9th Aug 2024
সাহিত্য
শুভমানস ঘোষ
লোকটার মুখের কাটিং অবিকল আমার মতোই। কাটা কাটা মুখ-চোখ। ধারালো ঠোঁট। উন্নত কপাল। খাড়া নাক। হাইটটাও এক চুল এদিক-ওদিক নেই— পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। যে-ম্যাচো ফিগারের জন্য আমি লেডি কিলার বলে প্রসিদ্ধ, লোকটারও তাই। একেবারে আমার কপি পেস্ট।
কপি পেস্ট। কথাটা আমার নয়। ছেলের। সে সায়েন্স ফিকশনের গল্পে পড়েছে মানুষের চোখ-কান-হাত-পা, নাকের ফুটো সবই যখন দুটো দুটো তখন পৃথিবীতে এক জন মানুষের নিশ্চিত ভাবেই কপি পেস্ট কেউ আছে। থাকতেই হবে।
আমি সাগ্রহে লোকটাকে দেখতে লাগলাম। লোকটা বসন্তের মুরগির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে উল্লসিত-তৃপ্ত মুখে মুরগি-কাটা দেখছে। শুধু চেহারা নয়, লোকটার স্বভাবও দেখছি আমারই মতো। মুরগির মরণ-যন্ত্রণা স্বচক্ষে দেখা আমার প্রিয় বিনোদন।
নেশাও বটে। বাজার করতে গিয়ে কিনি বা না, বসন্তের দোকানে গিয়ে দাঁড়াই। মুন্ডুহীন মুরগির ছটফটানি দেখতে-দেখতে আনন্দে মন ভরে ওঠে। এক-একটা মুরগির আবার টেম্পার বেশি। সহজে ছটফটানি যায় না। তখন বসন্ত তাকে বঁটির পাটায় ফেলে আছড়াতে থাকে। দেখে রাগই হয়ে যায়। ভাবি কী বেরসিক ছেলে রে বাবা! মুরগিটা বেশ তো শো দিচ্ছিল। দিচ্ছে মজাটা মাটি করে! আর একটু কষ্ট দিয়ে মারলে কী মহাভারত অশুদ্ধ হত তোর!
কিন্তু অদ্ভুত মানুষের ভাবের গতি। আজ বরং লোকটার উল্লাস দেখে উলটোই ভাবলাম। এত সুন্দর চেহারার লোকের এ কী উৎকট রুচি! এ লোক ভগবানের নয়, শয়তানেরই সৃষ্টি। ওই বসন্ত ছোকরা তারই অনুচর। ব্যাটা মুরগিটাকে কী নৃশংস ভাবেই না বঁটির পাটায় আছড়াচ্ছে! পালক খসে-খসে পড়ছে। পালকের খাঁজের দুর্গন্ধময় ধুলো উড়ছে। অসহ্য! ভাবছি দিই কষে দাবড়ানি, হঠাৎ অবাক কাণ্ড।
‘মারছ কেন মুরগিটাকে? অ্যাই মারছ কেন?’ লোকটাই উলটে বসন্তকে ধমকাল, ‘আহ্ এত কষ্ট দিয়ে বেচারিকে মেরেও শান্তি হচ্ছে না! থামো!’
বসন্ত মুখ তুলে লোকটাকে দেখে থতমত খেল। ভাবল আমি। ‘ও সুজনদা!’ বলে মুরগিটাকে ছেড়ে দিল। টুঁটি ধরে ঝুলিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল। ছটফট করতে-করতে নেতিয়ে পড়লে তার পর তার ছাল ছাড়াবে। মাংস কাটবে। শ্রদ্ধায় আর লজ্জায় চোখই তুলছে না বেচারা। দেখতে-দেখতে বিরক্তির বদলে অদ্ভুত এক পবিত্র স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেল লোকটার মুখ। তার দিকে চেয়ে আমার মনে পড়ে গেল বিশ বছর আগের কথা।
তখন আমার বিয়ে হয়নি। কঠোর ভাবে নিরামিষাশী গুরু ঠাকুরের কাছে সবে দীক্ষা নিয়েছি। প্রাণীহত্যা দেখলেই গা রিরি করত। পশুদের উপর অত্যাচার সইতে পারতাম না। পশুক্লেশ নিবারণী সংঘের দলেও ভিড়েছিলাম। প্রকাশ্যে প্রাণীহত্যা বন্ধ হওয়া উচিত বলে লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করতাম। লোককে বোঝাতাম স্বভাবগত ভাবে নিরামিষাশী মানুষের পক্ষে মাংসাহার কতটা ক্ষতিকর।
কিন্তু মানুষেরই তো মন। বিয়ের পরে এই আমিই বউয়ের চাপে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাই। নিরামিষ ছেড়ে আমিষ খাওয়া ধরি। প্রথমে মাছ-ডিম দিয়ে জিভের আড় ভেঙে স্ট্রেট মাংসে চলে যাই।
এখন সব রকম মাংসই পরম তৃপ্তিতে চেটেপুটে খাই। সঙ্গে তরলও চলে। দু’বেলা গুরুমন্ত্র জপ করতাম। নিরামিষের সঙ্গে আস্তে আস্তে তা-ও ছেড়ে যায় আমায়। ঘরে গুরু ঠাকুরের ছবি একটা আছে বটে, অযত্নে ও অনাদরে তাতে ধুলো-পড়া মাকড়সার জাল। তবে কি এই লোকটা কুড়ি বছর আগের ভূত হয়ে-যাওয়া আমি? না কি ভূত-টুত নয়, এখনকারই আমি?
