12th Apr 2024
সাহিত্য
অদিতি ভট্টাচার্য
গতকাল থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে ? না শ্রীলেখার। আজকাল যে খুব একটা বেশী ভালো যায় তা অবশ্য নয়, তবুও কাল থেকে যেন মনে হচ্ছে আর পারছেন না। আর মন? সেটা যে কোনও সময়ে ভালো থাকতে পারে তাই যেন ভুলতে বসেছেন শ্রীলেখা, আজ নয়, বহু কাল। অথচ কাল কিন্তু সেরকমই একটা দিন ছিল, মন ভালো থাকার। নিজের কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার দিন। এটা অবশ্য প্রথম নয়, কিন্তু এই স্বীকৃতি যাঁদের কাছ থেকে এসেছে সেই সংস্থাটি বহু পুরোনো এবং যথেষ্ট বিখ্যাত। প্রতি বছর সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ কল্যাণ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্যে এঁরা কয়েকজনকে পুরস্কৃত করেন, সমাজ কল্যাণের জন্যে এবার শ্রীলেখা নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংবাদটি প্রচারিত হওয়া মাত্র অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে গেছিলেন শ্রীলেখা। হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে, ফেসবুকের পাতায় কোথায় ছিল না সে সব শুভেচ্ছা বার্তা? তাছাড়া ফোন তো আছেই, অনেকে দেখা করেও নিজেদের ভালো লাগাটুকু, খুশিটুকু অকুণ্ঠ চিত্তে প্রকাশ করে গেছিলেন। শ্রীলেখা আর মৃন্ময়ের অক্লান্ত পরিশ্রম যে আজ উপযুক্ত স্বীকৃতি পেল তা জানিয়েছিলেন। এঁরা মন থকেই বলেছিলেন, এঁরা শ্রীলেখার শুভাকাঙ্ক্ষী- শ্রীলেখা জানেন সে কথা। কিন্তু তাও, তাও আজকাল এই সব স্বীকৃতি, সম্মান, পুরস্কার প্রাপ্তি যেন মনের জ্বালাটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আনন্দ? ওই তীব্র দহন জ্বালার কাছে সে কিছুই নয়। না, শ্রীলেখা এসব কাউকেই বুঝতে দেন না, কষ্ট করে হলেও অল্প হাসেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তাতে ক্লান্তিটা অবশ্য সবারই চোখে পড়ে, সেটা কোনও আবরণেই আবৃত করা যায় না, কিন্তু কেউ তার প্রকৃত কারণ বুঝতেও পারে না। সবাই ভাবে, খাটনি কি কম যায়, বয়স তো কিছু কম হল না, ক্লান্ত হতেই পারেন। এই তো গত কালের অনুষ্ঠানে একটি মেয়ে সুদৃশ্য থালায় স্মারক, মানপত্র আর পুষ্পস্তবক নিয়ে মঞ্চে এল, পরণে তার ধবধবে সাদা খোলের সিল্কের শাড়ি, চওড়া লাল সবুজ নকশা করা পাড়, খোলে ছোট্ট ছোট্ট লাল সবুজ ফুল, সুন্দর লাগছিল মেয়েটিকে। কিন্তু হঠাৎই শ্রীলেখার চোখে সে মেয়ের মুখ বদলে গিয়ে যেন অন্য কারুর হয়ে গেল, ছোটো মেয়ে একটা, এরকমই একটা শাড়ি পরা সেও, উছলে ওঠে আনন্দে সে লাফাতে লাফাতে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আজ সবাই কী বলছিল জানো মা? বলছিল এই শাড়িটা পরে আমাকে নাকি একেবারে লক্ষ্মী ঠাকুরের মতো লাগছে।” শ্রীলেখা নিজের মন শক্ত করে নিজেকে সামলালেন। