14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

নাটক, সিনেমা, সিরিয়ালে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ...

29th Aug 2024

বিনোদন

কমলেন্দু সরকার


স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ 'ঠিক যেমন সূর্যোদয়ের সূর্য' প্রবন্ধে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব সম্পর্কে লিখছেন, 'এক আশ্চর্য পুরুষ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ! তাঁর প্রতিষ্ঠা সত্যে, স্থিতি অনন্ত করুণায়। তিনি বিত্তবান ছিলেন না, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বা দার্শনিকও ছিলেন না; সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিচারে তাঁর কোনও পরিচয় ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণ আনন্দময় পুরুষ, আনন্দই তাঁর স্বরূপ। তাঁর উপস্থিতিতে বসে 'আনন্দের হাট'। সে হাটে বিনামূল্যে মেলে অমূল্য প্রেম ও করুণা; যার স্বাদ নিতে অগণিত মানুষের সমাগম হয় তাঁর কাছে। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ মার্চ, ২০২১)। লাইনগুলো চমৎকার। বাঙালির মনের মানুষ, কাছের মানুষ, পরম মানুষ রামকৃষ্ণ দেব। শুধু বাঙালি বলি কেন, সমগ্র দেশ তো বটেই, বহু বিদেশির কাছেও ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব হয়ে উঠেছেন এক পরম পুরুষ। বিশেষ করে, বাঙালি তাঁদের নিজের ঘরের প্রিয়জনই মনে করেন, ভক্তি করেন তাঁকে। তাই তো বাঙালি বিনোদনের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছেন তাঁদের মনের মানুষ পরম পুরুষকে। বারবার মঞ্চ, সিনেমা, সিরিয়ালের বিষয় হয়েছেন বাঙালির মনের ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব। ইদানীং, একটি চ্যানেলে "করুণাময়ী রানী রাসমণি" চলে আসছে সাড়ে চার বছর ধরে। রানি রাসমণির প্রয়াণের পরও দেখা যাচ্ছে বা চলছে সিরিয়ালটি সমান গতিতে! তারও প্রায় মাস পাঁচেক কাটলো। এখন বিষয় হয়ে উঠেছে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব। যিনি রানি রাসমণির ছোট ঠাকুর বা ছোট ভট্টাচার্য। তাই জানবাজারের পুরো মার পরিবারের কাছে তিনি ছোট ঠাকুর। দর্শক প্রায় ভুলেই গেছেন ধারাবাহিকটি রানি রাসমণির জীবনকেন্দ্রিক। বাঙালির কাছে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব এতটাই কাছের, মনের পরম পুরুষ। রামকৃষ্ণ দেবকে নিয়ে বিনোদনের শুরু সম্ভবত বিশ শতকের চল্লিশের দশকে। কালিকা থিয়েটারে। ১৯ নভেম্বর, ১৯৪৮। এই প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হল 'যুগদেবতা'। পরিচালক বিধায়ক ভট্টাচার্য, নাট্যকার তারক মুখোপাধ্যায়। রামকৃষ্ণ- এর ভূমিকায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। রানি রাসমণি- চন্দ্রাবতী দেবী। টানা শত রজনীরও বেশি চলেছিল নাটকটি। নাটকের জনপ্রিয়তা দেখে পরবর্তী সময়ে ছবিও করেছিলেন পরিচালক। অভিনেতা- অভিনেত্রীদের সবাই ছিলেন মঞ্চেরই। সেকথায় পরে আসব। বাঙালি দর্শক গুরদাসকেই রামকৃষ্ণ দেব ঠাওরালেন! গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বাঙালির কাছে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব! তাই মঞ্চের রামকৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন গুরুদাস। মিনার্ভা থিয়েটারে 'ঠাকুর রামকৃষ্ণ' (১৯৫৫), রঙ্গনায় পরিচালক জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের 'নটনটী' (১৯৭৫) ইত্যাদি নাটকে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল সেই গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। চল্লিশের দশক থেকে সত্তরের দশক টানা তিন দশক ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব-এর ভূমিকায় ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। রামকৃষ্ণ দেব নিজেও থিয়েটার দেখতে ভালবাসতেন। তিনি বলেছিলেন, থিয়েটারে লোকশিক্ষা হয়। স্টার প্রেক্ষাগৃহে দেখতে এসেছিলেন গিরিশ ঘোষের 