24th Jul 2024
বিনোদন
নিজস্ব প্রতিনিধি
বাংলা চলচ্চিত্রে প্রতিভাবান অভিনেতার অভাব নেই। কিন্তু মহানায়ক একজনই। তিনি উত্তম কুমার। হয়তো সে কারণেই সত্যজিৎ রায় তার 'নায়ক' চলচ্চিত্রে সাধারণ তরুণ থেকে চিত্রনায়ক হয়ে ওঠা অরিন্দম চ্যাটার্জির ভূমিকায় উত্তম কুমার ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই পারেননি। এ এক রাজ পথের গল্প। কিন্তু এ পথে পৌঁছনোটা খুব সহজ ছিল না। অনেক গলি পথ পেরিয়ে তাঁকে আজকের এ পথে পৌঁছতে হয়েছে। সবাই পারেন না। কেউ কেউ পারেন। আর এই কেউ কেউ-এর মধ্যে অবশ্যই পড়েন উত্তম কুমার। যাঁর কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
উত্তম কুমার তার অভিনয়, নায়কোচিত সৌষ্ঠব ও তারকাদ্যূতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছেন। যতটা সহজে বলা গেল বিষয়টা, ঠিক ততটা সহজ ছিলনা। চলচ্চিত্রের ইতিহাস হতে তাঁকে অনেক কিছু সইতে হয়েছে। অনেক বাঁধা পেরতে হয়েছে। অনেক অপমান নীরবে সহ্য করতে হয়েছে। সেদিন যদি এই কঠিন পরীক্ষায় তিনি না বসতেন, তাহলে সাফল্যের সিঁড়ির সন্ধানটা কি পেতেন? পেতেন না। কি চূড়ান্ত অপমান। তাকে সহ্য করেছেন। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা। সম্মান বোধ যাঁর আছে, তাঁরই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। উত্তম কুমারেরও সে সম্মান বোধ প্রখর ছিল। তথাপি তাঁর মধ্যে ছিল জেদ।আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি। তাই সব অপমানকে সেদিন তিনি হজম করতে পেরেছিলেন। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, কান্না যেন দলা পাকিয়ে উপরে উঠে আসতে চাইছে। কিন্তু তাকে প্রাণপনে আটকেছেন। বাইরে প্রকাশ হতে দেননি। কেবল যে লক্ষে পৌঁছুবার স্বপ্ন দেখতেন তিনি, সেই লক্ষে পৌঁছনোর চেষ্টাতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন চিরকাল। চলেছে গভীর অনুশীলন, অপরিসীম পরিশ্রম, নিষ্ঠা ও চেষ্টা। পাশাপাশি রপ্ত করছেন জীবনে পাওয়া উপহার অপমান, লাঞ্ছনা, পরিহাসকে উপেক্ষা করতে। পারলেন। শুধু পারলেন না, এ পর্যন্ত বাংলা ছবির দৌরদন্ডপ্রতাপ শিল্পীদের পিছনে ফেলে সহস্র যোজন দূরে এগিয়ে গেলেন। এতটাই দূরে, তাকে ছোঁয়া এখন দুঃসাধ্য হয়ে গেল। আর ওই অপমান করা লোকগুলো যাঁরা সেদিন ঘর ভর্তি লোকের সামনে উত্তম কুমারের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিলেন, আজ তাঁরা নিজেদের সম্মান বাঁচাতে বারবার ছুটে যাচ্ছেন মহানায়কের কাছে। কত অনুরোধ, উপরোধ। যদি একটা ছবি উনি উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলেই তাঁদের জীবনটা বাঁচে। কী অপরিসীম লীলা খেলা! এভাবেই বোধহয় কালের চাকা বক্রগতিতে ঘোরে। কালের শীর্ষে থেকে অহংকার বর্ষণ কিন্তু কালই কালের গর্ভে পতিত হতে পারে। আর লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে তাহলে শত ঝড় বাঁধাও তাকে রুখতে পারে না। সে এগিয়ে যাবে। যাবেই। যেমন এগিয়ে গেছেন মহানায়ক উত্তমকুমার। এখানেই তিনি অন্যের থেকে আলাদা। স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। পরম পুরুষ। এগুলিই তাঁর কাছ থেকে শেখার বিষয়।
১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এই মহান অভিনেতার জন্ম। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু। পারিবারিক নাম ছিল অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার আহিরীটোলায় মামাবাড়িতে জন্ম। ভবানীপুরের গিরিশ মুখার্জি রোডে ছিল পৈতৃক বাসভবন। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং মা চপলা দেবী। এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। দাদু আদর করে নাম রাখলেন উত্তম। ঠাকুরমা ডাকতেনও উত্তম নামে। উত্তমকুমার যখন নিতান্তই শিশু তখন একবার তাদের বাড়িতে আসেন পরিবারের কুলগুরু। তিনি শিশু উত্তমকে কোলে নিয়ে বলেন- "এই ছেলে একদিন হাসিতে ভুবন ভোলাবে।" পরবর্তীতে কথাটি সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল।
