14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

গো গোয়া গন....

19th Aug 2024

ভ্রমণ

অরিত্র ঘোষ


বলুন দেখি কোথায় যাওয়ার প্ল্যান সবচেয়ে বেশী ক্যান্সেল হয়? বলুন দেখি কোথায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাড়ির অনুমতি বাগাতে ছেলেমেয়েরা উচ্ছেসেদ্ধও সোনামুখ করে গিলে নেয়? বলুন তো দিল চাহতা হ্যায়, গোলমাল, ডিয়ার জিন্দেগি, দৃশ্যম, ধামাল এসব সিনেমার নাম করলে আপনার কোন জায়গার কথা মাথায় আসে?

ঠিক ধরেছেন, উত্তরটা 'গোয়া"। গোয়া ব্যাপারটাই একটা 'ছোট প্যাকেট বড় ধামাকা"। আয়তনের হিসেবে ভারতের ক্ষুদ্রতম এবং জনসংখ্যার হিসেবে ভারতের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম অঙ্গরাজ্য হলেও এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জনজীবন, মানুষের সংস্কৃতি বা রুচিবোধ, খাদ্যাভ্যাস সবকিছুর মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র্য ব্যাপার আছে। আজকের পর্বে আসুন গোয়া ও তার খাবার-দাবার নিয়ে খানিক নাড়াঘাটা করা যাক।

কোন জায়গার খাবার-দাবারের ধাঁচ, তার উৎপত্তি- ব্যুৎপত্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করার আগে সেই জায়গার ইতিহাসটা একটু জেনে নেওয়া খুব জরুরি। যে জায়গার ইতিহাস নিয়ে বড় বড় কেতাব লেখা হয়ে যেতে পারে, তাকে ছোট পরিসরে স্বল্প-শব্দে বন্দী করার ধৃষ্টতা নিজগুণে পাঠক মাফ করবেন। ইতিহাস মানেই ধোঁয়াশার হালকা চাদর, টুকটাক প্রামাণ্য টুকু বাদ দিলে অনেকটা যুক্তিভিত্তিক অনুমান আর বিরুদ্ধ-যুক্তি। গোয়া নিয়েও নানা মুনির নানা মত, আমি সারটুকু অল্প করে বলেই ক্ষান্ত দেবো, কারণ এ লেখার উদ্দেশ্য তত্ত্বের কচকচি নয়, বরং বিশুদ্ধ খাদ্যরসালাপ।

অতি-প্রাচীন গোয়ার ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তির উল্লেখ পাওয়া যায় যেমন-অশোকের মৌর্য বংশ, সাতবাহন রাজা, চালুক্য, রাষ্ট্রকুট বংশ ইত্যাদি। তবে মোটামুটি ঠিকঠাক একটা টাইমলাইন আমরা পাই যখন গোয়া ময়ূরশর্মা প্রবর্তিত কদম্ব সাম্রাজ্যের আওতায় আসে। এই কদম্ব রাজবংশ কর্ণটিকের কিছু অংশ, কোঙ্কণ উপকূল সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু সময় ধরে শাসন করে। প্রাচীন সাহিত্য, শিলালিপি থেকে গোয়ার বেশ কিছু পুরনো নামও পাওয়া যায়; যেমন গোভ, গোভাপুরী, গোমন্ত, গোমঞ্চলা, গোপাকাপুরী, গোপাকাপট্রম ইত্যাদি। মধ্যযুগীয় আরবীয় ভূগোলবিদরা আবার গোয়াকে 'সিন্দাবুর' বা 'সান্দাবুর' নামেও জানতেন। তৎকালীন সময়ে হিন্দুদের সাথে সাথে বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মাবলম্বীরাও যথেষ্ট সংখ্যায় ছিলেন। এই সময় থেকেই গোয়ার খাবারের ওপর হিন্দুধর্মের প্রভাব পড়তে থাকে। তদুপরি এই সময় অনেক বণিক ও ব্রাহ্মণ পন্ডিত গৌড়দেশ থেকে মাইগ্রেট করে কোঙ্কণ উপকূলবর্তী এলাকায় পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করার কারণে উদ্ভব হয় এক নতুন রন্ধণপ্রণালী, ঠিক যেখানে বর্তমান 'সারস্বত হিন্দু কুইজিন' এর টিকি বাঁধা আছে বলেই মনে করা হয়।

