31st Aug 2024
সাহিত্য
সাদাত হোসাইন
আমরা পাগলটাকে চিনতাম। মধু পাগলাকে। কোনেও অপরাধীকে আমি একটু বেশিই চিনতাম। কারণ সে ছিল আমার ছড়া কিংবা শ্লোক শেখা বিদ্যার গুরু। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মধু পাগলা যখন গাঁয়ের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যেত, তখন আমরা ছেলেপুলের দল তার পিছু নিতাম। তবে তাতে আমাদের বাবা-মায়েদের ভীষণ আপত্তি ছিল। তারা কোনেওভাবেই চাইতেন না যে আমরা মধু পাগলার পেছন পেছন ছুটি! এর অবশ্য যথাযথ কারণও ছিল। মধু পাগলা ছিল ভীষণ খেয়ালি। সে কখন কী করে বসে তার কোনেও ঠিকঠিকানা নেই। এই খুব ঠোঁট ভাসিয়ে মুখ হাসিয়ে খলবল করে কথা বলল তো, পরক্ষণেই আবার চোখ রাঙিয়ে মুঠি পাকিয়ে যমের মতন লাঠি হাতে তেড়ে আসতো। তবে মধু পাগলাকে নিয়ে আমাদের অভিভাবক মহলে যে কেবল এই ভয়ই ছিল তা-ই নয়। এরচেয়েও ঢের বেশি ভয় ছিল তার মুখের আলটপকা নানান কথাবার্তা নিয়ে। সে যখন তখন হেড়ে গলায় গান গেয়ে উঠত। সেই গানের আগামাথা কিছু ছিল কি না, তা আমরা ছোটরা সেভাবে বুঝতাম না। বুঝতাম না তার আবোল-তাবোল নানান কথার মাথামুন্ডুও। তবে সেই কথাবার্তা যে প্রায়ই তুমুল অশালীন আর শ্রবণ অযোগ্য ছিল, তা আমরা বুঝতে পারতাম আমাদের বাবা মায়েদের সংকুচিত, সভয়, সলাজ প্রতিক্রিয়া দেখে। তারা মধু পাগলার ওসব কথাবার্তা শুনে আড়ালে মুখ লুকাতেন। ভ্রু কুঁচকে, দাঁতে জিভ কাটতেন। তবে মধু পাগলা যখন বাচ্চাদের মতো মাথা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আধো বোলে বলতো-
আয় আয় ছুইটা আয়, ইশকুল হইল ছুটি,
খোলা মাঠা, আসমানেতে তারা কুটি কুটি,
আমেনা, জরিনা আর মানিক, রতন, দেখ দেখ জুনিপোকা তারার মতন...।
তখন আমরা বাচ্চারা ভীষণ মুগ্ধ হয়ে যেতাম। খুব আগ্রহ নিয়ে তার চারপাশে ভিড জমাতাম। ঘুরঘুর করতাম। প্রথমত, আমরা খুব চিন্তিত, গম্ভীর ভঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করতাম, মধু পাগলা কোনেও ছদ্মবেশী গোয়েন্দা-টোয়েন্দা নয়তো? ডিটেকটিভ বইতে এমন অনেক ঘটনার কথাই আমরা পড়েছি। পলাতক বড় ধরতে দুদে গোয়েন্দারা এভাবে গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়ায়। তারা নানান ছদ্মবেশে মানুষের সঙ্গে মিশে থাকে। সবচেয়ে সুবিধাজনক হল পাগলের ছদ্মবেশ। এতে করে কেউ কিছু সন্দেহ করে না। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া সহজ হয়। তারপর তথ্য সংগ্রহ করে, সময়-সুযোগ বুঝে খপ করে একদিন সেই অপরাধীকে ধরে ফেলে। দ্বিতীয়ত, তার এই ছড়া কেটে কেটে কথা বলা, কিংবা শ্লোক বলা আমার ভীষণ পছন্দের। আমার বন্ধুরা ঠিক কী কারণে মধু পাগলার চারপাশে ঘুরঘুর করত তা স্পষ্ট না,-হলেও, আমার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আমি তার কাছ থেকে ওইসব ছড়া, শ্লোক শিখতে চাইতাম। তবে এই উদ্দেশ্য বেশিরভাগ সময়ই সফল হত না। কারণ, মধুপাগলা কালেভদ্রে ওসব বলত। সে বেশিরভাগ সময়ই যা বলত, তা ছিল অশালীন। ফলে, তার কাছে যেতে হত লুকিয়েচুরিয়ে। কেউ দেখলেই যদি মা-বাবাকে বলে দেয়, এই ভয়ে থাকতে হত সদা সন্ত্রস্ত। আর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে মধু পাগলার অঘটন-ঘটন-পটিয়সি মেজাজতো ছিলই। হুটহাট রেগে যেত সে। তার সেই তিরিক্ষি মেজাজ আর রুদ্র চেহারা বড় ভয়ানক।