এখন যেমন আমি বদলাতে-বদলাতে পাক্কা ভদ্রবেশী শয়তান, মনে এক ভাবি বলি উলটো, করি তারও উলটো— এ-ও তাই? হয়তো আমার মতোই অভিনয় প্রতিভাও তার ট্যাঁকে।
হুঁ অভিনয় প্রতিভা। সুশ্রী শয়তানদের এটাই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এর জোরেই আমরা অনায়াসেই হ্যাঁ-কে না, না-কে হ্যাঁ করতে পারি। নারী শিকারে, বিশেষ করে কুমারী মেয়ে শিকারে এর বিকল্প নেই। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাদের অনাঘ্রাতা শরীরের সুগন্ধ পান করে দাগি করে ছেড়ে দিই। সমস্ত জীবন কবন্ধ মুরগির মতো অশান্তিতে ও অতৃপ্তিতে ছটফট করে তারা। আমি মোবাইলের অ্যালবামে তাদের খোলামেলা ছবি দেখে পরম তৃপ্তিতে জীবন কাটাই।
ভাবতে-ভাবতেই লোকটার চোখ গেল আমার দিকে। সাগ্রহে এগিয়ে এল। দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে আছি। বাজারের লোকজনও যেতে-যেতে থমকে যাচ্ছে। ‘যমজ’, ‘মানিকজোড়’, ‘জেরক্স কপি’ ইত্যাদি মন্তব্য পাস করছে।
‘আরে অবাক কাণ্ড! আপনাকে দেখতে দেখছি ঠিক আমার মতো!’ নীরবতা ভেঙে আমিই বললাম।
‘উহুঁ আপনাকে দেখতে আমার মতো,’ লোকটা শুধরে দিল, ‘চেহারায় যখন এত মিল, নামেও নিশ্চয়ই মিল হবে আমাদের। যদি ভুল না করি আপনিই তো কুজনকৃষ্ণ রায়?’
‘প্রায় কাছাকাছি গেছেন,’ এ বার আমার শুধরে দেওয়ার পালা, ‘আমার নাম সুজনকৃষ্ণ রায়।’
‘সুজন! বোঝো!’
হুঁ। বোঝার মতো ঘটনাই বটে। আমি সুজন, এ কুজন! তা হলে তো অবিকল কপি পেস্ট হল না। ভেজাল ঢুকে গেল। আমি আর এক দফা জরিপ করলাম কুজনকৃষ্ণকে। কুজনকৃষ্ণ আমার মতোই প্যান্টশার্ট পরে আছে। আমার মতনই তারও পায়ে চটি। এমনকী, জামার ফাঁকে আমার মতো তারও সোনার চেন উঁকি দিচ্ছে। সবই তো মিলছে। শুধু নামটাই যা এক চুল আলাদা। না কি, ইচ্ছে করে নামটা একটু বদলে আমাকে বাজাচ্ছে?
আমিই বা কম যাই কেন? আমিও তাকে বাজাতে চাইলাম। মুরগি-কাটার দৃশ্যটা কতটা উপভোগ্য হল জিজ্ঞেস করলাম। সাত সকালে এ রকম কাটাকাটি, রক্তারক্তির দৃশ্য দেখলে শরীরে ব্লাড সার্কুলেশন বেড়ে যায় মশাই!
‘আরে ছি! ছি! বলছেন কী আপনি!’ কুজনকৃষ্ণ আঁতকে উঠল, ‘একটা নিরীহ প্রাণীর মরণ-যন্ত্রণা দেখে আপনি আনন্দ পান? আপনি মানুষ না পিশাচ?’
