31st Jan 2025

Highlights :

www.rojkarananya.com news

ভূতেরা কি বোরোলি ভালবাসে না?

31st Dec 2024

সাহিত্য

কমলেন্দু সরকার


আমি কোনওদিন শুনিনি ভূতেরা কোনওদিন কোনও বোরোলি মাছওয়ালার পিছু নিয়েছেন। এক সাহিত্যিক শেখর বসুর একটি ছোট গল্পে পড়েছিলাম ভূতেরা চাউমিন ভালবাসে। গ্রামেগঞ্জে তো এখনও মেছোভূত পিছু নেয়। আমি এই শহর কলকাতায় থাকা শিক্ষিত মানুষকে জানি, তিনি রাত্রিবেলা মাছ কেনেন না। অথচ তিনি থাকেন বিলাসবহুল এক আবাসনে। তিনি নাকি শুনেছিলেন, যে-জায়গায় আবাসনটি সেটি নাকি ভূতেদের কলোনি ছিল। তাই ভদ্রলোকের মত ছিল দুএক পিস ভূত কী অবশিষ্ট নেই! নিশ্চয়ই আছে। কাছেই ভেড়ি ছিল মেছোভূতও ছিল।

তবে কলকাতা শহরে বোরোলি মাছ আর কোথায় পাবে ভূতেরা! বোরোলি ভালবাসে এমন ভূতের খোঁজে যেতে হবে উত্তরবঙ্গে। ইলিশ মাছ ভূতেরা সবচেয়ে ভালবাসে। আধা শহর বা মফসসলে বাজার থেকে যদি কিছুটা হাঁটাপথে বাজার হয় তাহলে অন্ধকার পথে ইলিশভূত পিছুনে পড়ে যায়। সেইজন্য রাত্রি বাড়ি ফিরে বহুরকম বিধিনিষেধ মেনে মাছ খেতে হয়। পকেটে তুলসীপাতা নিয়ে যেতে হয় আর হোমিওপ্যাথির শিশিতে গঙ্গাজল। তারপর বাড়ি ফিরে একটি টুকরো ভূতেদের উদ্দেশে ছুড়ে দিতে অন্ধকারে। এতসব কথা বোরোলির ক্ষেত্রে শুনিনি। 

বরোলি শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের তিস্তা-তোর্যায় পাওয়া যায়। আমাদের যদি জলের রুপোলি ইলিশ হয়, তাহলে উত্তরবঙ্গের বোরোলি।

উত্তরবঙ্গে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘা, গরুমারা, চাপড়ামারি ইত্যাদি অভয়ারণ্য, দার্জিলিং বা চা-বাগানের টানে ছুটে চলি। এখন কত কত জায়গা হোমস্টের সুবাদে নতুন নতুন জায়গা চোখ মেলছে, পরিচিতি বাড়ছে, কিন্তু কজন আমরা বোরোলি মাছের টানে যাই! যিনি একবার খাবেন বা খেয়েছেন তিনি বোরোলি মাছের স্বাদ না-নিয়ে আসবেন না। সেই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলতে হবে, এ স্বাদের ভাগ হবে না। সে প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এমনকী কট্টর নিরামিষাশী শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও বোরোলির গুণগান করতে ছাড়েননি। তিনি বলেছিলেন, উত্তরবঙ্গের কথা বললেই বোরোলির কথা মনে পড়ে। সর্ষে দিয়ে বোরোলির পাতুরি কিংবা কাঁচালঙ্কা দিয়ে সবজে রঙের ঝোলও দারুণ! উত্তরবঙ্গের বাসিন্দারা বলেন, নদীর রুপোলি শস্য-বোরোলি। অনেকেই ভালবেসে বলেন তিস্তার ইলিশ। অথচ মাছটি খুব বড় হলে সাড়ে তিন-চার ইঞ্চি। ছ ইঞ্চি বোরোলিও দেখেছি। তাতেই স্বাদে মাতে আম বাঙালি।

কোনও সন্দেহ নেই বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশ। মৎস্যপ্রিয় বাঙালি অনেকেরই মত ইলিশকে ছাপিয়ে বেশকিছু মাছ টেক্কা মারতে পারে। কিন্তু প্রচারের কারণে কুলীন হতে পারেনি। এই তো উত্তরবঙ্গের বোরোলি ইলিশ ফেলে খাবেন। আমার ব্যক্তিগত মত, উত্তরবঙ্গের বাইরে এল না বলে বোরোলি জাতে উঠল না। স্বাদের জাদুতে বোরোলি অতুলনীয়! উত্তরবঙ্গে জামাই আদর পায় বোরোলি।

