5th Feb 2025
সাহিত্য
রজতশুভ্র মজুমদার
এত দিন পর এলি বল তো বাবা!
তা প্রায় পনেরো বছর!
এত দিন পর মাসিমাকে মনে পড়ল তোর?
অভিনিবেশ চুপ করে রইল। কোন ভোরবেলা বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। ভোরই বা কোথায়, তখন তো রাতের অন্ধকার। লাইট অন করে বাথরুম যেতে হয়েছে, মুখ ধুতে হয়েছে, ড্রেস করতে হয়েছে। সকাল আটটা অবধি ঘুমোনোর অভ্যেস যে ছেলের, সে কিনা ভোর তিনটেয় উঠে রেডি হয়েছে, ভাবা যায়? আগের রাতে মা ফ্লাস্কে চা করে রেখেছিলেন। সেই ঈষদুষ্ণ চা ফ্লাস্কের ঢাকায় ঢেলে দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট দিয়ে খেয়ে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। অভিনিবেশ বাসি চা একদম পছন্দ করে না। সত্যি-সত্যি যারা চা-খোর, তারা কেউই কি টাটকা চা ছাড়া খেতে চায় না? দিনে দশ থেকে বারোবার চা চলে অভিনিবেশের। যখন হস্টেলে থাকত, নিজেই চা বানাত। বেশ ভালই চা বানাতে পারে অভিনিবেশ। রুমমেট থেকে শুরু করে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হস্টেলের অনেক আবাসিক, এমনকী রাঁধুনিরা পর্যন্ত কয়েকজন, তার চায়ের ভক্ত ছিল। ভোররাতে উঠে ঢুলুঢুলু মেখে তা বানাতে নিয়ত বা ভাল লাগে? মা মাইগ্রেনের রুণি। কাল রাতে শুতে গিয়েছেন পেন কিলার খেয়ে। তাঁকে বিব্রত করা কোনওভাবেই উচিত হত না। এই রকম পরিস্থিতিতে ওই বাসি চা গেলা ছাড়া অভিনবেশের কাছে আর দ্বিতীয় কোনও বিকল্প ছিল না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার রাস্তা। দীর্ঘ যাত্রাপথে বেশ কয়েকবার চা খেয়েছে অভিনিবেশ। কিন্তু ট্রেনের চাও তার পছন্দসই নয়া একরকম বাধ্য হয়েই খেতে হয়েছে। ট্রেনে আসতে আসতে অভিনিবেশ একমনে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। সকালের নরম বাতাস তাকে ফ্রেশ করে দিচ্ছিল শরীরে, মনে। একেকটা সবুজ মাঠ, গ্রাম পেরিয়ে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে আর অভিনিবেশ মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করছিল প্রকৃতির সৌন্দর্য। গ্রাম বরাবরই অভিনিবেশকে টানে। হয়তো কোনও কালে গ্রামে বাস করেনি বলেই এই টান। সাতপুরুষের ভিটে কলকাতায়, মামা-কাকা-পিসি-জেঠু কারও বাড়িই গ্রামে নয়। তাই গ্রামে সেভাবে থাকাই হয়নি কখনও। কিন্তু গ্রামের প্রতি একটা অদম্য আকর্ষণ বেঁচে আছে সেই ছোট্ট থেকেই। বেঁচে আছে মানে, বাঁচিয়ে রেখেছে সে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গ্রাম দেখতে গিয়েছে অনেকবার। মন-প্রাণ দিয়ে গ্রামের আত্মাকে অনুভব করার চেষ্টা করেছে দূর থেকে। দূর থেকে মানে, দু-এক ঘণ্টায়। দু এক ঘণ্টায় কারও আত্মাকে ছোঁয়া যায় নাকি? বন্ধুরা ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে, বলে, এ এক ধরনের রোমান্টিসিজম। এ সব দু এক ঘণ্টার জন্যই সম্ভব, টানা গ্রামে বাস করতে হলে। এমন ভালবাসা নাকি জানলা দিয়ে বেরিয়ে যেত। অভিনিবেশ ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়ে শোনায়, কিটসের টু ওয়ান হু হ্যাজ বিন লং ইন সিটি পেন্ট আবৃত্তি করে। সেই যে সেই শহরে বন্দি ক্লান্তপ্রাণ কবি গ্রামের মাঠে গিয়ে বসলেন, তাকালেন নীল আকাশের দিকে, বুক ভরে গ্রহণ করলেন বাঁচার অক্সিজেন আর ফিরে আসার সময়ে তাঁর মাথায় টুপ করে ঝরে পড়ল নিশার কামরে কী ভোলা যায় না, জাস্ট ভোলা যায় না। আর বুলবুলি পাখির ডাক। বন্ধুরা বলে, ডাক্তার না হয়ে কবি হলে পারতিস। সে মন্দ হত না, অভিনিবেশ ভাবে। অভিনিবেশের গ্রামপ্রীতি দেখে বন্ধুরা বলেছিল, এই তো পাশ করার পর প্রথমে গ্রামেই পোস্টিং দেবে। তখনই দেখব বাবুর ভালবাসা।