'চৈতন্যলীলা'। তাঁকে মুগ্ধ করেছিল নিমাই-এর ভূমিকায় নটী বিনোদিনীর অভিনয়। নাটক-শেষে তিনি বিনোদিনীকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, 'মা তোর চৈতন্য হোক'। মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, 'বল মা, হরি গুরু, গুরু হরি।' রামকৃষ্ণ-আশীর্বাদধন্য নটী বিনোদিনী হয়েছিলেন শুধুই বিনোদিনী। থিয়েটার থেকে সিনেমায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচিতি পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ হিসেবেই। যদিও তিনি বহুরকম কালীপ্রসাদ ছবিতে গুরুদাস ছবি 'রানি রামকৃষ্ণের তবে প্রথম 'যুগদেবতা' ১৫ দিন প্রদেশপাল কাটজু। ' ২৯ রামকৃষ্ণর দেওয়া। নাটকটি ছবিটি নাকি পত্রপত্রিকা পরিচালক ভট্টাচার্যর (১৯৫৬) (১৯৬৪)-এ দেখা গেছিল গুরুদাস তবে বাংলা সমালোচক প্রশংসা পেলেও সেভাবে নজর কাড়তে চরিত্র করেছিলেন সিনেমায়। পরিচালক ঘোষের 'বিদ্যাসাগর' (১৯৫০) রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করলেন বন্দ্যোপাধ্যায়। একই পরিচালকের রাসমণি' (১৯৫৫) ছবিতে ভূমিকায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ই। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে সিনেমায় রামকৃষ্ণের ভূমিকায় দেখা যায় ছবিতে। মুক্তি পেয়েছিল সেপ্টেম্বর, ১৯৫০। ছবি রিলিজের উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মাননীয় (রাজ্যপাল) ডাঃ কৈলাসনাথ বিদ্যাসাগর' মুক্তি পেয়েছিল সেপ্টেম্বর, ১৯৫০। 'যুগদেবতা' ছিল জন্ম থেকে বিবেকানন্দকে দীক্ষা এর মধ্যে আসে নানান ঘটনা। যেভাবে খুশি করেছিল দর্শকদের, তা পারেনি। সেইসময়কার ঘেঁটে এটুকু জানা যায়। মধু বসুও হাঁটলেন বিধায়ক পথে। তাঁর 'মহাকবি গিরিশচন্দ্র' এবং 'বীরেশ্বর বিবেকানন্দ' ছবিতেও রামকৃষ্ণের ভূমিকায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচালক গুরু বাগচি করলেন 'যত মত তত পথ' (১৯৭৯)। রামকৃষ্ণদেব ওই একজনই, বন্দ্যোপাধ্যায়। সিনেমায় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে রামকৃষ্ণ দেব-এর ভূমিকায় দেখা গেছিল মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে। পরিচালক অমর মল্লিক-এর 'স্বামিজী' ছবিতে। এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৭ জুন, ১৯৪৯। রামকৃষ্ণর ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শক, সকলকেই। গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মঞ্চ এবং সিনেমা দুই মাধ্যমেই দাপুটে অভিনেতা ছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব-এর ভূমিকায় অভিনয় করে নজরে এসেছিলেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁকে আর দেখা যায়নি ওই ভূমিকায়। কারণ, 'পথের পাঁচালী'র আড়ালে চলে গেছিল 'ভগবান শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ' ছবিতে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়-এর অভিনয়। এ-ছবিতে তিনি একেবারে ভিন্নভাবে রামকৃষ্ণ দেবকে এনেছিলেন অভিনয়ে। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ে রামকৃষ্ণ দেব প্রকাশিত হয়েছিলেন একজন সহজ-সরল, বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে। রামকৃষ্ণের ভূমিকায় তাঁর অসাধারণ অভিনয় পারেনি কী দর্শকের, কী সিনেমার লোকজনের। রামকৃষ্ণদেবকে আড়াল করে দিয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী'র হরিহর। এ-নিয়ে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপশোস কম ছিল না। তিনি বলেছিলেন, "জানো ভাই, এই চরিত্র হাতে পেয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেছিলাম। পড়তে পড়তে রামকৃষ্ণদেবের ইনটেলেক্টটাকে ধরবার চেষ্টা করেছিলাম। যত পড়ছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার নিজের মধ্যেই নানা ভাঙচুর শুরু হয়ে গিয়েছিল। কী বলব বলো, আমারই দুর্ভাগ্য। ছবিটা ভাল করে কেউ দেখলই না। (কানুদা, সাতরঙ , রবি বসু)।

