14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

সাত পানসির বিল..

23rd Aug 2024

সাহিত্য

সায়ন্তন ঠাকুর


বৈঠকখানা রোডের পুরাতন মেসবাড়ি থেকে ব্যাগ গুছিয়ে অমল রাস্তায় পা দিয়েই বুঝল আজ দেরি হয়ে গেছে বেশ, জামার পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল, বেলা প্রায় সাড়ে চারটে, ওদিকে চারটে সাতান্নর শান্তিপুর লোকাল আদৌ পাবে কিনা সন্দেহ, টিকিট কাটার ঝামেলা রয়েছে তার উপর শনিবার এমনিতেই রেলগাড়ি ভিড়ে থইথই, সেই রানাঘাটের আগে বসার আসন পাওয়া তো দূরের কথা সামান্য পা রাখার জায়গাও থাকে না। পথও নেহাত কম নয়, শান্তিপুর জংশনে নেমে বাসে চরহরিপুর পৌঁছতেই পঁয়তাল্লিশ মিনিট, তারপর রাতবিরেতে সেখান থেকে মোটর বসানো ভ্যান রিকশা না-পেলে হাঁটা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই, ডিহিরদহ গ্রাম খুব কম করেও হাঁটাপথে মাইল দুয়েক হবে। কিচিরমিচির বাজার পার হয়ে দ্রুত পায়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছে অমল, দুপাশে চৈত্র মাসের ব্যাপারীরা নূতন জামাকাপড়ের পশরা সাজিয়ে বসেছে, সামনেই পয়লা বৈশাখ, সস্তার জিনিস সব, মধ্যবিত্ত মানুষ দরদাম করে কিনছে, একজন অল্পবয়সি বউকে তার যুবক বর একটি নীল রঙা হাতকাটা নাইটি দেখিয়ে বলছে, এইটা নাও! মেয়েটির মুখে অস্তগামী সলাজ আলো মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল, বরের দিকে গাঢ় চোখে একপলক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, 'থাক, তোমার ঘরে পরার লুঙ্গির যা-দশা, তারপর বাবুর জামাও নিতে হবে।'

ফুটপাতে দোকানের পাশে একখানি পুরাতন শিমুল গাছ মেয়েটির কথা শুনে বোধহয় আনমনে মুচকি হেসে একমুঠি চৈত্র কুসুম উপহার দিল তাকে, বাতাসের দোলায় ভাসতে ভাসতে কুসুমসখীর দল ওই অভাবী তরুণীর শাড়ির আঁচল স্পর্শ করে ধুলাপথের উপর পড়েই রইল, কেউই খেয়াল করল না তাদের! মানুষ ওরকমই, সময় কোথায় সংসারে যে ফুল খসে পড়া চেয়ে দেখবে!

তবে অমলের চোখ এড়াল না কিছুই, তার হাতের বড়ো চটের ব্যাগে স্ত্রীর নতুন কাপড় রয়েছে একখান, পিন্টুর জন্য জামা আর হাফপ্যান্ট নিয়েছে, মায়ের সাদা থানও আছে, গতকাল রাত্রে মেসে ফেরার পথে ভাঙা বাজার থেকে সস্তায় অনেক দরদাম করে কিনেছে, একটা প্লাস্টিকের বন্দুকও নিয়েছে, পিন্টুর ভারী পছন্দ হবে নিশ্চয়। ইচ্ছে ছিল একটা নকল সোনার হার কিনবে কিন্তু পয়সায় কুলনো না আর, জয়া মুখ ফুটে কখনও কিছুই চায় না, হার পেলে মনে মনে ঝলমল করে উঠতো নিশ্চয়। কিন্তু হল না, পাবেই-বা কোথায়, সামান্য এসি মেরামতির কাজ, যা উপার্জন তার সবটাই দেশে সংসারের জন্য পাঠিয়ে দিতে হয়, বাকি সামান্য টাকায় পিঁপড়ের ডিম চুষে খাওয়ার মতো মেসে পড়ে থাকে অমল, দু'বেলা জলের মতো ডাল, একটা ঘ্যাঁট তরকারি, হড়হড়ে ভাত আর স্কেল দিয়ে মাপা যায় এমন মাছের টুকরো দিয়ে পেট ভরিয়ে এই খর রৌদ্রে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘর ঠান্ডা করার যন্ত্র ঠিক করে বেড়ায়, সেসব মানুষদের ঘরদুয়ার ছবির মতো সাজানো, কেমন ফুলেল সুবাস চারপাশে, তারপর হা-ক্লান্ত শরীরে বিগতযৌবনা শহরে রাত্রি পথ বেয়ে মেসে ফেরা, রাত্রে উঠানের খোলা চৌবাচ্চা থেকে যখন বালতি বালতি জল ঢেলে স্নান করে অমল তখন তার মাথার উপর ফুটে ওঠে চৈত্র মাসের কালপুরুষ, আকাশ থেকে কালপুরুষের শিকারি কুকুর চেয়ে থাকে অপলক, মেসের তিনতলার ঘরে জানলার ঠিক পাশেই কদম গাছের পাতাগুলি ঝিরঝির শব্দে কী যেন বলে চলে, এই অপরূপ আয়োজন পানে চেয়ে অমল যেন একটু খুশিই হয়, মনে মনে নিজেকেই বলে, আনন্দ তো কম নাই বাবু, খুঁজে নিতে জানলেই হল! আজ প্রায় তিনমাস পর বাড়ি যাচ্ছে অমল, এই খরার দিনে ছুটি পাওয়া খুবই মুশকিল, এখন তো শহুরে মানুষের ঘরে ঘরে পাখার মতোই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র বসানো, দিনে আটটা-, দশটা বাড়িতে সার্ভিসিং-এর জন্য ছুটতে হয়, কোনও কোনওদিন ফিরতে রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা বেজে যায়, শনি-রবি বা ছুটিছাটার কোনও বালাই নাই সেখানে। কোনও মতে আগামী কাল আর এই আজ শনিবার আধবেলা ছুটি জোগাড় করেছে অমল, তাও বাড়ি পৌঁছতেই শনিবার শেষ হয়ে যাবে, সোমবার আলো ফোটার আগেই আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। মেসে তার ঘরের অন্য সঙ্গী কালীদাও নাই আজ, ছাপাখানার কর্মী, বয়স্ক মানুষ, সেই বনগাঁর দিকে বাড়ি, তিনিও অনেকদিন পর সকালেই দু'টি ডাল- ভাত মুখে দিয়েই বেরিয়ে গেছেন, শনিবার একা মেসের ওই ঘরে থাকতে ঠিক ভরসা পায় না অমল। বছর দুই-তিন আগে এমনই এক শনিবার, তখন অবশ্য আষাঢ় মাস, ঝুম নেশার মতো বৃষ্টি নেমেছিলসেদিন কলকাতায়, কালীদা বাড়ি গেছেন, একলাই ছিল অমল, মেসের অন্যান্য ঘরও প্রায় ফাঁকা, আজও সেই রাত্রির কথা মনে পড়লে গা ঝিমঝিম করে ওঠে।

