4th Jun 2024
সাহিত্য
পত্রলেখা নাথ
এই ডায়েরিটা যদি কোনোদিন কেউ কৌতূহলবশত পড়েন তার কাছে অনুরোধ ডায়েরির চরিত্রগুলি বাস্তবে খুঁজতে যাবেন না। তাদেরকে তাদের মতো করে বাঁচতে দিন। বলতে পারেন এই ডায়েরিটি আমার আত্মগ্লানি থেকে লেখা। আজ আর আমার স্বীকারোক্তি করার মতো কেউ নেই। যিনি এই ডায়েরিটা পড়বেন তার কাছেই আমার এই স্বীকারোক্তি।
উত্তর কলকাতার একটি পুরানো বাড়ি। বয়স প্রায় দেড়শো। লম্বা বারান্দা, স্যাঁতস্যাঁতে চুন সুরকির দেওয়াল। কড়িবরগার ছাদ। খড়খড়ি দেওয়া বিশাল কাঠের জানলা দিয়ে আলো এসে পড়ে বারান্দার কোলে। কড়িবরগার ফাঁকে পায়রা তার সঙ্গিনীর সংগে কথা বলে চলে অবিরত। সামনের রাস্তা দিয়ে ঢং ঢং শব্দ তুলে ট্রামের যাতায়াত, এসব দেখতে দেখতে এই বাড়িতেই আমার বড়ো হয়ে ওঠা। আমার ঠাকুরদা কলকাতার দত্ত পরিবারে নায়েবের কাজ করতেন। উনিশ শতকের শেষ দিকে দত্ত পরিবারের বড়ো কর্তা সুবিনয় দত্ত আমার ঠাকুরদাকে এই বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করার অনুমতি দেয়। দত্তদের কলকাতায় পাঁচ পাঁচটি বাড়ি। এই বাড়িটি বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। আমার ঠাকুরদাকে কাজের প্রয়োজনে কলকাতায় থাকতে হত। ফলে ওই সময়ই আমাদের পরিবার চাকদা থেকে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসেন। পরে দত্তবাবুর ছোটো ছেলে ঠাকুরদাকে এই বাড়িটি দান করেন। আমরা চারজনের পরিবার। আমি, বাবা, মা ও আমার থেকে বছর তিনেকের বড় আমার দাদা।
আমাদের বাড়ির ছাদটা বড়ো সুন্দর। বিশাল ছাদ। এই ছাদে দাঁড়িয়েই আমার বঙ্কিম রচনাবলীর পাতা ওলটানো আর শরৎবাবুর লেখায় চোখের পাতা ভিজিয়ে ফেলা। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, বাল্য প্রেমে অভিশাপ আছে। সেই কথাটাই আমার জীবনে সত্যি হয়েছিল কিনা জানিনা। আমার যখন বারো বছর বয়স আমি প্রথম নবীনদার চোখে চোখ রেখে লজ্জা পেয়েছিলাম। আমাদের ঠিক পাশের বাড়ি রামকমল মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র ছেলে নবীন মুখোপাধ্যায়, আমার নবীন দা। রোজ অনেক রাত অবধি নবীনদা বেহালা বাজাতেন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতাম। নবীনদার বেহালা না শুনে আমার ঘুম আসতো না। নবীনদাদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটা আমার খুব প্রিয় ছিল। সুযোগ পেলেই আমাদের বাগানের ফুল নিয়ে নবীনদাদের বাড়ি গিয়ে হাজির হতাম। সম্পর্কটা দীর্ঘদিন এইভাবেই ছিল বেহালার সুরের ধীর লয়ের গতের মতো। নবীনদার আমাকে ভাললাগত কিনা জানিনা। কখনো বুঝতে পারিনি।
