14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

তোমায় সাজাব যতনে, গয়না ও রতনে...

1st Aug 2024

বিনোদন

নিজস্ব প্রতিনিধি


ভোর, আকাশের রঙ ঘাস ফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল। চারদিকে পেয়ারা আর নোনার গাছ, টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা এখনও  আকাশে জেগে রয়েছে। পাড়া গাঁ-র বাসর ঘরের সবচেয়ে গোধূলি মদির মেয়েটির মতো।' কবি জীবনানন্দের এই অনুভব। আসলে বিয়ে মানেই লাজুক সন্ধ্যা, শুভ পরিণয়, বউভাত আর নানা আয়োজন। শুভ এই ক্ষণটিকে ঘিরেই নববধূর কত শত পরিকল্পনা! সবাই চায়, কনেকে আলাদা করে দেখাতে। পোশাক, গয়না, সাজ বাহারে বধূ যেন স্বতন্ত্র হয়। যেন চোখ ফেরানো না যায়! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তো সব কিছুরই বদল ঘটে। ইচ্ছেগুলোরও রঙ বদল হয়। পোশাকে বদল, রূপে বদল, গয়নায় বদল। আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে কনের গয়নার রুচিও। অলংকারের ট্রেন্ডে যোগ হয়েছে কত নিত্যনতুন ডিজাইনও। কনের গয়না তৈরি হচ্ছে, হীরে, সোনা, রুপা বা কয়েকরকম ম্যাটেরিয়ালের মিশেল ডিজাইনেও। শুধু তাই নয়, গয়নার মিল থাকছে পোশাকের সঙ্গে, যা হচ্ছে মেকআপের সঙ্গেও মানানসই এবং রুচিসম্মত। কনে সাজ একবারই আসে জীবনে। সেরা সময়টি তাই হয়ে থাকে ঐতিহ্য এবং স্টাইলের সঙ্গে। কনের সাজে দেখতে ভালো লাগে, নেকলেস, কানের দুল, আংটি, চুড়ি-বালা, নূপুর, টায়রা, টিকলি, নোলক। বাজারে বড় জুয়েলারিতে বিয়ের গয়না সেট হিসেবে পাওয়া যায়।আলাদা আলাদাভাবেও পাওয়া যায়। বিয়ের গয়নার সেটের মধ্যে রয়েছে সীতাহার, নথ, দুল, চুড়ি, তাজ, আংটি, বাজু এবং পায়েল।

গয়না চাই?

বিয়েতে খরচ তো হয়ই। কোথাও কোথাও সাধ আর সাধ্যের ব্যবধানও তো থাকেই। তাই সাধ্যের মধ্যে সেরাটিই কেনার চেষ্টা করতে হবে। ডায়মন্ডের আলোকোচ্ছটায় কনের সাজে থাকতে পারে দৃষ্টিসুখ। পুরো সেট না হোক দুই-একটা হীরার গয়না না থাকলেই নয়। সে ক্ষেত্রে গয়নার নির্দিষ্ট অংশে  ব্যবহারে সাজানো যেতে পারে পছন্দের ডিজাইন। বাকি অংশে আসতে পারে অপেক্ষাকৃত কম দামের অর্নামেন্টসের ব্যবহার। এখন গয়নায় মুক্তা, রুপা বা দামি পাথরের কাজ দেখা যায়। দেখা যায় পুঁতির কাজও। কোনও কোনও ডিজাইন করা হয় সোনার বর্ডার দিয়ে। থাকে গোল্ড প্লেটেড গয়নাও। রুপার গয়নাও এখন বেশ ট্রেন্ডি এবং স্টাইলিশ। এখন গয়নার ডিজাইন ও ট্রেন্ডি, স্টাইলিশ করে তোলার ক্ষেত্রে শুধু হীরে এবং সোনার ব্যবহারই সঙ্গে চলে আসে অন্য অন্য মেটিরিয়ালের ফেব্রিকের ডেকোরেশন। আজকাল অনেকের বিয়ের নেকলেসের গয়নাতেই দেখা যায় সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতার মিশেল। কানের দুল, টায়রার ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। এখন গয়নাগুলোয় করা হচ্ছে বড় আকারের নকশা। আংটি ও বালা খুব বেশি গর্জিয়াস না হলেও নূপুর এবং টিকলিতে থাকছে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক গয়নার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো রং। বিয়ের গয়নায় বর্তমানে সাবেকি সোনালি রঙের ছোঁয়াই থাকতে হবে এমনটাও নয়। রংবেরঙের পোশাকের সঙ্গে মিল রেখেও ব্যবহার করা যায় ব্রাইডাল অর্নামেন্টস। তবে দিন বুঝে বেছে নিতে হবে বিয়ের গয়না। গায়ে হলুদে একটু ফুলেল মোটিফ গয়না বেশ মানায়। আবার বিয়ের দিন অলংকার হতে হবে ঐতিহ্যবাহী, জমকালো এবং দারুণ স্টাইলিশ। বউভাত অনুষ্ঠানের গয়না হোক আরেকটু ছিমছাম এবং হালকা-পাতলা।