আপনারা জানেন, কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুলের ছাত্র ছিলেন উত্তম। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন তিনি। পাড়ার থিয়েটারেও অভিনয় করতেন। গোয়েংকা কলেজে লেখাপড়া করেন। তবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে পারেননি পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে। তার আগেই চাকরি নেন কলকাতার পোর্টে। প্রেম করে বিয়ে করেন গৌরী দেবীকে। একদিকে চাকরি আর সংসার অন্যদিকে অভিনয়ের আগ্রহ। মধ্যবিত্ত ঘরের এই তরুণের পক্ষে বেশ কঠিন হয়েছিল সিনেমায় সুযোগ পাওয়া। অনেক পরিচালকের নির্মম বিদ্রুপেরও শিকার হতে হয়েছে।
সিনেমায় প্রথম সুযোগ পান 'মায়াডোর' ছবিতে। ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। নীতিন বোস পরিচালিত 'দৃষ্টিদান' মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। এটি উত্তম অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। এরপর 'কার পাপে' সহ কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। দুয়েকটি ছবিতে নায়কও হয়েছিলেন। তবে কোন সিনেমাই ব্যবসা সফল হয়নি। ফলে তার নামই হয়ে যায় 'ফ্লপ মাস্টার'। তিনি সেটে ঢুকলেই লোকজন ঠাট্টা তামাশা করত তাকে নিয়ে। এ সময় অরুণ চ্যাটার্জি, অরূপ কুমার, উত্তম চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিনয় করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উত্তম কুমার নামেই থিতু হন। পাহাড়ি সান্যালের পরামর্শ অনুযায়ী। 'বসু পরিবার' সিনেমায় এক যৌথ পরিবারের আদর্শবাদী বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি দর্শকদের দৃষ্টি কাড়েন। এ সিনেমায় সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন তার ছোট বোনের ভূমিকায়। উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত প্রথম ছবি এটিই।
'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে উত্তম প্রথম জুটি বাঁধলেন নবাগতা সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। ছবিটিতে তারা রোমান্টিক জুটির ভূমিকায় থাকলেও এর মূল অভিনেতা ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী। ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায় প্রমুখ শিল্পী। কমেডি এই সিনেমাটি ব্যবসাসফল হওয়ায় উত্তম কুমারের ভাগ্য খুলে যায়।
১৯৫৪ সালে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প অবলম্বনে 'অগ্নিপরীক্ষা' সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির পর্দা-রোমান্স বেশ জনপ্রিয়তা পায়। আর এ সিনেমার সঙ্গেই শুরু হয় উত্তম সুচিত্রা যুগের। ছবিটি দারুণভাবে ব্যবসা সফল হওয়ায় নায়ক উত্তম কুমারের আসন স্থায়ী হয়ে যায়। একের পর এক মুক্তি পায় উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত সুপারহিট ছবি 'শাপমোচন', 'শিল্পী', 'হারানো সুর', 'সাগরিকা', 'পথে হলো দেরী', 'ত্রিযামা', চাওয়া পাওয়া, 'সপ্তপদী', 'বিপাশা', 'ইন্দ্রাণী', 'সূর্য তোরণ', 'সবার উপরে' ইত্যাদি। সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, মাধবী মুখোপাধ্যায় সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় নায়িকার বিপরীতে অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করলেও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তার জুটি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি বলেই বিবেচিত।