এরপর ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আলাউদ্দিন খিলজীর প্রতিনিধি হয়ে মালিক কাফুর এই অঞ্চলে লুঠপাট চালু করেন আর এখান থেকেই গোয়ার ইতিহাসের পাতায় মুসলিমদের আগমনের সূত্রপাত। কাফুরের লুঠতরাজে ভীত হয়ে অনেক গৌড় ব্রাহ্মণ পালিয়েও যান গোয়া ছেড়ে। চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয়নগরের হিন্দু রাজারা গোয়া দখল করে শাসন করতে থাকেন প্রায় ১৪৬৯ সাল অবধি। সময়ের নিয়মে সবই পাল্টায় আর সেই নিয়ম মেনেই বাহমনি সালতানাতের হাত ঘুরে গোয়া যায় বিজাপুরী সালাতানাতের আদিল শাহিদের হাতে।

ঠিক এই সময় ১৪৯৮ নাগাদ, জামোরিন শাসিত কালিকট বন্দরে নোঙর ফেলে বিখ্যাত পর্তুগিজ অভিযাত্রী ভাস্কো- দা-গামার জাহাজ। এরপরই বিধাতা ভারতের ভাগ্য একটু অন্য ভাবে লিখতে শুরু করেন। ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার হওয়ায় ইউরোপীয়ানদের কাছে খুলে যায় এক নতুন দরজা। শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, আদান-প্রদান। জলপথ থাকার কারণে গোয়া বরাবরই নাবিকদের নেক-নজরে থেকে এসেছে। অবশেষে ১৫১০ সালে বণিকের মানদন্ড দেখা দিলো রাজদন্ড রূপে। পর্তুগিজ জেনারেল আফনসো দে আলবুকার্ক স্থানীয় এক নির্বাসিত হিন্দু তিমোজা বা তিমোয়া নায়েকের সহায়তায় আদিল শাহিদের পরাজিত করে গোয়ার মসনদে বসে পড়েন। এই সময় ওল্ড গোয়া পর্তুগিজদের কাছে 'ভেলহা গোয়া নামেই পরিচিত ছিলো।

এই সময়ে গোয়ায় আনাগোনা বাড়তে থাকে পর্তুগিজদের। ফলতঃ তৈরী হতে থাকে নতুন নতুন চার্চ, আমদানি হতে থাকে মিশনারি পাদ্রী ও ক্যাথোলিক জেসুইট মঙ্কদের। ইউরোপীয় ধাঁচে ঘরবাড়ি তৈরী করে অনেকে স্থায়ী ভাবে সংসার শুরু করেন, ফলে পর্তুগাল থেকে আসা নারীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এবার পাশাপাশি দুরকম সংস্কৃতি থাকলে তার মধ্যে আদান-প্রদান অবশ্যম্ভাবী। গোয়ার খাবারের ইতিহাসের কথা উঠলে এই সংস্কৃতি-কৃষ্টির আদানপ্রদান, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দীর্ঘ সহাবস্থান, ভৌগলিক অবস্থান কোনটাই বাদ দেওয়া যাবে না। আস্তে আস্তে ভারত পরিচিত হয় আলু, টমেটো, লঙ্কা, কাজু, আনারসের মতো অধুনা অতি-সাধারণ দ্রব্যের সাথে। আফ্রিকা ও মোজাম্বিক ফেরত পর্তুগিজ বণিকরা নিয়ে আসেন পেয়ারা, ধনেপাতা ইত্যাদি।