আসলে কানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগেই গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালির মনে গেঁথে দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ দেবের আচারব্যবহার সম্পর্কে একটি ধারণা। সেই ধারণা থেকে বেরোতে পারেননি বাংলা ছবির দর্শকেরা। রামকৃষ্ণ-এর ভূমিকায় তাঁর মেলোড্রামা ভাল লেগেছিল দর্শকদের। তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন তাঁদের মনের ঠাকুর, প্রাণের ঠাকুর পরম পুরুষের এমনটাই ছিলেন। দর্শককুল মনে করতেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ই হলেন তাঁদের রামকৃষ্ণ দেব। অথচ দর্শক এবং অভিনেতা কেউই চাক্ষুষ করেননি রামকৃষ্ণ দেবকে। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় রেখে পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী যে-সাহস দেখিয়েছিলেন তেমনই পেয়েছিলাম পরিচালক সুজিত গুহর 'ক্ষ্যাপা ঠাকুর' ছবিতে। ছবিটি ছিল বামাখ্যাপার ওপর। তবে ছবিতে রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকাও ছিল। এই ভূমিকায় ছিলেন কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। তিনিও ভিন্নরকম অভিনয় করেছিলেন। একেবারেই গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভাবিত ছিল না। চমৎকার করেছিলেন রামকৃষ্ণের ভূমিকাটি। অথচ গুরুদাস পরবর্তী সময়ে যাঁরাই রামকৃষ্ণ-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রভাবিত ছিলেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের রামকৃষ্ণ অভিনয়ে।