এভাবেই মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম, রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়ি-সিগারেটের টুকরোগুলোর মাথায় আগুন ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে আয়েশে লম্বা টান দিত সে। প্রতি টানে প্রাণভরে কাশতো। তার সেই কাশির দমকে ঝনঝন করে বাজত তার অকেজো শরীরের বিদ্রোহী কলকজা।
সে রাস্তায় বের হলেই গাঁয়ের দুষ্টু ছেলের দল তার পিছু নিত। তারপর নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঢিল ছুড়ত তার গায়ে। মধু পাগলা তখন কুৎসিত ভাষায় বাপ-মা তুলে গালাগাল দিত। ছেলেরা অবশ্য সেসব গায়ে মাখত না। তারা বরং মধু পাগলার সুর নকল করে, তার মতোই ছড়া কেটে বলত-
হই হই ছাগলা, যায় মধু পাগলা,
পাগলসার কান্ধে, ভূতে ভাত রান্ধে।
রাস্কায় গন্ধ, মধু পাগলা অন্ধ। মধু পাগলা তখন আসলে অন্ধেরই মতন। তার বাঁ চোখে কী-একটা অসুখ করেছে। সেই চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে। তবে সেসব সে থোড়াই কেয়ার করত। বরং এ-ছড়া কেউ বললেই হিংস্র পশুর মতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসত সে। ছেলেপুলের দল
পাগলার ত্রি সীমানায়ও যেতে না-পারি, সেজন্য কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতেন।
তখন দিগ্বিদিক দৌড়ে সরে যেত। তারপর খানিক বাদেই আবার ফিরে আসত। তারপর আবার ছড়া কেটে মধু পাগলাকে খেপিয়ে তুলত। আবার তাড়া করতেই ভোঁ-দৌড়। সে এক আনন্দের দিন বটে!
মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। থুতনির নীচে এক গোছা দাড়ি। খালি গায়ের মধু পাগলার পরনে দুই ভাঁজ করা হাঁটু অবধি লুঙ্গি। বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলের নখখানা মরা, আঙুলটা থেঁতলানো। সেই থেঁতলানো আঙুল থেকে পুঁজ পড়ে। মধু পাগলা ইশকুলের বারান্দার একপাশে সারাক্ষণ বসে থাকে। মাঝমধ্যে ঢুলুঢুলু চোখে তাকায়। তারপর ঝিমায় তার চারপাসে উচ্ছিষ্ট পচা-গলা খাবারের স্তূপ। সেসবের লোভে মাছি ছুটে আসে। সেই মাছি এসে তার পুঁজ পড়া বৃদ্ধাঙ্গুলির ঘায়ে বসতে চেষ্টা করে। সে তখন হাত নেড়ে হুশহাশ শব্দে তাদের তাড়ায়। মাছিগুলো ঠিক ওই দুষ্টু ছেলের দলের মতোই খানিক দূরে গিযে অপেক্ষা করে। তারপর ফিরে আসবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। মধু পাগলা হয়তো একটু ধাতস্থ হয়। তবে মাছগুলো তাকে নিস্তার দেয় না। সে চুপচাপ বসতেই আবার ভনভন করে ছটে আসে। তার ওই পায়ের আঙুলের পুঁজে তাদের রাজ্যের লোভ। মধু পাগলা ভীষণ বিরক্ত হয়। সে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে, নিস্পন্দন হয়ে ওঁত পেতে থাকে। তারপর হঠাৎ ঝড়ের বেগে ডান হাতটা ঝটকা মেরে বাড়িয়ে দু'তিনখানা মাছি মুঠোবন্দি করে ফেলে। তারপর তাদের মনের আনন্দে পিষে মারতে থাকে। তবে ও পাড়ার জাকির নাকি একবার বিভৎস এক দৃশ্য দেখেছিল। মধু পাগলা সেই মাছিগুলো টপাটপ মুখে পুরে খেয়ে ফেলেছিল। সেই দৃশ্য দেখে সে হড়হড় করে বমি করে ফেলেছিল।