পর্তুগিজরা জাহাজে করেই এই দেশে আসতে থাকে, আর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তাদের সাথে থাকতো সল্টেড পর্ক, রসুন আর প্রচুর ওয়াইন। ফলে ভারতীয় কুইজিনে যুক্ত হয় পর্তুগিজ কুইজিনের ধারা, আসে অনেক নতুন কুকিং টেকনিক। উপকূলবর্তী অঞ্চল মানেই টক খাওয়ার প্রবণতা আর গোয়াতে তেঁতুল আর কোকামের প্রচলন ছিলো যথেষ্ট, সেই সঙ্গে পর্তুগিজদের সাথে আসে আসে পাম ভিনিগার, কোকোনাট ভিনিগার, ওয়াইন আর ওয়াইন ভিনিগারের মতো কুকিং লিকুইড। এদেশ থেকে পর্তুগিজরা নেয় বিভিন্ন মশলা প্রধানতঃ গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি। শাসক, বণিক, মিশনারি পাদ্রী, জেসুইট মঙ্ক, পর্তুগিজ নারী সবাই কোন না কোন ভাবে ছাপ ছেড়েছে গোয়ান কুইজিনে। এখনও বহু কালিনারি বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস ইন্দো-পর্তুগিজ রান্নার মূলে রয়েছেন ওল্ড গোয়ার 'কনভেন্ট দা সাপ্টা মণিকা' এর নানরা। আগেকার সেইসব রেপিপি এখনও ক্যাথোলিক বাড়িতে ট্র্যাডিশনাল উৎসবে ব্যবহৃত হয় তবে অনেক রেসিপিই কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে।

এরপর ১৫৬০ সাল নাগাদ গোয়ায় শুরু হয় কুখ্যাত 'ইনকুইজিশন'। জোর করে হিন্দু-জৈন-বৌদ্ধদের ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিস্টান বানানো শুরু হয় পোপের নির্দেশে। ভেঙে ফেলা হয় বহু মন্দির-মসজিদ, বদলে তৈরী হতে থাকে রোমান ক্যাথোলিক চার্চ। এর ফলে সদ্য ধর্মান্তরিতদের মধ্যে তৈরী হয় 'Crypto-Hinduism', অর্থাৎ মুখে নিজেকে খ্রিস্টান বললেও ভেতরে ভেতরে পুরনো ধর্ম হিন্দুত্ব পালন। তবে প্রভু পর্তুগিজদের এ জিনিস বুঝতে বেশী দেরী হলো না। ইনকুইজিশনের একটা পর্যায়ে পর্ক না খাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ধরা হতো। অতএব পরিবর্তন এলো খাদ্যাভ্যাসে। পাশাপাশি একদিকে পর্তুগিজরা আস্তে আস্তে ভারতীয় মহিলাদের বিবাহ করতে লাগলেন আর অন্যদিকে বন্দরে গণিকারাও অনেকে পর্তুগিজ নাবিকদের দ্বারা গর্ভবতী হলেন। এসব থেকে গোয়ান কুইজিনে হিন্দু-মুসলিম ঘরানার সাথে পর্তুগিজদের এত অবাধ যাতায়াতের কারণ স্পষ্টতই দৃশ্যমান।
এসব থাক, আসুন আমরা গোয়া যাই আর পকেট বাঁচিয়ে কবজি ডুবিয়ে রসনা তৃপ্ত করি। প্রথমেই নিকটস্থ এয়ারপোর্ট বা রেলওয়ে স্টেশনে নেমে চলুন নর্থ গোয়ার দিকে। মান্ডবী নদী ধরে যেতে যেতে টুক করে দেখে নিন Reis Magos Fort। ফোর্ট থেকে নারকেল গাছের সারি আর সমুদ্রের ঘন নীল জল দেখে তাক লাগবেই। এরপর সোজা পৌঁছে যান হোটেলে বা AirBnB তে। গিয়েই Goan Pao আর ওখানকার স্পেশাল Ros Omelette দিয়ে ব্রেকফাস্টটা করেই হাতে প্রিয় ঠান্ডা পানীয় নিয়ে সুইমিং পুলে নেমে শরীর আর মন দুটোই চাঙ্গা করে নিয়ে স্কুটি, বাইক বা গাড়ি করে বেরিয়ে পড়ুন আরামবোল, ম্যান্ড্রেম, মর্জিম, ভাগাতোর, অনজুনা বিচ ঘুরতে। ফিরে এসে রাতে বাগা আর ক্যালাঙ্গুটে বিচ দেখে টিটোস লেনে নাইট লাইফ কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসুন। চাইলে বাগা বিচে নাম করা 'Britto's' অথবা ক্যালাঙ্গুটেতে বিখ্যাত 'Souza Lobo' রেস্তোরাঁতে রাতের পেটপুজোটা সারতেই পারেন। গোয়ায় এখন দিকে দিকে সাউথ ইন্ডিয়ান ও পিওর ভেজ রেস্তোরাঁ পেয়ে যাবেন, আপনি চাইলে ইডলি- দোসা-সাম্বার ইত্যাদি দিয়েও কাজ চালিয়ে নিতেই পারেন। খেতেও ভালো, সাশ্রয়ীও।