উত্তম কুমার হিরো। উত্তম কুমার ম্যাটিনি আইডল। তখন তো বটেই, আজও উত্তম কুমারের ছবি দেখে বাইরে বেরিয়ে নিজেকে উত্তম কুমার ভাবেন না, এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। তবে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয়। অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্রেও অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার, যা তাকে অভিনেতা হিসেবে সার্থক প্রমাণিত করেছে। অষ্টাদশ শতকের ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনির জীবনী নিয়ে অনবদ্য ছবি 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি', যার নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। বিপরীতে ছিলেন তনুজা।
একজন কবির আবেগ, হতাশা, যন্ত্রণা, কবির লড়াইয়ে উত্তেজনা সবই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন উত্তম কুমার। আবার 'মরুতীর্থ হিংলাজ' ছবির উন্মত্ত যুবক থিরুমলের কথাই ধরুন না! এখানে তার বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। 'অগ্নীশ্বর' ছবিতে অভিনয় করলেন ডাঃ অগ্নীশ্বরের ভূমিকায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' অবলম্বনে তৈরি সিনেমায় গৃহভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তম কুমার। বিমল মিত্রের উপন্যাস নিয়ে 'স্ত্রী' ছবিতে লম্পট অথচ সরলমনা জমিদারের চরিত্রেও তিনি অনন্য। এখানে খলনায়ক হয়েও প্রধান ভূমিকায়। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
তেমনই অদ্বিতীয় জমিদার সূর্যকিশোর নাগ চৌধুরীর চরিত্রে অভিনয়, 'সন্ন্যাসী রাজা'তে। তিনি তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'বিচারক' অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। বিচারকের মনোজগতের দ্বন্দ্ব সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি। 'মায়ামৃগ' সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেও দৃষ্টি কেড়ে নেন। 'শেষ অংক' ছবিতে তিনিই যে স্ত্রীর হত্যাকারী এ বিষয়টি দর্শককে চমকে দেয়। যেমন চমকে যাই আমরা ওঁর 'বহ্নিশিখা' ছবিতে খল নায়কের চরিত্রের অভিনয় দেখে। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অজয় করের ছবি 'সপ্তপদী'তে ফাদার কৃষ্ণেন্দু, 'নিশিপদ্ম' ছবির মাতাল, 'থানা থেকে আসছি'র ইন্সপেক্টর, 'দেবদাসে'র চুনিলাল এমন অনেক অনেক চরিত্রই নায়ক উত্তমকে নয় বরং অভিনেতা উত্তমকেই তুলে ধরে। 'আমি, সে ও সখা' ছবিতে ডাক্তার সুধীরের ভূমিকায় তার অভিনয়ও ছিল অসাধারণ।
সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন দারুণ মানানসই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত 'গৃহদাহ', 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত', 'কমললতা', 'চন্দ্রনাথ', 'পথের দাবী' ও 'বড়দিদি'তে তিনি নায়ক চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন। এর মধ্যে পাঁচটিতেই তিনি জুটি বেধেছিলেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। উত্তম কুমার ২১২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকবাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট ও ৫৭টি ছবি ব্যবসা সফল হয়েছে। শক্তি সামন্ত পরিচালিত উত্তম কুমার অভিনীত হিন্দি ছবি 'অমানুষ' ও 'আনন্দ আশ্রম' সুপারহিট হয়। এ দুটি ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিৎ রায়ের 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় ছিলেন অসাধারণ। 