আজি যত গয়না তব বিয়েতে.....

ডায়মন্ডের অলংকার মানেই আভিজাত্য। যদিও তা কিছুটা বড়লোকি ব্যাপার। বাজারে বোম্বে কাট ও বেলজিয়াম কাট ডায়মন্ডের গয়নাও পাওয়া যায়। দামে সস্তা বলে বোম্বে কাটের চাহিদাই বেশি। সোনার ক্ষেত্রে কিছুটা ঊর্ধ্ব বা নিম্নগতি থাকলেও বিয়েতে সোনার গয়নার চাহিদা আজও বেশি। বাজারে ১৮ ক্যারেট, ২১ ক্যারেট, ২২ ক্যারেটের সোনা পাওয়া যায়। আছে সনাতনী সোনাও। চাইলে নেওয়াই যায় প্লাটিনামের গয়নাও। প্লাটিনামের গয়না বেশ সুন্দর ও সুক্ষ্ম হয়। মুক্তা বার বার ভোল পাল্টে আসে নতুন রূপ নিয়ে। মুক্তার গয়নায় কনের রুচিশীলতা আর আভিজাত্য ফুটে উঠবে। আধুনিক ফ্যাশনে হোয়াইট গোল্ড বেশ জনপ্রিয়। দিন দিন কিন্তু এর চাহিদা বাড়ছে।

ইতিহাস কী বলে...

অলংকার ব্যবহারের ইতিহাস প্রাচীন। আমরা যে নিদর্শনপাচ্ছি, সেই ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয়, ১১৫০০০ বছর আগে ইউরোপীয়রা হাড়, কাঠ সামুদ্রিক ঝিনুক, শামুক, পাথর ব্যবহার করে অলংকার তৈরী করেন। রাশিয়ায় মার্বেলের তৈরী আংটির প্রচলন হওয়ার কথা জানা যায়। মোসোপটমিয়, গ্রিক, মিশর, চীন ও ভারতে পাওয়া অলংকার নিদর্শনগুলোও অনেক প্রাচীন। হাল ফ্যাশনে গয়নার প্রতি মেয়েদের দুর্বলতা নিয়ে নতুন কিছু আর বলার নেই। আর তা যদি বিয়ের গয়না হয়, তাহলে তো তার পরিকল্পনা সেই ছোট্টবেলার থেকেই মনের কোণে ঘর করা শুরু করো