আমি থতমত খেলাম। পর ক্ষণেই অভিনয় প্রতিভায় মাত করে ফিক করে হেসে বললাম, ‘হান্ড্রেড পারসেন্ট মানুষ। আপনার সঙ্গে রসিকতা করছিলাম।’
‘তাই বলুন,’ কুজনকৃষ্ণ হাঁপ ছাড়ল।
নামে গোলমাল। স্বভাবেও তো একটা গোলমাল বেরিয়ে গেল! লোকটা সত্যি সত্যিই আমারই অতীতের ভূত? না, আমার যেটা ইউএসপি সুন্দর অ্যাক্টিংয়ের খেল? নাহ্ পরীক্ষা করে দেখতে হচ্ছে দেখছি।
‘আপনার স্ত্রী বর্তমান তো?’ আমি সটান চলে গেলাম ঘরের কথায়।
‘নাহ্!’ কুজনকৃষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘বছর দুই হল মারা গেছে।’
‘ভেরি স্যাড।’ আমার মুখ ফসকাল, ‘সুইসাইড কেস না কি?’
কুজনকৃষ্ণ চমকাল, ‘কী করে জানলেন?’
‘না মানে– আমার স্ত্রীও তো সুইসাইড করেছিল।’
‘ও,’ কুজনকৃষ্ণ ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘নার্ভের প্রবলেম ছিল। রাতে ঘুমোত না। অনেক রকম ট্রিটমেন্ট করেছিলাম। সব ফেলিওর। শেষে সুইসাইড করে মুক্তি পায়। আমাকেও মুক্তি দিয়ে যায়। অতি উন্নত মনের মহিলা ছিল। বড্ড মিস করি তাকে জানেন?’
জানলাম। কিন্তু তাতেও আবার গরমিল। স্ত্রীকে ভালবাসার গল্প আমার জীবনে অন্তত ছিল না। আমার মোবাইলের হট পিকসের অ্যালবামটা দেখে ছেলেকে বলে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিল বলে তাকে মেরে পুলিশকে টাকা খাইয়ে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিয়েছি।
এই ঘটনায় আমার ছেলে বেজায় ধাক্কা খায়। এতটাই যে তার পর থেকে তার মাথায় কপি পেস্টের ভূত চেপেছে। সে চায় মায়ের কপি পেস্টকে খুঁজে বের করতে। কোন বজ্জাত লেখক যে তার মাথায় ঢুকিয়েছে, প্রায়ই বলে পাছে একটা নষ্ট হয়ে যায়, তাই প্রকৃতি মানুষ সমেত সব জিনিসেরই একটা ব্যাক আপ কপি রেখে দেয়। ছেলের পাগলামি দেখে আমার রাগ হয়, আবার কষ্টও হয়। যতই হোক ছেলে। বড্ড ভালবাসি। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারি না।
‘আপনার ছেলেও বোধ হয় একটিই?’ একটু চুপ করে থেকে কুজনকৃষ্ণকে শুধোলাম।
কুজনকৃষ্ণর ঠোঁটে হাসি ফুটল, ‘সম্ভবত আপনি আমার ফোটো কপি। সবই মিলে যাচ্ছে। এটাও মিলল। আমারও ওই একটিই সন্তান।’
আমি বললাম, ‘সামনের বার মাধ্যমিক দেবে। কী বলেন?’
‘রাইট! তবে পরীক্ষায় কী রেজাল্ট হবে বুঝতেই পারছি। একদম পড়াশোনা করে না মশাই। মা-কে হারিয়ে দিনরাত ‘মা! মা!’ করছে! সে না কি মা-কে আবার ফিরিয়ে আনবে।’
‘স্ট্রেঞ্জ!’ আমি নিখুঁত ভাবেই আকাশ থেকে পড়লাম, ‘সেটা আবার হয় না কি?’
‘বিজ্ঞানে আজকাল সবই সম্ভব, বুঝলেন? আপনি যদি আমার ফোটা কপি হয়ে আমার সামনেই হাজির হতে পারেন, এটাই বা সম্ভব নয় কেন?’ কুজনকৃষ্ণ বলে চলল, ‘কিন্তু মুশকিলটা কী জানেন? ছেলে আমাকে আজকাল আর সহ্যই করতে পারে না। তার বিশ্বাস মা সুইসাইড করেনি। আমিই তাকে মার্ডার করে সুইসাইড বলে চালিয়েছি।’
‘অ্যাঁ!’ এ বার আমার অ্যাক্টিংটা ন্যাচারালই হল।
‘চমকে উঠলেন যে?’
