27th Sep 2024
ভ্রমণ
কমলেন্দু সরকার
পুজোয় অনেকেই ছুটি পান না। বাড়ি থেকে কাজ করতে হয়। শেষ মুহূর্তে পুজোর চারদিন ছুটি মিলল। তাই পুজোর চারদিন যেতে চান এই কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও। গাড়িটা রেডি করে রাখুন। ষষ্ঠী অব্দি কাজ করে, সময় নষ্ট না-করে বেরিয়ে পড়ুন ভোর ভোর। কোথায় যাবেন? তারই খোঁজখবরে কমলেন্দু সরকার।
ওডিশার মিনি লাদাখ তাপাং
গতবছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ জায়গা বলে যাওয়ার অনুমতি মিলত না। এবছর থেকে ওডিশা সরকার যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে। সবুজ হ্রদের তাপাংয়ের সৌন্দর্য অবর্ণনীয়! অনেকেই বলেন, তাপাংয়ের সৌন্দর্য অবিশ্বাস্য! অবর্ণনীয় আর অবিশ্বাস্য দুই সৌন্দর্যই তো স্বর্গীয়! তবে জেনে রাখা ভাল এখানে থাকার কোনও জায়গা নেই, রেস্তরাঁও নাকি নেই। আশপাশে কয়েকটি জায়গা আছে সেখানে দিন দুয়ের জন্য ডেরা বেঁধে নিন। আবার তো গাড়ি নিয়ে রওনা দেওয়া দশমীর ভোরে। ভুবনেশ্বর থেকে ৩৭-৪০ কিমি তাপাং। আর ভুবনেশ্বর এবং তার আশপাশে দেখা, থাকা বা ঘোরাঘুরির জায়গা প্রচুর। তাপাং থেকে চিলিকা মাত্র ৬০-৬২ কিমি। তাপাং থেকে নিউ জগন্নাথ রোড ধরে কমবেশি ঘণ্টা দুইয়ের জার্নি। সপ্তমী রাত ভুবনেশ্বরে কাটিয়ে অষ্টমীর দিন সকাল সকাল বেরিয়ে তাপাং হয়ে পুরী। অষ্টমীর দিন জগন্নাথ দর্শন খুবই পুণ্যের কাজ। পুরীর থেকে ১১ কিমি দূরে পটের গ্রাম রঘুরাজপুর। তালপাতায় আঁকেন শিল্পীরা। নবমীর দিন চিলিকা হ্রদের বুকে নৌকাবিহার মন্দ লাগবে না! দশমীর দিন ভোরে কলকাতার উদ্দেশে রওনা।
ওক পাইনের মাঝে পাহাড়ি গ্রাম বাগোরা হাত বাড়ালেই উত্তরবঙ্গ
শিলিগুড়ি থেকে ঘণ্টা তিন-চারের মধ্যে কতশত জায়গায় পৌঁছনো যায় অনায়াসেই। এখন তো পাহাড়ের সর্বত্রই হোমস্টে আর হোমস্টে। বেড়ানোওয়ালাদের বেশ সুবিধে করে দিয়েছেন পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষগুলো। আর যখনই যাওয়া যাক না কেন পাহাড়ে, মন হয় আনন্দে টইটম্বুর। তেমনই ভরপুর আনন্দময় পাহাড়ি গ্রাম কার্শিয়াংয়ের বাগোরা। একেবারে অফবিট বেড়ানো। ঘোরাঘুরির জন্য আদর্শ জায়গা। সাত হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। এখানকার অপরূপ রূপসৌন্দর্য আকর্ষণ করবেই। পাহাড়ঘেরা ছোট্ট বাগোরা সুন্দর তো বটেই, নির্জন, নিরিবিলিও। মেঘ, পাহাড়, পাইন, ঝরনা আর ফুল মন ভরিয়ে দেয়। বাগোরার কাছেই চিমনি গ্রাম। এখানে মিশে আছে প্রাকৃতিক রূপ-মাধুর্যের সঙ্গে ইতিহাস। রূপবতী