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরে শ্রীলেখা যখন পুরস্কার গ্রহণ করছেন, করতালিতে প্রেক্ষাগৃহ মুখরিত, মনে হল সে যেন আবার এসে উপস্থিত হয়েছে, অত। ছোটো নয় আর সে তখন, আগের সেই উজ্জ্বলতাও নেই, বরং শুকনো মুখে জলভরা চোখে সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শ্রীলেখার দিকে। শ্রীলেখা পারলেন না সে চোখে চোখ রাখতেন, বন্ধ করে ফেললেন নিজের চোখ। পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক নজর করেছিলেন ওঁর এই অবস্থা, মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "কী হল ম্যাডাম? শরীর খারাপ লাগছে?" শ্রীলেখা ফিকে হেসে না বললেন। তারপর নিজের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন, উদ্যোক্তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
নিজের মনের অবস্থা যাই হোক না কেন, নিজের কর্তব্য থেকে চ্যুত হন না তিনি, সে বিষয়ে অতি সচেতন তিনি, এক সময়ে বড়ো বেশী ত্রুটি করে ফেলেছিলেন বলেই কি? তখন বোঝেননি, কিন্তু এখন তাই মনে হয়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান শেষ হতেই নিজের শারীরিক অসুস্থতার কারণ দর্শিয়ে চলে এসেছিলেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তখনও বাকি, তা উপভোগ করার জন্যে আর বসে থাকতে পারলেন না। অথচ নিজে এক সময়ের প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী। আজও কম ধকল যায়নি সারাদিন। রিহ্যাব সেন্টারের কাজ। ছিল অনেক, তার মধ্যে আবার দীপার মেয়েটা নার্সিং হোমে ভর্তি, ডেঙ্গি হয়েছে। অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক ছিল, সন্ধ্যের দিকে একটু ভালোর দিকে যাওয়ায় বাড়ি এসেছেন। যথেষ্ট বয়স হয়েছে ওঁর, এখন আর কত ধকল, কত টেনশন সহ্য হয়? অদ্ভুচ দীপাকে ছেড়েও আসতে পারছিলেন না। হাউহাউ করে কাঁদছিল মেয়েটা। শ্রীলেখার মনে পড়ছিল পাঁচ বছর আগের কথা। দীপার কোলের সেই সময় দু মাসের মেয়ে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিল। আক্ষরিক অর্থেই। প্রথম সন্তানও মেয়ে ছিল, পৃথিবীতে সে ছ'মাসও অতিক্রম করতে পারেনি। স্বাভাবিক মৃত্যু না অন্য কিছু- সে বিষয়ে সন্দেহের সথেষ্ট অবকাশ আছে। দীপা শ্রীলেখাকে বলেছিল, "বাপই খুন করেছে, মেয়ে চায়নি যে।"
দ্বিতীয়বার আবার মেয়ে। এবার আর দীপার ঠাঁই হল না বাড়িতে। বাপের বাড়িও তথৈবচ। দুটো পেটের দায়িত্ব কে নেবে? শ্রীলেখার বাড়িতে আশ্রয় পেল শেষ অবধি। সেদিনও ঠিক এরকম করেই কাঁদছিল মেয়েটা। মারের কালশিটের দাগগুলো তখনও শরীর থেকে মেলায়নি। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলেন শ্রীলেখা। দীপা এখন রিহ্যাব সেন্টারে কাজ করে। শুধু দীপা নয়, এরকম আরো কিছু মেয়ে আছে। যাদের প্রয়োজন আছে, শুধু অর্থের নয়, সঠিক পথ প্রদর্শনের, সহমর্মিতারও।
নার্সিং হোম থেকে ফিরে শুয়ে পড়েছিলেন, চোখ বন্ধ করেই ছিলেন, কিন্তু থেকেই থেকেই দীপার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে যাক, আর কত দুঃখ পাবে মেয়েটা? ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করেন শ্রীলেখা। নিজের জন্যে আর আছে কি চাওয়ার? যা ইচ্ছে, যা চাওয়া- সব তো এদেরই জন্যে। রিহ্যাব সেন্টার ঠিক মতো চলুক, অসুস্থরা সুস্থ হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে যাক, দীপারা স্বনির্ভর জীবন যাপন করুক, ছেলেমেয়ে মানুষ করুক- ব্যাস এইটুকুই। হঠাৎ এই সব কথা মুছে গেল, দীপার মুখ মিলিয়ে গেল, তার স্থান নিল অন্য আর এক মুখ, এক তরুণীর মুখ। এ সেই মুখ। চুল তার উশকোম্বুশকো, যেন কত দিন তাতে চিরুনি পড়েনি, চোখ কোটরে ঢুকেছে, পুরু কালি সে দুটোর তলায়।