প্রতি বছরের মতো সে বছরও নবীনদাদের ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলছে। পুজোর কটা দিন আমার সময় কাটে ওদের বাড়িতেই। কিন্তু অন্য বছরের থেকে এবছরটা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেল আমার কাছে। এই বছর প্রথমবার পুজোয় নতুন শাড়ি পরে নবীনদাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। নবীনদার বাবা আমায় দেখে বলেছিলেন, 'কিরে মিনু, তুই যে গিন্নি হয়ে গেলি!' আমায় দেখে নবীনদা ওর ক্যামেরায় একটা ছবি তুলে দিয়েছিল। বিজয়া দশমীর দিন বড়োদের সঙ্গে নবীনদাকে যখন প্রণাম করলাম, নবীনদা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল ওর চিলেকোঠার ঘরে। তারপর বিছানার তোষক সরিয়ে একটা প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিল, বলল এখন না। বাড়ি গিয়ে খুলে দেখিস। তারপর আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে বলল, আমায় কি দিবি মিনু? আমি বললাম, তুমি কি চাও বলো? নবীনদা মুচকি হেসে বলেছিল, যা চাইব তাই দিবি? আমার খুব লজ্জা করেছিল সেদিন। নবীনদা কিন্তু কিছু চায়নি সেদিন। শুধু বলেছিল, আমায় মনে রাখিস চিরকাল। এটুকুই চাই তোর থেকে। বাড়ি ফিরে প্যাকেটটা খুলে দেখেছিলাম, আমার ছবিটা সুন্দর ফ্রেমিং করে দিয়েছে। এরপর বেশ কয়েকবার নবীনদার বাড়ি গিয়েছি, গোপনে দেখা করবার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু লক্ষ্য করেছি নবীনদা আর কখনো আমার কাছে নিজেকে মেলে ধরেনি। কৌশলে এড়িয়ে গেছে। ছেলেমানুষিবশত একটা চিঠি লিখেছিলাম কিন্তু সে চিঠি সম্ভবত নবীনদার হাতে পড়েনি। তার আগেই নবীনদার মা দেখে ফেলেন। আমায় সরাসরি কেউ কিছু না বললেও তার দুদিনের মধ্যেই আমার বাড়ি থেকে বেরনোয় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর পর হঠাৎই এক ভোররাতে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায় নবীনদাদের বাড়ির সামনে। নবীনদার মায়ের কান্নাকাটিতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দোতলার জানালার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখি পুলিশের জিপের ভেতর ঠেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নবীনদাকে। নিজেকে খুব অসহায় লেগেছিল সেদিন। বাবা জোর করে জানলা থেকে টেনে সরিয়ে এনেছিল আমাকে। কষ্টে বুক ফেটে গেলেও এতটুকু শব্দ করিনি। চোখের জলে বালিশটা ভিজে গিয়েছিল। শুধু মা বুঝেছিলেন। নবীনদা তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতার সংগে এম এ পাশ করেছেন। এত ভাল একটা স্টুডেন্টকেকেন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল এ প্রশ্ন বাবা-মা কে বার বার করেও কোনও উত্তর পায়নি। সময়টা ১৯৭১। কলকাতার পরিস্থিতি একদম ভালো নয়। কদিন আগেই দিনে দুপুরে প্রকাশ্য রাজপথে খুন হয়েছেন হেমন্ত বসু। তারপর থেকে প্রায়ই চলছে স্কুল কলেজ বন্ধ, বাস ধর্মঘট। বাড়ির মেয়েদের বিকেলের পর বেরনো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যে থেকেই থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পুলিশের টহল। রাস্তার আলো নেভানো। সে এক দমবন্ধ পরিস্থিতি। সে বছর আমি প্রি- ইউনিভারসিটির পরীক্ষা দেব। স্কুল থেকে ফিরে নিচে দরজায় পাড়ার দুটি বন্ধুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। নবীনদা নেই, তবু বার বার নিচ থেকে নবীনদার বাড়ির দিকে তাকাচ্ছি। যদি কাকিমাকে একবার দেখা যায়, কোনও খবর পাওয়া যায়। পাশের মাঠে পাড়ার