পাহাড়ি গ্রাম চিমনি যেন এক ঘুমন্ত পরি। বাতাসে ভেসে আসে পাইন, ওকের শব্দ। শ্রবণেন্দ্রিয় খুশি করে পাখির ডাক। কতরকমের পাহাড়ি পাখি ইতিউতি উড়ে যায়, ডেকে যায় অনর্গল! জানা যায়, ব্রিটিশরা নাকি রাত কাটাত এই গ্রামে। তারা ঠান্ডার হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য একটি চিমনি তৈরি করে। সেসব একশো বছরের পুরনো কথা। ব্রিটিশদের তৈরি এই চিমনি এখন পর্যটন কেন্দ্র। এই গ্রামকে ঘিরে রেখেছে তিস্তা ও মহানন্দা।
গুলমা খোলা
শিলিগুড়ির কাছেই গুলমা খোলা বা গুলমা। অজানা, অদেখা হটস্পট। শিলিগুড়ি শহর আর নগর জীবনকে ভাগ করেছে ছোট্ট রেলস্টেশন গুমলা আর নদী। জায়গাটিতে একবার পৌঁছতে পারলে ভাল না-লেগে উপায় নেই! গুলমাখোলা নদীর সৌন্দর্য জায়গাটিকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে। স্টেশনটিও ভারী সুন্দর! স্থানীয়রা অনেকেই বলেন, কখনও কখনও ঝিঁঝির ডাক ছাপিয়ে ভেসে আসে ময়ূরের ডাক, হাতির বৃংহণ। ভাগ্য ভাল থাকলে হরিণ, হাতি, লেপার্ডের দেখা পাওয়া যেতে পারে। তারা জল খেতে আসে ভোরে বা শেষ বিকেলে। আছে পাখি। গা ঘেঁষে রয়েছে ইংরেজ আমলের মোহরগাঁও-গুলমা চা-বাগান। উদাসী মন হারিয়ে যায় দুটি পাতা একটি কুড়ি ভিতরা এখানে রয়েছে মহানন্দা নদীও। রূপসী মহানন্দা রূপে মুগ্ধ করে। এই নদীর আলাদা একটা রূপসৌন্দর্য আছে।
কামারপুকুর
আমাদের খুব পরিচিত জায়গা কামারপুকুর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের জন্মস্থান। এখান থেকে কয়েক কিমি দূরে সাতবেড়িয়া। সেখানেই গ্রামবাংলার মাঝে চন্দ্রমণি ইকোটুরিজম পার্ক। কমবেশি কিলোমিটার তিনেক দূরত্বে রামকৃষ্ণ দেবের মাতৃদেবীর নামে এই পার্ক। গ্রাম্য পরিবেশ শহুরে মানুষদের ভাল না-লেগে যায় না! থাকার জায়গাটিও গ্রামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বানানো। চিত্রিত দেওয়ালের মাটির বাড়ি আর কটেজ। অথচ ভিতরে ব্যবস্থা পুরোটাই আধুনিক। জয়রামবাটি-কামাপুকুরের কাছেই একটি অফবিট লোকেশন বা নির্ভেজাল ছুটি কাটানোর জায়গা! ইংরেজিতে যাকে বলে off the beaten track. কামারপুকুর থেকে জয়রামবাটি যেতে পারবেন খুব সহজেই। মেরেকেটে আধঘণ্টার পথ। সারদা মায়ের জন্মস্থান। কামারপুকুরের থেকে ঢিল ছোড়া দূরে গড় মান্দারন। এই মান্দারন দুর্গকে ভিত্তি করেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী। এখানে রয়েছে এক দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। যাওয়া যেতে পারে রামকৃষ্ণ দেবের পৈতৃক ভিটে দেড়ে গ্রাম।