এইসব সাত-পাঁচ পুরনো ভাবনার মাঝেই টিকিট কেটে প্রায় দৌড়ে একনম্বর প্ল্যাটফর্মে রেলগাড়ির কামরায় পা দিতেই বিষন্ন ও গম্ভীর স্বরে বাঁশি বাজিয়ে দুলে উঠল চারটে সাতান্নর আপ শান্তিপুর লোকাল। একমুহূর্তের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কামরার ভেতরে একবার তাকাল অমল, ভিড় অন্যান্য শনিবারের তুলনায় অনেকটাই কম, ফাঁকা সিট না-থাকলেও মোটামুটি দাঁড়ানোর জায়গা রয়েছে, খোলা দরজার পাশে এসে দাঁড়াল, রেলগাড়ির গতি এখন মন্থর, দূরে পশ্চিমাকাশ কমলা আর বিচিত্র এক প্রায়-গেরুয়া রঙে উজ্জ্বল, দেখে মনে হয় কোনও প্রাচীন সন্ন্যাসী আলোর দিকে মুখ করে হেঁটে চলেছেন, পেছনে থেকে বিবাগী বাতাসে পাখা মেলে উড়তে থাকা তাঁর গেরুয়া উত্তরীয়র স্পর্শ শুধু এই মায়াজগতের ধুলায় এখনও লেগে রয়েছে। সহসা একটি অচেনা কন্ঠে নিজের নাম শুনতে

পেয়ে মুখ ফেরাল অমল, দ্যাখে কয়েকটি সারির পর জানলার পাশে একটা আসন থেকে তাকেই ডাকছে একজন যুবক, দু'এক মুহূর্ত পরেই চেনা মুখের আদল স্পষ্ট হয়ে উঠল মনে, ব্যাগ হাতে নিয়ে লোকজনকে পাশ কাটিয়ে কাছে এসে অমল সামান্য হেসে বলল, 'আরে মানস যে, বহুদিন পর দেখা হল।'

--চিনতে পেরেছ তাহলে?

--তোকে চিনতে পারব না! মাঠে কত খেলেছি একসঙ্গে, তবে বহুদিন পর দেখা তো, তাই প্রথমে

ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি!

এক মুহূর্তের জন্য মানসের মুখে মৃদু জলভরা মেঘের ছায়া ফুটে উঠেই যেন মিলিয়ে গেল,

কৈশোরের স্মৃতি মানুষকে বড়ো আনমনা করে দেয়। মানস। মলিন হেসে বলল, 'কবেকার কথা বলো, বাইশ তেইশ বছর হবে, তাই না?'

--তা হবে, গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পড়ে আছি কি আজ থেকে রে! শেষ বোধহয় তোকে দেখেছিলাম ধর্মতলায়, তাও মনে হয় বছর দুয়েক হল।

পাশের লোকটির দিকে তাকিয়ে মানস অনুরোধের সুরে বলল, 'দাদা একটু চেপে বসুন না, তাহলে আরেকজন হয়ে যাবে।'

টাক মাথা মাঝবয়সি লোকটি বিরক্তিভরা গলায় বেজে উঠলেন, 'আর কোথায় চাপব দাদা, এবার তে কোলে উঠে বসতে হয়।' মানসের দিকে তাকিয়ে অমল তাড়াতাড়ি বলে উঠল, 'আরে তুই বস না, আমার দাঁড়াতে অসুবিদ হচ্ছে না কোনও।'

