21st Dec 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

মেঘ-পাহাড়ের মুলুকে চা-বাগানের মাঝে...

16th Jul 2024

ভ্রমণ

কমলেন্দু সরকার


মেঘ-পাহাড়ের মুলুকে মেঘ আর চা-বাগানের কোলাকুলির দৃশ্য কেমন লাগবে! অস্ফুটে বেরিয়ে আসবে-- আহা, কী দেখিলাম যাহা জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না! শত চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবেন না। আর এই চিত্র যা দেখা যায় হরবখত! মাঝেমধ্যেই ঘুরতে-আসা পর্যটকদের শরীর ছুঁয়ে যায় মেঘের আদর! মেঘের এ-আদর একেবারে সারা শরীর জুড়ে! অবাক হচ্ছেন? না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বাস করুন, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না। আমাদের এমনটাই হয়েছিল। এমনটাই হয় পূর্ব নেপালের কন্যমে! পূর্ব নেপালের চা- বাগানের ভিতর ছোট্ট নিরিবিলি চমৎকার এক পাহাড়ি জায়গা। ঘুম ভেঙে হোটেলের ব্যালকনির দরজা খুলতেই পুব আকাশে নতুন ভোরের লাল আভা ছড়িয়ে গেল ঘরে। লালজামা গায় হামা দেওয়া সূয্যিমামা বলেন, 'ভোর হল দোর খোলো খুকমণি-খোকামণি ওঠো রে।' সূয্যিমামার লাল জামা কখন যে সাদা জামা উঠবে বুঝতেই পারবেন না। আমি অন্তত পারিনি! শুধু আমি কেন, নির্মল-সুজাতাও পারেনি। আমরা তিনজনই গেছিলাম পূর্ব নেপালের কন্যম, ইলম, শ্রী আন্টু। মাঝপথে টুকটাক আরও কয়েকটি জায়গায়। যাইহোক, যা বলছিলাম ভোরের সূর্যের লাল রং কখন যে সাদা হয়ে উঠল তা টেরই পেলাম না। তার কারণ, এতটাই মোহিত হয়ে উঠেছিলাম কন্যমের মনোরম প্রকৃতি দেখতে দেখতে! দেখে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার মতো এখানকার প্রকৃতি! কিছুক্ষণ পর দেখা যায় পাহাড়ের নীচ থেকে মেঘ তার শাড়ি মেলে দিতে দিতে উঠে আসছে ওপরে আকাশ- বুকে! হোটেলঘরের ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অতিথিদেরসোহাগে ভরিয়ে দেয় মেঘবালিকা! তখন সারা শরীরে জড়িয়ে মেঘের আদর। মেঘের এমন আদর খেতে হলে আসতেই হবে কন্যম। এমন এক স্বর্গীয় অনুভূতির মাঝে ডেকে যায় পাহাড়ি পাখির দল। তারাও আসে অতিথিদের ঘুম ভাঙাতে আসে। গান গায়, শিস দেয়। যে যেমন পারে। হোটেলের - ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মনভুলানো সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তও দু'টিই দৃশ্যমান। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা!