শিউলিবনা
শিউলি ফুলের মতো স্নিগ্ধ শিউলিবোনা শরৎ মানেই নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। আর শরতের বাতাসে মাঠে-প্রান্তরে কাশের ঢেউ! সেইসঙ্গে শাল, পিয়াল আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। সবুজ পাহাড়। আর এককাপ ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিয়েবন বাংলোর হাতায় বসে প্রকৃতি উপভোগ করা। জাস্ট ভাবা যায় না। এমনটাই পাবেন। তার জন্য শিউলিবনা। শরতের শিউলির আপেক্ষায় রয়েছে কোনও সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। না, জানার কোনও প্রয়োজনও নেই। ঠকাবে না শিউলিবোনা। শিউলিবোনা, শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে আদিবাসী গ্রাম। সদ্য যাওয়া বর্ষায় আরও সবুজ হয়ে থাকে অরণ্য। নতুনভাবে প্রাণ পায় লাল মাটির গ্রামের গাছগাছালি। বয়ে যায় শালি নদী। চারিপাশ ঘিরে আছে শাল-পিয়াল আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। শুধু প্রকৃতি নয়, শিউলবনাতে আছে বহু পুরাতাত্বিক নিদর্শন। আছে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা রাজা চন্দ্র বর্মনের প্রাচীন শিলালিপি। কাছই ভরতপুরে পটশিল্পীদের গ্রাম। শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় পটে ফুটে ওঠে নানাবিধ ছবি। একদল শিল্পী আছেন যাঁরা পাথর কেটে সৃষ্টি করেন দুর্গা, গণেশ ইত্যাদি। এঁরা তৈরি করেন পাথরের বাসনও। গাংদুয়ার থেকে দেখা যায় নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত! শিউলিবনা থেকে ১১ কিমি দূরে ছাতনা। এখানেই জন্মেছিলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন-এর কবি বড়ু চণ্ডীদাস। কবি বড়ু চণ্ডীদাসকে নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে কোনও কোনও গবেষক মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন বাঁকুড়া জেলার ছাতনারই বাসিন্দা। আগে এখানকার নাম ছিল ছত্রীনগর। ছত্রীনগর থেকে ছাতনা। কেউ কেউ মনে করেন এখানে ছিল ছাতিম গাছের জঙ্গল। ছাতিম থেকেই ছাতনা। শিউলিবনা থেকে গাড়ি নিয়ে আশপাশে ঘুরে আসা যেতেই পারে। ঘুরে আসতে পারেন, বিহারিনাথ, বড়ন্তি, গড় পঞ্চকোট, বিষ্ণুপুর, জয়পুরের জঙ্গল ইত্যাদি। চুপচাপ ঘরে বসে না-থেকে গাড়ি নিয়ে আধাবেলা ঘুরে নিতে পারেন শিউলিবনার আশপাশ। সঙ্গে নেবেন সামান্য কিছু খাবার আর জল। মন্দ লাগবে না। প্রয়োজন মনে করলে, গাড়ি নিয়ে রওনা দেওয়ার আগে থাকার জন্য ফোন করে নিতে পারেন অনিমেষ নন্দীকে, ফোন: 07501844554.