দাদারা ফুটবল খেলছিল। হঠাৎ মেন রোড থেকে আমাদেরই একবন্ধু চিৎকার করতে করতে এগিয়ে এলো, দাদাদের খবর দে। পুলিশের জিপ ঢুকছে। সে সময় পুলিশের জিপ মানেই আতঙ্ক। কম বয়সী ছেলে হাতের সামনে পেলেই পুলিশের জিপ তুলে নিয়ে যেত। আমার দাদাও পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল, আমি আর দেরি না করে দৌড়লাম ওদের খবর দিতে। বরাবরই আমার ভয়-ডর কম। খবর পেয়ে দাদারা যে যার মতো নিরাপদে পালিয়ে গেল। আমিও হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। আমার রাস্তা আটকে দাঁড়াল একটি পুলিশের জিপ। কিছু বোঝার আগেই অফিসার আমার দিকে ব্যঙ্গ্যোক্তি করে বললেন,- 'কি দাদাদের খবর দিয়ে এলে বুঝি? তা কে কে আছে তোমাদের দলে? নাম কটা বলে ফেল দেখি।' আমি খুব বিরক্তির সঙ্গেই বললাম, 'দেখুন, আমি ওসব জানিনা। আমি এইবছর বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেব। বন্ধুর বাড়িতে গত বছরের প্রশ্ন আনতে গিয়েছিলাম। অফিসার বিশ্বাস করলেন না বলাই বাহুল্য। রীতিমত আমায় জোর করে গাড়িতে তুললেন। তখন আমার বয়স ১৭ শেষ হয়েছে।
এর আগে কোনোদিন থানায় যায়নি। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। থানায় অনেকক্ষণ আমায় বসিয়ে রেখেছিল অফিসার। নানারকম প্রশ্ন, নানা ইঙ্গিতেও যখন কোনও উত্তর পেল না, তখন আমার বাড়ির লোকের খোঁজ করা হল। ইতিমধ্যেই অবশ্য বাড়িতে খবর পৌঁছেছে। দেখলাম পাড়ার কাকু, জ্যেঠু স্থানীয় লোকেরা বাবার সঙ্গে থানায় এসে আমায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার কদিনের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম, আমার সঙ্গে আমার পাড়ার বন্ধুরা আর আগের মতো কথা বলে না। যেভাবে বাবা নবীনদাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছিল ঠিক সে ভাবে। সে বছরই নভেম্বরে আমি আঠারোতে পড়েছি। দেখলাম, বাবা হন্যে হয়ে আমার জন্যে পাত্র খুঁজছেন। অবশেষে পাত্র হল এক পুলিশ অফিসার। যেটা আমার একেবারেই অপছন্দ। তার সঙ্গেই আমার বিয়ে ঠিক হল। ১২ ফেব্রুয়ারি ছিল আমার বিয়ের তারিখ। সেদিন মনে হয়েছিল এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। বাবা খুব ধুম ধাম করে পাড়ার লোকেদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। নবীনদার মাও এসেছিলেন আমার বিয়েতে। সেদিনও আমি নবীনদার কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলিনি। কিন্তু নবীনদার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। নবীনদা কে ধরে নিয়ে যাওয়ার কারণ, পুলিশ অফিসারকে খারাপ লাগা এসব তখন আমার মন একটু একটু করে বুঝতে শিখেছে।