‘কই না!’ আমি বানিয়ে-বানিয়ে ম্যানেজ দিলাম, ‘আপনি আমাকে বলছেন ফোটো কপি, কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখছি আমার অমিলও আছে। আমার ছেলে কিন্তু আমাকে সন্দেহ করেনি। অবিশ্বাসও করেনি। অগাধ বিশ্বাস তার আমার ওপর।’
‘তার মা-কে মার্ডার করা সত্ত্বেও?’
‘না! না!’ আমি আঁতকালাম।
কুজনকৃষ্ণর মুখ-চোখের ভাব বদলাল। গলা চড়ল, ‘তা হলে আমার ছেলে আমাকে সন্দেহ করে কেন? জীবনে একটা পিঁপড়েকেও মারলাম না, আমাকেই সন্দেহ? হুঁ এ বার বুঝেছি।’
‘কীইই?’ আমার ভয় হচ্ছে। সত্যি সত্যিই ভয়।
‘আমার স্ত্রী সুইসাইড করেনি। মার্ডারই হয়েছিল। প্রকৃতির দুর্বোধ্য ভুলে আপনিই তাকে মার্ডার করেছেন। তার জন্যই আমার এত ভাল ছেলেটা রাতারাতি বদলে গেছে। আমায় ঘেন্না করতে শুরু করেছে।’
‘না! না!’
কুজনকৃষ্ণর চোখে আগুন ছুটল। খপ করে চেপে ধরল আমার হাত, ‘এক্ষুনি চলুন বাড়িতে। ফয়সালা করব।’
‘আবার ফয়সালাটয়সালা কেন রে বাবা!’ আমি কঁকিয়ে উঠলাম, ‘প্লিজ হাতটা ছাড়ুন! আমি আপনার স্ত্রীকে মার্ডার করিনি। মা কালীর দিব্যি!’
‘চোপ!’ বলে রাম ধমক দিয়ে কুজনকৃষ্ণ যা বলল শুনে হাড় হিম হয়ে গেল আমার। আমাকে তার বাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে সটান দাঁড় করিয়ে দেবে তার ছেলের সামনে। বলবে, তার মা-কে সে খুন করেনি। তার ফোটো কপি হিসাবে এই বদমাশ সুজনকৃষ্ণই খুন করে রেখে গেছিল। সে তার বাবা কুজনকৃষ্ণকে মিছিমিছিই ভুল বুঝছিল।
হুঁ সেটাই হল। কুজনকৃষ্ণর হাত ছাড়াতে পারলাম না। ধরা-পড়া খুনের আসামির মতো সে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলল আমায়। হাঁটতে-হাঁটতে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম প্রকৃতির কারসাজি। এ আমার কপি পেস্ট হলেও কুজন হয়েও সুজন। সদ্য দীক্ষিত আমারই বিশ বছর আগেকার পজিটিভ বিদ্যুৎ তরঙ্গ দিয়ে গড়া। আমি নামে সুজন হয়েও এখন নষ্ট হয়ে পাক্কা নেগেটিভ তরঙ্গের বাহক। রিয়েল দুর্জন।
পজিটিভের সঙ্গে নেগেটিভ পারে? না পেরেছে কখনও? আমি অসহায় ভাবে ছটফট করতে-করতে হেঁটে চললাম। বুঝলাম আমারই ভূতুড়ে কপির হাত থেকে আজ আমার নিস্তার নেই। মিনিট দশ হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল কুজনকৃষ্ণ। আমার বাড়ির মতোই মেন রোড ছেড়ে হেঁটে গলির শেষ প্রান্তে কুজনকৃষ্ণরও বাড়ি। এক ঝলক দেখেই নিশ্চিত ভাবেই নিজের বাড়িও চিনলাম।
কুজনকৃষ্ণ হুংকার দিল, ‘এই বাড়ি তো? এখানেই খুনটা করেছিলেন তো?’
‘আমি খুন করিনি!’ আর্তনাদ করলাম।
‘আবার মিথ্যে বলে! দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখছি,’ কুজনকৃষ্ণ গলা ছাড়ল, ‘টাবুল! টাবুল!’
‘আরে! আরে! কাকে ডাকছেন? টাবুল আমার ছেলে!’