বাঁকিপুটের কুমারী তট
চারদিন সমুদ্রসৈকতে কিংবা সমুদ্রস্নান। এ এক এমন সমুদ্রসৈকত যেখানে নেই কোনও হইচই, চেঁচামেচি। এখানে কেবল সমুদ্রতীরের নিস্তব্ধতা ভাঙে সমুদ্র ঢেউয়ে। ঝাউ, ইউক্যালিপটাসও জোরে কিছু বলতে লজ্জা পায়, বাতাসের স্পর্শে ফিসফিসিয়ে কথা বলে কানে কানে। সমুদ্রের বুক হতে উঠে আসা বাতাসে মাতাল করে দেবে মন-প্রাণ। উদাস বাউলের মতো মন হাঁটা দেবে বালিয়াড়ি ধরে কোথাও। সমুদ্রের জল চুম্বনে ভিজে যাবে পদযুগল। তীরভাঙা সমুদ্র ঢেউয়ের জলকণা ভিজিয়ে দিয়ে যাবে মন, শরীর। উতল হয়ে উঠবে হৃদয়। ঝাউবনের আড়ালে বাঁকিপুট সমুদ্রসৈকত এক অনন্ত খুশির ভাণ্ডার! বাঁকিপুট বেলাভূমির লাল কাঁকড়া ভাললাগার এক অনন্য আকর্ষণ। সারা সৈকতে ছড়িয়ে থাকে! সমুদ্রপ্রেমী মানুষের কাছে স্বল্প পরিচিত বাঁকিপুটের কুমারী তট। এই বেলাভূমি থেকে সূর্যোদয় এবং অন্তের মোহিনী রূপ ভীষণভাবে হৃদয় উদ্বেলিত করবে। সবমিলিয়ে আত্মার আরাম বাঁকিপুট! এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে ইতিহাস। কমবেশি হাঁটাপথ আধ কিমি দূরে দরিয়াপুরে ব্রিটিশ আমলের বাতিঘর। ৯৬ ফুট উঁচু। বাতিঘরের ওপর থেকে পাখির চোখে বাঁকিপুট লাগে অপূর্ব! সামান্য অর্থের বিনিময়ে অনুমতি পাওয়া যায় বাতিঘরের ওপরে ওঠার। উঠতে হবে বেলা তিনটে থেকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে। বয়ে চলে ক্ষীণকায় রসুলপুর নদী। কপালকুণ্ডলার নদী। কিছুটা দূরেই বগুড়ান জলপাই। পাঁচ কিমি দূরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মৃতিবিজড়িত কপালকুণ্ডলা মন্দির। গাড়িতে কলকাতা থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে ছনম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সোজা মেচেদা। তারপর হলদিয়ার রাস্তা ধরে নন্দকুমার। সেখান থেকে দিঘার পথে কাঁথি। এরপর জুনপুট হয়ে বাঁকিপুট। যাওয়ার আগে মনে করলে একটা ফোন করে নিতে পারেন 09932677258.
দক্ষিণবঙ্গের কাশ্মীর
বিস্ময় জাগতেই পারে, দক্ষিণবঙ্গের কাশ্মীর আবার কোথায়! শুধু বরফই পড়ে না এখানে। তবে আছে হাড়কাঁপানো শীত এখানে। অতি গরমেও সূর্য ডুবে গেলে বেশ আরামদায়ক। দুচার পশলা বর্ষণ হয়ে গেলে রাত্রিবেলা গায়ে চাদর দিতে হয়। শরতের নীল আকাশে যখন সাদা মেঘের ময়ূরপঙখি ভেসে চলে আর বাঁধের জলে মুখ দেখে গাছগাছালি, আহা সেকী রূপমাধুরী অযোধ্যা পাহাড়ের। মনে হবে, এমন রূপসৌন্দর্য আর কোথায় পাওয়া যাবে! পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের বুক চিরে চলে গেছে কালো ফিতের মতো পথ। সে-পথের একটি গেছে মুরগুমা। অপূর্ব এখানকার