নিশ্চয়ই। তখনই পরীক্ষা হয়ে যাবে। চ্যালেঞ্জটা অ্যাকসেপ্ট করেছিল অভিনিবেশ। সত্যি-সত্যিই গ্রামে পোস্টিং হল। কলকাতা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রাম দেখতেই ভোরবেলা বেরিয়েছে অভিনিবেশ। সমস্ত দেখেশুনে ফিরতি পথে মাসির বাড়িতে একবারটি আসা। এখানেই দুটো দিন কাটিয়ে যাবে সে। মা বারবার করে বলে দিয়েছেন দিদিকে একবার দেখে আসতে। কতদিন যে দিদির সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। মায়ের বতড কষ্ট হয়, কিন্তু সংসার এমন জায়গা, ইচ্ছে হলেও যাওয়া আর হয়ে ওঠে না সহজে। মাসিমার আক্ষেপের জবাবে বেশ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে অভিনিবেশ বলল, এবার থেকে মাঝে মাঝেই আসব, তুমি দেখে নিও।
করে অভিনিবেশ, আচ্ছা মাসিমা, আমি ভোর তিনটেয় উঠেছি ঘুম থেকে, আমিও আমায় ফ্রেশ হতে বললে না কিন্তু। মাসিমা এইবার গলে গিয়ে ডান হাতের হরেক রকমের আংটি পরা আঙুলগুলো দিয়ে অভিনিবেশের চুলে-কপালে স্নেহস্পর্শ বুলিয়ে দিতে লাগলেন, যা বাবা, হাত-মুখ ধুয়ে আয়। অভিনিবেশও মাসিমার করতলে আলতো চুমু দিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
আজ চূর্ণী মাসিমার বাড়িতে উৎসব। কত দিন পর অভিনিবেশ এসেছে এ বাড়ি। সকাল-সকাল মেসোমশাই বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন টাটকা সবজি, মাছ, মাংস। রান্নার বউকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে দুদিনের জন্য। এই দুদিন রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন মাসিমা। দিনকয়েক আগেই খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় দেখেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিজের হাতে রান্না করার ছবি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে আসছেন বিদেশ থেকে। তাই নিজের হাতে রান্না করছেন মা। ছবিটা দেখে যারপরনাই উল্লসিত হয়েছিলেন মাসিমা। তাঁর না হয় নিজের ছেলেপুলে নেই, তা বলে আজ চূর্ণী মাসিমার বাড়িতে উৎসব। কত দিন পর অভিনিবেশ এসেছে এ বাড়ি। সকাল-সকাল মেসোমশাই বাজার থেকে নিয়ে এসেছেন টাটকা সবজি, মাছ, মাংস।
ছাই আসবি, মাসিমার অভিমান কমে না সহজে।
না না সত্যি আসব। আই প্রমিস। যে গ্রামে অভিনিবেশের চাকরি হল সেখান থেকে পাক্কা উনিশ কিলোমিটার দূরে এই মফসসল শহর। সুতরাং ইচ্ছে করলে। অভিনিবেশ আসতেই পারে সময়ে-অসময়ে। সেটাই সে বোঝানোর চেষ্টা করে মাসিমাকে। মাসিমা পোড় খাওয়া মানুষ, অত সহজে বুঝবার পাত্রী তিনি নন। তাঁর সারা মুখে উষ্ণ অভিমানের একটা আন্তরিক সস্নেহ স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বাঁ হাতের শাঁখা-পলার সঙ্গে ব্রোজের ওপর সোনার জল করা আটপৌরে চুড়ির মৃদু সংঘর্ষের আওয়াজ তুলে মাসিমা বললেন, পনেরো বছরে একবার। আর এখন তো হাসপাতালে কাজের চাপ, এটা ওটা... আসতে পারবি তুই? পারবি আসতে?
চেষ্টা থাকলে সব হয় মাসিমা।
ওহো, তার মানে এত দিন কোনও চেষ্টা ছিল না, বল।
মাসিমার সঙ্গে কথায় পেরে ওঠা সম্ভব নয় বুঝে কথা ঘোরানোর চেষ্টা অভিনিবেশ কি ছেলে না? আজ কত বছর পর সে এসেছে এ বাড়ি! যে দিন জানতে পারলেন হাসপাতাল দেখে ফিরতি পথে দিন দুয়েকের জন্য অভিনিবেশ আসবে এ বাড়ি, সে দিন থেকেই চূর্ণী মাসিমার আনন্দের অন্ত নেই। এ বাড়ির দোতলায় দুটো মাত্র প্রাণী।
