহ-সহ একাধিক নামীদামি পরিচালকের ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের 'অপরাজিত' (১৯৫৬) ছবিতে স্কুল ইনসপেক্টরের ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। কোটপ্যান্ট, টাই, হ্যাট-এ পুরোদস্তুর স্কুল ইনসপেক্টর করে তুলেছিলেন নিজেকে। এর ঠিক দু'বছর পর করলেন সত্যজিৎ রায়ের 'পরশ পাথর' (১৯৫৮)। এ-ছবিতে মণি শ্রীমানিকে দেখা গেল ডাক্তারের ভূমিকায়। প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস পরশ পাথর গিলে ফেলেছেন। তিনি এলেন ডাক্তার নন্দীর কাছে। ডাক্তার নন্দী প্রিয়তোষের এক্স-রে রিপোর্ট দেখে 'অ্যামেজিং, অ্যামেজিং' শব্দটি এমন অদ্ভুতভাবে উচ্চারণ করলেন যে, পুরো ব্যাপারটাই বোঝা গেল খুব সহজেই। 
একেবারে অন্যরকম ভূমিকায় দেখা গেছিল মণি শ্রীমানিকে। ছবি সলিল সেনের 'মণিহার' (১৯৬৬)। এই ছবিটিতে তিনি ছিলেন এক সুদখোর ষড়যন্ত্রকারীর ভূমিকায়। এই চরিত্রেও তিনি অনবদ্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং গঙ্গাপদ বসুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেন তিনি। পাশাপাশি 'ধন্যি মেয়ে' (১৯৭১) ছবিতে মাইকের দোকানের মালিক। যিনি পালা-পার্বণে, নানারকম অনুষ্ঠানে মাইক ভাড়া দেন। একেবারে বিপরীত ভূমিকা। কানে শুনতে পান না। কথা বুঝতে না-পেরে উল্টোপাল্টা উত্তর দেন। সুখেন দাস এবং তাঁর কামাখ্যামামা (মণি শ্রীমানি)-র অংশটুকু খুবই উপভোগ্য। একেবারে স্বাভাবিক অভিনয়। ভাঁড়ামি নেই। জোর করে হাসানোরও কোনও ব্যাপারই ছিল না। দর্শক সংলাপ শুনেই হাসতেন। মণি শ্রীমানির খুব গর্ব ছিল তাঁর জন্মসাল ১৯১১-র কারণে। মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জেতার কারণে। নবদ্বীপ হালদার, শ্যাম লাহার মতো একই বছরে জন্ম মণি শ্রীমানির।
নবদ্বীপ হালদার, শ্যাম লাহা, মণি শ্রীমানির জন্ম একই বছরে। নৃপতি চট্টোপাধ্যায় এবং হরিধন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম একই বছর ১৯০৭। প্রায় একই সময় বাংলা ছবির পঞ্চরত্নের জন্ম। এঁদের পাঁচজনের অভিনয়ের ধরন একেবারেই ভিন্ন। কিন্তু একটি মিল ছিল এঁরা অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিনয় করতেন। কথা বলার ধরন এবং সংলাপ বলার মধ্যে চমৎকার এক ব্যাপার ছিল হরিধন মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর সংলাপ শুনেই হাসতেন দর্শক। তাঁর সংলাপ বলার মধ্যে খিটখিটানি আর নাকিসুরকে চমৎকার ব্যবহার করতেন। কথা বলার মধ্য একটা ঝগড়ুটে ভাব থাকত। এসব ছিল ম্যানারিজম। এগুলোকেই নিয়ে তাঁর নিজস্ব অভিনয় ধারা গড়ে তুলেছিলেন হরিধন মুখোপাধ্যায়। যা অন্যকোনও বাঙালি কমেডিয়ানের মধ্যে ছিল না। কোনও বাড়াবাড়ি নেই, সংযত অভিনয় করতেন। এ-প্রসঙ্গে 'সাড়ে চুয়াত্তর' (১৯৫৩) ছবির মেসবাসী বয়স্ক লোক শিববাবুর চরিত্রের কথাটি আসতেই পারে। 'আমারই যৌবন' গানটির সময় মেস মালিক তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে ওই ঝগড়ুটেভাবটি পাওয়া যায়। কয়েক মুহূর্তের অভিনয়ে নজর কেড়ে নেন হরিধন। ছোট্ট ছোট্ট ভূমিকা করতেন অথচ কোনও অবহেলা ছিল না অভিনয়ে। 