"আমার কথা এমন করে ভাবোনি কেন? আমার সঙ্গে ওরকম করে কথা বলতে কেন? কী বলেছিলে আমাকে, মনে আছে তোমার? বলেছিলে 'কত শখ করে নাম রেখেছিলাম শ্রীময়ী, অথচ দিন কে দিন তুমি শ্রীহীন, কদর্য হচ্ছ। নামটাকে প্রহসনে পরিণত করেছ।' মনে পড়ছে তোমার?" মুখটা বলে উঠল। ধড়ফড় করে উঠে বসলেন শ্রীলেখা। না ঘরে কেউ নেই। ঘরে কেন, গোটা বাড়িতেই বা কে আছে, উনি আর প্রিয়ঙ্কা ছাড়া? সেও তো রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত, আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীলেখা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, বারান্দায় এসে
দাঁড়ালেন। দোতলা ঘরের সংলগ্ন বারান্দা। ওপর থেকে নীচের ব্যস্ত রাস্তা দেখা যাচ্ছে। কত মানুষ যাতায়াত করছে, কতরকমের গাড়ি যাচ্ছে। বিচিত্র তাদের শব্দ। কিন্তু সে সব কিছু ছাপিয়েও শ্রীলেখার কানে বাজতে লাগল শ্রীময়ীর কথাগুলো, রাজপথের ব্যস্ততার চিত্রর ওপর ভেসে উঠল তারই মুখ। চোখ বন্ধ করে শক্ত হাতে বারান্দার রেলিং চেপে ধরলেন শ্রীলেখা। কত দিন হল চলে গেছে শ্রীময়ী? সময়ের হিসেব বলে দেড় দশকেরও কিছু বেশী। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে তত বেশী যেন নিজের মনে তার। উপস্থিতি টের পাচ্ছেন শ্রীলেখা, অথচ রক্ত মাংসের মানুষটার জলজ্যন্ত উপস্থিতি যখন ছিল এই দৃশ্যমান, স্পৃশ্য জগতে, তখন সে কতটা উপস্থিত ছিল শ্রীলেখা আর মুন্ময়ের জীবনে? বাড়ির একটা ঘরের দখলদারি ছিল বটে তার, কিন্তু ওইটুকুই, তার বাইরে আর কোথাও নয়। সব জায়গা থেকেই সে যেন উধাও হয়ে গেছিল, শ্রীলেখা আর মৃন্ময়ের মন থেকে তো বটেই। সেটা অবশ্য অনেকটা জোর করেই করা হয়েছিল। অদ্ভুত উদাসীন হয়ে।
"বাদ দাও ওর কথা! কী আশা করেছিলাম আর কী হল। নিজের জীবনটা তো নষ্ট করলই, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মান সম্মানও। ওইভাবে চুপচাপ ঘরে পড়ে থাক, ওই ভালো। বাইরে এলেই তো আবার হাজার কথা, হাজার প্রশ্ন্য" মৃন্ময় প্রায়ই বলতেন এ' কথা। উম্মা, বিরক্তি প্রকাশ পেত প্রতিটা শব্দে। শ্রীলেখাও মেনে নিয়েছিলেন তাই। বাধ্য হয়ে নয়, স্ব-ইচ্ছেতেই। নিজের প্রতিষ্ঠা, নিজের সামাজিক অবস্থানকে তো আর একটা মেয়ের জন্যে তছনছ হতে দিতে পারেন না। একদিনে হয় না এ'সব। প্রথিতযশা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী শ্রীলেখা নিয়োগী একদিনে প্রথিতযশা হননি। অনেক অধ্যাবসায়, অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে এই উচ্চতায় পৌঁছেছেন। তাকে কি এক মুহূর্তে নষ্ট হতে দেওয়া যায় এক ব্যক্তি বিশেষের জন্যে? হলই বা সে তাঁর আত্মজা। মৃন্ময়ের মনোভাবও তাই ছিল। শ্রীময়ী তাই তখন উধাও হয়েছিল ওঁদের মন থেকে। কী অদ্ভুত পরিহাস ভাগ্যের, যখন এই জগৎ থেকেই সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হল সে, তখন জাঁকিয়ে বসল মৃন্ময় আর শ্রীলেখার মনোজগতে। বড়ো ভয়ঙ্কর এই উপস্থিতি!