‘আপনার ছেলে মানে? খবরদার! টাবুল আমার ছেলে!’ কুজনকৃষ্ণ গর্জে উঠল, ‘আপনি রাম বাজে লোক। টাবুল আপনার ছেলে হতেই পারে না।’
টাবুল আমার ছেলে নয়? চড়াক করে মাথাটা গরম হয়ে গেল। নার্ভাসনেস কেটে গেল। আমি খারাপ হতে পারি, চরম বাজে লোক হতে পারি, কিন্তু ছেলেই আমার প্রাণ। ছেলের অধিকার কিছুতেই ছাড়ব না। গোলমাল যেখানে যা বেরিয়েছে মানতে রাজি আছি, এটা মানব না।
‘একদম বাজে কথা বলবেন না!’ পালটা গলা চড়ালাম, ‘টাবুল আমার ছেলে! আপনি ভূত। ভূতকে কেউ ভালবাসে না। আপনাকেও আপনার ছেলে ভালবাসে না।’
‘আমি ভূত?’
‘আলবত ভূত। বিশ বছরের পুরনো একটা ডেড বডি। আমি তা নই। তাই সে ভালবাসে আমাকে। আপনাকে নয়। টাবুল আপনার ছেলে হতেই পারে না।’
কুজনকৃষ্ণ রুখে উঠল, ‘কেন ভালবাসে না সেটারই তো এসপার-ওসপার করতে আপনাকে ধরে এনেছি। আপনিই মেন কালপ্রিট। ছেলের ভুল ভাঙাতেই হবে আমাকে। তার পর দেখব কেমন ভালবাসে আপনাকে!’
রাগে অন্ধ হয়ে ভুলেই গেলাম কুজনকৃষ্ণ একটা ডেড বডি। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার ওপর। কুজনকৃষ্ণও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে-ও লড়ে গেল। কিল-চড়-ঘুসি কিছু বাদ গেল না। কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না, কেউ কাউকে ছাড়ছি না দেখে শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে আমরা স্থির করলাম, এ ভাবে হবে না। ব্যাপারটা বরং টাবুলের ওপরই ছাড়া যাক। তার মা-কে অ্যাকচুয়েলি কে মার্ডার করেছে ডিসাইড করে ছেলে যাকে বাবা বলে চাইবে সে-ই হবে বাবা। অন্যকে পথ দেখতে হবে।
হুঁ তাই হল। কিন্তু তার আগেই যে অন্য কিছু হবে কে জানত! আমরা জামা-প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে ডোর বেলটা বাজাতে যাব, ঘটে গেল ভয়ংকর কাণ্ড! বন্ধ ঘরের ভেতর দুম করে শব্দ হল। ‘আঁ! আঁ! আঁ!’ করে উঠল টাবুল।
আমি ‘কী হল টাবুল!’ বলে চেঁচিয়ে লাথি কষিয়ে দরজা ভেঙে পড়িমরি ছুটলাম বেড রুমে। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। দেখলাম টাবুল ফ্যানের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলছে। নীচে গড়াগড়ি যাচ্ছে টুলটা। পাশে পড়ে আছে আমার মোবাইল। তাতে ওপেন হয়ে আছে আমার গোপন ছবির নিষিদ্ধ অ্যালবাম। মায়ের পর তার ছেলে খুঁজে পেতেই বাবার প্রতি সব ভক্তি-বিশ্বাস আর ভালবাসা হারিয়ে মা-কা ব্যাটার মতো সে-ও ক্ষোভে-দুঃখে স্ট্রেট ঝুলে পড়েছে।
দেখে এমন ধাক্কা খেলাম, অবাক কাণ্ড, তাতেই মাথাটা ফটাস করে খুলে গেল আমার। বুঝলাম এমন দুর্জয় অভিমানের বশে যে এত বড় কাজ করার ধক রাখে তাকে আমার বিশ বছর আগেকার ভূত জন্ম দিলেও প্রকৃতির সেই দুর্বোধ্য খেলাতেই আসল বাবাকে ভাল না-বেসে সে ভালবেসেছে নকল বাবাকে। তা হলে আমার কী দায়!
কাজেই ভালবাসার বাবা কুজনকৃষ্ণ আর্তনাদ করে টাবুলকে বাঁচাতে ছুটছে দেখে হাঁপ ছেড়ে বললাম, ‘দাঁড়ান! দাঁড়ান! দেখতে দিন! আরে দেখতে দিন না মড়াভূত!’
কুজনকৃষ্ণ থমকে দাঁড়াল। আমি তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দম বন্ধ করে চেয়ে রইলাম টাবুলের ঝুলন্ত দেহের দিকে। দেখতে-দেখতে উল্লাসে প্রাণ নেচে উঠল। কী ফার্স্ট ক্লাস ছটফট করছে! মুরগির মরণ-যন্ত্রণার অবিকল হিউম্যান কপি পেস্ট! আমার সবচেয়ে ফেভারিট প্লেজার!
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ওয়াও! লাভলি!’