23rd May 2024
ভ্রমণ
কমলেন্দু সরকার
জামশোলা নেমে নিরিবিলি পথে হেঁটে যেতে যেতে মুগ্ধ হয়েছি ক্ষণে ক্ষণে! তখনও জানি না চমক আরও লুকিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। পৌঁছলাম হাতিবাড়ির অঙ্গনে। দেখি সুবর্ণরেখা এক সুন্দরী নারীর মতো ঠমকে গমকে বয়ে চলেছে। নদীর বুকে বিশাল বিশাল পাথর, সে যেন বিউটি স্পট। অনেক বেশি সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে সুবর্ণরেখার। এ মনোহারিতা না-দেখলে উপলব্ধি হয় না। রূপবতী রূপের অহংকারে নিজের মতো চলেছে। এমনই সুন্দর হাতিবাড়ির সুবর্ণরেখা। আসলে সুবর্ণরেখার রূপ-সৌন্দর্য এক এক জায়গায় এক এক রকম। এখানেও তাই।
হাতিবাড়ির অরণ্যটিও অপূর্বা পলাশ, শিমুল, শাল, পিয়াশালের আরও কত গাছ। চারিদিকে শুধুই সবুজ। একদিকের সবুজ মাড়িয়ে চলে যাওয়া আর এক সবুজের প্রান্তে। জঙ্গলের কেমন যেন গন্ধ থাকে। সবুজের গন্ধা এখানেও সবুজের সুবাস নাকে লাগে। নাকে লাগে জলের ঘ্রাণ। দু'টি মাতাল করে দেয় অরণ্য-বাভাসে। সবুজের ফাঁকে দেখা যায় নদীর বুকে পড়ন্ত সূর্যের লাল আভা। আলো ক্রমশ নামে আকাশে। নামে ভূমেও। সন্ধ্যা নামে জঙ্গলের মন্ত্রিত বাতাসে। বনভূমির ভিতর থেকে উঠে আসে চাঁদ কাঁসার থালার মতো। সান্ধ্য-জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যায় হাতিবাড়ির অরণ্য। দেখি সুবর্ণরেখার জলে পড়ে আছে চাঁদ তার রূপের ছটা নিয়ে। স্বপ্নমাখা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কে যেন বলল রাত- গভীরে পরিরা নামে সুবর্ণরেখার জলে। এমন পরিবেশেই তো পরিরা নামে। রাতের পরিদের দেখার ইচ্ছে নিয়েই থাকতে বেশ লাগে হাতিবাড়ির বনবাংলোয়।
অন্ধকার নামে ক্রমশ। তবে কামরাঙা জ্যোৎস্না বুঝতে দেয় না রাত কত হলা রাতপাখিরা রাত-পাহারায় বেরিয়ে পড়েছে নীড় ছেড়ে। তাদের ডাকে রহস্যময় হয়ে ওঠে হাতিবাড়ির অরণ্য-অঙ্গনা গাছেদের ছায়া পড়ে চাঁদের আলোয়। রাত-পরিদের দেখার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিছানায় বিশ্রাম নিতে নিতে কখন যে নিদ্রাদেবী কোলে তুলে নিয়েছেন জানি না। বুঝলাম পাখির ডাকে।
জানালা দিয়ে ভোরের আলো টুইয়ে পড়েছে। জানালা গলিয়ে গাছের সবুজ ঘ্রাণ ঘরের ভিতর উড়ে বেড়াচ্ছে। ভোরের নারীকে দেখার লোভ সামলানো গেল না। একছুটে নদীর ধারে। সদ্য ঘুম ভাঙা রমণীর মতো রমণীয় সুবর্ণরেখা। কেউ ডিঙি নৌকায়, কেউ শালতি চেপে ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে। সূর্যের নরম আলো ছড়িয়ে আছে। নৌকা হতে কেউ যেন হাঁক মারে, "বাবু নেবেন নাকি মাছ। এই ধরলাম।" হাতে তুলে দেখালো। ভোরের আলোয় মাছের গায় রুপোলি ঝিলিক। নিলাম। অপূর্ব তার স্বাদ। সবাই বলে, সুবর্ণরেখার মাছের স্বাদ লা-জবাব।
নীল দিগন্তে ম্যাজিক শুরু হয়েছে। গাড়ি কিংবা পায়ে পায়ে যাওয়া যায় কমবেশি পাঁচ কিমি দূরে ঝিলিবাঁধে। কতশত পাখি এখানে। দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। কেউ পেনসিল দিয়ে আউটলাইন করে রেখেছো কী চমৎকার জায়গা। হাতবাড়ির অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে মন উদাস হয়ে যায় আপন-খেয়ালে। কত গাছ, কত ফুল। হাতিবাড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিমি বাংরিপোসি। এ আর এক রোম্যান্টিক জায়গা। এটি হল সিমলিপাল অরণ্যের বাইরের দিক।