হোটেল থেকে কিছুটা দূরেই লাভ পয়েন্ট। হাঁটাপথ। তবে অটোতেও যাওয়া যায়। হেঁটে গেলে প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। চা-বাগানের ভিতর চমৎকার এক জায়গা লাভ পয়েন্ট! এখানে প্রেমিক-প্রমিকারা আসেন। মজা করেন। আনন্দ করেন। সেলফি তোলেন। তার মানে এই নয় যে আপনার সেখানে নো এন্ট্রি। তা একেবারেই নয়। সকলেই স্বাগত লাভ পয়েন্টে। ছোট-বড় সকলেরই। চারপাশে শুধুই চা-বাগান। চা-বাগানের বুক চিরে পথ গেছে নিজের মতো। আশপাশের পাহাড় থেকে মিঠেকড়া ঠান্ডা বাতাস মাতাল করে দেয়! সঙ্গে আরামদায়ক রোদ্দুর। তবে বাতাসের সঙ্গী হয়ে কখনওসখনও মেঘ আসে আদরে ভরিয়ে দিতে! যেমনটি ভরিয়ে দেয় চা-বাগানের আড়ালে প্রেমিক-প্রেমিকা। ভেবে নেবেন কলকাতার ভিক্টোরিয়ার মাঠ। খুব বেশি পরিচিত নয় পূর্ব নেপালের কন্যম। ভিড় নেই। নেপালের স্থানীয় যুবক-যুবতী সংখ্যায় বেশি। এছাড়া নেপালের বিভিন্ন জায়গার মানুষ এখানে আসেন। এখানকার মানুষ খুব ভাল। চমৎকার পরিবেশ লাভ পয়েন্টের। চা-বাগানের মাঝে অজস্র ভিউ পয়েন্ট। চারিদিকে শুধুই চা-বাগান আর পাইনের সারি। কন্যমের মুগ্ধতায় ডুবে পৌঁছে যেতে হয় এক কল্পলোকে! যেখানে কল্পনা আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার! লাভ পয়েন্টের নীচে লোকাল চকোলেট পাওয়া যায়। স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব। কিছুটা দূরেই ফিক্কল বাজার। পাহাড়ি পথের ধারে এক চিলতে বাজার। নেপালে তৈরি জিনিস আছে এখানে। এখানেও পাওয়া যায় স্থানীয়দের হাতে তৈরি চকোলেট। লা-জবাব স্বাদ! দাম বাজেটের মধ্যেই। যে-কোনও নামী চকোলেটকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে। কন্যম থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ ইলম। পাহাড়ি পথ যেমন হয়, চড়াই-উতরাই। পাহাড়ি শহর যেমন হয়, তেমনই হল ইলম। হোটেলের পিছন দিকের রাস্তায় গেলে মনে হবে এ বোধহয় অন্য কোনও জায়গা। পাহাড়ের ঢালে-গায়ে শুধুই চা-বাগান! চোখে লাগে শুধুই চা-বাগানের সবুজ ঘোর! তারই ফাঁকে উঁকি মারে পাইনের সারি। উঁকি দেয় আরও কতশত পাহাড়ি গাছ। সবচেয়ে শিহরিত আর বিস্মিত করল ইলমের চা-বাগান পেরিয়ে ভালুকডাঙা যাওয়ার পথটি! গহীন অরণ্যের ভিতরে পথের চড়াই-উতরাই। জঙ্গল এখানে এতটাই গভীর যে, দুপুরের রোদ্দুর গায়ে পড়ে না! কোনও কোনও জায়গায় বেশ চড়াই। কয়েক জায়গায় চড়াই পথে খালি গাড়িও ঠেলতেহয়। গাড়ি ওঠে না। নামা-ওঠা আর হাঁটা। এই করতে করতে জঙ্গলের পথ পেরোনো। মনে আশঙ্কা জাগে এই বোধহয় বন্যজন্তুর মুখোমুখি হতে হল! স্থানীয়রা বললেন, 'না, কোনও ভয় নেই। একসময় এখানে প্রচুর বন্যপ্রাণ ছিল। এখন নেই তেমন।' তবুও ভয়-ভীতি নিয়ে পৌঁছনো গেল ভালুকডাঙা। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আর পাহাড়। দূরে দু'একটা বাড়ি। গা-ছমছমে ব্যাপার! একসময় এখানে বাস ছিল ভালুকের। যে-কোনও সময় তারা হেলতেদুলতে বেরিয়ে পড়ত। প্রচুর ভালুক ছিল ভালুকডাঙায়। নামেই বোঝা যায়। এখন নেই। তবে দু'একটা অবশ্য এসে পড়তেই পারে। শিহরন জাগানো অপূর্ব জায়গা ভালুকডাঙ। আচমকা বন্যপ্রাণের উপস্থিতি আর গভীর অরণ্যের গন্ধ নিয়ে বেশ কিছুটা কাটালাম। মনে হচ্ছিল আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে। কিন্তু সূয্যিমামা পাটে যেতে বসেছেন ভোরের লালজামা গায়। তাই ভালুকডাঙা ছেড়ে অন্য কোনওখানে রওনা হওয়া গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছলাম ছিয়াবাড়ি কটেজ। নামটি বড় সুন্দর, জায়গাটিও। আর একটি চমৎকার জায়গা! চারিপাশে চা-বাগান আর চা-বাগান! তারই মাঝে কালো ফিতের মতো রাস্তা। ছিয়াবাড়িতে রয়েছে কটেজ আর পাকাবাড়ি। ছিয়াবাড়ির অর্থ ছায়াবাড়ি। সত্যিই ছায়াবাড়ি। গাছগাছালির ছায়া মেলা চারিদিকে। এখানে খাওয়া আর আড্ডার জায়গাটি তৈরি পাহাড়ি বাঁশে। কাছেই নজরমিনার। উঠলেই দৃষ্টিনন্দন লাগে ইলম! এ এক অন্য ভূস্বর্গ! ঘন সবুজ অরণ্য। চড়াই-উতরাইপথ। শীতের শিহরন। সুন্দরের হাতছানি। স্থানীয়দের মুখে অমলিন হাসি। সৌন্দর্যের খনিতে হাঁটতে হাঁটতে বুঁদ হয়ে গেছি। বেলাশেষের রোদ্দুরে স্বপ্নেরা ভিড় করে! রূপকথার দেশে এসে মনে হয় যেন স্বপ্নজড়িমায় আছি। সামনে চা- বাগানের উতলা নির্ঝর সবুজ। কানে আসে যেন সবুজাভ ঝরনার উচ্ছ্বাস! না তো আশপাশে কোনও পাহাড়িয়া ঝরনার উপস্থিতি নেই। তবে কী! পাহাড়-ছোঁয়া বাতাস চা-বাগানের সবুজ ছুঁয়ে শরীর-মন আবিষ্ট করে! ভয়ংকর ওই সৌন্দর্যের হাতছানি উপেক্ষা করা যায় না কন্যম আর ইলমের ছিপছিপে রোমাঞ্চকর পাহাড়ি পথে!