সত্যজিৎ রায়ের 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৯) ছবিতে গুপীকে ব্যঙ্গ করছেন গ্রামের বৃদ্ধেরা, সেই দলে ছিলেন হরিধন। ছোট একটি মুহূর্ত অথচ অভিনেতার জাত চিনিয়ে দিলেন। সত্যজিৎ রায়ের 'পরশ পাথর' ছবিতে ইনসপেক্টর চ্যাটার্জির চরিত্রটি করেছিলেন হরিধন। 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিতে অশোকের (অরুণ মুখোপাধ্যায়)-এর শীতকাতুরে মামা। 'কাপুরুষ মহাপুরুষ' (১৯৬৫)-এর 'মহাপুরুষ'  অংশে তাঁর অভিনীত গণেশ চরিত্রটি ছিল ধান্ধাবাজ। পরবর্তী সময়ে ' 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০)-ও করেছেন। এ-ছবিতে তিনি ছিলেন হীরক রাজার রাজজ্যোতিষীর ভূমিকায়। পরিচালক রবি বসুর 'মিস প্রিয়ংবদা' (১৯৬৭) ছবিতে পতিতপাবনের ভূমিকা অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন হরিধন। মিস প্রিয়ংবদাবেশি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে হরিধনের পর্বটি ছিল অত্যন্ত উপভোগ্য। 
জানা যায়, মণি শ্রীমানির 'যোগাযোগ' নাটকটি যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্টারে বসে দেখেছিলেন, তেমনই জোড়াসাঁকো গিয়ে কবিকে গান শুনিয়ে এসেছিলেন হরিধন মুখোপাধ্যায়। তিনি যে চমৎকার গান গাইতেন তার পরিচয় পাওয়া গেছিল পরিচালক তরুণ মজুমদারের  'ফুলেশ্বরী' (১৯৭৪), পীযুষ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'ভোলা ময়রা' (১৯৭৭), রঞ্জিতমল কাংকারিয়ার 'ডাক দিয়ে যাই' (১৯৭৮) ইত্যাদি ছবিতে। তিনি একাধিক ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছিলেন। তিনি মহিলা-চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন একাধিক নাটকে। সোনোরে পিকচার্স-এর প্রথম সবাক ছবি 'খাসদখল' (১৯৩৫)-এ প্রথম অভিনয় করেন হরিধন মুখোপাধ্যায়। পরিচালক রমেশচন্দ্র দত্ত, সবাই তাঁকে বলতেন চানী দত্ত। এর ন'বছর পর হরিধনকে দেখা যায় পরিচালক অপূর্ব মিত্রের 'সন্ধি' (১৯৪৪) ছবিতে। এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় ছবি।