বর্ষাকাল না হলে পরদিন সকালে ওল্ড গোয়ার 'ব্যাসিলিকা অফ বম জেসাস চার্চ' আর 'সে ক্যাথেড্রাল' দেখে চলে যান দুধসাগর ফলস। সাদা সফেন জলের ধারা আর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের রাস্তা, ভারী মনোরম পরিবেশ। চাইলে নীচে জমা জলে নেমে একটু জলকেলি করে স্পাইস গার্ডেন হয়ে হোটেলে ফিরে আসুন। ইচ্ছে হলে Sunrise Cruise বুক করতে পারেন বা রাতের উদ্দাম পার্টিতে শরীর-মন সঁপে দিতেই পারেন। আজ রাতের ডিনারটা 'Fat Fish" এ করলে খারাপ হয় না বটে। তবে আজ কিন্তু স্থানীয় অ্যালকোহলিক বেভারেজ "Urrak" ট্রাই নিয়ে দেখতে পারেন। লিমকা, লেবু আর লঙ্কা দিয়ে মন্দ নয়। তবে লোকাল কড়া কিছু চাইলে অবশ্যই আপনার চয়েস হবে 'Feni'। দুটোই কাজু থেকে বানানো, পার্থক্য এটুকুই যে Urrak প্রথম ডিস্টিলেশনের ফসল আর Feni দ্বিতীয় ডিস্টিলেশনের, তাই এতে অ্যালকোহলের মাত্রাটা একটু বেশী। TUBORG

পরদিন নর্থ গোয়া ছেড়ে পাঞ্জিম হয়ে চলে যান সাউথে, ভিড় ভাট্টা ছেড়ে অনেক দূর। পথে পাঞ্জিমে Viva Panjim, Cafe Tato, Ashok Bar & Restaurant, Mr Baker 1992 এর মতো নামকরা ফুড-জয়েন্ট পড়বে, মিস করবেন না যেন। এরপর Zantye's থেকে লোকাল কাজু কিনে সোজা পালোলেম বা সাউথ গোয়ার কোন বিচসাইড রিসর্টে উঠে পড়ুন। ফ্রেশ হয়ে সমুদ্র সংলগ্ন রেস্তোরাঁয় ইংলিশ ব্রেকফাস্ট অথবা পিজ্জা আর প্রিয় পানীয় নিয়ে সময় কাটান। এরপর বিচে সান-বাঘরত অথবা সাঁতারে মত্ত সুন্দরীর দিকে "কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি' দৃষ্টি না হেনে নেমে পড়ুন জলে। বিকালের দিকে সানসেটের সময় সমুদ্রের রূপ বর্ণনা করার সাধ্য এই অধমের নেই, তবে বঙ্কিমবাবু আগেই কপালকুণ্ডলায় এর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন 'যেদিকেই চোখ যায়, অনন্ত জলরাশি চঞ্চলরবিরশ্মিমালাপ্রদীপ্ত হইয়া গগনপ্রান্তে গগনসহিত মিশিয়াছে'। যাই হোক, সন্ধ্যায় খিদেটা চাগাড় দিলে পালোলেম বিচেই 'দ্রোপদী' তে ডিনারটা সেরে নিতেই পারেন। বিচসাইডে টেবিল পেতে ক্যান্ডেল-লাইট ডিনারও কিন্তু বেশ রোম্যান্টিক হয়।পরদিন ভোরবেলা উঠে আগে থেকে বুক করে রাখা বোটে বাটারফ্লাই বিচ, হানিমুন আইল্যান্ড সব ঘুরে খেয়ে দেয়ে আগোন্ডা বিচ, কোলা বিচ, কাবো দে রামা ফোর্ট আর স্পেশালি নারকেল গাছে ঘেরা পেবল বিচ এসব ঘুরে হোটেলে ফিরে আসুন বা ট্রেন/ফ্লাইট ধরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসুন। ফেরার আগে Fisherman's Wharf এ সি-ফুড দিয়ে লাঞ্চ কিন্তু জমে যাবে।