কাজের মাসি দুবেলা বাসন মেজে দেয়, ঘর মুছে দেয় আর সপ্তাহে একদিন কাপড় কেচে দেয়। রান্নার বউ প্রতিদিন দুবেলা রান্না করতে আসে। বেশিরভাগ দিনই আলুপোস্ত হয় এ বাড়িতে। মেসোমশাইয়ের প্রিয় খাদ্য আলুপোস্ত। রিটায়ারমেন্টের পর পায়ে পা তুলে আরাম করছেন। বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন না। পাশবালিশে ঠেস দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পের বই পড়ার নেশা। শীর্ষেন্দু, সমরেশ, হুমায়ুন, সুচিত্রায় ঘর বোঝাই হয়ে আছে। রোগ-বালাই সে রকম নেই বললেই চলে। মাসিমা আবার গল্পের বইটই পড়েন না সে রকম। তাঁর সময় কাটতে চায় না সহজে। অবশ্য মেসোমশাইয়ের সঙ্গে গল্প-গুজবে তাঁর ক্লান্তি নেই। সেই যে ইংরেজ কবি লিখেছিলেন না যুদ্ধের বৃত্তান্ত শেষ হয়ে যায় একদিন, কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকার ফিসফিসানি ফুরোয় না কখনও। সত্যিই প্রেম বটে মাসিমা-মেসোমশাইয়ের। এখনও এক ঘণ্টা হয়নি এ বাড়ি আসা, এরই মধ্যে অভিনিবেশ সেটা টের পেয়েছে ভালোমতো এবং এটা বেশ এনজয়ও করছে সে। অভিনিবেশের মনে হয়, তার মা-বাবা কিন্তু জীবনটা উপভোগ করতে পারলেন না এভাবে। টাকা-পয়সার অভাব কোনও দিনই ছিল না, মারাত্মক কোনও রোগব্যাধিও না, তবু কোথাও যেন একটা সুরকাটা ভাব। একটাই ছেলে, তাকে ডাক্তার বানিয়েছেন মা-বাবা, তবু সংসারে শান্তি কই? মাইগ্রেন। কাবু করে ফেলেছে মাকে তো বাবার দখল নিচ্ছে ডিপ্রেশন। আসলে জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হয়। মাসিমা-মেসোমশাইকে যত দেখছে অভিনিবেশ, ততই সে মুগ্ধ হয়ে পড়ছে। হসপিটালটা কেমন লাগল তোমার? মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পেল অভিনিবেশ। ভাল, তবে বেশ ছোট, এক কথায় সারার চেষ্টা করল কবিগুরুর ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় কি এগুলোই। বাড়িগুলো যেন কত দিনের চেনা, যেন অভিনিবেশকে ডাকছে অকৃপণ আতিথেয়তায়। কেন এমন হয়? নিশ্চয়ই বাড়ির ভেতরে উঠোন আছে, উঠোনে একটা করে গোলা আছে, গোলাভরা লক্ষ্মী আছে। দুপুরের নিরিবিলিতে লোকজন কম ছিল রাস্তায়। দু-চারজন বউ নদীতে স্নান সেরে ফিরছিল ঘরের পথে। তাদের গায়ে ভিজে কাপড় জড়ানো, কাপড় উঠে আছে হাঁটু অবধি, ভিজে শাড়ির জল টসটস ছুঁয়ে পড়ছে মাটির ওপর। বেশ অনেকটা আসার পর রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে পশ্চিমের দিকে, তারপর আরও একখানা বাঁক। ভারী সুন্দর টার্নগুলো। প্রায় ইউ শেপের টার্নগুলোর দুধারে বড় বড় গাছ-তাল, নারকোল, জাম, জামরুল... গাছগুলো বিশাল উঁচু বলিষ্ঠ দারোয়ানের মতো তারা যেন গ্রামের ইজ্জত আর নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী আত্মপ্রত্যয় তাদের পাতাচারণায়, কী অবদমিত অহংকার তাদের ছায়া বিস্তারে। অথচ কত বিনয়াবনত শ্রদ্ধাবোধ অভিনিবেশের মতো দূরাগত গন্ধটা ভীষণ চেনা মনে হয়েছিল তার, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিল না। অনেক ভেবে বের করেছিল, আশপাশের বাড়িতে ভাত ফোটার গন্ধ। মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতে ভাত ফোটে মোটা চালের ভাত। সে ভাতের মাহাত্ম্যই আলাদা। সবাই উপলব্ধি করতে পারে না, অভিনিবেশ পারে। খিদেয় পেট টুইটুই করছিল তার। ট্রেনের খাবার সে কি খাবার নাকি? ওই চাল যাওয়া মাটির বাড়িগুলোর ঠান্ডা দাওয়ায় বসে মেকের ওপর চাটাই পেতে সদ্য উনুন থেকে নামানো ওই ফ্যানমাখা ভাত, আহা। বন্ধুরা কলবে বড়লোকের বিলাসিতা কিংবা ডাক্তারবাবুর কবিত্ব। যে যাই বলুক, অভিনিবেশের খুব ইচ্ছে হল খেতে। কিন্তু কে তাকে খাওয়াবে এই অচেনা অজানা গ্রামে? কে-ই বা তার খিদের খবর রাখে? অভি খেয়ে নে, এক প্লেট চিকেন পকোড়া আর পরিমাণ মতো সস নিয়ে মাসিমা এসে দাঁড়ালেন অভিনিবেশের সামনে, সারা দিন তো কিছুই পেটে পড়েনি।
ট্রেনে খেয়েছি তো।
এক্ষুনি খেয়ে নে। আমি ঘন ছায়ার নীচে অভিনিবেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল স্তব্ধ হয়ে। তারপর আবার হাঁটা লাগিয়েছিল হাসপাতালের দিকে। হাসপাতাল যেতে বাঁ দিকে একটা সংরক্ষিত জায়গায় কবরখানা।
অভিনিবেশ।
গ্রামটাও তো খুব ছোট শুনেছি।
ছোট কিন্তু লাভলি।
ল্যান্ডস্কেপটা ভাল লেগেছে?
ভীষণ। একেবারে প্যানোরামিক...