সৌন্দর্য! পাহাড় ঘেরা টলটলে জলের লেক মুরগুমা। বাঁধের জলে যখন সূর্য তার বেলা শেষের লাল আভা ছড়িয়ে দেয় রূপকথার মতো সৌন্দর্য আর কোথায় মিলবে জানি না। শাল, সেগুন, পিয়াল, পলাশের ছায়ায় জিরোয় ছোট্ট একটি গ্রাম। শরতে মুরগুমা ভীষণই মনোরম আর লোভনীয়াঅপূর্ব সুন্দর প্রকৃতিকে উপভোগ করার লোভ সামলানো খুব কঠিন। আকাশভাঙা জ্যোৎস্না রাতে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করবে। কিন্তু তারাও তো বেরোয় রাত্রিবেলা। তাই লোভ সামলে উপভোগ করতে হয়।
অযোধ্যা পাহাড়ের ওপর চারদিন কাটাবার ফাঁকে এপাশ ওপাশ ঘুরতে মন্দ লাগবে না, বেশ লাগবে। প্রথমেই বলি, চিরুগোড়া-পারডির অরণ্যে যাওয়ার কথা। চিরুগোড়া আর পারডি পুরুলিয়ার দুই লাগোয়া গ্রাম। অনেকের কাছেই এই নাম দুটি অচেনা। পুজোর ছুটির চারদিন ছোট্ট ছুটিতে ঘোরাঘুরির পক্ষে আদর্শ! যাওয়ার রাস্তাটি চমৎকার। ডাইনে-বাঁয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় শাল, পিয়াল, পলাশ, মহুয়ার অরণ্য। মনে পড়বে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া বিখ্যাত সেই গান দোলে শাল পিয়ালের বন, যেন যায় হারিয়ে মন। অরণ্যের মাঝে মাথা উচিয়ে সার বাঁধা পাহাড়। পাহাড়ের গা সবুজ কিন্তু মাথা ন্যাড়া। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য পাখি উড়ে চলেছে। হ্যাঁ, এটাই সেই পরিচিত পাখি পাহাড়। চিরুগোড়া আর পারডির কাছেই কাঁঠালজল ঝরনা। তারই জলে পুষ্ট পাপড়িকোচা ড্যাম। কোচা মানে জল। আর পাপড়ি তো ফুলেরই হয়। ড্যামের জলে বাতাস লেগে ছোট ছোট ঢেউ খেলে। তখন মনে হয়, অজস্র ফুল সব পাপড়ি মেলছে এক এক করে। তবে লেকের জলে ফুটে আছে পদ্ম। টলটলে জল যেন আয়না। সেই আয়নায় মুখ দেখে আকাশ! পাহাড় আর অরণ্য তার প্রতিবিম্ব ছড়িয়ে দিয়েছে জল-আয়নায়! যাওয়ার আগে ফোন করে নিতে পারেন।
মৈরুঙ
মেঘ-পাহাড়ের মুলুকে ঘুম ভাঙবে পাখির ডাকে। উপত্যকার চারিপাশ ঘিরে রয়েছে পাহাড় আর অরণ্য। অরণ্যানীর সবুজের ছায়া পাহাড়ি উপত্যকার একফালি অরণ্য-পথে পড়ে আছে আপন-খেয়ালে। চোখ মেললে শুধুই গাছগাছালির সবুজ। পুরো চত্বরটি পাহাড়ে ঘেরা। প্রথম দর্শনেই ভাললাগে। উন্মুক্ত আকাশের পথে রঙিন ডানার রং করিয়ে উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। পাখির ডাক, প্রজাপতির নরম স্পর্শ আর অরণ্যের ছায়া পৌঁছে দেবে পাহাড়ের আস্তানায়। হোমস্টেটির অবস্থান ভারী চমৎকার জায়গায়। ঠিক স্বপ্নের মতো। ঘর থেকে বারান্দায় এলেই কেবলই পাহাড় আর জঙ্গল। মন ভরে যায় কুশাং তামাঙের হোমস্টেতে এসে! প্রকৃতির রূপ- মাধুর্য আর হোমস্টের মতোই