মধু পাগলাকে আমি ও আমরা চিনতাম। সে ছিল মস্তবড় চোর। বাজারে দোকানিদের সামান্য অসতর্কতার সুযোগে চোখের পলকে বিস্কুটের বয়াম সাবাড় করে দিত সে। চিনির বয়াম থেকে চিনি, মুড়ির টিন থেকে একমুঠো মুড়ি কিংবা খানিক গুড় নিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। শুধু এসবই কেন, মধু পাগলার চুরির তালিকা থেকে নিস্তার পায়নি কলা, মুলা, মাংস, ঢেঁকি শাক অবধি। সেবার সে কাজি-বাড়ির উঠোন থেকে টিনের বদনা, খাঁয়েদের বাড়ির খোলা রান্না ঘর থেকে পাতা-পুঁতা, এমনকী রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড়, ছেঁড়া জুতো। ভাঙা কাঠের টুকরো অবধি চুরি করে নিয়েছিল।
মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম। সবচেয়ে ভাল চিনত আমাদের পাশের বাড়ির পিনু। সেবার পাগলামিটা খুব বেড়ে গিয়েছিল মধুর। গাঁয়ের মুরুব্বিরা বলতেন, মধু পাগলার পাগলামির সঙ্গে চাঁদ-সূর্যের কী জানি কী সম্পর্ক ছিল! অমাবস্য আর পূর্ণিমায় জোয়ার-ভাটা হলে তখন পাগলামিটা খুব বেড়ে যেত তার। পিনু সেদিন বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। স্কুলের কোনা পার হতেই সে দেখল আধো অন্ধকারে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মধু পাগলা। মিতি সুরে খানিক নাকও ডাকছে। সঙ্গেসঙ্গেই দুষ্টু বুদ্ধিটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল পিনুর। এইতো সুযোগ মধু পাগলাকে খানিক অতিষ্ট করে তোলার। এমনকী তার কাছে তো খুব একটা ঘেঁষা যায় না। এখন এই অন্ধকারে তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল পিনুর। এই তো সুযোগ মধু পাগলাকে খানিক অতিষ্ঠ করে তোলার। এমনিতে তার কাছে তো খুব-একটা যাওয়া যায় না। এখন এই অন্ধকারে তার ঘুমের ঘোরে যদি যাওয়া যায়! কিন্তু গিয়ে কী করবে সে? মধু পাগলার থুতনির দাড়িটা বেশ বড় হয়েছে। মাথার চুলগুলোয় প্রায় কাঁধ ছুঁই ছুঁই। হঠাৎ এই চেহারায় দেখলে কেমন ভয়ই হয়। এ-কারণে ঠিকঠাক খেপাতেও কেমন ভয় হয়। আচ্ছা, গোঁফ- দাড়ি, চুলবিহীন মধু পাগলাকে দেখতে কেমন লাগবে? দৃশ্যটা চিন্তা করতেই চোখ দুটো চকচক করে উঠল পিনুর! কেমন হাবাগোবা নিরীহ গোছের এক পাগলের ছবি ভেসে উঠল তার কল্পনায়। আচ্ছা অমন হাবাগোবা চেহারার মধু পাগলারও কি এখনকার মতো এতো রাগ থাকবে? এমন খেপাটে হবে সেও? নিশ্চয়ই নয়। ভাবতে ভাবতেই বাজার থেকে একখানা ঝাঁ-চকচকে কাঁচি কিনে নিয়ে এলো পিনু। তারপর আবছা অন্ধকারে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমোনো মধু পাগলার সামনে গিয়ে চুপিচুপি বসল সে। তারপর?