শ্রীলেখা বারান্দা থেকে আবার ঘরে এলেন। বড়ো অস্থির লাগছে। প্রায়ই লাগে আজকাল। তখন কড়া ঘুমের ওষুধের দ্বারস্থ হতে হয়। তবু যখন মৃন্ময় ছিলেন, দুজনে বুঝতেন দুজনের অবস্থা। নীরবেই দুজন দুজনকে সামলাতেন। কিন্তু এখন শ্রীলেখা একা, সাত মাস আগে চলে গেছেন মৃন্ময়। দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়েছিলেন। খুব বেশী দিন রোগ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি, এইটুকুই যা পুণ্য। নাহলে এই মানসিক যন্ত্রণার ওপর যা হত। পরিচিত মানুষ, শুভাকাঙ্ক্ষীরা দেখতে আসতেন মৃন্ময়কে, দুঃখপ্রকাশ করতেন, বলতেন, "ভালো লোকেদের কপালেই কি যত কষ্ট, যত দুঃখ! একে তো এত বড়ো শোক পেলেন, তার ওপর আবার এই!" ওরা চলে গেলে মৃন্ময় উত্তেজিত হয়ে উঠতেন, চেঁচিয়ে উঠতেন, "ভালো ভালো। ওরা বলে আর আমি ওর মুখটা দেখতে পাই, হাসছে, আমাকে ব্যঙ্গ করছে।" শ্রীলেখা থাকতেন পাশে, হাতদুটো ধরে, কখনও কপালে হাত বুলিয়ে শান্ত করতেন। নীরবেই। কী বলবেন? বলার মতো যে কিচ্ছু নেই। আজও যেমন কাউকে কিছুই বলার নেই শ্রীলেখার। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ওষুধও কি আজ তাঁকে ঘুম পাড়াতে পারবে? মনে হয় না। কত কিছু যে মনে ভিড় করে আসছে। ছবির মতো। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পরিবর্তিত হচ্ছে।
শ্রীময়ী এ বাড়িতে চলে এসেছে। আর সম্ভব নয় তীর্থর সঙ্গে থাকা, বিবাহ বিচ্ছেদ ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় নেই। তীর্থ অন্য নারীতে আসক্ত, তাকেই জীবন সঙ্গিনী করতে চায় সে।
"ভাবলে আশ্চর্য লাগে আমার যে তুমি বিয়েটাও টেকাতে পারলে না! অথচ তীর্থ তোমার নিজের পছন্দই ছিল। আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো করে গান শেখো, একজন ভালো শিল্পী হও- তুমি তা হলে না। গানের প্রতি তোমার কোনও ভালোবাসাই ছিল না, ছোটোবেলায় আমি জোর করে নিয়ে বসাতাম বলে যতটুকু বসতে। তোমার বাবা চেয়েছিলেন ওর মতো লইয়ার হও, প্র্যাকটিস করো কোর্টে- তুমি সে পথও মাড়ালে না। হিস্ট্রি নিয়ে পড়লে, এম এ পাশ করলে, কিন্তু চাকরি বাকরির কোনও চেষ্টাও করলে না। পাশ করতে না করতেই বিয়ে করলে। তাতেও আমাদের কোনও আপত্তি ছিল না। তুমি ভালো থাকো তাহলেই হল। কিন্তু তুমি সে জীবনও ভালো করে কাটাতে পারলে না। "তীর্থর নজর অন্য মেয়ের দিকে গেল কী করে তুমি থাকা সত্ত্বেও? আমাকে দেখো। এ বাড়িতে যখন বউ হয়ে এসেছিলাম তখন গান করা, গান শেখাই বন্ধ হয়ে গেছিল। আমার বাবা, মা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিলেন, আমি নিজে করিনি। কিন্তু তাই বলে কি সারা জীবনের মতোই আমি গানকে জলাঞ্জলি দিয়েছি? যা করেছি তা এই বাড়িতে থেকেই। গানও শিখেছি, অনুষ্ঠান করেছি, শিখিয়েওছি। আস্তে আস্তে সব পালটেছি, নিজের ইচ্ছে মতো সব করেছি, এখনও করছি। তার জন্যে চালাক হতে হয়, কোথায় কতটুকু ছাড়তে হবে আর কোনটা নিজের হাতে রাখতে হবে তা বুঝতে হয়। কিন্তু তুমি কিছুই পারলে না। তোমার জন্যে আমাদের মান সম্মান কীরকম নষ্ট হল বুঝতে পারছ?