সুন্দর জায়গাটির নাম- মৈরুঙ! সূর্যের আলো ভরিয়ে রাখে মৈরুঙের পাহাড়, অরণ্য আর বাড়িঘর। এখানকার রাত ভীষণই মোহময়ী। বিশেষ করে, পূর্ণিমায় বানডাকা কামরাঙা জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় অরণ্যানী, পাহাড়। হোমস্টের বারান্দায় লুটোপুটি খায় জ্যোস্না! রাত যত বাড়ে, ততই রূপ খোলে জ্যোৎস্নাস্নাত প্রকৃতির! নির্জনতাময় মৈরুঙ হয়ে যায় যেন রহস্যময়ী এক নারী! ১০-১১ কিমি দূরে ডুকা। গাড়ি যায়। তবে হেঁটে যাওয়ায় পাওয়া যায় ভিন্নরকম মজা। যাওয়ার পথে এলাচ খেতের ভিতর ছোট্ট এক গ্রাম তন্দ্রাবুগ। এই ছোট্ট গ্রামটি পেরিয়ে ডুকা। অরণ্যময় পাহাড়ি পথের শেষ। পশ্চিমবঙ্গের শেষ গ্রাম। এখানেই পথের শেষ। পাহাড় আর অরণ্য আটকে দেয় রাস্তা। যাওয়ার উপায় নেই। জঙ্গল মানে গভীর অরণ্য। ওই অরণ্যে প্রচুর ওয়াইল্ড লাইফও আছে। তাদের হুংকারও শোনা যায়। সুন্দর শান্ত মনোরম পরিবেশ। নির্জন, নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভাল লাগে! আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে দেখা যায় স্বমহিমায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দাঁড়িয়ে! রওনা হওয়ার আগে একবার ফোন করে নিতে পারেন। কুশাং তামাং, ফোন: 099331 87984.
দাগারা সৈকত
যে-সমুদ্রসৈকতে নির্জনতা ভাঙে ফেনিল ঊর্মিমালা বাঙালির সমুদ্র বলতে এখন শুধুমাত্র দিঘা, পুরী নয়। দিঘা-পুরী গিয়ে গিয়ে ক্লান্ত হলেও এই দুই সমুদ্রসৈকত এখনও প্রিয়। নতুন নতুন সমুদ্রসৈকতের খোঁজে থাকেন বাঙালি সমুদ্রবিলাসীরা। কিংবা খোঁজ পেলেই ছোটেন সেই সমুদ্রের বালুময় তীরে। এবার পুজোর চারদিন হইহট্টগোল ছেড়ে একটি নির্জন সৈকতে যেতে মন চাইছে। কলকাতার খুব কাছে নয়, খুব দূরেও নয়, মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যান সমুদ্র সৈকতে। গাড়িতেই সেখানে পৌঁছানো যায়। ট্রেন-বাসের ঝক্কি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই নির্জন সৈকতের নাম দাগারা সৈকত। নাম শুনে গোয়া ভাবার কোনও কারণ নেই। নামটা অন্যরকমের হলেও কলকাতার খুব দূরে নয়। গাড়িতে বড়জোর ঘণ্টা পাঁচ-সাড়ে পাঁচের জার্নি। কাছেই জলেশ্বর মন্দির। একঢিলে দুই পাখি দাগারা বিচ আর জলেশ্বর মন্দির। সুবর্ণরেখা নদী পেরিয়ে দাগারা বিচ। চমৎকার রাস্তা। অনেক নিরিবিলি। সমুদ্রবিলাসীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সৈকত ঘিরে ঝাউবন! সমুদ্র বাতাসে ঝাউবন কথা বলে ফিসফিসিয়ে! উত্তাল সমুদ্রে স্নান করার মজা আছে দাগারায়। পুজোর চারদিনের ছুটি কাটানোর perfect desti- nation. অনাঘ্রাত পুষ্পের