--হয়ে যাবে, দ্যাখো না, এখানেই হয়ে যাবে। ডিহিরদহ ইস্কুলে অমলের থেকে দু'ক্লাস নীচে পড়ত মানস, ব্যাক পজিশনে ফুটবল কথা কইত ওর পায়ে, তখন সেই অস্ফুট কৈশোরে স্বপ্ন ছিল একদিন মোহনবাগান খেলবে, তা ওই বয়সের স্বাস্ত্রে মায়াদেবীর অভিশাপ লেগে থাকে, সেসব কিছুই আর করা হয়ে ওঠে না, শেষবার যখন ধর্মতলায় দেখা হয়েছিল তখন ব্যাক পজিশনের দুরন্ত প্লেয়ার বলেছিল কী-একটা পাঁপড় নাকি বিস্কুটের কোম্পানি সেলসে কাজ করে, মফসসলে ঘুরে ঘুরে কাজ, এখন চোখের তলায় অল্প কালি, সামনের দিকের পাতলা হয়ে আসা চুলে সাদা ছোপ, শুধু হাসলে গহিন কালস্রোত থেকে অপরূপ মায়াকাজল দু'মেসে মেখে সেই কিশোর এখনও মুহূর্তের জন্য ভেসে টা পরক্ষণেই আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চাপাচাপি করে সিটে বসে অমল জিজ্ঞাসা করল, স রে তোর কাকা যতনবাবুর কী খবর রে?' অমলের কথা শুনে অবাক চোখে একবার চাইল মানস, দু'এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল 'কাকার কথা তোমার এখনও মনে আছে?' রেলগাড়ির কামরায় ঝালমুড়ি ফিরি করা লোকটিকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে অমল সামান্য হেসে বলল, 'অনেকদিন আগের কথা কিন্তু মনে আছে। বাবার কাছে মাঝে মাঝেই আসতেন।'

'পাড়ার মধ্যে তোমাদের বাড়ির রমেনজ্যাঠাই যা একটু ভালো করে কথা বলতো বাকিরা তো সারাদিন', মুখের কথা শেষ না করেই চুপ করে গেল

ঝালমুড়িওয়ালাকে বেশি করে লঙ্কা আর তেল দিয়ে দু'ঠোঙা মুড়ি মাখতে বলে আপনমনেই অমল বলল, 'তোরাও গাঁ ছেড়ে পাকাপাকি শান্তিপুর চলে গেলি, যতনকাকার সঙ্গেও আর দেখা হয়নি তারপর, আমিঃ তো কতদিন গাঁয়ের বাইরে, আজকাল কী জানি কেন মনে হয় সেই সময়টাই খুব আনন্দের ছিল।'

হাত বাড়িয়ে মুড়ির ঠোঙা নিয়ে একমুঠি মুড়ি মুখে পুরে খুবই শান্ত স্বরে মানস বলল, 'কাকা দু'বছর আগে এমনই চৈত মাসে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলঅমলদা।'

বিস্মিত স্বরে অমল শুধোলো, 'তারপর?'

--পরদিন বাবলার দিকে বড়ি পাওয়া গিয়েছিল। বড়ো রাস্তার ওপরেই পড়ে ছিল।

আগরপাড়া সোদপুর পার হয়ে হু হু ছুটে চলেছে রেলগাড়ি, চরাচরে কোন অদৃশ্য বাজনদারের ইশারায় ঝমঝম শব্দে বেজে উঠেছে চৈত্র অপরাহ্ণ, পীতবসনা আলোয় ভরে গেছে কামরা-যেন হলুদজলে স্নান করে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের দিকে রওনা দিয়েছে এই অলীক রেলগাড়ি, দূরে শহরতলির সীমানা মুছে কখনও ফুটে উঠছে ফসলি জমি হাওড় ক্ষুদ্র জনপদ খোড়ো চালের ঘর আবার পরমুহূর্তেই নির্জন মফসসলি গলির মাথা স্পর্শ করে ভেসে চলেছে অস্তগামী আলোর ভেলা, সেদিকে তাকিয়ে অমলের মনের গহিনতল থেকে উঠে আসছেন যতনবাবু, পাড়ার ছেলেরা খ্যাপানোর জন্য বলত, পাগলা যতন ল্যাঙটা, পাগলা যতন ল্যাঙটা! যতবার বলতো ততবার তেড়ে যেতেন যতনকাকা, শীর্ণ চেহারা, গালের হনুদুটি উঁচু হয়ে রয়েছে, কোটরাগত চোখ, পরনে একখানি মলিন ধুতি আর ফতুয়া, বয়স বেশি ছিল না, পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ হবে কিন্তু দেখে মনে হত কবেই যেন ষাট পার হয়ে গেছে, কাঁচপাকা একমাথা রুক্ষ চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, পাগলা যতন!

অমলের স্পষ্ট মনে পড়ছে, একবার দুপুরের দিকে বাবার কাছে এসেছেন, কাজকর্মের বিষয়ে নয়, এমনিই এসে বসতেন বাড়ির দাওয়ায়, আজ বুঝতে পারে অবিবাহিত ভাইদের সংসার দুয়ারে দু'টি ভাত- কাপড়ের আশায় পড়ে থাকা ভবঘুরে মানুষটির প্রতি বাবার এক ধরনের আলগা স্নেহই বোধহয় ছিল। তা সেদিন তেমন এসেছেন, বাবা সবে খাওয়া শেষ করে উঠেছেন, যতনকাকাকে দেখেই অন্যদিনের মতোই বলে উঠলেন, 'এই যে যতন, বোসো বোসো, দু'টি খেয়ে যাও!'