বিয়ের পর স্বামীই মেয়েদের কাছে সবচেয়ে আপন। কিন্তু আমার কাছে সম্পূর্ণ উল্টোটা হয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে আমি নিজের বলে মেনে নিতে পারিনি। আমার বাল্যপ্রেমের নির্মম পরিণতির জন্য যেন ওকেই দোষী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলাম। বিয়ের প্রথম রাতটা মেয়েদের জীবনে সব থেকে প্রিয় হয়। প্রথমরাতে স্বামী সোহাগের স্বাদ মেয়েরা চিরজীবন মনে রাখে। আমার স্বামীর ভাবনায় কোনও ভুল ছিল না। সেই মধুররাতে সে আমার আলিঙ্গনে আবিষ্ট হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার কানে তখনও বেহালার ছরে দরবারি বাজছে, আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। নারী পুরুষ ঘি আর আগুন, পাশাপাশি থাকলে একবার না একবার জ্বলে উঠবেই। সে ভাবেই আমাদের পরিবার বেড়েছিল আমার দুজন থেকে তিনজন হলাম। পৃথিবীতে এলো আমাদের সন্তান সমীর। এরপর জীবনটা এগিয়েছে বাঁধা ছকে। নকশাল আন্দোলনে সারা বাংলা তোলপাড় ওইসময়। পুলিশে চাকরি করার দরুন পলাশকে দেখতাম রোজই ভোররাতে বাড়ি ফিরছে। ভোর রাতটা আমার কাছে অশুভ। এই ভোররাত ই একদিন আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছিল নবীনদাকে। সে রকমই কুয়াশার প্রলেপ মোড়া ২৯ ফেব্রুয়ারি, দিনটা আমার আজও মনে আছে। সেদিন ভোররাতে হন্ত দন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল পলাশ। মুখে চিন্তার ছাপ। বার বার জিজ্ঞাসা করেও চিন্তার কারণ জানতে পারিনি ওর কাছে। পরদিন কাগজে দেখেছিলাম পুলিশের এনকাউন্টারে নকশাল নেতা দিলিপ মজুমদারের মৃত্যু সংবাদ। কাগজে লিখেছিল এনকাউন্টারের পর দিলিপ মজুমদারের মুখটা চেনা যাচ্ছিল না। পোশাক দেখে তাকে আডেন্টিফাই করা হয়। এই দুর্দান্ত নকশাল নেতাকে খতম করার সবটুকু কৃতিত্ব নাকি আমার স্বামী পলাশ মুখোপাধ্যায়ের। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী আমায় ডেকে সেদিন বলেছিল তুই ভাগ্যবতী এমন স্বামী পেয়েছিস। আমার যে এতটুকু গর্ব হয়নি তা আপনারা বুঝতেই পারছেন। বরং মনে হয়েছিল আমার ভালোবাসার দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটল। এই সব ঘটনা ঘটে গেছে আজ থেকে ৪০-৪৫ বছর আগে। আজ আমার স্বামী আর জীবিত নেই। আমাদের একমাত্র পুত্র সমীর বিদেশে থাকে। আমি বারাসাতের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। আমার স্বামী সাধ করে একটি বাড়ি করেছিলেন ছেলে বিদেশে যাওয়ার সময় আমায় এখানে রেখে বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। বাড়ি থেকে শেষবারের মতো বেরোবার সময় সো-কেসে রাখা কিছু পুরানো বই ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে আনিনি। শরীরটা কদিন ধরেই ভাল যাচ্ছিল না। আসার পর থেকে বইগুলো আর নাড়াচাড়া করা হয়নি। আমার স্বামী পলাশ প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে একটি বই আমায় উপহার দিয়েছিল, সে বই কোনদিনও খুলে দেখিনি, আজ কেন জানিনা জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই বইটাকেই কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে হল। মনে হল আজ এই একাকিত্বের জীবনে পলাশের এই বইটাই আমার একমাত্র অবলম্বন। বইটার পাতা ওলটাতে বড়ো ভাললাগছিল, হয়তো ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর না হলেও হত।বৃদ্ধাশ্রমে আমার ঘরটা দোতলার ওপর। খাবার ঘর নিচে। বেল বাজালে হস্টেলের মতো একসাথে সবাইকে খেতে যেতে হয়। বেলের শব্দে ইজিচেয়ার থেকে উঠে বইটা বিছানার ওপর রাখতেই একটা কাগজ বেরিয়ে পড়ল বইয়ের ফাঁক থেকে। এত বছর পর পুরানো বইয়ের থেকে চিঠির মতো কি এটা! হাতে নিয়ে দেখলাম ১৯৭৫ সালের একটি চিঠি। পলাশকে লেখা-