মধু পাগলার এলোমেলো দাড়ি নেমে এসেছে গলা অবধি। পিনু তার লিকলিকে লম্বা বাঁ হাত খাড়া বাড়িয়ে সেই দাড়ি গোছা ধরল। তার ডান হাতে কাঁচি। এখুনি কচাৎ করে ওই দাড়ি গোছা কেটে ফেলবে সে।
আর ঠিক তক্ষুণি অঘটনটা ঘটল। হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল মধু পাগলা। তারপর দাঁড়িয়ে গেল। অন্ধকারেও তার চোখ দু'খানা জ্বলে উঠল গনগনে আগুনের মতন। ঘটনা বুঝতে যেন মুহূর্তকালও বিলম্ব হল না তার। সে হিশহিশ শব্দে অকস্মাৎ কষে এক লাথি বসালো পিনুর বুক বরাবর। পিনু ইশকুলের বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ল মাঠে। মধু পাগলা এবার ষাঁড়ের মতো ছুটে এসে সজোরে লাথি বসাল পিনুর বুক বরাবর। পিনু ইশকুলের বারান্দা থেকে ছিটকে পড়ল মাঠে। মধু পাগলা এবার ষাঁড়ের মতো ছুটে এসে সজোরে লাথি বসাল তার পাঁজরে। যেন মড়মড় শব্দে দু'খানা হাড় ভেঙে গেল। পিনু তখন দম নিতে পারছিল না। তার ফুসফুস ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মধু পাগলা সেসব গ্রাহ্যই করল না। সে পাথরের মতো বুকে চেপে বসল পিনুর। তারপর যেন সত্যি সত্যিই নিজের পাগল পরিচয়ের সার্থকতা প্রমাণে সক্রিয় হয়ে উঠল সে। উন্মত্ত মধু সপাটে কিল ঘুসি বসাতে লাগল পিনুর বুকে, মাথায়, মুখে। পিনুর তখন মৃতপ্রায় অবস্থা। দম আটকে মরেই যাচ্ছিল সে। তাকে বাঁচালো ইশকুলের অঙ্কের শিক্ষক আলিমস্যর আর ছাত্ররা। কিন্তু ওই বেঁচে থাকা অবধিই। পিনু আর পুরোপুরি ভাল হয়ে উঠল না কখনও। চিরস্থায়ী হাঁপানির রোগী হয়ে গেল সে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর যে ব্যাপার, তা হল ঘর থেকে আর বের হতে পারত না সে। বাইরের কাউকেই দেখলেই তীব্র আতংকে চিৎকার করে উঠত। ফলে তাকে করেই রাখতে হত সবসময়। মধু পাগলাকে আমরা চিনতাম। আমরা সবাই। আমি পিনু, কাজি কিংবা খাঁ-বাড়ির লোক। মুড়ি, গুড়, চিনি, বাদাম, কলা, মুলা, মাছ, শাকের দোকানিরা পর্যন্ত। এ-গাঁয়ের সবাই তাকে চিনত। আমাদের পাশের গাঁয়ের সোবহান মাস্টারের পোষা কুকুরটা অবধি। দূর থেকে দেখলেই তীব্র চিৎকারে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসত সে। যেন ভয়ানক কোনও জন্তু-জানোয়ার দেখেছে সে। আমরা সকলেই তাকে চিনতাম। মধু পাগলাকে।
আমি এবং আমরা।
সেবার শুরু হল ভয়ানক বন্যা।
সেই বন্যায় সব তলিয়েছে। রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, হাটবাজার সব। গ্রামের মানুষ আশ্রয় নিয়েছে স্কুলঘরের পাকা ছাদে। কিন্তু এত মানুষ অতটুকু ছাদে কী করে ধরবে? গাদাগাদি করে নাভিশ্বাস অবস্থা! কিন্তু তাতেও নিস্তার কী? দূরদূরান্ত থেকে নৌকা করে মানুষ আসছে। কী হবে কে জানে? সেদিন সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি। হু হু করে তীব্র স্রোতে নদীর জল বাড়ছে। সেই স্রোত দেখলে ভয়ে গা-হিম হয়ে আসে। নৌকার পর নৌকা মানুষ আসছে।