সুন্দর ছন্দময় ছোট শব্দ গয়না। তবে তার ইতিকথা যোট নয়। বিশাল। সেই কবে কখন কোন সময়টিতে নারী গয়নাকে সাজসজ্জার ভূষণ হিসেবে একান্তভাবে গ্রহণ করেছিল, তা সঠিকভাবে সময় নির্ধারণ সম্ভব নয়। তারপরও ধারণা করা যায়, সভ্যতার শুরু থেকে বিভিন্ন যুগের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারী গয়নাকে সাজের অঙ্গ এবং পুরুষেরা নিজের প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে নিজের অলংকরণ করতে গয়নাকে বেছে নিয়েছে। প্রাচীন সভ্যতায় চোখ ফেরালে দেখা যায়, গৃহচিত্র থেকে শুরু করে হাজার বছর ধরে নানা ধরনের শিল্পে গয়নার ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, সিন্ধু সভ্যতার কথা হচ্ছে। এসবের যে নমুনা আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যায়, সেই প্রাচীন যুগ থেকে পুরুষ ও নারী নানা ধরনের গয়নায় নিজেকে সজ্জিত করেছে। মিসরের মমির দেহে নানা অলংকার দেখা গেছে, এ ছাড়া মন্দিরের গায়ে যেসব চিত্র-ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে নানা ধরনের নকশাসংবলিত গয়না খুঁজে পাওয়া গেছে। এই গয়নাগুলোর নমুনা দেখে বোঝা যায়, সে সময়ে ফুল, পাতা, বীজ, মাটি, পশুপাখির হাড়, পাখির পালক ও বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার ছিল গয়নায়। তারপরও ধীরে ধীরে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গয়নাশিল্পের নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হয়। আনুমানিক হাজার তিন বছর আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার সময়ে সোনা ও রুপা দিয়ে গয়না তৈরি শুরু হয়। সেই সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে যেসব মূর্তি ও ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকার সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। বিশেষ করে ওডিশার কোনার্ক মন্দির, তমলুকের মন্দিরে যেসব দেবদেবীর মূর্তি দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকারের ব্যবহার লক্ষিত হয়। এই সব অলংকারের মধ্যে মাথার টিকলি, গলার সাতনরি হার, কোমরের চন্দ্রহার, হাতের বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, রতনচুড়, বিভিন্ন নকশার আংটি, পায়ের খাতু, চরণচক্র, কানবালা, কেউর (বাজুবন্ধ), বিছাহার, সীতাহার, কান ঝুমকা (কানঢাকা ঝুমকা), অলংকৃত চিরুনি, অলংকৃত চুলের কাঁটা, মাদুলি, মুকুট বেশি দেখা যায়।

পরবর্তী সময়ে মুসলিম যুগে যখন মোগলেরা ভারতে করে, তখন অলংকারশিল্পের পরিবর্তন ঘটে। পারস্য থেকে শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অলংকারের প্রচলন ঘটে। তখন সোনার অলংকারের সঙ্গে দামি রত্নের ব্যবহার শুরু হয়। মোগল রাজকন্যারা সোনার সঙ্গে মুক্তা, হীরা, পান্না, চুনি, নীলা ইত্যাদি রত্ন ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। বাদশাহ ও বেগমদের মুকুটে রত্নের ব্যবহার ছিল অত্যাবশ্যকীয়। মোগল যুগের গয়না বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

আঠারো শতকের পরবর্তী সময়টিকে গয়নার আধুনিক যুগ। এ সময় এই উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের সভ্যতার প্রসার লাভ করে। পাশ্চাত্য ঘরানার অলংকারশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দামি পাথর ও অল্প সোনার ব্যবহার। প্রধানত সেই সময় থেকে সোনার সঙ্গে রুপা, প্লাটিনাম, স্টিল বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং নকশার দিকেও বেশি নজর দেওয়া শুরু হয়। উনিশ শতক থেকে প্রিসিয়াস মেটালের পরিবর্তে কৃত্রিম উপাদান দিয়ে তৈরি গয়না, যা আমরা কস্টিউম জুয়েলারি হিসেবে এখন চিনি, তার প্রচলন হয়। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এ ধরনের গয়না খুবই জনপ্রিয়তা পায়।

গয়নার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত শুধু উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তর লোকজনই বিয়েতে সোনা-রুপাসহ দামি রত্ন ব্যবহার করে আসছে। তবে যার যেমন সাধ্য সে তেমন গয়নার আয়োজন করে। বিয়ের কনে সেজে ওঠেন নিত্য নতুনভাবে। আর আমরা যেন বলে উঠি, তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে...

Archive

Most Popular