মৃন্ময় নিয়োগী আর শ্রীলেখা নিয়োগীর মেয়ের ডিভোর্স হচ্ছে এটা রীতিমতো একটা রসালো আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে সোসাইটিতে! তোমার বাবাকে এখন তোমার কেসের জন্যে ব্যবস্থা করতে হচ্ছো ছিঃ! তোমার আর কী? তুমি তো যখন যা মনে হয়েছে তখন তাই করছ। যত জ্বালা তো আমাদের!" শ্রীলেখা একদিন বলেছিলেন মেয়েকে, এ বাড়িতে আসার পরপরই। এত কথা বলা বোধহয় ওই একদিনই। তারপর তো কথাই ফুরিয়ে গেছিল। কমতে কমতে প্রায় বন্ধই।
এম এ পাশ করার পর কিছু দিন পরই বিয়ে হয়েছিল শ্রীময়ীর। নিজের পছন্দেই। তীর্থদের নিজস্ব ফার্ম। বাপ, ঠাকুরদা সবাই আর্কিটেক্ট, তীর্থও তাই। পড়াশোনা শেষ করে নিজেদের ফার্মেই কাজ করছে। শ্রীময়ীই বাড়িতে জানিয়েছিল। নিজের পছন্দের কথা। মৃন্ময়, শ্রীলেখা আপত্তি করেননি। সোশ্যাল স্ট্যাটাসে ভালোই মিলেছিল। শ্রীলেখা শুধু একটু আশ্চর্য হয়েছিলেন কখন, কীভাবে, কোথায় তীর্থর সঙ্গে শ্রীময়ীর আলাপ হয়েছিল জানতে পারেননি বলে, মেয়ে তো একেবারে বিয়ের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। বিশেষ করে অনেক জায়গায় নেমন্তন্ন করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে তারা শ্রীময়ীর সঙ্গে তীর্থর সম্পর্কের কথা আগে থেকেই জানে। জানতেন না শুধু ওঁরা দু'জন। শ্রীলেখা নিজেই নিজেকে এর হেতুও দর্শিয়েছিলেন অবশ্য। তিনি কি আর ওদের মতো একজন সাধারণ মহিলা, সাধারণ গৃহবধূ? মা ঠিকই, কিন্তু শুধুমাত্র মা হওয়াই তাঁর জীবনের এক মাত্র লক্ষ্য কোনওদিন ছিল না। সময় কোথায় তাঁর এত দিকে খেয়াল রাখার? গান নিয়েই দিন কেটে যায়। মৃন্ময়ও তাই, ব্যস্ত নিজের কাজের জগতে। তাছাড়া মেয়ে বড়ো হয়েছে, তার সব ব্যাপারে নাক গলানো তিনি একেবারেই পছন্দ করেন না। বিশ্রী মানসিকতা, অন্তত তাঁদের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। কারণ খুঁজে পেয়ে নিজেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। হয়তো মৃন্ময়ও মনে মনে কারণ খুঁজেছিলেন আর একইভাবে খুঁজে পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া দ্রুতই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছিল।
দু'পক্ষেরই তাই ইচ্ছে ছিল, তীর্থর নতুন জীবনসঙ্গিনী লাভ করার তাড়াও ছিল।
কাজেই তাড়াতাড়িই সব কিছু মিটে গেল। শ্রীময়ী নতুনভাবে এ বাড়িতে নিজেকে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি প্রক্রিয়া দ্রুতই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছিল।