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল অভিনিবেশ।।
ধানসিঁড়ি নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম পলাশপুর। নদী না বলে বড় ঝিল বলাই ভাল, কিন্তু গ্রামের লোক আদর করে ডাকে ধানসিঁড়ি নদী। অভিনিবেশের পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। খর রোদ্দুরে গ্রামটাকে প্রত্যক্ষ করেছে সে। দু ধারে ধানজামি, মাঝে লালচে মাটির রাস্তা। জমিতে লাঙল চালাচ্ছে চাষি। সাদা ধবধবে গরু পথিকের পথ আগালে কৃষ্ণ-কালো চোখে যেন কিছু বলতে চাইছে। কী বলতে চাইছে সে? স্বাগত আমাদের গ্রামে? সারি সারি মাটির বাড়ি। প্রত্যেকটা বাড়ির গঠনশৈলী অপূর্ব। কোনও কোনও বাড়ির চাল খড় দিয়ে ছাওয়া। আগন্তকের প্রতি।।
ঘন ছায়ার নীচে অভিনিবেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল স্তব্ধ হয়ে। তারপর আবার হাঁটা লাগিয়েছিল হাসপাতালের দিকে। হাসপাতাল যেতে বাঁ দিকে একটা সংরক্ষিত জায়গায় কবরখানা। ও দিকে তাকিয়ে গা-টা শিরশির করে উঠেছিল তার। কী শান্ত লিপ্ত সারা পৃথিবীর সমস্ত স্তব্ধতা যেন ভিড় করে আছে ওইখানে। কত মানুষ চিরকালের জন্য শুয়ে আছে মাটির তলায়, তারা টেরই পাচ্ছে না বাইরের রোদ-বৃষ্টি-কড়। অথচ ওরাও তো একদিন ঘুরে বেড়াত এই গ্রামে, ওই গাছের তলায় হয়তো তাদের কেউ দু দণ্ড বসে জিরিয়ে নিত কখনও। এই লাল মাটির কাঁকরে তাদের পায়ের ছাপ লেগে আছে, ওই ধানসিঁড়ির জলে তাদের আকুল স্পর্শ জেগে আছে। তারা গল্প করত, বাজারে যেত, বাস ধরত এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে, উৎসবের দিনে আনন্দ করত একসঙ্গে। আরও এগিয়ে গিয়ে অভিনিবেশ একটা সুন্দর গন্ধ পেয়েছিল। কীসের গন্ধ?
ফলের রস নিয়ে আসি, মাসিমার গলায় অপত্য স্নেহের ছোঁয়া।
অভিনিবেশ খাবারে মন দেয়। মাসিমার নিজের হাতে তৈরি পকোড়া তার স্বাদকোরকে অদ্ভুত তৃপ্তির আস্বাদ নিয়ে আসে। খেতে-খেতেই হঠাৎ দূর থেকে একটা জোরালো কাশির শব্দ কানে আসে তার। একটানা কাশছেন কোনও বৃদ্ধ মানুষ। শব্দটা বেশ পীড়াদায়ক। অভিনিবেশ প্রশ্ন করার আগেই মেসোমশাই কিছুটা কুণ্ঠিত গলায় বলে ওঠেন, আমার মা। আর উঠতে পারেন না। ইস, বয়স কত?
এইটটি ফাইভ আপ। কাল থেকে ভীষণ কাশি শুরু হয়েছে।
কোথায় আছেন তিনি?
মা একতলায় থাতেন। যাও দেখে এসো।
দেখাশুনো? দেখাশুনো কে করেন? খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলে সোজা মেসোমশাইয়ের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল অভিনিবেশ।
একজন আয়া আছেন। দুবেলা আসেন। স্নান করানো, বাথরুম করানো, খাওয়ানো, কাপড় কাচা প্রায় সবটাই উনি দ্যাখেন। আর রাত্রে শোয় শিবরাম, শিবরাম মুষ্ঠু-এ বাড়ির বহু পুরনো লোক। আমাদের দেখাশোনা মূলত ওরই হাতে, এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চুপ করে গেলেন মেসোমশাই। শিবরামের নাম আমি মা-র মুখে শুনেছি।
নিশ্চয় শুনে থাকবে। শিবরাম ছিল আমার বাবার খাস লোক। বাবা ছিলেন ভীষণ গণ্যিমান্য মানুষ, এলাকার লোক তাঁকে ভগবান আনে শ্রদ্ধা করত। শিবরামকে তাঁর ছায়াসঙ্গী বলতে পারো।
আমি বোধ হয় ছোটবেলায় তাকে দেখেওছি।
হ্যাঁ, তুমি একবার দেখেছ মনে হয়।
বিকেল গড়িয়ে লাল টকটকে সন্ধে নামছে।
পেছনের পিপুলগাছটা কেমন মোহময় হয়ে উঠেছে শব্দটার স্পষ্ট ও নিখুঁত উচ্চারণ স্ট্রাইক করল অভিনিবেশের মনে। আপনার বাড়ি কোথায়? ফের প্রশ্ন করল অভিনিবেশ।