আষাঢ় মাস, পুবদিক আঁধার করে মেঘ উঠেছে তখন, বাড়ির উঠানে জামগাছের পাতায় সরসর শব্দে বাস্তুসাপের মতো হাওয়া বাতাস বুকে হেঁটে যেন চলে বেড়াচ্ছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যতনকাকা বলে উঠলেন, 'রমেনদা, এই য্যা ম্যাঘ দ্যাকচেন, এ আসলি ম্যাঘ নয়।'

এমনই উদ্ভট ছিল মানুষটির কথা বলার ধরন, অন্য লোকে বিরক্ত হলেও বাবা কোনওদিন বিরক্ত হতেন না, মা অনেকসময় আড়ালে বলতেন, আশকারা দিয়া মাতায় তুলচো তুমি। বাবাও বলতেন, 'রমা, দু'টি ভাতের লাগি বেলা দুপুর গড়িয়ে ওদের বাড়ির দাওয়ায় বসি থাকে, কতদিন সাইকেল নিয়ে ফেরার সময় দেকচি, কেউ খাতি ডাকে না, যতনও মুখ ফুটে কিছু বলে নাকো কাউকে, তা সেদিন দেকি চারটে বাজে, একবাটি শুকনা চিড়া গৰগৰ করি খাচ্ছে...ওরে কিছু বোলো নাকো তুমি!' কতই-বা বয়স ছিল তখন অমলের, দশ-বারো বছর

হবে, অবাক হয়ে ভাবল কত কথাই না মনের আঁধারে ডুবে থাকে, আজ কেমন দিঘির জলে

খেলে-বেড়ানো পুরাতন কালবোস মাছের মতো তারা মনতটে ঘাই মারছে।

সেই আষাঢ় দ্বিপ্রহরে যতনকাকার কথা শুনে বাবা হেসে শুধোলেন, 'কও কী যতন! ম্যাঘ নয় তো কী?' চোখ মটকে খুব গোপন কোনও কথা বলার মতো ভঙ্গি করে নিচু স্বরে যতনকাকা বললেন, 'উসব হল গে পরিদের প্যাখম! দাদা, পরিদের প্যাখম! উয়ারা জল হওয়ার আগি খ্যালতে নামি, ইসব ম্যাঘ নয়!' ডিহিরদহ গাঁয়ের প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারমশাই রমেনবাবু কচি ছেলেদের কথা শুনে যেমন মজা পান তেমন মুখ করে গলা নামিয়ে শুধোলেন, 'তা তুমি দ্যাকচো নাকি তাদের কোনওদিন?'

-দ্যাকচি না! কতোদিন দ্যাকচি! নাহলি কী

আপনারি এমনি বলচি দাদা!'

-তা কোথায় দেখলে?

-ক্যানো সাত পানসির বিলের ধারি, উকানেই তো উয়াদের আড্ডা।

বাবা এ-কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠতেই যতনকাকার চেহারা নিমেষে বদলে গেল, রাগে চোখ দু'টি লাল, তেজি গলায় বলে উঠলেন, 'কোন কতা বিশ্বাস করতি পারেন নাই আপনারা, সব এক, সব এক, পারবিন কী করি, সমসারে থাকি থাকি চোখ দু'কান তো পচি গেচে, পচা চোকে পইসা চেনা যায় সুদু, বুজলেন, সুদু পইসা চেনা যায়, পরি দেকার চোক না থাকলি কী করে আর দ্যাকবেন।' এর বহুবছর পর ওই একই কথা অমলকে একবার বলেছিলেন যতনবাবু... রেলপথের দু'পাশ আলো করে ফুটে আছে ঘেটু ফুল, কোনও এক অপরিচিতা বালিকা যেন সারাদিনের ধূলাখেলারশেষে মরা আলোর সুতো দিয়ে বোনা তার শাড়ির আঁচলখানি বিছিয়ে দিয়েছে এখন ভুবনডাঙায়, নূতন পীরিতের মতো ছুটে আসছে আসন্ন সন্ধ্যার বাতাস, রেলগাড়ির কামরায় ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে, পাশে মানস জানলায় মাথা ঠেকিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে- সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ অমলের সেই দিনটির কথা মনে পড়ে গেল, যতনকাকা বলেছিলেন এক আশ্চর্য আখ্যান, কে যেন গুনগুন শব্দে অন্ধ ভ্রমরের মতো কানের কাছে বলে উঠল একটি নাম, সাত পানসির বিল! সাত পানসির বিল।

সে আজ কুড়ি-বাইশ বছর আগের কথা, অমল সদ্য কলেজে ঢুকেছে কিন্তু পড়াশোনায় মতি তো তেমন ছিল না কোনওদিন, বাবা মারা গেছেন ক'মাস হয়েছে, কাজকর্মের ধান্দায় এদিক-ওদিকে ঘুরে বেড়ায়, তবে রোজগারের থেকে সেসময় পথের দিকেই টান ছিল বেশি, কত ভবঘুরে মানুষ সাধুসন্নিসির সঙ্গেই-না আলাপ হয়েছিল তবে সেসব পথের আলাপ ধূলাখেলায় হারিয়ে গেছে আজ বহুদিন। আজকাল ওই সময়টা অমলের কেমন যেন গতজন্ম বলে মনে হয়।