মতো অনাঘ্রাত সৈকত। স্থানীয়রা বলেন, ডোগরা বিচ। বহু সমুদ্রবিলাসী পর্যটক এই সাগরবেলার খোঁজখবর জানলেও, এখনও তেমন ভিড় জমেনি। তাই যাওয়ার আগে একবার ওডিশা টুরিজম অফিসে খোঁজখবর নিলে ভাল। নইলে সোজা রওনা দিন দাগারা বিচ। নিবিড় ঝাউবনের ভিতর দিয়ে পথ চলে গেছে সাগরতটে। বিশাল লম্বা আর প্রশস্ত সোনাঝরা বালুসৈকতের রূপমাধুরী মুগ্ধ করবে, রূপকথার মতো লাগবে! সম্মুখে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র আর পিছনে ঝাউবন। সমুদ্রস্নানরত মানুষ। মনে হবে, প্রকৃতি তার সবচেয়ে বড় গুণী শিল্পীকে দিয়ে বিশাল এক ক্যানভাসে ছবি আঁকিয়ে রেখেছেন দাগারায়! শহরের কোলাহল মুক্ত দাগারায় হারিয়ে যায় মন ঝাউবনের সবুজ অন্ধকারে। ঝাউ অরণ্যে ডেকে যায় নাম না-জানা পাখির দল। তার সঙ্গে মিশে যায় সমুদ্র বাতাসে ঝাউবনের ঝিরিঝিরি শব্দ! ভুলিয়ে রাখে সবকিছু স্নিগ্ধতায়।
গোলপাতা জঙ্গল
নীল আকাশের নীচে গোলপাতার জঙ্গল সুন্দরবন না-গিয়েও যদি সুন্দরবনের অনুভূতি, মজা ইত্যাদি পাওয়া যায়, তাহলে ক্ষতি কী। বাস্তবে তেমনই আছে হাতের কাছে, ঢিল ছোড়া দূরত্বে। কলকাতা থেকে কমবেশি সত্তর কিমি দূরে টাকির কাছেই গোলপাতা জঙ্গল। সুন্দরবনে না-গিয়েও সুন্দরবনের অনুভূতি আর গন্ধ আছে গোলপাতার জঙ্গলে। ইছামতী নদীর ধারে টাকি। টাকি অপূর্ব এক জায়গা। ওপারে বাংলাদেশ। ইছামতীর বুকে নৌকা নিয়ে ঘোরা যায়।ইছামতী বাঙালির প্রাণের নদী, আপনার নদী। মায়াবতী ইছামতী নদীর ধারে শরতের সোনা রোদ্দুর বড়ই প্রাণবন্ত! ইছামতীর ধারে দাঁডালে মনের ভিতরের পাখিটা ডানার ঝাপটা দেয়। মন করে ওঠে আনচান! অদ্ভুত এক মায়াজাদু খেলা করে টাকির ইছামতীর ধারে এলে। সে বড় সুখের সময়, সে বড় ভাললাগার সময়! আগেই বলে রাখি, গোলপাতার জঙ্গলে এলে পকেটে সর্বদা নিজের পরিচয়পত্র রাখবেন। কখনওই ভুলবেন না। যদি মনে করে থাকেন পুজোর সময় একবার মাতৃদর্শন করব না, তাহলে তিনশো বছরের পুরনো কালীমন্দির আর জোড়া শিবমন্দির ঘুরে আসতে পারেন, ভাল লাগবে। ছোট হুজুরের দরগাও যেতে পারেন। ইছামতী আর ভাসা নদীর মিলনে মাছরাঙা দ্বীপ। গোলপাতা জঙ্গল এক মিনি সুন্দরবন। কানে আসবে হয়তো কোনও মাঝিভাই নৌকা ভাসিয়ে চলেছেন আব্বাসউদ্দিনের গান গেয়ে। অবশ্যই খাবেন টাকির বিখ্যাত ছানার মালপোয়া আর মাখা সন্দেশ। যাঁরা ঠিক করে ফেলেছেন উত্তরবঙ্গ যাবেন তাঁরা যাওয়ার আগে একবার নীচে দেওয়া ফোন নাম্বারে প্রয়োজন মনে করলে যোগাযোগ করে নিতে পারেন। ফোন করে খবরাখবর নিন বেড়ানোর সুবিধার্থে-- Travellers Companion, Siliguri Enquiry no- 9832060275, 9832434027, 8250760028, 7029853094