'চিড়িয়াখানা' ও 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে বছর (১৯৬৭) তিনি সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬১-তে 'দোসর' ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। 'হারানো সুর', 'হ্রদ', 'সপ্তপদী', 'নায়ক', 'গৃহদাহ', 'এখানে পিঞ্জর', 'অমানুষ', 'বহ্নিশিখা' ছবির জন্য ৮ বার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান।
কমেডিতেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে 'ছদ্মবেশী' সিনেমায় তার অভিনয় নির্মল হাসির খোরাক দেয় দর্শককে। তনুজার বিপরীতে 'দেয়া-নেয়া' আরেকটি অনবদ্য হাসির ছবি। 'নবজন্ম' সিনেমাতেও কমেডি চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার। 'নবজন্ম' ছবিতে নিজের কণ্ঠে ৬ টি গানও গেয়েছিলেন তিনি। বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। 'অভয়ের বিয়ে' সিনেমায় জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও সরল ধনাঢ্য যুবক অভয়ের ভূমিকায় উত্তমের কমেডি ছিল অনবদ্য। তবে উত্তমের সেরা কমেডি বলা যায় শেক্সপিয়রের নাটক 'কমেডি অফ এররস' অবলম্বনে নির্মিত 'ভ্রান্তি বিলাস' সিনেমাটিকে। এখানে উত্তম কুমার ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যাযের দ্বৈত অভিনয় ছিল অনন্য। উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতো না হলেও উত্তম- সুপ্রিয়া জুটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উত্তম- সুপ্রিয়া অভিনীত 'চিরদিনের', 'বনপলাশীর পদাবলী', 'কাল তুমি আলেয়া', 'লাল পাথর', 'শুন বরনারী', 'মন নিয়ে', 'শুধু একটি বছর', 'সন্ন্যাসী রাজা' ব্যবসা সফল হওয়ার পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও পায়।
উত্তম-সাবিত্রী জুটিও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। বস্তুত তার বিপরীতে যে নায়িকারা অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে সাবিত্রীর অভিনয়ই ছিল সবচেয়ে সাবলীল ও স্বাভাবিক। তিনি গ্ল্যামারাস নায়িকা না হলেও সুঅভিনেত্রী ছিলেন নিঃসন্দেহে। ফলে উত্তম-সাবিত্রী জুটির অভিনীত সিনেমাগুলো ছিল স্বাভাবিক অভিনয়ের ধারায় সুনির্মিত। প্রসঙ্গত এই জুটির 'নিশিপদ্ম', 'নবজন্ম', 'মরুতীর্থ হিংলাজ', 'অভয়ের বিয়ে' 'হাত বাড়ালেই বন্ধু', 'কলংকিত নায়ক', 'কুহক' 'দুই ভাই', 'ভ্রান্তি বিলাস', 'মোমের আলো', 'মৌচাক' ব্যবসা সফল সিনেমা।
এঁদো গলি থেকে লেন, বাইলেন পেরিয়ে রাজপথে পৌঁছতে অনেক কিছু দিতে হয়েছে, করতে হয়েছে, ভাবতে হয়েছে তাঁকে। সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন তিনি। সকলের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখতে পারতেন। তারপর তো ছিলই কাজের প্রতি নিষ্ঠা, জানার আগ্রহ, অসম্ভব বলে কিছু নেই-এমন মানসিকতা সর্বোপরি পরিশ্রম করার ক্ষমতা উত্তম কুমারকে 'উত্তম' কুমার করে তুলেছে। পেশাগত জীবনে সহঅভিনেতাদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে পাহাড়ি সান্যাল, বিকাশ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তার সহোদর অভিনেতা তরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে রসায়ন ছিল দেখার মত।