ওই যে দেখতে পাচ্ছ ওই লালচে রঙের বাড়িটা, ওটাই আমার বাড়ি। জানলার কাছে গিয়ে আঙুল তুলে বৃদ্ধা অভিনিবেশকে তাঁর বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন। এত কাছে। বাঃ খুব ভাল, বিস্ময় মেশানো আনন্দের সঙ্গে বলল অভিনিবেশ। সে বুঝতে পারল, বাড়িটা এত কাছে বলেই হয়তো তাঁর পক্ষে দুবেলা দিদুনকে সামলানো সম্ভব হচ্ছে। নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলার টাকা-পয়সার বড় অভাব, না হলে এত বৃদ্ধ বয়সে পরের বাড়ি কাজ করতে আসবেন কেন? শরীরে মাংস নেই বললেই চলে, পাঁজরের হাড়গুলো কঙ্কালের মতো বেরিয়ে এসেছে। দুচোখ গভীর কোটরে ঢোকা, নাকটা বিশাল লম্বা, গালের হাড় ভাঙা। কপালে একটা ছোট কাটা দাগ। ছোট হলে কী হবে, এখনও শুকোয়নি সে ক্ষত। মনে হয়, কোথাও পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন ভাল রকম। একমাথা সাদা ধবধবে চুল ওই পাংশু মুখটাকেও যতটা সম্ভব মালিন্যমুক্ত করার চেষ্টা করে চলেছে। পরনের শাড়িটা কিন্তু যথেষ্ট অভিনিবেশ ভাবছে, এখানকার মানুষগুলো কত সরল সুন্দর। এই বৃদ্ধা তো তার কেউ না, সামান্য কিছুক্ষণের আলাপ, অথচ কত আপন করে নিলেন তাকে। তারও মুখ দিয়ে কত অনায়াসে বেরিয়ে এল দিদা শব্দটা। অথচ কলকাতায়? সেখানে কেউ চেনে কাউকে? ভাবে কারও জন্য কেউ? কেমন একটা বন্দি জীবন যেন। সো কনজেসটেড, সো সাফোকেটিং অভিনিবেশ ভাবল, অত ভিড়ের মধ্যেও সমস্ত যেন ফাঁকা ফাঁকা, হা-হা শূন্যতা বিরাজ করছে সর্বত্র। কিন্তু যে গ্রামে যে ডাক্তারি করবে সেই গ্রাম, কিংবা সেখান থেকে উনিশ কিলোমিটার দূরের এই মফসসল শহর যেন তার সমস্ত মানুষজন-গাছগাছালি-পশুপাখি তার সাঁঝবেলার সমস্ত আলোছায়া-মনন্তষ্টি মধুমাধবী নিয়ে অভিনিবেশকে বরণ করে নিজে গভীর মুগ্ধতায়, ভালবাসায়... বৃদ্ধার গায়ে হাত রেখে অভিনিবেশ বলল, তোমাকে কিছু ওষুধ খেতে হবে দিদা। আমি লিখে দেব।
তুমি বুঝি ডাক্তার?
হ্যাঁ তো। অভিনিবেশ বুঝল, এতক্ষণ বৃদ্ধা তার পরিচয়টাও জানতেন না।
আমাকে বুঝি শক্ত করে দেবে? ফোকলা
সত্যি? আমি আরও অনেক দিন বাঁচব? মুখচ্ছবি, চোখের কোনা চিকচিক করে উঠল। জীবন কত মহার্ঘ। মূহুর্তে বদলে গেল ভদ্রমহিলার অভিনিবেশ অনুভব করল সন্ধের রক্তাভ আলোয়। দূর থেকে শাঁখের শব্দ কানে আসছে। কলকাতায় শাঁখের শব্দ শুনতে পায় না অভিনিবেশ। এই শহরে এখনও।
শাঁখ বাজে, মেয়েরা উলু দেয়। বেশ লাগে অভিনিবেশের। সে একতলায় নেমে ধীরে ধীরে দিদুনের বেডের পাশে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে কাশিটা বন্ধ হয়েছে। প্রায় মৃতের মতো পড়ে আছেন বৃদ্ধা। পাশে আরেকজন বৃদ্ধা। তিনিও তো অশক্ত, থুথুড়ে। কী করে দেখাশোনা করেন? অভিনিবেশের মনে প্রশ্ন জাগে। সে কাশির সিরাপটা তুলে নিয়ে দ্যাখে, হ্যাঁ, ঠিক ওষুধই দেওয়া হচ্ছে।
ডাক্তারবাবুই তো দিয়ে গিয়েছেন এসে, আগ বাড়িয়ে বলে উঠলেন আয়া ভদ্রমহিলা।
আচ্ছা, আপনাকেও তো বেশ দুর্বল লাগে। পারেন আমার দিদুনকে দেখতে? অভিনিবেশ প্রশ্ন করে।
আমার কোনও প্রবলেম হয় না বাবা, ভদ্রমহিলা কাঁপা-কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন । কথাবার্তায় তাঁকে খুব সপ্রতিভ লাগল। অভিনিবেশের। বৃদ্ধার গলায় প্রবলেম পরিষ্কার। পোশাকের পরিচ্ছন্নতা থেকেই বৃদ্ধার রুচির পরিচয় পাওয়া যায় কিঞ্চিৎ। তাঁর সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তা বলে অভিনিবেশের মনে হল, ভদ্রমহিলা যথেষ্ট শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্ন ঘরের মানুষ। যত তাঁকে দেখছে অভিনিবেশ ততই তাঁর প্রতি কৌতূহল বাড়ছে তার। দিদুনের বেডের কাছে ঝুঁকে পড়ে তাঁকে ছুঁতে গেলে অভিনিবেশকে প্রায় বাধা দিয়েই বৃদ্ধা বলে উঠলেন, এইমাত্র ঘুমিয়েছেন। জেগে গেলে কাশিটা আবার শুরু হবে। একটু পরে না হয় বাবা বৃদ্ধার কথায় রাগ করা তো দূরের কথা, অভিনিবেশ প্রায় মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল, ঠিকই বলেছেন। ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট
তুমি কিছু মনে করলে না তো বাবা ?