দু'পক্ষেরই তাই ইচ্ছে ছিল, তীর্থর নতুন জীবনসঙ্গিনী লাভ করার তাড়াও ছিল। কাজেই আবিষ্কার করল, বিবাহ পূর্ববর্তী জীবনে একরকমভাবে ছিল আর বিবাহ পরবর্তী জীবনে আরেক রকমভাবে। সে এক অসহ্য সময়, অস্বীকার করেন না শ্রীলেখা। পরিচিত মহলে রসালো গল্পর খোরাক হয়ে উঠেছিল শ্রীময়ী। আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এলেও সেই একই কথা, সেই একইরকম আহা উহু। উত্যক্ত হয়ে উঠতেন মৃন্ময় আর শ্রীলেখা। মনে হত শ্রীময়ী সবার সামনে না এলেই ভালো, ঘরের ভেতরেই থাক সবার চোখের আড়ালে। রাগও কি কম হত? "কই আমাদের আত্মীয়স্বজনের কারুর ছেলেমেয়ের তো এরকম হয়নি, আমাদের কপালেই ছিল সব? তুই বড়ো হওয়ার পর সবাই বলত আমার থেকেও সুন্দরী তুই। সে রূপ কোন কাজে পাগল? একটা ছেলেকে ধরে রাখতে পারলি না। বিয়ের চার বছর পর অন্য মেয়ের দিকে তার নজর গেল কী করে? বাচ্চাকাচ্চাও কেন হয়নি তাও জানি না।" শ্রীলেখার মনে হত, সব
সময়ে মনে নয়, মুখেও কখনও কখনও প্রকাশ করে ফেলতেন। শ্রীময়ীর কানেও যেত। যাবে নাই কেন? না যাওয়ার মতো করে তো আর বলা হত না। মোট কথা, তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন
শ্রীলেখা আর মৃন্ময়। ওই একটা মেয়ের জন্যে ওঁদের মান সম্মান ধুলোয় মিশছে। কী ভেবেছিলেন আর কী হল। এই থেকেই জন্ম নিল
এক অদ্ভুত উদাসীনতা শ্রীময়ীর প্রতি। হ্যাঁ, এখন মর্মে মর্মে অনুভব করে শ্রীলেখা কতটা উদাসীন তিনি ছিলেন নিজের আত্মজার প্রতি। কী করছে শ্রীময়ী, কখন খাচ্ছে, তাড়াতাড়িই সব কিছু মিটে
গেল। কখন খাচ্ছে না, কখন ঘুমোচ্ছে- কিছুই জানতেন না। জানার কোনও ইচ্ছেই হত না। কচ্চিৎ কদাচিৎ যদি বা মনে হত, পর মুহূর্তে নিজেকে বোঝাতেন, কচি খুকি নয় যে এসব খেয়াল হবে। নিজে যখন নিজের পছন্দ মতো বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাখতে আবার সে বিয়ে ভাঙারও, তখন নিজের খেয়ালও রাখতে পারবে। দুজনেই আরও বেশী করে নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়েছিলেন। কাজই অধিকার করেছিল মনের পুরোটা, শ্রীময়ী কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল। এখন মনে হয় কী করে সম্ভব। হয়েছিল? কিন্তু হয়েছিল সম্ভব। ওঁর থেকে ভালো আর কে জানো। কাদিন আগে প্রিয়ঙ্কা কাজ করে বাড়ি যাচ্ছিল, শ্রীলেখা মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন, "কী রে কী হয়েছে? শরীর খারাপ? বলবি তো আগে! নিজের একটু খেয়াল তো রাখতে হয়। দাঁড়া ওষুধ দিচ্ছি।"