অনেকদিন পর গাঁয়ে ফিরে সেদিন বিকেলের দিকে হটিতে বেরিয়েছে অমল, হাটতলা রাজু জ্যোতিষীর একফালি টিনের চালের বাড়ি পার হয়ে আরও পশ্চিমদিকে, ওইদিকেই বড় বিল, ডিহিরদহ গাঁয়ের লোক বলে সাত-পানসির বিল। তা সেদিন বিশুকাকার চায়ের দোকানে বসেছে অমল, কাঠের আখায় গুড় দিয়ে ফোটানো চায়ের স্বাদ তেমন না হলে কী হবে, কত লোক আসে বিকেলের দিকে, গল্পগাছা হয়, যতনকাকাও ছিলেন ওইদিন, তাঁকে দেখে অমল শুধোলো, 'কাকা, চা খাবেন নাকি?' এই ক'বছরে আরও বুড়ো হয়েছেন যতন, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে এসেছে, শিরাওঠা হাত জীর্ণ পাতার মতো সবসময় তিরতির করে কাঁপে, পরনের ধুতিটি ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, তবে এতকিছুর পরেও মুখের হাসিটি অমলিন, একমুখ হেসে বললেন, 'রমেনদার ব্যাটা বাপের ধারা পাইচে, বুজলা বিশু, বাপের ধারা, দ্যাকলেই যতন আসো খাও বসো, ত্যামনপারা মনিস্যি কী আর সমসারে বেশিদিন থাকে, থাকে না, চলি যায় তারা।'

দোকানের বাইরে কাঠের বেঞ্চির উপর চা নিয়ে গল্প করতে করতে বলছিলেন, 'সাতটা পানসি, বোজলা কিনা, সাতটা, বৈকাল হলেই বিলে ভাসত। -সাতটা পানসি একসঙ্গে?

-একসঙ্গি। -অদ্ভুতা বিলে মাছ ধরতে যেত নাকি?

আজকালকার অমলের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে খানিকটা বিরদ্ধ হয়েই বৃদ্ধ বললেন, এই এক হইচে, ছোড়াদের নিয়ে জ্বালা। কিসুই জানে না।' অবাক হয়ে অমল শুধোল, 'কেন? কী হল?'

-কী হল। আবার শুদোও কী হল। বলি, পানসি নিয়ে কেউ মাচ ধরে? তাও আবার বৈকালে। -তবে?

সেদিনও আজকের মতোই অপরাহ্ণ ফুটে উঠেছে আকাশে, কার্তিক মাস, বিশ্বনাথের চা-দোকানের পাশে ছাতিম গাছটি ফুলে ফুলে যুবতীর ভালবাসার মতো হয়ে উঠেছে, হিম বাতাস দু'একটি ঝরা পাতার সুবাসে চঞ্চল, যতনকাকা সামান্য হেসে বললেন, 'সে অনেক কতা! বোজলা, অনেক কতা!'

-কী রকম?

-ইদিককার জমিদার, তারই সাতখান পানসি কথার মাঝেই অমল বলে ওঠে, 'জমিদার। এদিকে

আবার জমিদার ছিল নাকি?'

তাইলে আর বলচি কী!

-কিন্তু সে মানে জমিদারি উঠে যাওয়া তো আজকের কথা নয়, আর এসব অঞ্চলে

-কোন আবাগীর ব্যাটা বলচে আজকের কতা। তা ধরো না কেন দেড়শো বচর, হাঁ, দেড়শো বচর তো হবেই!

-দেড়শো?

বেশি তো কম নয়! -

-আচ্ছা, তাহলে সেই জমিদারেরই পানসি সব? মলিন ধুতি আর হাফহাতা ফতুয়া পরে যতনকাকা অমলের পাশে বসে রয়েছেন, শীর্ণ চেহারা, হাতের শিরাগুলি চৈত্রের নদীচরের মতো জেগে উঠেছে, তবে চোখদু'টি ভারী উজ্জ্বল, বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে শরীর বিষের সুবাসে মতো ঝিমঝিম করে, ঈষৎ অন্যমনস্ক হয়ে জড়ানো স্বরে টেনে টেনে বললেন, 'হাঁ! জমিদারের পানসি... বৈকাল হলেই, সব মোচ্চব, মোচ্চবে মাতবে... বাজারে মেয়েচেলের তো অভাব নাই...'

অবাক হয়ে অমল জিজ্ঞাসা করল, 'কাকা, আপনি এসব জানলেন কোথা থেকে?'ছোট গল্প

বিষাদঋতুর ভুবনে তখন মরা আলোর ঢল নেমেছে, মাথার উপর ভনভন করে উড়ছে মশার দল, দোকানে নতুন আঁচ দিয়েছে বিশুকাকা, ধোঁয়া মলিন আলো আর নূতন ছাতিম সুবাসে চারপাশ কেমন যেন অস্পষ্ট, বৃদ্ধ কোনও কথার উত্তর না-দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। কয়েক মুহূর্ত পর অমল একটু অধৈর্য গলায় জিজ্ঞাসা করল, 'কী হল? বললেন না তো!'

-সব কতা কি একদিনে হয় বাবা।

তারপর দু'এক মুহূর্ত পর ফের বলে উঠলেন, 'এসব কতা জানতে কত বচর যে লাগি গেল। হঃ! আর ইনি এইচেন, সব কতা একদিনে শুনবেন। শক কতা'

-মানে?