আর এক রামকৃষ্ণ দেখা গেছিল 'শ্রীরামকৃষ্ণ'-এ। তবে এটি ছবি নয়, সিরিয়াল। পরিচালক অনিন্দ্য সরকার ডিডি বাংলায় করেছিলেন 'শ্রীরামকৃষ্ণ'। সময়টা ১৯৯৭। নব্বই দশকের শেষদিকে ছোটপর্দার বাঙালি দর্শকেরা ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন মেগা সিরিয়াল বা ডেলি সোপ দেখতে। তার কারণ, পরিচালক বিষ্ণু পালচৌধুরীর 'জননী'। ১৯৯৫-এ দেখানো হত ডিডি বাংলায়। 'জননী' অভ্যাস হয়ে উঠেছিল বাঙালি দর্শকদের। তেমনই হয়েছিল অনিন্দ্য সরকারের 'শ্রীরামকৃষ্ণ'ও। ১৯৯৭ থেকে ২০০০, টানা তিনবছর চলেছিল। এরপর বাধ্য হয়েছিলেন সিরিয়ালটি বন্ধ করে দিতে। 'শ্রীরামকৃষ্ণ' সিরিয়ালটি জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে অনেক কারন। সে সম্পর্কে পরিচালক অনিন্দ্য সরকার বললেন, "আমরা চিত্রনাট্য পাঠাতাম রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশন থেকে অনুমতি পেলে তবেই শুটিং হত। আমাদের অনেক Originality ছিল। আমরা ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের জন্ম থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত আসতে পেরেছিলাম। এমনকী বিবেকানন্দ আনতে পারিনি। কথামৃত-এ প্রবেশ তো ছিল দূর অস্ত।" এই রামকৃষ্ণ-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অরিজিৎ সেনগুপ্ত। খুব স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন অরিজিৎ। এরপর করেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়। এই ধারাহিকটি শেষ হওয়ার ঠিক দশ বছর পর কোনও এক বেসরকারি চ্যানেলে 'প্রেমের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ'ও চলেছিল টানা তিন বছর। শেষ হয় মোট ৮৫০টি পর্বে। বছর চার-পাঁচ আগে এক বেসরকারি চ্যানেলে মা সারদার জীবন ভিত্তি করে একটি সিরিয়াল হয় 'জগৎ জননী মা সারদা'। কিন্তু এই ধারাবাহিকে প্রধান হয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ দেব। তার অন্যতম কারণ নবাগত সুমন কুণ্ডুর রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয়। তিনি কোনও পূর্বসূরির অভিনয়ে মোটেও প্রভাবিত ছিলেন না। তিনি নিজের মতো রামকৃষ্ণ দেবকে বুঝে খুব স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন। সেই চ্যানেলটি পাল্লা দিয়ে লড়াই করেছিল অন্যান্য অতীব জনপ্রিয় চ্যানেলগুলোর সঙ্গে। বাঙালির বসার ঘরে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে প্রবেশ করিয়েছিলেন অনিন্দ্য সরকার সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। তার মস্ত বড় উদাহরণ 'করুণাময়ী রানি রাসমণি'। টানা সাড়ে বছর ধরে চলছে। রানি রাসমণির মৃত্যুর পর হাল ধরেছেন রামকৃষ্ণ দেব। সেও হয়ে গেল মাস চারেক। তবে 'করুণাময়ী রানি রাসমণি' সিরিয়ালের রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তাঁর পূর্বসূরির অভিনয়ের কিছুটা ছোঁয়া থাকলেও আছে। তবে তা নিজের মতো করে নিয়েছেনঅভিনেতা। যাইহোক না কেন, রামকৃষ্ণের সৌরভ সাহাকে নিয়েছেন ছোটপর্দার বাঙালি দর্শক। তবে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় সৌরভের এটি প্রথম অভিনয় নয়, আগেও করেছেন। বেশ কয়েকবছর আগে সারদা মঠের তত্ত্বাবধানে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব-এর ওপর একটি ডকুমেন্টারি করেছিলেন পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী। এই ছবিতে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন সৌরভসাহা। পরিচালক হরনাথ জানান, "ছবিতে সৌরভ বেশ ভাল কাজ করেছিল। আমি যা চাইছিলাম সেটাই করেছিল সৌরভ।" রামকৃষ্ণ-এর ভূমিকায় অভিনয় করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। ছবির নাম 'বিবেকানন্দ'। পরিচালক জি ভি আয়ার। পরিচালক যখন মিঠুন চক্রবর্তীর কাছে রামকৃষ্ণ দেবের ভুমিকায় আভনয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান তখন তাঁর মনে হয়েছিল, "ভদ্রলোকের কথা শুনে আমার তখন ভয়ংকর হাসি পেয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, এই লোকটা বোধহয় দেশের একনম্বর পাগল অথবা মাতাল ব্যক্তি। পাগলামির জন্য ওঁকে জাতীয় পুরস্কার দেওয়া উচিত।" (বর্তমান, ৩ এপ্রিল, ১৯৯৪)। রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকায় অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কারটি কিন্তু পেয়েছিলেন মিঠুন চক্রবর্তীই, পরিচালক নন। অ্যাকশন এবং রোম্যান্টিক-ডান্সিং হিরো ভাবমূর্তির পাশাপাশি রামকৃষ্ণের ভূমিকায় চরম সাফল্য পেলেন তিনি। তাঁর অভিনয় কুশলতা দর্শকে ভাবতেই দেয়নি তিনি ডিস্কো ডান্সার মিঠুন চক্রবর্তী!

