14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

অস্কার পাওয়ার মুহূর্তে সত্যজিৎ রায়...

27th Jun 2024

বিনোদন

হীরক সেন


এখনও মনে পড়ে সেইদিনটি। সত্যজিৎ রায়ের হাতে অস্কার তুলে দিতে অস্কার কমিটির লোকজন ছুটে এসেছেন কলকাতায়। যেখানে তিনি চিকিৎসার কারণে ভর্তি আছেন। প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রকার হিসেবে সত্যজিৎ রায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবথেকে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার পান।

পরিচালনাসহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে অস্কার কমিটি তাঁকে জীবনকৃতি সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। তাঁর নির্মিত বহু চলচ্চিত্র কান চলচ্চিত্র উৎসব, ভেনাস চলচ্চিত্র উৎসব, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসব-সহ বিশ্বের নামীদামি চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রদর্শিত এবং পুরস্কৃত হয়। অপু ট্রিলজি (পথের পাঁচালি, অপরাজিত, অপুর সংসার) তাঁরই সৃষ্টি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সিনেমার যে-কোনও তালিকায় অপু ট্রিলজিকে খুঁজে পাওয়া যায়। অপু ট্রিলজির প্রথম ছবি 'পথের পাঁচালি' ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা 'হিউম্যান ডকুমেন্ট অ্যাওয়ার্ড' লাভ কর।

আপনারা সবাই জানেন, চার্লি চ্যাপলিনের পর তিনিই পৃথিবীর দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাকে সেই দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লিজিয়োঁ দ্য'নর-এ ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে সত্যজিৎ রায় পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাকে প্রদান করে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে সত্যজিৎ রায়কে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ অস্কার প্রদান করে। ১৯৯৩ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা ক্রুজ সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড স্টাডি কালেকশন প্রতিষ্ঠা করে। তবে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রজীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় পুরস্কার ১৯৯২ সালে অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার (অস্কার)। যা তিনি সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেন। যদিও অসুস্থ থাকায় তিনি পুরস্কার মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেননি। মৃত্যুশয্যায় তার অস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতির ভিডিও করে পরবর্তীকালে অস্কার অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, যেটি ঘোষণা করেছিলেন অড্রে হেপবার্ন। সেদিন এই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের এ হেন বিশ্ববরণ মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। শুধু তো ভারতে নয়, আমরা সবাই জানি, সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতি ছিল চলচ্চিত্র বিশ্বের প্রতিটি কোনায়। ১৯৬২ সালে সত্যজিৎ'র লেখা 'বন্ধুবাবুর বন্ধু' নামে একটি বাংলা কল্পগল্প সন্দেশ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সেই গল্পের ওপর ভিত্তি করে ১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ রায় 'দ্য অ্যালিয়েন' নামের একটি ছবির চিত্রনাট্য লেখেন, যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক হিসেবে ছিল কলাম্বিয়া পিকচার্স আর পিটার সেলার্স। এর প্রধান অভিনেতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল তৎকালীন হলিউডের সুপারস্টার মার্লোন ব্রান্ডোকে। কিন্তু চিত্রনাট্য লেখার কাজ শেষ করে সত্যজিৎ জানতে পারেন যে সেটির স্বত্ব তার নয় এবং এর জন্য তিনি কোনও সম্মান দক্ষিণাও পাবেন না। মার্লোন ব্র্যান্ডো সে সময়ে প্রকল্পটি থেকে বেরিয়ে আসেন। মার্লোনের জায়গায় জেমস কোবার্ন-কে আনার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু মেসোমশাই নিরাশ হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। পরে উনি বলেছিলেন। জেনেছিলাম সেখান থেকে। এরপর ৭০ ও ৮০-র দশকে কলাম্বিয়া কয়েকবার প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

১৯৮২ সালে যখন স্টিভেন স্পিলবার্গের ই.টি. দ্য এক্সট্রা- টেরেস্ট্রিয়াল মুক্তি পায়, তার কাহিনির সঙ্গে অনেকেই তখন সত্যজিৎ রায়ের লেখা চিত্রনাট্যের মিল খুঁজে পান। মেসোমশাই মানে সত্যজিৎ রায় ১৯৮০ সালে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের একটি ফিচারে প্রকল্পটির ব্যর্থতা নিয়ে বলেছিলেন। ঘটনার আরও বৃত্তান্ত রয়েছে অ্যান্ড্রু রবিনসনের লেখা সত্যজিৎ রায়ের জীবনী 'দ্য ইনার আই'-এ। সত্যজিৎ- এর মতে তাঁর লেখা 'দ্য এলিয়েন-এর চিত্রনাট্যটির মাইমোগ্রাফ কপিটি সারা যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে ছড়িয়ে না পড়লে ব হয়তো স্পিলবার্গের পক্ষে চলচ্চিত্রটি বানানো সম্ভব হত না। চার দশকের কেরিয়ারে ৩২ বার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। গোল্ডেন লায়ন, গোল্ডেন বিয়ার, সিলভার বিয়ার ছাড়াও ১৯৯২ সালে জীবনকৃতির সম্মানসূচক এই একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয় করেন তিনি।