অনেক গল্প হলো, এবার আসি গোয়ার কিছু বিখ্যাত রান্নার কথায়। পর্তুগিজ কুইজিন থেকে ডিরেক্ট নেওয়া বা একটু রদবদল করে নেওয়া প্রচুর খাবার রয়েছে গোয়াতে-সেটা স্টার্টার হোক, ড্রিংকস হোক, মেন কোর্স হোক কি ডেজার্ট। এদের মধ্যে Vindaloo, Sorpotel, Xacuti, Balchao, Cafreal, Feijoada, Serradura ইত্যাদি বেশ উল্লেখযোগ্য। সাথে যেটা না বললেই নয়, তা হলো গোয়ার বান বা ব্রেড কালচার। গোয়ান বেকারি বেশ বিখ্যাত, আর তার সাথে বেশ কিছু ব্রেড বা বান এক আলাদাই মাত্রা জুড়ে দিয়েছে। সাধারণ পাও বা কাটরে পাও, পোই, উনো, সান্না ইত্যাদি বেশ বিখ্যাত। গোয়ায় বেশ কিছু ঘরোয়া বেকারি রয়েছে যাদের বলা হয় 'Poder", এরা সকাল সকাল বেতের টুকরিতে ব্রেড সাজিয়ে ভেঁপু বাজিয়ে বিকিকিনিতে বের হন আর সেই আওয়াজে গৃহকর্তা/কর্ত্রী বেরিয়ে এসে প্রয়োজন মতো রসদ যোগাড় করে নেন নেন।

আসুন বেশ কিছু স্পেশাল গোয়ান ডিশ ঘেঁটে দেখা যাক:-

Xacuti: বলা হয় পারনেম তালুকের হারমাল অঞ্চলে (অধুনা আরামবোল) স্থানীয় মৎস্যজীবীদের হাতে এর উৎপত্তি। Xacuti বা Shagoti Masala এই পর্তুগিজ প্রভাবিত রেসিপির জান। বিভিন্ন সুগন্ধী গোটা গরম মশলা, পোস্ত, শুকনো লঙ্কা, পেঁয়াজ, নারকেল একসাথে রোস্ট করে মশলাটা বানানো হয়। আর রান্নায় থাকে নারেকেলের দুধ। খেতে জাস্ট অসাধারণ। গোয়ায় ভালো Xacuti এর সন্ধানে চলে যেতেই পারেন পানাজি হেড পোস্ট অফিসের কাছে Ashok Bar and Restaurant এ। অসাধারণ একটা পাড়ায় দোকানটা। ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা-ঘাট আর পুরো ইউরোপীয় ঢঙে সাজানো, চোখের

আরাম বললে ভুল কিছু হবে না। এখানে পাওয়া যায় মাত্র দুটোই ডিশ। স্রেফ Chicken আর Mutton Xacuti, আর কিছু না। তবে Xacuti এর সাথে খাওয়ার জন্য পেয়ে যাবেন বিখ্যাত গোয়ান ব্রেড উনো (Unndo/Oondo) আর গলা ভেজানোর জন্য সুরার ব্যবস্থাও আছে। বর্তমান মালিক বল্লভ নারভেকর-এর সাথে কথা বললে জানতে পারবেন দোকানটি রয়েছে প্রায় 1969-70 সাল থেকে আর তখন থেকেই মাত্র দুটোই আইটেম পাওয়া যায়। গ্রেভিতে পেঁয়াজ লাচ্ছা আর লেবুর রস ছড়িয়ে ব্রেড ছিঁড়ে গ্রেভিতে ডুবিয়ে খাওয়াই হলো এর রেওয়াজ। উনো ব্রেডটাও সুন্দর, বাইরেটা শক্ত আর ভেতরটা তুলতুলে। গোয়ায় গেলে এ জিনিস খেতে ভুলবেন না যেন।