টালিগঞ্জে একসময় রামকৃষ্ণ, ব্যামাখ্যাপা, শ্রীচৈতন্যদেব, সাধক কমলাকান্ত, লোকনাথ বাবাদের নিয়ে বহু ছবি হয়েছে। বলিউডেও এমন ছবি হতে দেখা গেছে। ইদানীং কালে এ-ধরনের ছবি আর হয়ই না টালিগঞ্জে। বর্তমানে বাংলা ছবির বিষয় এবং দর্শক দুইয়েরই বদল ঘটেছে। জায়গাটা নিচ্ছে সিরিয়াল। তাই ছোটপর্দায় দেখা যাচ্ছে শ্রীচৈতন্যদেব, রামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা, লোকনাথবাবার উপস্থিতি। ইদানীং কালের মধ্যে ২০১৩ অর্থাৎ আট বছর আগে 'দ্য লাইট: স্বামী বিবেকানন্দ ছবিটি দেখা গেছে। স্বামী বিবেকানন্দ-এর ১৫০ বছর উপলক্ষে হিন্দি এবং বাংলা ভাষায় ছবিটি করেন উৎপল সিনহা। যাঁর পরিচিতি টুটু সিনহা হিসেবেই। পরবর্তী সময়ে ১৮ ভাষায় ডাব করা হয়। এই ছবিতে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন প্রেমাঙ্কুর চক্রবর্তী। এঁর অভিনয়ের মধ্যেও পূর্বসূরিদের প্রভাব লক্ষ করা গেছিল। তবে, এ-ছবির রামকৃষ্ণ তুলনামূলকভাবে মোটা। সেটা খুব ভাল লাগেনি ছবিতে। রামকৃষ্ণ দেবের যেসব ছবি আমরা দেখি বা দেখেছি সেগুলোতে কখনওই তাঁকে অত মোটা লাগে না। এ-ত্রুটি অবশ্য পরিচালকের। অথচ জি ভি আয়ার-এর 'বিবেকানন্দ' ছবিতে রামকৃষ্ণর ভূমিকায় কত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন পরিচালক। মেক-আপ এত সুন্দর রামকৃষ্ণ-উপযুক্ত হয়েছিল যে, আলাদা করে কেউই মিঠুন চক্রবর্তী হিসেবে চিহ্নিত করেননি। মিঠুনের অভিনয় ছিল ভীষণই পরিশীলিত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার পূর্ববর্তী কোনও অভিনেতার অভিনয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ ছিল না। মিঠুন নিজের মতো রামকৃষ্ণ বুঝে করেছিলেন তাঁর অভিনয়।

সম্ভবত ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব-এর ভূমিকায় সেরা অভিনয় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য-এর। যাঁর পরিচিতি 'মহর্ষি' হিসেবে। পরিচালক অমর মল্লিকের 'স্বামীজীর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। ছবির আগের নাম ছিল 'বিবেকানন্দ'। বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উঠলে ছবির নামকরণ হয় 'স্বামীজী'। তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এই ছবিটি প্রভৃত প্রশংসিত হয়। সঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয়েরও। সেইসময়কার সাপ্তাহিক 'দেশ', ৭ জুলাই, ১৯৪৯, সংখ্যায় সমালোচক লিখছেন, '... স্বামীজীতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে মানুষ বিবেকানন্দকে, তাঁর মনের দিকটাকে। বাল্যের যে ঘটনা এতে দেওয়া হয়েছে তাতে আমরা পাই বিবেকানন্দের আদি মানসিক বৃত্তির পরিচয়। যৌবনে আমরা যাঁকে পেয়েছি সেটা হলো বিবেকানন্দের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। তারপর শেষ বয়সের যাঁকে পাই তিনি হলেন, মানুষের দুঃখ-বেদনায় উদ্বেলিত-অন্তর বিবেকানন্দকে। ছবিতে বিবেকানন্দ জীবনের এই তিনটি ধাপকে মূর্ত করে তোলা হয়েছে। প্রথম থেকে দ্বিতীয় ধাপের শেষ পর্যন্ত, অর্থাৎ বাল্যে মহাপুরুষের পূর্বাভাস থেকে যৌবনে পরমহংসের সঙ্গে সাক্ষাৎ। পরমহংসের কাছে দীক্ষাগ্রহণ এবং পরমহংসের তিরোভাব পর্যন্ত 'স্বামীজী' এমন একটা প্রভাবে দর্শককে একেবারে অভিভূত করে রেখে দেয় যাকে অলৌকিক কিছু মনে করলে বোধ হয় ভুল করা হবে না।... পরিচালনার মধ্যে একটা গভীর নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায়, যা আমার দেশে খুবই বিরল।... 'স্বামীজী'র অসাধারণত্বের জন্য পরিচালক অমর মল্লিকের পর যাঁদের নাম উল্লেখ করতে হয়, তাঁদের মধ্যে প্রথম মনে আসে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নাম। পরমহংসদেবের চরিত্রকে তিনি রূপায়িত করেছেন। পরমহংসদেবকে দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। তাঁকে আমরা জেনেছি, তাঁর কথা শুনে এবং তাঁর বিষয় পড়ে। তা থেকে তাঁর সম্পর্কে আমাদের অন্তরে যে ছবি মুদ্রিত হয়েছে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের রূপায়ণে যেন সেইটাকেই সামনে তুলে ধরে দিয়েছে- দৃষ্টিতে, চলনে বলনে, হাবভাবে কোন বিষয়েই যেন সেই ছবির সঙ্গে এতটুকু পার্থক্য নেই। এ এক অবিস্মরণীয় চরিত্রচিত্রণ। পৃথিবীর যে-কোন শ্রেষ্ঠ চরিত্র সৃষ্টির সঙ্গেই এর তুলনা হতে পারে। নামভূমিকায় অবতরণ করেছেন নবাগত অজিত চট্টোপাধ্যায়। বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর চেহারায় সাদৃশ্য অদ্ভুত'।