'প্রথমেই আপনাকে প্রণাম জানাই পলাশবাবু। আপনি সেদিন সঙ্গে না থাকলে আমার বাঁচা সম্ভব হত না। যেভাবে সে সময় পুলিশ আমার পিছিনে লেগেছিল আপনি যদি পালাবার সুযোগ করে না দিতেন এবং আমার মৃত্যুর খবরটা প্রচার না করতেন আমি আর কোনওদিনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতাম না। আমার মা ভালো আছেন। আপনার দেওয়া টাকাটা আমি পার্টির কাজেই লাগিয়েছি। আপনার মতো কিছু পুলিশ অফিসার যদি এগিয়ে আসতেন, আমাদের নকশালবাড়ি আন্দোলনের আজ এই পরিণতি হত না। আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে রইল। ইতি -দিম।
কে এই দি ম, ভাবতে গিয়ে প্রথমেই যে নামটা মনে আসছিল তিনি নকশাল নেতা দিলিপ মজুমদার। সেসময় আমার স্বামীর সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিল বলে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম। তবে কি পলাশ কি ওকে পালাতে সাহায্য করেছিল!
'-ও মাসিমা খেতে আসুন। একতলা থেকে রূপার ডাকে চমকে উঠলাম। খেতে বসে একটা দানাও গলা দিয়ে নামল না। বার বার চিঠির কথাগুলো কানে বাজছিল। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ওপরে এলাম।'বৃদ্ধাশ্রমে আমার ঘরের সঙ্গে একফালি বারান্দা আছে। দেখি রাতের ঘুমপাড়ানি জোৎস্না এসে পড়েছে আমার ঘরে। এখন রাত প্রায় ১১ টা। সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি। দূরে তালগাছের সারি। চাঁদ মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ছে গাছের আড়ালে। কি একটা কষ্ট গলার কাছে আটকে আছে। আজ নিজেকে যে কী ভীষণ অপরাধী লাগছে!
বিয়ের পর থেকে পলাশকে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি, কারণে অকারণে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। বিছানার জৈবিক চাহিদা ছাড়া হৃদয়ের তাগিদ কখনও অনুভব করিনি।
পলাশ আমায় একদিনের জন্যও তো ঠকায়নি। বরং আজ মনে হচ্ছে স্ত্রী হিসাবে আমি ওকে ঠকিয়েছি। আজ এই বইটা না খুললে এত বড় সত্যিটা জানতেও পারতাম না। পলাশ কি তবে আমায় জানাতে চেয়েছিল সে জন্যই এই বইটির মধ্যে চিঠিটা ঢোকানো ছিল! উফহ। আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না। এরপর ডায়েরিটায় আর কিছু লেখা নেই। কলেজস্ট্রিটের পুরানো বইয়ের খোঁজ করা আমার নেশা। প্রতি শুক্রবারের মতো আজ কলেজস্ট্রিট পাড়ায় এসেছিলাম। প্রেসিডেন্সির দেওয়ালে একটা বাঁধা দোকান থেকে নিয়মিত ভালো বই পাই, আজ সেই বইয়ের তাগাড় থেকে মিলল ২০০০ সালের এই ডায়েরিটা। ডায়েরির সামনের পাতায় রয়েছে একটা নাম অনন্দিতা মুখোপাধ্যায়। বারাসাত। একবার মনে হয়েছিল ভদ্রমহিলার খোঁজ করি। উনি এখন কেমন আছেন জানতে বড় ইচ্ছা করছিল। সামলালাম নিজেকে। তারপর ডায়েরিটা আবার মিশিয়ে দিলাম পুরানো বইয়ের তাগাড়ে। শুধু কাহিনিটুকু রইল আমার স্মৃতিতে।