ওষুধ দিলেন প্রিয়ঙ্কাকে, প্রিয়ঙ্কা নিল। তারপরই হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়ঙ্কা হয়ে গেল শ্রীময়ী। চোখদুটো লাল টকটকে, মুখ থমথম করছে, মেয়েটা খেতে চাইছিল না, সবিতাদি দুটি খাও, সকাল থেকে কিচ্ছু খাওনি" বলে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। শ্রীলেখার গানের অনুষ্ঠান ছিল, সেজেগুজে ঘর থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্যের মুখোমুখি। "কী মুখ চোখের ছিরি। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে একেবারে ঢি ঢি পড়ে যাবে। আমাদের মুখে একবার চুনকালি মাখিয়েও দেখছি ক্ষান্ত হওনি।" শ্রীলেখা বলেছিলেন চলে যেতে যেতে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেল বলে বিরক্তও হয়েছিলেন। বোঝেননি, বুঝতে চাননি আগের দিন থেকেই শ্রীময়ীর ধুম জ্বর। সবিতাও কি সেদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মালকিনের দিকে? বোধহয়। সেদিন দেখেও দেখার সময় ছিল না, কিন্তু ইদানীং মনে হয়। প্রিয়ঙ্কার ওষুধ নেওয়া হয়ে গেছিল কিন্তু শ্রীলেখা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। "কী হল জেঠি?
সেখানেই কী হল?" করে ওই চেয়ারে বসিয়েছিল। বুঝেছিল জেঠির কিছু মনে পড়ে গেছে। মাঝে মাঝেই হয় এরকম, দেখে তো। মেয়ের শোক এখনও সামলে উঠতে পারেননি- এই ভেবেছিল। কী সামলে উঠতে পারেননি তা জানেন শুধু শ্রীলেখা।
আবার বিয়ের চেষ্টা করতে বলেছিলেন মৃন্ময়ের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, "একবার এরকম হয়েছে তো কী হয়েছে, তাই বলে কোনও চেষ্টা করবে না? আস্ত জীবন পড়ে আছে, এত সুন্দর একটা মেয়ে।" মৃন্ময় কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ছিলেন তাঁর দিকে। সে দৃষ্টির ভাষায় যা বোঝার বুঝে গেছিলেন মানুষটি। এত বড়ো স্পর্ধা যে মৃন্ময় নিয়োগীকে এসব ব্যক্তিগত পরামর্শ দিতে আসে। শ্রীময়ীর সম্পর্কে মনের ভাব ছিল এইরকম- আগেও যা করার নিজেই করেছে যখন, এবারও ইচ্ছে হলে নিজেই জুটিয়ে নেবে।
শেষদিকে মাঝে মাঝে কোথাও যেত শ্রীময়ী। কোথায় তা জানেন না শ্রীলেখা। কোনও বন্ধুর বাড়ি কি? কে জানে। তারপর তো সেই দিন। সেদিন সন্ধ্যেয় বাড়ি ছিলেন শ্রীলেখা। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল, মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল খুব, তাই গানের ক্লাস আর নেননি। ফোন এসেছিল বাড়িতে। শ্রীময়ীর দুর্ঘটনা ঘটেছে। ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে নাকি আনমনা হয়ে এলোমেলো হাঁটছিল। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু বিশেষ কিছু চেষ্টা করার আগেই সে অতীত। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তাই শেষ হয়েও যেন সব শেষ হতে চায় না, মারা