গানের বিষয়ে খুব সিরিয়াস ছিলেন। যে গান লিপসিং করতে হবে সেটি অনেকক্ষণ ধরে নিজে গেয়ে অভ্যাস করতেন যাতে পর্দায় তা স্বাভাবিক মনে হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে এবং শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার তার অধিকাংশ গানে প্লেব্যাক করেছেন।গৌরীদেবীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু এক সময় দাম্পত্য জীবনে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। তাই ১৯৬৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই থাকতেন।
উত্তম কুমার চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও সাফল্য পান। 'কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী', 'বনপলাশীর পদাবলী', 'শুধু একটি বছর' সহ বেশ কয়েকটি ছবি তিনি পরিচালনা করেন। 'উত্তর ফাল্গুনী', 'হারানো সুর', 'সপ্তপদী'র মতো সফল ছবির প্রযোজকও ছিলেন তিনি। 'কাল তুমি আলেয়া', 'সব্যসাচী' সিনেমার সংগীত পরিচালনাও করেন তিনি। 'অগ্নিপরীক্ষা'র গল্প নিয়েই হিন্দিতে তিনি তৈরি করলেন 'ছোটিসি মুলাকাত'।
সিনেমার ব্যস্ততার পাশাপাশি মঞ্চেও অভিনয় করতেন। 'শ্যামলী' নাটকে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন। 'শ্যামলী' পরে সিনেমাও হয়েছিল। সেখানে নায়ক ছিলেন উত্তম এবং নায়িকা ছিলেন কাবেরী বসু। উত্তম কুমার বিভিন্ন সময়ে সমাজের কল্যাণে, সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উদ্যোগ। উত্তম কুমার অভিনীত শেষ ছবি 'ওগো বধূ সুন্দরী'। বার্নার্ড শ'র নাটক 'পিগম্যালিয়ন' অবলম্বনে হলিউডের ছবি 'মাই ফেয়ার লেডি'র বাংলা রিমেক ছিল 'ওগো বধূ সুন্দরী'। এই ছবিতে ডাবিং সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি উত্তম কুমার। পরবর্তীতে ছোটভাই তরুণ কুমার তার কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
সিনেমায় যেমন হয়, ঠিক তেমনটা নয়। প্রকৃত অর্থেই উত্তম কুমার কিন্তু আন্তর্জাতিক মাপের অসামান্য অভিনেতা ছিলেন। 'স্পেল বাউন্ডে' গ্রেগরি পেকের অভিনয়ের সঙ্গে তুলনায় 'হারানো সুর'-এ উত্তম কুমারের অভিনয় কোনও অংশে নিচু মানের নয়। 'ওগো বধূ সুন্দরীতে' তিনি কোথাও কোথাও 'মাই ফেয়ার লেডি'র রেক্স হ্যারিসনকেও অতিক্রম করে গেছেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারা পাল্টে দিয়েছিলেন। লাউড অভিনয়ের ধারা পাল্টে তিনি আন্ডারটোন এবং স্বাভাবিক অভিনয়ের ধারার সূচনা করেন। বাস্তব জীবনে মানুষ যেভাবে হাঁটা-চলা, কথা-বার্তা বলে তিনি ক্যামেরার সামনে তাই করতেন। উত্তম কুমার ছিলেন বাঙালির প্রাণের নায়ক। স্বাভাবিক অভিনয় এবং নায়কোচিত গ্ল্যামার তার মধ্যে মিশেছিল সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল তার দৈহিক সৌষ্ঠব, সুন্দর চেহারা এবং অনাবিল হাসি।
কতটা পথ হাঁটলে তবে পথিক বলা যায়, এটা যেমন একটা প্রশ্নই থেকে যায়, ঠিক তেমনই প্রশ্ন থেকে যায়, একজন অভিনেতার মধ্যে এমন কী কী গুন থাকলে তিনি সর্বজন গ্রহিতা হতে পারেন! শুধু গ্রহণই নয়, তিনি আপামোর বাঙালির মনের মণি কোটায় পাকাপাকি জায়গা করে নিতে পারেন। আসলে মানুষের জন্য শিল্প, না শিল্পের জন্য মানুষ? এই বোধটা যদি পরিষ্কার থাকে, তাহলে তিনি বড় হবেনই। উত্তম কুমার এটা ভালো করে জানতেন। এবং তা মানতেন। এখানেই তিনি উত্তম- উত্তমকুমার।
৪৪ বছর হলো তিনি লোকান্তরিত। তার মৃত্যুর পর কত নায়কই না এসেছেন এই বাংলার রূপালি ভুবনে। কিন্তু বাংলা ছবির দর্শকদের মনে তিনি চিরদিনই মহানায়কের আসনে অধিষ্ঠিত আছেন এবং থাকবেন। আর প্রকৃত অর্থে উত্তম কুমার একজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যাঁর কাছ থেকে জীবনে চলার অনেক কিছু শেখা যায়। জিরো থেকে হিরো হওয়ার কমপ্লিট গাইড। পরিপূর্ণ একজন মানুষ।