বাংলা ছবির পাঁচ রত্ন কমেডিয়ান-- নবদ্বীপ হালদার, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, শ্যাম লাহা, মণি শ্রীমানি এবং হরিধন মুখোপাধ্যায় ছবির জগতে আসেন তিরিশের দশকে। মোটামুটিভাবে তাঁরা কেউ কেউ কাজ করেছিলেন ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত। প্রত্যেকেই অভিনয় করেছিলেন কয়েক শো ছবিতে।  একটা ব্যাপার লক্ষ করা গেছে এঁদের কমেডিয়ান হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হলেও, কমেডির বাইরেও একেবারে ভিন্নরকম চরিত্রে বা ভূমিকায় কাজ করেছিলেন। সেইসব ভূমিকায় দাপিয়ে কাজ করেছিলেন। প্রশংসিত হন দর্শক এবং সমালোচক দ্বারা। আসলে এঁরা সকলেই অভিনেতা। আলাদা করে কমেডিয়ান, খলনায়ক নন। কমেডিয়ান প্রসঙ্গে রবি ঘোষ বলেছিলেন, "... কমেডিয়ান বা ভিলেন বলে আলাদা কিছু হয় না। সব অভিনেতাই অভিনেতা। এক একজনকে একেকটা রোলে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু এই বাংলায় ওসব আলাদা করে বোঝার কোনও চেষ্টা নেই। শুধু স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া। শুধু দাগ দিয়ে যাওয়া।" (সাক্ষাৎ-স্মৃতি, কান্তিরঞ্জন দে)।
এঁরা জানতেন কি করলে দর্শক হাসবেন। সে শরীরী অভিনয় হোক বা সংলাপ বলার ধরন। ছবির অধিকাংশ পরিচালকই কমেডিয়ানদের ব্যবহার করার সময় প্যাটার্নের বাইরে গিয়ে কিছু ভাবতে পারতেন বলে মনে হয় না। একজন পরিচালকের অন্যতম কাজই হল কমেডিয়ানের ব্যবহার অর্থাৎ অভিনয়ের সময় তিনি কেমনভাবে তাঁর শরীরকে কাজে লাগান, তাঁর মনস্তত্ত্বকে জানা ইত্যাদি। পরিচালক যেমন বললেন তেমনভাবেই করলেন। কমেডি সম্পর্কে ধ্যানধারণা থাকাটা সবচেয়ে বড় ব্যাপার। বাংলা ছবিতে কমেডি অভিনয়ের ধারণাটাই বদলে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার। তিনি বড় অভিনেতা তাই পারতেন। যদিও তিনি ছিলেন একেবারে আদর্শ পরিচালকের অভিনেতা। তাঁর কমেডি অভিনয়ের brilliance  ছিল অসাধারণ। এঁদেরও ছিল। কিন্তু সেকালের কমেডিয়ানদের জন্য অভিনয় কতটুকুই বা  বরাদ্দ থাকত। এই পাঁচ কমেডিয়ানদের কথাই ধরা যাক, ছবির ফাঁকেফাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হত এঁদের। সমস্ত কমেডিয়ানদের ক্ষেত্রে তাই ছিল। অথচ পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকে বহু ছবিই সম্পূর্ণ হত কি, যদি-না বাংলা ছবির কমেডিয়ানরা মজার দৃশ্যগুলো করতেন! এমনকী দেখা গেছে ছবির নায়ক, নায়িকাকে সরিয়ে প্রধান হয়ে উঠতেন এইসব কমেডিয়ানরা। এঁরা কত ভাল ভাল কাজ করে গেছেন। বাংলা ছবিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
তাই রবি ঘোষের কিছু কথা উল্লেখ করা জরুরি, "একজন চরিত্রাভিনেতাকে কমেডিয়ান বলে দাগ মেরে দেওয়া খুব সোজা। যেন কমেডি অভিনয় করা খুব সোজা ব্যাপার। দর্শকেরা ভাবেন, অনেকক্ষণ পর্দায় নাচ গান কান্নাকাটি হল, এবার একটু ছ্যাবলামি হয়ে যাক। এখানে অধিকাংশ মানুষই কমেডি বলতে ছ্যাবলামি বোঝেন। অবশ্য, শুধু দর্শকদেরও দোষ দিয়ে লাভ নেই। এটাই সাধারণ বাঙালির মাইন্ডসেট।" (সাক্ষাৎ-স্মৃতি, কান্তিরঞ্জন দে)।

Archive

Most Popular