না না, মনে করব কেন? তুমি তো ঠিকই বলেছ দিদা, অভিনিবেশের গলায় দিদা ডাক শুনে মনটা আনচান করে উঠল বৃদ্ধার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, তোমার ভাল হোক, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
হাসি হেসে উঠলেন বৃদ্ধা।
দ্যাখো তো! তুমি আরও অনেক দিন বাঁচবে।
সত্যি? আমি আরও অনেক দিন বাঁচব? মূহুর্তে বদলে গেল ভদ্রমহিলার মুখচ্ছবি, চোখের কোনা চিকচিক করে উঠল। অভিনিবেশ অনুভব করল জীবন কত মহার্ঘ। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ল তার মরিতে চাহি না আমি সুন্দর এ ভুবনে সত্যিই তো এ পৃথিবী অপরূপা এ সংসার মায়াময়, এ মায়া অনিঃশেষ। এখানে মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চায়। শত দুঃখ-দারিদ্র-হতাশা-গ্লানির মধ্যেও জীবন খুঁজে নেয় তার বেঁচে থাকার রসদ। অভিনিবেশ বুঝল, এই হাড়-জিরজিরে কঙ্কালসার বৃদ্ধাও জীবনকে কত ভালবাসেন; এই ভালবাসার নামই তো বেঁচে থাকা। নিশ্চয় দিদুনও বেঁচে থাকতে চান আরও অনেক অনেক দিন। এ ঘরে এসে অভিনিবেশ তাঁকে ঘুমন্ত দেখছে, বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া একটা অস্তিত্ব। তাঁর চলে যাওয়ার জন্য প্রহর গুনছেন মেসোমশাই, কিন্তু দিদুন কি চলে যেতে চান? অভিনিবেশের ভীষণ ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে সে? কী জিজ্ঞেস করবে? দিদুন কি কথা বলতে পারেন? পারলেও কি সত্যি কথা বলবেন তিনি। হয়তো মুখে বলবেন, হে ঈশ্বর, আমাকে উদ্ধার করো। কিন্তু মনে-মনে নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন এই বিছানার তুলো-কাপড়-কাঁথায় যতটুকু জীবনের কষ লেগে আছে এখনও, তাকে সন্তর্পণে রক্ষা করতে, সযত্নে লালন করতে। এরই তো নাম জীবন, এরই নাম মায়া, বেঁচে থাকা অভিনিবেশ বৃদ্ধার চোখে চোখ রেখে বলল, সত্যি।
সারা দিনের ধকলের পর সকাল সকাল ডিনার সেরে অভিনিবেশ ঘুমিয়ে পড়েছে অঘোরে। দোতলার সামনের দিকের গেস্ট রুমে শুয়েছে সে, ভেতরের ঘরে মাসিমা-মেসোমশাই। এ ঘরের ডান দিকের জানলা কিছুটা খোলা। আধখোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে অভিনিবেশের মুখে। তিরতির হাওয়ায় পরদাগুলো কাঁপছে।
হালকা ঝিঁঝির ডাক ছাড়া চারদিকে নির্জন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। হঠাৎ দরজা পেটানোর দুড়দাড় শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অভিনিবেশের। কীসের শব্দ? কিছুই ঠাহর করতে পারল না প্রথমটায়। সে কি ভুল শুনেছে? না, ভুল তো হওয়ার কথা নয়। রাত কত হল এখন? কে জানে। বোতলের ছিপি খুলে গলা ভেজাল অভিনিবেশ, জানলার দিকে মুখ বাড়িয়ে ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে চেষ্টা করবে ভাবল, এমন সময়ে আবার একই রকম শব্দ-দরজা পেটানোর! দমাদম দরজা পেটাচ্ছে কেউ। হ্যাঁ, এই বাড়িরই দরজা। এত রাতে কে দরজা পেটাচ্ছে? কেন পেটাচ্ছে? প্রায় হকচকিয়ে গেল সে। জানলাটা সম্পূর্ণ খুলে মুখ বাড়াল রাস্তায়। ওই তো দরজার গোড়ায় পুলিশ! একজন, দুজন, তিনজন... পাশে পুলিশের গাড়ি চাঁদের আলোয় গা ধুচ্ছে। কিন্তু পুলিশ কেন? গায়ে জামাটা গলিয়ে অভিনিবেশ নীচে নেমে এল। ততক্ষণে শিবরাম জেঠু বেরিয়ে এসেছে।
পুলিশের সঙ্গে কথা চলছে শিবরামের। সে কিছু একটা চিনিয়ে দিচ্ছে পুলিশকে। কী চেনাচ্ছে সে? অভিনিবেশ রাস্তায় নামতেই একজন উর্দি পরা লোক তার দিকে তাকিয়ে খানিক কুণ্ঠিত গলায় বলে উঠলেন, সরি টু ডিসটার্ব ইউ। আসলে আমরা সৌমেন্দু সরকারকে খুঁজছিলাম।
সৌমেন্দু সরকার? কে সে? অভিনিবেশের জানার কথা নয়। শিবরাম চেনে। সে-ই দেখিয়ে দিয়েছে সৌমেন্দু সরকারের বাড়ি। পুলিশ গাড়িতে উঠল। কৌতূহলী অভিনিবেশ শিবরামকে প্রশ্ন করে জানতে পারল, সৌমেন্দু হল এ বাড়ির ঠিক পশ্চিমের লালচে বাড়িটার লোক। ওই বাড়িটাই পুলিশকে চিনিয়ে দিচ্ছিল শিবরাম। সে তো হল, কিন্তু বাড়িটা সেই বৃদ্ধা মহিলার না? খটকা লাগল অভিনিবেশের। সে ফের প্রশ্ন করল শিবরামকে, ওই বাড়িতে একজন বৃদ্ধা থাকেন না?