হঠাৎ কালীপুজোর রাতে হাতে তৈরি তুবড়ির মতো ভুস করে যেন জ্বলে উঠলেন বৃদ্ধ, চোখ দু'খানি ধকধক করছে, কয়েক মুহূর্ত পূর্বের স্নেহময় কণ্ঠস্বর হারিয়ে গেল নিমেষে, দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, 'ও খেকোর দল সব জুটচি, দ্যাকার চোক আচি তোদের যে দ্যাকবি, জানার মন আচি যে জানবি, গু দেকে দেকে সব অন্দ হইচিস, সব অন্দা সমসারের পুকারা যানবে সাত পানসির কতা! শক কম নয়!' কথাগুলি একনিশ্বাসে যাত্রার পার্ট করার মতো বলেই উঠে পড়লেন যতন! আস্তে আস্তে সন্ধ্যার দিকে হেঁটে চলে গেলেন, অমল অবাক হয়ে বসে রয়েছে, দু'একটি ছাতিম টুপটুপ করে খসে পড়ছে শরীরে, দোকান থেকে বেরিয়ে বিশ্বনাথকাকা অমলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'তুমিও য্যামনা পাগোল পাগোল, উর কাচে গেচ কতা বলতি। যতন পাগলার আবার কতা! আজ লতুন দ্যাকচো নাকি!'

ম্লান হেসে অমল বলল, 'যতনকাকা এসব গল্প কোথা থেকে যে পায়, কে জানে!' -তা এতক্কনে বুজতে পারলা না ? খ্যাপা খ্যাপা!

-তবুও, এমনিতে তো ভালোই থাকে সারাদিন। -ও দেকে আর কী বুজবা! ও নাকি দেকচে সব, সাত পানসির বিল সাত পানসির বিল করি হেদিয়ে মরল, সে আজ বিশ বচ্চর দ্যাকচি, এক কতা মুকে। আলবাল যত কতা! বাদ দাও তো!

'অমলদা, ও অমলদা এবার ওঠো!', মানসের গলার

স্বর শুনে মুহূর্তে বহুদিন অতিক্রম করে রেলগাড়ির কামরায় ফিরে এল অমল, চোখ খুলে জিজ্ঞাসা করল, 'চলে এসেছি নাকি?'

-কৃত্তিবাস হল্ট পার হয়ে গেছি। এমনিও পাড়ি আজ আধঘণ্টা লেট, এখনই সাড়ে সাতটা বেজে গেছে!

কামরার ভেতরে একবার চাইল অমল, মাত্র গুটিকয়েক লোক বসে আছে, বাকি সবাই ব্যাগপত্র নিয়ে গেটের কাছে জড়ো হয়েছে, সহসা গুমগুম শব্দে বাইরে মেঘ ডেকে উঠল যেন শূলপাণি চড়কের আগে ডম্বরু বাজিয়ে পথে নেমেছেন, বহুদূর থেকে ভেসে আসা ওই মেঘ অমলকে এক মুহূর্তের জন্য ফিরিয়ে নিয়ে গেল ডিহিরদহ গ্রামের চড়কতলায়, অজ পাড়াগাঁয়ে টলটলে কাকচক্ষু একটি দিঘি আর বাগদি পাড়ার পাশ দিয়ে ছিল বালক অমলের ঘরে ফেরার পথ। দালানের সামনেই অবারিত শস্যখেত, ওদিকে ধম্ম ঠাকুরের থান তার পেছনে ঝাঁকড়া আশশ্যাওড়ার গাছ, আষাঢ় মাসে দূর দিকচক্রবাল রেখা থেকে ছুটে আসতো বৃষ্টির অশ্বারোহী সৈন্য, এমন চৈত্র মাসে ডুডুম ডুডুম করে ডম্বরু বাজিয়ে পথে বেরিয়ে পড়তেন ভোলানাথ, পরনে বাঘছাল মাথায় একাদশী তিথির শশী, কণ্ঠে একটি বিষধর সর্প তাঁর অলংকার, ভিক্ষা চাইতেন হাসিমুখে। ধামায় করে আশুতোষকে কত দিন সিধে দিয়েছে অমল, প্রসন্ন মুখে হাত তুলে তিনিও যে কতবার ওই বালককে আশীর্বাদ করেছেন তার ইয়ত্তা নাই।

নিজের ব্যাগ বাঙ্ক থেকে নামিয়ে অমলের দিকে তাকিয়ে মানস বলল, 'যা ঘুম দিলে তুমি, সেই রানাঘাট থেকে আর সাড় নাই কোনও!'

ধরা পড়ে যাওয়া গলায় অমল একটু হেসে বলল, 'ডাকবি তো আগে!'