সন্ধ্যাবেলা বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল তুমুল ঝড়ো হাওয়া। সেই হাওয়ায় উত্তাল হয়ে উঠল নদী। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল নদীর তীরে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে লাগল দুই ধারের মাটি। মাটির সঙ্গে উপড়ে পড়তে লাগল বড় বড় গাছ। ধসে যেতে লাগল বসত বাড়ি। মুহূর্তেই যেন খুনি উন্মাদিনী হয়ে গেছে নদী। ঠিক এইসময়েই নৌকাটা আসছিল নদীর ওপার থেকে। ছোট নৌকাটায় তিন-চারটি গৃহস্থ পরিবার। তারা জবুথবু হয়ে বসে আছে নৌকার পাটাতনে। ঢেউয়ের মুহুর্মুহু ধাক্কা সামলাতে তারা শক্ত করে পাটাতনের তক্তা ধরে আছে। কিন্তু তাতে যেন স্থির হয়ে বসতে পারছে না কেউ। ঠিক এই মুহূর্তে ঝড়টা উঠল। আকাশ কালো করা মেঘের প্রবল ঝড়। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টিও। নদীর পারে দাঁড়ানো মানুষগুলো ভেবেছিল, এই বুঝি নৌকাটা পাখখড়ির মতো ভেঙে দু'টুকরো হয়ে যায়, কিংবা ওই প্রলয়ঙ্করী ঢেউ তাকে আছড়ে ফেলে জলের বুকে। তারপর ভাসিয়ে নিয়ে যায় তীব্র স্রোত। ডুবিযে দেয় নদীর অতল জলে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডুবিডুবি করেও নৌকাটা শেষ অবধি ভালয় ভালয় মাঝ নদী পার হযে তীরের কাছাকাছি চলে এল। প্রবল দুশ্চিন্তা কাটিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তীরের মানুষগুলো। স্বস্তি দেখা গেল নৌকার যাত্রীদের মধ্যে্যও।
ততক্ষণে নদীও যেন খানিক শান্ত হয়ে এসেছে। তোড়জোড় ছেড়ে ক্রমশই মৃদু হয়ে আসছে ঢেউগুলোও। কিন্তু তীর থেকে হাত দশেক দূরে থাকতেই অকস্মাৎ বিশাল ঢেউটা ধেয়ে এলো নৌকাটার দিকে। তারপর পাহাড়ের মতো শরীর নিয়ে তীব্র বেগে আছড়ে পড়ল নৌকার গায়ে।
অত বড় ঢেউ এ-নদীতে এর আগে কেউ দেখেনি। সেই ঢেউ প্রায় উল্টেই ফেলেছিল নাওখানা। কিন্তু দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো সেই ঢেউয়ের আগায় বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ভেসে রইল নৌকাটা। ডুবল না শেষপর্যন্ত। এ-এক অলৌকিক দৃশ্যই বটে! দূরে তাকিয়ে থাকা লোকগুলো বিস্মিত চোখে দৃশ্যটা দেখল। কী আশ্চর্য, ওই অতো বড় ঢেউয়ের ভেতর থেকে নৌকাটা ঠিকঠাক বেরিয়ে এলো! পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে জবুথবু হয়ে নৌকার পাটাতনে তখনও বসে আছে মানুষগুলো।
কিন্তু সবুজ শাড়ি পরা মাঝবয়সি নারীটি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, ময়না, আমার ময়না...ও ময়না...। ময়নার বাপ, আমার ময়না! আমার ময়না কই? ময়নার ঢেউয়ে লইয়া গ্যাছে। গাঙ্গের ঢেউ লইয়া গ্যাছে। ও ময়নার বাপ, ও ময়না। ময়না.... মাগো, ও মা, মা-রে।
ময়না নামের সাত-আট বছরের মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল নৌকার গলুইয়ের কাছে। প্রবল ঢেউ তাকে ছিটকে দিয়েছে নদীতে। কিন্তু এখন আর তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অসংখ্য চোখ তাকিয়ে আছে নদীতে। সেখানে তখন আবারও একসঙ্গে তীব্র স্রোত এবং ভয়ংকর ঢেউ। সেই ঢেউয়ের ভেতর ময়নাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কোথাও না। তাকে গিলে নিয়েছে রাক্ষুসি নদী। নৌকা ততক্ষণে তীরের মাটি ছুঁয়েছে। কিন্তু ময়নার মায়ের তীব্র চিৎকারে যেন কেঁপে উঠছে সন্ধ্যার আকাশ। নদীর দুইপাশে ক্রমশই জড়ো হতে থাকল আরো মানুষ। আরো অসংখ্য বানভাসি মানুষ। সেইসব বন্যাক্রান্ত অসহায় মানুষের শুকনো শীর্ণ মুখে তখন তীব্র ভয়। ময়না ও তার মায়ের জন্য করুণ কান্না। কিন্তু এই মৃত্যুর মতো ভয়ংকর জলে ময়নাকে খুঁজতে নামবে কে? কার এত সাহস ওই প্রলয়ঙ্করী নদীর জল থেকে ময়নাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে? কেউ না। কারণ, সবাই জানে, এখানে এখন নামা মানে নির্ঘাত মৃত্যু!