হ্যাঁ থাকেন তো। উনিই তো এ বাড়ির মায়ের আয়া।
সৌমেন্দু ওঁর কে হয়? কী করেছে সৌমেন্দু? অভিনিবেশের গলায় বিস্ময় পড়তেও পারছে না যেন অপরিহরণীয় এক দায়বোধ থেকে। জানলা দরজার কপার্টগুলো ঘুণপোকার আক্রমণে ধরন্তপ্রায়। একটা হ্যারিকেন জ্বলছে টিমটিম করে। বিছানার বাঁ দিকে একটা অসাড় বৃদ্ধ মানুষ। কে ওই লোকটা? ও-ই তো গোঙাচ্ছে। অভিনিবেশ কাছে যেতেই লোকটা মুখের ইশারায় কিছু বলতে চাইল। ঠোঁটের কোণে তখনও লেগে আছে তরল খাবারের দাগ। এত রাতে কী খাচ্ছিল সে? পাশেই একটা ভাঙা স্টিলের বাটিতে ছাতুগোলা। সম্ভবত ওটাই ওকে খাওয়ানো হচ্ছিল। অভিনিবেশ বৃদ্ধকে নেড়েচেড়ে দেখল-হ্যাঁ, যা ভেবেছিল ঠিক তাই। লোকটা মারাত্মকভাবে প্যারালাইজড। বসার ক্ষমতা নেই, শুধু শুয়ে থাকে। কথা বলতে পারে না, গোঙাতে পারে ব্যথায়, উত্তেজনায়। বেডসোর হয়ে গিয়েছে। এই ধরনের রুগির রিকভারি আর কোনওভাবেই সম্ভব নয়। প্রথমাবস্থায় কিছু চিকিৎসা অবশ্যই ছিল, কিন্তু এখন সে যে স্টেজে, সে জায়গা থেকে আর পজিটিভ কিছু আশা করা অন্যায়। পাশের ঘরে পুলিশের তীব্র দাপাদাপির কালক্ষেপ না করে অভিনিবেশ ছুটে গেল বৃদ্ধার বাড়ির দিকে। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। বাইরে পুলিশ, ভেতরে পুলিশ। গলাবাজি করছে পুলিশ। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার সঙ্গে তীব্র বাধা মানে না। সুর চড়িয়ে সে বলে, বলবে আমায় জেঠু? মাথার পেছনের চুলগুলো বাঁ হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে শিবরাম বিড়বিড় করে বলল, সেটাই তো বুঝতে পারছি না বাবু। পুলিশ বললে, রেপ কেস। তা কী করে হয়?
কালক্ষেপ না করে অভিনিবেশ ছুটে গেল বৃদ্ধার বাড়ির দিকে। বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। বাইরে পুলিশ, ভেতরে পুলিশ। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার সঙ্গে তীব্র গলাবাজি করছে পুলিশ। ভারী বুটের আওয়াজে গমগম করছে চারদিক। সার্চলাইটের আলোর ঝলকানি। বৃদ্ধার পিঠে হাত রেখে অভিনিবেশ বলল, কী হয়েছে, দিদা?
কিছুই জানি না ভাই, বৃদ্ধার গলায় অসহায়তার চিহ্ন স্পষ্ট। ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ পেয়ে অভিনিবেশ সোজা ঢুকে গেল শোবার ঘরে। বহু পুরনো আমলের ঘর। অগোছালো। মাথার ওপর কড়িবরগাগুলো বিপন্নপ্রায়, আর ধরে রাখতে পারছে না অত বড় ছাদটাকে। তবু ভেঙে শব্দে কানটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল অভিনিবেশের। সে শুনতে পেল, একজন উর্দিধারী মহাপুরুষ বৃদ্ধাকে বলছেন, কাগজপত্র কই? কাগজপত্র দেখাও। মেডিকেল কাগজপত্র ছাড়া কিছু বিশ্বাস করি না। অভিনিবেশ স্বগতোক্তি করল, এই লোকটাই তবে সৌমেন্দু সরকার ? সে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশের মুখোমুখি হল, আপনাদের লজ্জা করে না এত দিনের পুরনো এমন একটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগিকে গ্রেপ্তার করতে এসেছেন। রেপ কবে হয়েছে, বলুন। বলুন, আমি জানতে চাইছি।
গত বুধবার রাতে। পক্ষাঘাতের নাটক আমরা বিশ্বাস করি না।
শাট আপ! আমি একজন ডাক্তার। আমি বলছি।
কাগজপত্র কই? মুখের কথার কোনো দাম নেই আমাদের কাছে।
ততক্ষণে বৃদ্ধা কাঁপা-কাঁপা হাতে নিয়ে এসেছেন পক্ষাঘাতের সাত বছরের পুরনো মেডিকেল রিপোর্ট, কাগজপত্র, ফাইল, নার্সিংহোমে অ্যাডমিশনের নথি। ইতিমধ্যে একজন অফিসারের মোবাইলে ওপরওয়ালার ফোন এল, সৌমেন্দু সরকার অলরেডি অ্যারেস্টেড। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল অফিসারের। সরি বলার অবস্থাও তাঁর নেই এখন। অভিনিবেশ গলা উঁচু করে বলল, বেরিয়ে যান। এক্ষুনি বেরিয়ে যান। খোঁজখবর না নিয়ে গরিব অসহায় মানুষের বাড়ি ডাকাতি করতে এসেছেন? আপনারা না সমাজের রক্ষক? আমি কেস করব আপনাদের বিরুদ্ধে
ক্ষমা করে দিন ডাক্তারবাবু, ভুল হয়ে গিয়েছে, হাত দুটো চেপে ধরে অনুনয়ের ভঙ্গিতে অফিসার বললেন।
একটা মানুষকে চোখে দেখেও বুঝতে পারেন না আপনারা। রেপিস্ট সৌমেন্দু সরকারের বয়স আর এই লোকটার বয়স এক হতে পারে? ননসেন্স যত সব। রাগে গজগজ করছে অভিনিবেশ। ততক্ষণে সুড়সুড় করে কেটে পড়েছে পুলিশ। বৃদ্ধা ভদ্রমহিলার চোখভরতি জল। অভিনিবেশ আলতো স্পর্শ করল তাঁর চিবুক, সন্তর্পণে জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, কী হয়েছিল সৌমেন্দুবাবুর?