তাই জঙ্গলের পরিবেশের মধ্যেই দিন কাটানো। জন্দন আর পাহাড়ের মাঝে বাংরিপোসি যেন এক সবুজ দ্বীপ। এক ঢাল কালো চুলের মতো রাস্তা চলে গেছে দূরে পাহাড় পেরিয়ে। বাংরিপোসির রাস্তা ধরে ঘাট পেরিয়ে পাহাড়ে যেতে বেশ লাগে। বিশেষ করে, রাত্রিবেলা দলবেঁধে যেতে। তেমনই গেছিলাম একসঙ্গে জোটবেঁধে। সে ভয়ংকর শিহরন জাগানো যাত্রা। তবে একটু সাবধানে যেতে হয়। কেননা, এটি গাড়ি চলার পথ। প্রচুর গাড়ি যায় এ-পথে। তবে পাহাড়ে উঠে পড়লে হাজার মজা। মনে হয়, এই বুঝি কোনও বন্যজন্তু লাফিয়ে পড়ল সামনে। বন্যপ্রাণীর লাফিয়ে পড়াটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, এখানকার জঙ্গলে প্রচুর ওয়াইল্ড লাইফ আছে।
বাংরিপোসির পাহাড় ডিঙিয়ে বিষয়ী। এখানে হাট বসে। ভীষণ সুন্দর সেই হাটা কত কী বিক্রি হয়। বিষয়ী থেকে কিছুটা গেলেই জোশীপুর। গেটওয়ে অফ সিমলিপাল ফরেস্ট। জোশীপুরে বুদ্ধপূর্ণিমায় শিকার উৎসবের মেলা বসে। বিশাল মেলা। পাহাড় আর জঙ্গলের মাঝে মেলা, তার মেজাজই আলাদা। বাংরিপোসির সরকারি টুরিস্ট বাংলোর সামনে দিয়ে সোজা এক ঢাল রাস্তা চলে গেছে দূরে। সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে দারুণ লাগে। পথের দু'পাশে বিশাল বিশাল গাছ। তারা পথে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতিপ্রেমিকদের মাথায় ছাতা মেলে থাকে সর্বদা। হাঁটতে হটিতে সোজা গেলে এক পাহাড়-শরীরে ধাক্কা খেতে হবে। পাহাড়ের নিচ দিয়ে নদীর একটা নালা বয়ে যাচ্ছে। তার জল এতই পরিষ্কার যে নুড়ি-পাথর গোনা যায়। আর দেখা যায় কত মাছ খেলা করে। একমনে এইসব দেখতে দেখতে পাতাখসার শব্দে চমক লাগে। এইবুঝি জঙ্গল থেকে কেউ এসে দেখা করতে আসে। অভ্যর্থনা জানাবে বেরিয়ে এসে অরণ্য হতে। না, পরক্ষণেই দেখি জঙ্গলে টুপটাপ শুকনো পাতাখসার শব্দ। নিরিবিলি নির্জনে ভয় দেখায় প্রকৃতি। এখানকার সৌন্দর্য, অপূর্ণা
বাংরিপোসি থেকে ১২-১৩ কিমি কানচিন্দ্রা। ধানখেত আর নরম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। এখানে ভালুক আছে। তবে দেখিনি। এখানে অলস লাবণ্যে ভরা প্রকৃতি।
পাঁচ কিমি দূরে কালাবধি। বুড়িবালাম নদী। টলটলে জল। আকাশ এই নদীর জলে মুখ দেখে। তাই মেঘের নকশা ফুটে ওঠে বুড়িবালামের জলে। সেই দৃশ্য বড়ই মনোরম। এখানেই নাকি বাঘা যতীনের সঙ্গে লড়াই হয়েছিল ইংরেজের। বুড়িবালাম ভীষণ সুন্দর! কত পাখি। বাংরিপোসি-সহ চারপাশে প্রচুর পাখি। অনেকরকম পাখি এক সফরে হাতিবাড়ি আর বাংরিপোসি দারুণ লাগবে। অরণ্য, নদী, পাখি, প্রকৃতি-সবমিলিয়ে কমপ্লিট টুর। কলকাতা থেকে খুব দূর নয়, কাছেই চমৎকার দু'টি বেড়ানোর জায়গা আছে যা না-গেলে ভাবাই যায় না।
কীভাবে যাবেন: এসপ্ল্যানেড থেকে ওড়িশার কেওনঝড়ের বাসে জামশোলা নেমে যেতে হবে হাতিবাড়ি। গাড়িতে গেলে সোজা জামশোলা। সেখান থেকে হাতিবাড়ি। হাতবাড়ি থেকে জামশোলা এসে বাংরিপোসি যেতে হবে। কেওনঝড়ের বাসেও বাংরিপোসি যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন:
হাতবাড়ি ওয়েস্টবেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট থেকে হাতিবাড়ির বুকিং করতে হবে। আর বাংরিপোসির জন্য ওয়েলিংটনে উৎকল ভবন থেকে বুকিং পাওয়া যাবে। এছাড়া বেসরকারি থাকার জায়গাও আছে।