সেদিন ছিল ১৬ এপ্রিল ১৯৯১। মেসোমশাই তখন বেলভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি। হঠাৎ সকালবেলায় গেলাম বাবুর বাড়ি। বাবু মানে সন্দীপ রায়। সত্যজিৎ রায়ের পুত্র। আমি সন্দীপকে বাবু বলি। বাবুকে বললাম, যাবে তো মেসোমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে? আমি ওঁকে কম্পানি দিতাম। ওহো, বলা হয়নি, সত্যজিৎ রায়কে আমি মেসোমশাই বলতাম। যাহোক, বাবু তখন বলল, হ্যাঁ যাব। কিন্তু একটা মুশকিল হয়ে গেছে জানো। আমি বললাম, কি? বাবু বলল, অস্কারের অ্যানাউসমেন্ট হয়েছে জানো তো? বাবাকে অস্কার দেবে। তো, ওঁরা চাইছেন বাবার একটা ফোটো শুট করবেন। দু'জন লোক এসেছেন। ওঁকে নিয়ে শুট করবেন বলে। আমি বললাম, কিন্তু ওখানে তো অ্যালাউড নয়। বেলভিউ নার্সিং হোম! ওখানে তো...বাবু বলল, না, বাবা বলে দিয়েছে নার্সিং হোম অথরিটিকে যে, আমার লোককে অ্যালাও করতে হবে। ওরা কলকাতায় এসে বসে আছে অনুমতির জন্য। এটা মেসোমশায়ের কানে গেছে কোনওভাবে। স্লথ বলে একজন এসেছিলেন, উনিই ডিরেক্ট করবেন। সঙ্গে একজন ক্যামেরাম্যান। মেসোমশায়ের কানে সম্ভবত ডাঃ বক্সি-ই কথাটা পৌঁছে দিয়েছিলেন। ডাঃ কান্তি বক্সির আপত্তি ছিল। কিন্তু সে আপত্তি কি আর ধোপে টেঁকে? এ কি আর যে সে মানুষ? ইনি যে সত্যজিৎ রায়! বেলভিউয়ের মালিকের সহায়তায় সত্যজিৎ রায়ের ইচ্ছেতেই ওই নার্সিং হোমেই শুটিং হল। আমি সবসময় ক্যামেরা ক্যারি করি না। সেদিন ছিল।

ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে উনি আছেন। যাইহোক, সেদিন আমরা সবাই মিলে গেলাম। আমি, সন্দীপ, সন্দীপের স্ত্রী, আরেকজন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট সুজিত সরকার, আমরা সবাই মিলে পৌঁছলাম নার্সিং হোমে। দেখলাম মেসোমশাই শুয়ে আছেন। ডাক্তাররা আছেন, জুনিয়ার ডাক্তাররা। ডাঃ বক্সিও এলেন। মেসোমশায়ের নাকে নল-টল দেওয়া। অস্কারের দু'জন লোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, আমি একটা ফোটো নেব। ওঁরা আপত্তি করলেন। আমি ডোন্ট কেয়ার। তখন আমি মেসোমশাইকে জিজ্ঞাসা করলাম। আমি জীবনে যা কখনও মেসোমশাইকে জিজ্ঞাসা করিনি, সেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মেসোমশাই আমি ছবি তুলবো? সেদিন মেসোমশাই শুয়ে মাথা নাড়লেন, ইয়েস। অনুমতি পেলাম। বাবুর স্ত্রী ললিতা, আমার ছোটবেলার বন্ধু, ওরা সবাই ছিল। ওই ফোটো শুটের ডিরেক্টর মেসোমশায়ের অনুমতি নিয়ে শুট শুরু করলেন। শুধু মেসোমশাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওঁর গলাটা ভালো নেই। তারপর যখন মেসোমশাই গলাটা রেওয়াজ করে বললেন, ওকে। শুরু করা যেতে পারে। তখন শুরু হল। আমিও ছবি তুললাম বেশ কয়েকটি। তারপর দেখলাম সন্দীপ, ললিতা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো ভেজা। এই পরিস্থিতিটা ওঁরা ভাবতেই পারেননি। একদিকে অস্কার পাওয়ার আনন্দের উত্তেজনা, অন্যদিকে বর্তমান এই অবস্থা-এটা ওঁরা মেনে নিতে পারছেন না। আমারও খুব খারাপ লাগছিল। এটা আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয় ঘটনাআজ সত্যজিৎ রায় নেই, কিন্তু রয়ে গেছে সেদিনের সেই ঘটনা। যা কোনওদিনও ভোলার নয়। ভুলতে পারবোও না। পারিওনি।

Archive

Most Popular