যাওয়ার পরও বিস্তর নিয়মকানুন, কাটা ছেঁড়া। তাছাড়া বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী শ্রীলেখা নিয়োগীর মেয়ে। খবর ছড়াতে বিন্দুমাত্র দেরি হয়নি। সব কিছু ঠাপ্ত মাথায় সামলাতে হয়েছিল, পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও যাতে রসালো আলোচনার রসদ যোগানোর মতো কিছু না থাকে। যদিও শ্রীলেখা আর মৃন্ময় জানতে পেরেছিলেন যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল শ্রীময়ী। সম্ভবত খুব সম্প্রতিই। এসব খবর যেন বাইরে না ছড়ায় তার ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল বইকি। "তোরা জানতে পারিসনি? রিহ্যাবের কোনও চেষ্টাও করিসনি?" মৃন্ময়ের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বলেছিলেন, ভদ্রলোক ডাক্তার।
গুম হয়ে বসছিলেন মৃন্ময়, কোনও উত্তর দেননি। তারপর এই রিহ্যাব সেন্টার। বাইপাশের ধারে কিছুটা জমি ছিল মৃন্ময়দের, সেখানেই। যারা মাদকাসক্ত তাদের সেই আসক্তি নির্মূল করে সমাজের মূল স্রোতে আবার ফিরিয়ে দেওয়াই এর লক্ষ্য। মৃন্ময় দিন রাত এক করে সেন্টারটা দাঁড় করিয়েছেন। কোনও অসুস্থ দুঃস্থ মেয়ের কথা শুনলে শ্রীলেখাও নিজের মতো করে যথাসাধ্য করেন। গান? কমিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটাই, তবে তখনও একেবারে বন্ধ করেননি। লক্ষ্মীর অশেষ কৃপাধন্য তাঁরা, কিন্তু এসব কাজে কোনও পরিমাণই যেন যথেষ্ট নয়। সেই জন্যেই অনুষ্ঠান করা একেবারে বন্ধ করেননি, ওকালতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন মৃন্ময়ও। এত মানুষের এত দুঃখ কষ্ট! আগে যেন কখনও বোঝেনইনি! বুঝবেন কী করে? সময় কোথায় ছিল? নিজেদের জগতেই যে যাঁর মতো ব্যস্ত ছিলেন। শ্রীময়ী চলে গিয়ে কত কিছু যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে। গেল! সে যাওয়ার পরেই তাই এসবের সূচনা। কম প্রশংসা লোকে করেনি, করে না, পত্র পত্রিকায় এঁদের কর্মকাণ্ডের কথা কম প্রকাশিত হয়নি। লোকে বলে, "সন্তান শোক কি আর কেউ পায়নি? কিন্তু ক'জন তা সহ্য করে পর হিতে এভাবে ব্রতী হতে পেরেছে? এত মানুষের চোখের জল মোছাতে ক'জন পেরেছে? অঢেল টাকাকড়িও তো কম লোকের নেই, করছে তারা এসব?" মৃন্ময়, শ্রীলেখা শুনেছেন। শুকনো খটখটে চোখে, শুকনো মুখে শুকনো হেসেছেন। ভেতরে যা কী তীব্র দহন জ্বালা, অপরাধবোধের গ্লানি! সব কিছু তো সেই শুষে নিয়েছে।
প্রিয়ঙ্কার রান্না এখনও শেষ হয়নি । শ্রীলেখাও চুপচাপ বিছানায় বসে। এই ষোলো বছর ধরে তো কম কাজে ব্যস্ত নেই, কিন্তু তা হলেও এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে ভুলতে পারেননি। কত কিছু যে মনে পড়ে, কত কথা! এক মুহূর্তও যেন নিস্তার নেই। মৃত্যু নিস্তার না দিলে নিস্তার পাবেনও না। জানেন তিনি। এত বছর ধরে তো এই চলছে। একজন পেয়েছেন ক'মাস আগে, তাঁর পালা এখনও আসেনি।
"শাস্তি, শাস্তি, এ আমাদের শাস্তি, ভোগ তো করতেই হবে," মুন্ময় বলতেন, মাঝে মাঝেই। বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করে এখন সেই শব্দগুলোই উচ্চারণ করলেন শ্রীলেখা।