'ভাবলাম, খুব ক্লান্ত হয়ে রয়েছ নিশ্চয়, তাই আর ডাকিনি!', এক মুহূর্ত পর কী মনে হওয়ায় ফের বলল, 'যা মেঘ করেছে, আকাশ লাল একেবারে, আমি বলি কি, আজ রাত্রে আমার এখানে থেকে কাল

ভোর ভোর যেও, এমনিও এখন আর চরহরিপুর থেকে কিছুই পাবে না।'

-না রে, একটা দিনের জন্য আসা, পরশু তো আবার ফিরতে হবে। ওরা সব পথ চেয়ে বসে থাকবে।

-এই ঝড় বাদল মাথায় করে অতটা পথ আবার হাঁটবে? চরহরিপুর থেকে পথ তো কম নয়।

জানলা দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে অমল সামান্য হেসে বলল, 'আমরা গাঁয়ের ছেলে, হটিতে আবার ভয় কী রো বরং ঝড় হলে যাওয়ার পথে শীলদের আমবাগান থেকে কণ্টা কাঁচা আম কুড়িয়ে নিয়ে যাব।'

অমলের হাসির সঙ্গে গলা মিলিয়ে মানসও বলে উঠল, 'মনে আছে ছোটবেলায় আমরা শীলদের আমবাগানে যেতে কেমন ভয় পেতাম! কে যেন বলেছিল ওখানে নাকি নিশি থাকে।'

-সেসব দিন কি আর আছে রে, এখন নিশি হল গিয়ে টাকা রোজগার। টাকার কথা ওঠায় দু'জনেই কেমন চুপ করে গেল, গাড়ি ধীর গতিতে শান্তিপুর স্টেশনে ঢুকছে, দরজার কাছে এসে অমল বুঝতে পারল আকাশ সত্যিই ভারী হয়ে এসেছে, কুঁজোর জলের মতো এলোঝেলো বাতাস বইছে চারপাশে, দূরে গাছপালাগুলি মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কাকে যেন ডাকছে, এমন রাত্রে মনে হয় মায়াদেবী একখানি তালকোন্দা নিয়ে মেঘনদীর কিনারে বসে থাকেন, মৃদু দীপের আলোয় টলোমলো তাঁর নাও, বৃষ্টি আসার পূর্বমুহূর্তে তিনি নিজেই হয়তো একটি মাত্র ফুৎকারে জগতের সকল আলো নিভিয়ে সহস্র আঁধারমানিক খচিত তাঁর আঁচলখানি দিয়ে আচ্ছন্ন করবেন এই চরাচর। স্টেশনের বাইরে পা দিতেই দেখল একটা ছোট মোটর লাগানো ভ্যান রিকশা দাঁড়িয়ে রয়েছে, চরহরিপুর চরহরিপুর, একজন একজন মুখ বাড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে চালক, মানস অমলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'অমলদা, ওই দ্যাখো, শিগগির যাও, জল আসার আগে পৌঁছে যেতে পারলেই হল!' দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে যাওয়ার আগে অমল মুখ ফিরিয়ে বলল, 'ভালো থাকিস রে, দেখা হবে আবার।'

চরহরিপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমেই অমলের হঠাৎ মনে হল, মানসের ফোন নাম্বারটা তো নেওয়া হল না। মোবাইল বের দেখল রাত্রি পৌনে ন'টা, রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান, একখান চা-দোকানের উনান নিভিয়ে ঝাঁপ বন্ধ করছে দোকানি, কেমন মরা সাপের মতো হয়ে উঠেছে জগৎ, কিছুক্ষণ পূর্বের দামাল বাতাস কারওর অদৃশ্য ইশারায় যেন আত্মগোপন করেছে, সহসা পুব আকাশে যৌবনবতী নারীর কটাক্ষের মতো ঝলসে উঠল বিজুরি রেখা, কালভৈরবের ডম্বরুধ্বনি যেন শোনা গেল অন্তরীক্ষে, আর দেরি না-করে উত্তরগামী পথে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল অমল।

এই পথেই মাইলখানেক পরেই পড়বে সাত পানসির বিল, বিলের পাশ দিয়ে কিছুটা হাঁটলের বউডুবির চর তারপর তাদের গ্রামের মুখে গলায়। সড়ে বটতলাকে বাঁহাতে রেখে অল্পক্ষণ এগোলেই বাগদি পাড়া, সেখানে থেকে ভালোভাবে নজর করলে ভটচাষ পাড়ার শিবমন্দির চোখে পড়ে, ওখানেই অমলের দেশের বাড়ি, বউ, মা আর ছেলের সংসার যাদের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করে কলকাতার নোংরা মেসে আধপেটা খেয়ে পড়ে থাকে। সংসারের কথা চিন্তা করতেই অনেকদিন পর অকারণে মন তেতো হয়ে উঠল অমলের, কী লাভ এই কালক্ষয়ের, স্ত্রী-পুর পরিবার, মাঝে মাঝে কেমন যেন সব অর্থহীন মনে হয়, যদি এমন মেঘাচ্ছন্ন রাত্রে আজীবন হেঁটে যেতে পারত, কোথাও পৌঁছানোর তাড়া থাকত না, কারওর কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার বাসনাও থাকত না, পুনর্বার জন্ম নেওয়ার বাসনা নাই, ফলত ফিরে আসার কথা কত সহজে ভুলে যেতে পারতো, বেশ হত, অমলের সহসা মনে হল কী অপরূপ এই রাত্রি, যেন একখানি টলোমলো নৌকা, তাকে নিয়ে ভেসে চলেছে আর সেই অলীক নদীর দুই তীর ঘেঁটুফুলের জোসনায় অপরূপ ভালোবাসার মতো ঝলমলে হয়ে উঠেছে।