'স্বামীজী'র কাহিনিকার নৃপেন্দ্রকৃষ্ণচট্টোপাধ্যায়। যিনি বহু বাংলা হিট ছবির চিত্রনাট্যকার। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, জুন ২৪, ১৯৪৯, শুক্রবার সমালোচক লিখছেন, '.... ছবির চিত্ররূপটি সুন্দর। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার গুণে গল্পের স্রোতটি সহজ ও সাবলীল ধারায় প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে। সুপরিচালনার জন্য অমর মল্লিক প্রশংসার দাবী করিতে পারেন।...

ঠাকুরের ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য অঙ্গসজ্জায় ও অভিনয়ে যে অপূর্ব শিল্পপ্রতিভার পরিচয় দিয়াছেন তাহাই এ ছবির শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। একান্ত নিষ্ঠার সহিত ঠাকুরের যে রূপটি তিনি ফুটাইয়া তুলিয়াছেন তাহা বোধ হয় তাঁহার শিল্পিজীবনের শ্রেষ্ঠ দান হিসাবে রহিয়া যাইবে। নামভূমিকায় অভিনয় করিয়াছেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজিত চট্টোপাধ্যায়। স্বামীজীর সহিত তাঁহার আশ্চর্যজনক আকৃতিগত সাদৃশ্য আছে...'। সমালোচনা শুনে বা পড়ে বোঝাই যায় 'স্বামীজী' ছবি এবং রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয় সম্পর্কে। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয় অত্যন্ত স্বাভাবিক, সহজ, সরল ছিল তা বোঝাই যাচ্ছে। বর্তমানে এই ছবির সামান্যতম অংশ পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। তাই রামকৃষ্ণ দেবের ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যর অভিনয় দেখা থেকে আমাদের বঞ্চিত থাকতে হবে। যেটুকু জানা যায় তার সবটুকুই সেইসময়কার পত্রপত্রিকায়।

রামকৃষ্ণ দেবকে নিয়ে বহু ছবি হয়েছে। সেইসব ছবিতে রামকৃষ্ণের ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিরঞ্জন দে-কে। রামকৃষ্ণ জীবনীমূলক ছবিগুলো মোটামুটি এক ধাঁচের। আলাদা করে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। কিংবা দর্শকেরাও হয়তো চাইতেন না। তাই পরিচালকেরা একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি করে গেছেন। দর্শকদের চেনা-জানা ঘটনাগুলো এনেছেন বারবার। যেমন, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামকৃষ্ণ দেবের সাক্ষাৎ এবং বাদুড়বাগানের ঈশ্বরচন্দ্রর বাড়িতে যাওয়া এসব বহুল আলোচিত। 'বিদ্যাসাগর' ছবিতেও তা দেখানোও হয়েছে। কিন্তু রামকৃষ্ণ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ নিয়ে কোনও সিনেমাতেই তার ছবি দেখি না। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল নন্দনবাগানের ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে।