ইলম থেকে যাওয়া যায় সুখিয়া পোখরি। নেপাল দিয়ে সান্দাকফু যাওয়ার পথে পড়বে। অনায়াসে ঘুরে আসা যায় সান্দাকফু। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে তুষারপাত চাক্ষুষ করতে পারেন। কিংবদন্তি আছে, পঞ্চপাণ্ডবদের খুব প্রিয় জায়গা ছিল সুখিয়া পোখরি। এখানে তাঁরা ছিলেনও কিছুদিন। চমৎকার জায়গা। এখানে হিমালয়ান স্যালাম্যান্ডার দেখা যায়। তবে আমরা দেখিনি। ইলম এবং কন্যম দু'টি জায়গা থেকেই যাওয়া যায় শ্রীআন্টু পোখরি। স্বর্গের মতো সুন্দর। প্রচুর হোমস্টে আছে। লেক ঘিরে চমৎকার সব হোমস্টে। লেকের জলে সবুজ হয়ে থাকে চা-বাগান, পাইন আর পাহাড়ি গাছের ছায়ায়। সামান্য অর্থের বিনিময়ে বোটিং করা যায় লেকে। চারপাশে পাহাড় আর চা-বাগানের মাঝে লেকের সৌন্দর্য এককথায় অপূর্ব! কিছুটা দূরে পাহাড়ের ওপর রয়েছে সূর্যোদয় দেখার জায়গা। এখান থেকে সুর্যোদয় দেখার অনুভূতি অবর্ণনীয়! সারা ট্যুরটাই মনে থেকে যাবে বহুকাল। যাওয়া-আসাতে হ্যাপাও কম।

বাগডোগরা নেমে গাড়িতে ঘণ্টা তিনেক কন্যম। কমবেশি হতে পারে। জায়গাটির খোঁজ দিয়েছিলেন রাজ বসু আর অজয় রায়। কয়েক দিনেই বশ করে ফেলেছিল কন্যম আরইলম তাদের মায়াবী সৌন্দর্যে! মেঘমাখা ঝিম ধরানো পথে হাঁটতে বেশ লাগে। হাঁটার সময় কখনওসখনও ধরা দেয় মেঘ হাতের মুঠোয়। হাতভর্তি মেঘ, খুললেই ফক্কা। আসলে মেঘেরা যে ধরা দেয় না, তা খেয়াল থাকেই না মেঘের ডানায় ভর করে হাঁটার সময়। প্রজাপতির মতো মেঘেরা  উড়ে বেড়ায় এখানে। মেঘ-আকাশে! শরীর ঝাঁপিয়ে ঠান্ডা নামে ক্রমশ। হিমশীতল স্পর্শ তখন শরীরে। লেপ্টে থাকা শীতের জামা তখন উষ্ণতা দিতে শুরু করেছে ক্রমশ।  আকাশ পানে তাকালেই তারা-নক্ষত্রেরা লণ্ঠন জ্বালিয়ে রাত পাহরায়। দূষণ নেই। তাই অনিন্দ্যসুন্দর এক আকাশ তারা মাথার ওপর! নেপালে ভারতীয় মোবাইল সিম চলবে না। তবে হোটেলে ওয়াইফাই আছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক করা যাবে। বাইরে থেকে ফোন আসবে।

কীভাবে যাবেন: শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে এনজেপি বা শিলিগুড়ি। এখান থেকে বাস পাওয়া যাবে কাঁকরভিটার। তারপর ওখান থেকে গাড়ি নিতে হবে। কিংবা দমদম বিমানবন্দর থেকে বাগডোগরা। সেখান থেকে কাঁকরভিটা। তারপর গাড়ি নিতে হবে।

সবচেয়ে ভাল যোগাযোগ করুন হেল্প টুরিজমের সঙ্গে। ফোন: 097330 00445/097330 00447.

কন্যম: হোটেল ইস্টন ব্লু, নগেন্দ্র, ফোন- 00977 985 1094645.

Archive

Most Popular