অলস পায়ে হাঁটছে অমল যেন এই জগতে কেউ কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করে নাই, ফিরে যাওয়ার পথটিও হয়তো মুছে গেছে চৈত্র মাসের ধুলাবাতাসে, মেঘ গম্ভীর আকাশ, বামহাতে পুরাতন কোনও আখ্যানের মতো জেগে রয়েছে সাত পানসির বিল, গহিন নিথর, কৃষ্ণবর্ণা যুবতীর মতো তার দেহখানি, দূরে দিকচক্রবাল রেখা আজ মেঘকাজল পরশে লীন হয়ে রয়েছে আকশের কাছে। জল থেকে ভেজা পায়ে খুব মিহি বাতাস উঠে আসছে অবিরল, মরুরাত্রির মতো সেজেছে আজ চরাচর, ধু ধু বিল, ওদিকটি কুয়াশার মতো অস্পষ্ট, কতদিন আগে দেখা যতনকাকার চোখদু'টি মনে পড়ছে আজ অমলের, সেই যে আষাঢ় দ্বিপ্রহরে ফুলো ফুলো মুড়ি, ঘন দুধ আর চাঁপাকলা মেখে বড়ো জামবাটিতে খেতে খেতে মা'কে বলেছিলেন, 'বড় ক্ষুধা পাইচিল বউমা, কেউ তো এত যত্ন করে খাতি দেয় না, বেঁচে থাকো মা, সুকে থাকো, সমসারে শুদু পইসা আর পইসা, ক'জন এমন মায়ের পারা খাতি দিতে পারে!'

হাঁটছে আর যতনকাকার মুখটি মনে পড়ছে অমলের, সহসা জনমানবশূন্য নিথর রাত্রির বুকেভুস করে কী যেন একটা শব্দ উঠল, চমকে তাকিয়ে দ্যাখে সাত পানসির বিলের জল কিশোরীর নূপুরের মতো কুমকুম করে কাঁপছে, প্রথমে অমলের মনে হল খুব বড় কোনও মাছ হয়তো কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারল বিলের মাছ কোনও তিমি নয় যে জলে ঢেউ উঠবে, মনে হচ্ছে বিলের গহিন তলদেশ থেকে কেউ বা কারা যেন মাথা তুলে উপরে উঠে আসতে চাইছে, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে চেয়ে রইল অমল বিলের দিকে, জলে তখনও তেমনই কাঁপন, ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি, শুনেছে খুব বড়ো কোনও ঝড় আসার আগে অনেক সময় নাকি এমন হয়, তবে কি... মনের কথা মনেই রয়ে গেল, অমলের চোখের সামনে মেঘাবৃত আকাশের নীচে অতল কৃষ্ণবর্ণ জলরাশি ভেদ করে প্রবল বিক্রমে উঠে এল সাত সাতটি পানসি, দীপালোকে সজ্জিত সাতটি তরণী শ্বেতহংসীর মতো পাখা মেলে মৃদুমন্দ বসন্ত পবনের গতিতে উত্তরপথগামী, ভেসে আসছে নারীকণ্ঠ, কোনওটি থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গওহারজানের সুর আবার কোনওটি বীণা মূর্ছনায় চঞ্চলা, বাতাস এখন কস্তুরী সুবাসে আমোদিত, কুন্দকুসুমহার পরে সাতজন লীলাবতীর মতো পানসিরা যেন পরস্পরের হাত ধরে সুদূর গন্ধর্বলোকের দিকে ভেসে চলেছে, দেখে মনে হয় তারা যেন সখীর দল, এখনই হয়তো বেজে উঠবে নিধুবনের আড়বাঁশি... কয়েক মুহূর্ত মাত্র, চোখের পলকে সাত পানসির দল পুনরায় ভুস করে ডুবে গেল বিলের জলে, হয়তো শুধু অমলের জন্যই এই শেষ চৈত্রে, দেখবাতাসের রাত্রে তারা ফিরে এসেছিল।

হতচকিত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল অমল, তারপর আকুল বাতাস শরীর স্পর্শ করতেই বুঝতে পারল ঝড় আসছে, দ্রুত পায়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল, তার মাথার ভেতর উথালিপাতালি ঢেউ তুলেছে বহুদিন আগে বলা একজন বৃদ্ধ মানুষের কথা, কথাগুলি অস্পষ্ট, কিছু শব্দ চুরি করেছে বাতাস, কিছু কথা আলগোছে তুলে নিল এই মরুরাত্রি, তবুও বুঝতে পারছে অমল কথাগুলি- শু খেকোর দল চোক থাকলি তো দ্যাকবি, সমসার আর পইসা তুদের চোক খায়ি ফেলচে!

গলায়-দড়ে বটতলায় এসে পৌঁছানো মাত্রই বড় বড় ফোঁটায় আকাশ থেকে নেমে এলো শান্তিজল, অনেকদিন পর মাটির আশ্চর্য সুবাসে ভরে উঠল ভুবনডাঙা, মাথার উপরে আকাশের দিকে একবার তাকিয়েই অমল বুঝতে পারল অশ্বারোহীর মতো ছুটে আসছে বৃষ্টির সহস্র কোটি সৈন্য, কলকাতায় লোকের বাড়ি বাড়ি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র সারিয়ে বেড়ানো অমল, হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত যুবক, এই প্রবল কালবৈশাখীর জল ও অশান্ত বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনমনে হেসে নিজেকেই যেন বলল, 'বাবু, দেখার চোখ থাকলে এই জগৎ এখনও কত অপরূপ'....

Archive

Most Popular