কিছু রেসিপি থাক বোরোলির।      

১। বোরোলি মাছের তরকারি 

আঙুল চাটবেন বোরোলি মাছের তরকারি খেলে। অসাধারণ সুস্বাদু একটি পদ। কীকী লাগবে: পিঁয়াজবাটা, টম্যাটোবাটা, হলুদগুঁড়ো, জিরেরগুঁড়ো জিরে, তেল, নুন স্বাদমতো।

২। বোরোলি মাছের ঝোল

অনেকে আবার পছন্দ করেন বোরোলি মাছের ঝোল। বোরোলি মাছের ঝোল রান্নতেও কোনও হ্যাপাও নেই। কী কী লাগবে: বোরোলি মাছ, কালোজিরা, নুন, হলুদগুঁড়ো, ধনেপাতাকুচি, তেল,  কাঁচালঙ্কা।

৩। বোরোলি মাছের পাতুরি

ভেটকির পাতুরির কথা আমাদের সকলের জানা, তা বলে চার ইঞ্চি বোরোলির পাতুরি। চার ইঞ্চি বলে অতটা ঠাট্টা করবেন না। খেতে কিন্তু অত্যন্ত সুস্বাদু। তবে বোরোলির পাতুরি ততটা জনপ্রিয় নয়। তার কারণ রান্না করতে সময় লাগে বেশি। কষিয়ে কষিয়ে রান্না কতে হয়। কী কী লাগবে: বোরোলি মাছ, পেঁয়াজকুচি, কাঁচালঙ্কা, সর্ষে, পোস্ত একসঙ্গে বাটা, সর্ষের তেল, ধনেপাতাকুচি, হলুদগুঁড়ো।

৪। বোরোলি মাছের ঝাল

বোরোলি মাছের বেগুন-চচ্চড়ি। শীতকালে বেগুনের দাম অনেকটাই সস্তা হয় তাই এটি শীতকালে সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয়ে থাকে।

কী কী লাগবে: মাছ, আলু পেঁয়াজকুচি, টম্যাটো কুচি, কাঁচলঙ্কাবাটা, বেগুন, লম্বা লম্বা করে চেরা গোটা কাঁচালঙ্কা, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো।

৫। বোরোলি মাছের রসা

একথালা ভাত অনায়াসে সাবাড় করে দিতে পারেন বোরোলি রসা পাতে পড়লে। মনে হয়, দুনিয়ায় সবচেয়ে উৎকৃষ্ট খাবার। বোরোলি মাছ, সর্ষের তেল, আলু, বেগুন, টম্যাটো, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, ধনেপাতা।

৬। বোরোলির মুচমুচে ভাজা

চা, কফি থেকে ডাল-ভাতের সবকিছুর পাতিলেবুর রস মেখে খেতে জাস্ট অমৃত।

কী কী লাগবে: বোরোলি মাছ, সর্ষের তেল, হলুদগুঁড়ো, নুন, চাট মশলা।

৭। বোরোলির তেল-ঝাল

বোরোলি মাছের তেল-ঝাল অত্যন্ত সুস্বাদু।

কী কী লাগবে: বোরোলি মাছ, আলু, বেগুন, পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, টম্যাটো, শুকনোলঙ্কা, তেজপাতা।

৮। লা-জবাব পেঁয়াজকল-বোরোলি

পেঁয়াজকলি দিয়ে বোরোলি মাছ স্বাদের অন্যমাত্রা এনে দেয়।

কী কী লাগবে: বোরোলি মাছ, পেঁয়াজকলি, বেগুন, আলু, কালোজিরা, কাঁচালঙ্কাবাটা, চেরা গোটা কাঁচালঙ্কা, হলুদগুঁড়ো।

এবার তিস্তার ধারে গজলডোবা গিয়ে একপ্লেট বোরোলি মাছ ভাজা আর এককাপ কফি খেয়ে সময় কাটালাম বেশ লাগল। তা আমি গল্পগাছা করতে করতে যে দিদি বোরোলি ভাজছিল তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। আপনারা এই যে রাত-বিরেতে বোরোলি মাছ ভাজেন তা মেছো ভূতের উপদ্রব নেই। আমার কথা বলার ধরন এবং বিষয়ে মুখে আঁচল চাপা হাসলেন মহিলাটি। মনে হল, আমি যেন খুব হাসির কথা বলেছি। মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে বললেন, তেমন তো কিছু শুনিনি। আসলে ছোট মাছ তো তাই বুঝি পছন্দ নয় তেনাদের।

Archive

Most Popular