সোমু আমার ছেলে, একটা স্কুলে পড়াত।। পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। একদিন বাইক অ্যাকসিডেন্ট করল। যমে-মানুষে টানাটানি, কিন্তু যম নিল না।
কত বছর আগের ঘটনা? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল অভিনিবেশ।
আজ থেকে সাত বছর আগে। তখন ওর বয়স সাঁইত্রিশ। সে দিন থেকেই কথা বন্ধ আর ডান দিক পুরো অচল। অভিনিবেশ মনে মনে ভাবল, পক্ষাঘাত একটা চুয়াল্লিশ বছরের মানুষকে কেমন চুয়াত্তরের বৃদ্ধ বানিয়ে ছেড়েছে। বছর দুয়েক আগেও ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিলে বসতে পারত সোমু, আবার শুতে চাইলে শুইয়ে দিতাম, এখন আর কিছুই পারে না। তবে মুখের ইশারায় সব বোঝাতে পারে কীসে সে ভয় পায়, কীসে কষ্ট, কখন খিদে পায়। ধরা গলায় বৃদ্ধা বলে চলেছেন, ছাতুর শরবতটাও খাওয়াতে পারলাম না ছেলেটাকে, ওরা এসে এমন করতে লাগল... লন্ডভন্ড হয়ে থাকা ঘরের মেঝে থেকে ততক্ষণে একটা ছোট্ট সোনালি রঙের কৌটো তুলে নিয়ে কৌতূহলবশত খুলে ফেলেছে অভিনিবেশ। বুঝতে তার অসুবিধে হয়নি ঘরোয়া পদ্ধতিতে কী বিপজ্জনক জিনিস বানিয়ে রেখেছেন বৃদ্ধা। অনেকগুলো আপেলের বীজ দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুটিয়ে জলটা সম্পূর্ণ মেরে যে থকথকে জিনিসটা তৈরি করা হয়েছে, তারই কিছুটা নির্যাস রাখা আছে ওই কৌটোয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিপজ্জনক উপকরণটির নাম সায়ানাইড। এ সব কী দিদা? কৌটোটা খুলে সোজাসুজি প্রশ্ন করল অভিনিবেশ। বৃদ্ধা অকপট উত্তর দিলেন, যে দিন রাজেনের মা, মানে তোমার দিদুন, দেহ রাখবেন সে দিন থেকে তো আমার আর কোনও উপার্জন থাকবে না। কিংবা যে দিন আমি অশক্ত হয়ে পড়ব, আর খাওয়াতে পারব না সোমুকে, কাপড় পালটে দিতে পারব না, গা মুছে দিতে পারব না, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারব না, ওষুধ খাওয়াতে পারব না, সে দিন... সে দিন... মা-ব্যাটা দুজনে মিলে খাবারে মাখিয়ে ওই বিষটা... বলতে-বলতে গলা ভিজে গেল বৃদ্ধার। ঠোঁট বাঁকিয়ে কী রকম একটা ইশারা করল সৌমেন্দু সরকার। ছুটে গেলেন বৃদ্ধা। শাড়ির আঁচল দিয়ে আলগা মুছে দিলেন ঠোঁটের কোনায় জমে থাকা ছাতুর দাগ। অভিনিবেশ কোনও রকমে চোখের জল আটকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাথার ওপরের সংকটপূর্ণ বিপজ্জনক কড়িবরগাগুলোর দিকে। তার মনে হল, দু-চারটে কড়িবরগা যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে, না-পড়াটাই অস্বাভাবিক, কিন্তু কী যেন এক অনস্বীকার্য দায়বদ্ধতায় তারা অবশ্যম্ভাবী পতন থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে ছাদটাকে। ভোর তখনও ফোটেনি মোটেও। নিবুনিবু হ্যারিকেনের আলো দাঁতে দাঁত চেপে তখনও অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এ ঘরের জমাট বাঁধা স্থবির অন্ধকারের বিরুদ্ধে।