১৮৮৩, ২ মে, কাশীশ্বর মিত্রের বাড়ি বা নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব সঙ্গে রাখাল এবং মাস্টার। এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। রামকৃষ্ণ দেবের বয়স তখন ৪৭ আর রবীন্দ্রনাথ ২২ বছরের যুবা। দু'জনের ভিতর কথাবার্তাও হয়েছিল বলে জানা যায়। শোনা যায়, ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবকে পিয়ানো বাজিয়ে গানও শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনে রামকৃষ্ণ দেব ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েন বলে শোনা যায়। যদিও 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত' (পৃষ্ঠা- ১৮৩- ৮৪)-তে তেমন উল্লেখ নেই। ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়েছিল ঠিকই তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন বলে উল্লেখ নেই। ব্রহ্মসঙ্গীত শুনে রামকৃষ্ণ দেব প্রচুর আনন্দ পেয়েছিলেন এটাও ঠিক। স্তোত্রপাঠ শুনে ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন তিনি। উপাসনা শেষে তরকারি অপছন্দ হওয়ায় নুন দিয়ে লুচি আর সামান্য মিষ্টি খেয়ে ফিরে আসেন দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণ দেব।

রামকৃষ্ণ দেব অবতার কি অবতার নন, এসব প্রশ্ন বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু রামকৃষ্ণ দেব যে উনিশ শতকের এক আন্দোলনের জোয়ার, সে-কথা হলফ করে বলা যায়। সেসব কি উঠে এসেছিল রামকৃষ্ণ-সংক্রান্ত কোনও ছবি থেকে? সম্ভবত নয়। তৎকালীন কলকাতা শহরের তাবড়-তাবড় বুদ্ধিজীবীরা এসেছিলেন তাঁর কাছে। এমনকী, আত্মসমর্পণও করেছেন তাঁর কাছে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে ঘিরে এক স্বর্ণবলয় তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়। সেসবও কি উঠে এসেছিল ছবিগুলোতে? এ-জিজ্ঞাস্য থেকেই যায়। মানুষ রামকৃষ্ণ দেব নির্মাণে পরিচালকেরা খুব বেশি সচেষ্ট ছিলেন না। এ-প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণের ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার- এর একটি কথা বলতেই হয়। 'ডাক্তারের একজন বন্ধু ডাক্তারকে বলিতেছেন, মহাশয়, শুনতে পাই পরমহংসকে কেউ কেউ অবতার বলে। আপনি তো রোজ দেখছেন, আপনার কি বোধ হয়?

ডাক্তার- As man I have the greatest re- gard for him. (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, উদ্বোধন, পৃষ্ঠা ৯৫০)।

একসময় বাংলা ছবিতে একটা কথা প্রচলিত ছিল- ভক্তিতেই শক্তি। অর্থাৎ ভক্তিমূলক সিনেমা মানেই আর্থিক সাফল্য।

তাই দর্শকদের ভক্তিরসে গদগদ করে তোলো। দর্শক যেন ফুল, বেলপাতা, বাতাসা, নকুলদানা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে। ভক্তিমূলক ছবির একটা বিশাল বক্স-অফিস ছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল ছোটপর্দার মাধ্যমে দর্শকদের কাছে অনেক সহজে পৌঁছানো যায়। প্রেম, একাধিক বিয়ে, পারিবারিক ষড়যন্ত্র, ইত্যাদি নিয়ে সিরিয়ালগুলোর যেমন টিআরপি থাকে। তেমনই থাকে ধারাবাহিকগুলোতেও। অর্থাৎ এখানেও ভক্তিই শক্তি। একই নীতি। বাড়ির বৈঠকখানায় বসে টিভি দেখতে দেখতে যেন সন্ধ্যার পুজো- আচ্চা সেরে ফেলেন ছোটপর্দার দর্শকেরা। তাই বেড়েই চলেছে আধ্যাত্মিক বা ধার্মিক ধারাবাহিকের সম্প্রচার। বাংলার প্রথম সারির চ্যানেলগুলো তো বটেই, এছাড়াও অন্যান্য চ্যানেলগুলোও বেছে নিচ্ছে এমনসব কাহিনি। কেউ আর আসল মানুষটির নির্মাণে তৎপর নয়।

Archive

Most Popular