Vindaloo: ভিন্দালুর বেস গ্রেভি অনেকটা আচারের মতো। এর উৎপত্তি প্রায় হারিয়ে যাওয়া পর্তুগিজ রেসিপি "Carne de vinha d'alhos' থেকে, যেখানে 'Came' মানে 'মিট বা মাংস', 'Vinha' মানে 'মদ বা ওয়াইন' আর 'Alho" মানে 'রসুন'। ভিন্দালুর প্রচুর রেসিপি আপনারা পেয়ে যাবেন, তবে মূল রেসিপিটি প্রায় আর্কাইভাল। এই রেসিপি লিখিত ভাবে নথিভুক্ত নয়, জেনারেশনের পর জেনারেশন মুখে মুখে চলে এসে এখন সময়ের সাথে লুপ্তপ্রায়। তবে যেটুকু জানা যায় তার মূল উপকরণ- সল্টেড পর্ক, রক সল্ট, সবুজ তেজপাতা, বার্ড আই চিলি,শ্যালট, ব্রাউন সুগার, ৬-৭ মাস পুরনো টোডি ভিনিগার বা পাম ভিনিগার, রেড ওয়াইন ভিনিগার। রান্নাটি হতো মাটির বাসনে আর মূলতঃ যাওয়া হতো গোয়ান ব্রেড 'পোই" (Poie) এর সাথে।

Apa De Camarao: গোয়ার বিখ্যাত ও প্রায় লুপ্ত এক "Prawn Pie" রেসিপি। বেশ শ্রমসাধ্য রেসিপি, উৎসবে অনেক মানুষ এক জায়গায় হলে সবাই মিলে বানানো হতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে এর দেখা পাওয়াই ভার। এই রান্নায় ব্যবহৃত হয় মাটির তৈরী গোয়ান ওভেন যার ওপর ও নীচে নারকেল ছোবড়া ও শুকনো নারকেল পাতা দিয়ে আঁচ দেওয়া হয়। সাথে দেখা যায় গোয়ার বিখ্যাত রিচার্ড রিচাডো মশালার (Rechad/Recheado Masala) ব্যবহার যেটা জল ছাড়াই শুকনো লঙ্কা, গোয়ান ভিনিগার, বিভিন্ন মশলা, আদা- রসুন সব মিশিয়ে গ্রাইন্ড করে বানানো হয়। Apa de camarao এর জন্য পাথরের শিলনোড়ায় টোডি ভিনিগার মিশিয়ে ওভারনাইট ভিজিয়ে রাখা চাল ও নারকেল বেটে ডিমের কুসুমের সাথে মেখে ফার্মেন্ট করার জন্য কিছুক্ষণ রেখে দেওয়া হয়। এরপর একটা প্রিসড মোল্ডে অল্প ব্যাটার বেক করে একটা লেয়ার করে তার ওপর পেঁয়াজ, রিচাডো মশালায় টস করে নেওয়া প্রণের মিশ্রণটা দিয়ে ওপর থেকে আর একটু ব্যাটার দিয়ে বেক করে নেওয়া হয়।

Cafreal: পর্তুগিজদের সাথে সুদূর মোজাম্বিক থেকে গোয়ায় আগমন এই কাফ্রিয়ালের। দেখলে মনে হবে যেন বাঙালী বাড়ির ধনেপাতা-কাঁচালঙ্কা মুরগি। ধনেপাতা, পুদিনা, জিরে, গোলমরিচ, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, আদা-রসুন, অল্প পেঁয়াজ, গোয়ান ভিনিগার মিশিয়ে কাফ্রিয়াল মশালাটা বানানো হয়। এরপর চিকেনে মশলা মাখিয়ে হয় গ্রিল করে নেওয়া হয় নয়তো গ্রেভি বানিয়ে নেওয়া হয়।