ময়নার মা হাঁটুজলে নেমে বুক চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদছেন। তার কান্নার জলে হয়তো দু'ফোঁটা জল বাড়ছে নদীর। কিন্তু তাতে কারওর বুকে সাহস বাড়ছে না এতটুকুও। এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর কোলে কে নামবে? কে নামবে এই ভয়ংকর মরণ স্রোতে?
কেউ না?
কিন্তু কেউ একজন নামল। তাকে কেউ দেখল না। জানল না। খেয়াল্য করল না। তার আগেই সে ঝপ শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই প্রবল স্রোত আর তীব্র ঢেউয়ে। সেই ঢেউ নিমেষেই গিলে নিল তার কুচকুচে কালো শরীর। শুকনো, শীর্ণ, ম্লান এক মানুষ। আমরা সবাই তাকিয়ে রইলাম। আমরা ■ গ্রামসুদ্ধ সবাই। কিন্তু সেখানে, সেই নদীর জলের স্রোতে তখন ঢেউ ছাড়া আর কিছু নেই। কিচ্ছু না। কেবল খানিক আগে লাফিয়ে-পড়া মানুষটার জলে পড়ার ওই শব্দটুকু যেন অন্তহীন এক
প্রতিধ্বনির মতো কানে ভাসছে। কেবল ঝুপ করে পড়া ওই শব্দটুকুই!
মধু লাগলাকে পাওয়া গেল একদিন বাদে। নদীর পাড়ে ঘন কাশবনের ভেতর আটকে আছে তার কুচকুচে কালো শরীরটা। জল খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে সে। তার বুকের কাছে দু'হাতে জাপটে ধরা মৃত ময়নার শরীর। সে ময়নাকে খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু তাকে নিয়ে ওই প্রবল জলের স্রোত থেকে উঠে আসতে পারেনি সে। আমরা সেই মৃত শরীর দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি, পিনু, কাজি এবং খাঁ-বাড়ির লোকেরা। বিস্কুট, চিনি, মুড়ি, গুড়, কলা, মুলা, মাছ, ঢেঁকি শাকের দোকানিরা। সবাই। আমরা সবাই তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়েই রইলাম। নিষ্পলক। নির্জীব। নির্বাক।
আমরা মধু পাগলাকে চিনি। আমাদের সেই মধু। মধু পাগলা।
আচ্ছা, আমরা কি তাকে আসলেই চিনি? এই মধু পাগলাকে? ওই যে কালো শরীরের কুচকুচে একটা মানুষ? তার বুকের ভেতর কেমন শান্ত, নিথর, নিশ্চুপ শুয়ে আছে ময়না।
যেন এক পরম নির্ভার আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে! কার বুকে ঘুমিয়ে আছে সে? মধু পাগলার? কিন্তু মধু পাগলা কে?
কে জানে কে সে!
আমরা পাগলটাকে চিনতাম, মধু পাগলাকে। এই মানুষটাকে না।