Cavala De Forno: বলা হয় এটি প্রায় ৫০০ বছরেরও পুরনো রেসিপি। ম্যাকারেল জাতীয় মাছ বা Bangda কে রক সল্ট, লেবু, লঙ্কা দিয়ে ম্যারিনেট করে খড়ের আগুনে কুলো জাতীয় জিনিস দিয়ে হাওয়া করে করে আঁচ বাড়িয়ে বেক করে নেওয়া হয়। কথিত আছে চাষীরা ক্ষেত থেকে ফেরার সময় দুপেগ মদের সাথে এই পোড়ানো মাছ খেয়ে তবে ফিরতেন।

Fish Rava Fry: কোঙ্কণে বেশ চালু রেসিপি এটা। খুব সামান্য ম্যারিনেশনে মাছ জারিয়ে সুজিতে কোট করে মুচমুচে করে ভাজা। গোয়ায় বিপিনবাবুর কারণসুধার সাথে কিং/চনক ফিশ রাওয়া ফ্রাই বা প্রণ তাওয়া মশালা আপনি যত্রতত্র দেখতে পাবেন। সমুদ্রের ধারের স্যাকে এ জাতীয় খাদ্য ও পানীয় নিয়ে প্রকৃতির মাঝে বসে রাজা-উজির মারতে মন্দ লাগে না।

Serradura: পর্তুগিজ প্রভাবিত ডেজার্ট। মেরি বিস্কুটের গুঁড়োর বেসের ওপর কনডেন্সড মিল্ক মেশানো হুইপড ক্রিম দিয়ে চিলড সার্ভ করা হয়। এমন টেক্সচারের জন্য একে Sawdust Pudding ও বলা যায়। খেতে দুর্ধর্ষ আর সহজেই বাড়িতে বানানো যায়।Bebinca: এই লেয়ারড ডেজার্টেরও আগমন পর্তুগিজদের হাত ধরে। ময়দা, চিনি, ডিমের কুসুম, বাটার, নারকেলের দুধ দিয়ে বানানো বিবিঙ্কা সত্যিই বেশ খেতে। গোয়া গেলে পাঞ্জিমে Mr Baker 1922 থেকে ট্রাডিশনাল উড-ফায়ারড বিবিঙ্কা খেয়ে দেখতে পারেন। সাথে এখানে গোয়ান Batica কেক, Bolinhas Cookies, বিভিন্ন বেকরি আইটেম আর গোয়ান মিষ্টি Doce ও পেয়ে যাবেন।

সব লিখতে গেলে লেখা শেষ হবে না। বিডসের মতো দেখতে গোয়ান সসেজ Chorizo, মাছের ডিমের Gaboli Fry থেকে শুরু করে Beef Roast Tongue (Lingua Assado) বা ক্রোকেটস, চিংড়ি মাছের Prawn Baichao-সব জায়গায় গোয়া ভারতীয় কুইজিনে একটা স্বতন্ত্র ছাপ ছেড়ে গেছে।

যাই হোক, লেখা আর বাড়াবো না। তবে হ্যাঁ, সোনালী তরলের প্রভাবে সি-বিচে কোন স্বর্ণকেশী দীর্ঘাঙ্গীর চকিত হরিণী চাহনিতে কুপোকাত হয়ে 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী' গুনগুন করে উঠলে যদি চপেটাঘাতের শিকার হন, তবে কিন্তু লেখক বা ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ মোটেই দায়ী থাকবেন না।

পুনশ্চ: মজা করে ঘুরুন। সতর্ক ভাবে মদ্যপান করুন, স্পেশালি নিজে গাড়ি বা স্কুটি চালালে অথবা সমুদ্রে নামলে তো বটেই। আর হ্যাঁ, দয়া করে সমুদ্রের ধারে বোতল, প্লাস্টিক ফেলবেন না, নির্দিষ্ট ডাস্টবিন ব্যবহার করুন। আসুন, সবাই মিলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটা আর একটু বাস-যোগ্য করে তোলা যাক।

অলমিতি..

Archive

Most Popular