30th Jan 2025
সাহিত্য
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
জীবনের কিছু ঘটনা অলক্ষ্যে কোথাও তৈরি হতে থাকে যার মধ্যে মানুষের কোনও হাত থাকে না। যা কোনও দিন ঘটার কথা ছিল না সেরকমই এক অভিনব ঘটনার মুখোমুখি হঠাৎ এক আন্তরিক সকালে। কাছাকছি একটা বড়ো মাঠে আমার প্রতিদিনের মর্নিংওয়াক। কিছুণ হাঁটাহাঁটির পর ঘরে ফেরা। ফেরার পথে একটা পার্ক আছে-ভিতরে সবুজের রমরমা। কত রকমের গাছ। কত রঙের ফুল। পার্কেও প্রতিদিন ভোরে হাঁটতে থাকেন কিছু সুবেশ নারীপুরুষ, তাঁরা বড়ো মাঠে হাঁটতে না-গিয়ে পছন্দ করেন ছোটো পার্কের স্বল্পপরিসরে হাঁটা।
মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার পথে- পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কখনও চোখ রাখি ভিতরের দৃশ্যে। কেউ একা হনফন করে হাঁটছেন, কেউ-কেউ জোড় বেঁধে গল্পে মত্ত হয়ে। কারও বা হাঁটার কোটা শেষ, পার্কের বেঞ্চিতে বসে গল্পগাছায় ব্যস্ত। কখনও দুদণ্ড দাঁড়িয়ে দেখি পার্কের বাগানের নিত্যনতুন সেজে ওঠা।
এরকমই এক অলৌকিক সকালে মাঠ থেকে অন্যমনস্কভাবে ফিরছি পার্কের পাশ দিয়ে, হঠাৎ পথ অবরোধ করে দাঁড়ায় এক ছ-সাত বছরের বালিকা, কুণ্ঠা-কুণ্ঠা গলায় কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, তুমি কি লেখক?
আমি বিপর্যস্ত এই অভাবিত আত্রমণে। কখনও পথ-চলতি মানুষ এরকমই কাছে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি অমুক? কিন্তু এই বালিকা তো নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য! দাঁড়াতেই হয় অতএব, বলি, তুই কী করে জানলি?
-তা হলে ঠিকই ধরেছি। বইতে তোমার ছবি দেখেছি। আমার এম্মা লাইব্রেরি থেকে মাঝেমাঝে তোমার বই নিয়ে আসে। বইয়ের পিছনদিকে লেখকের ছবি থাকে। তোমাকে এখান দিয়ে রোজ যেতে দেখি, আমার মনে হচ্ছিল ছবিটা তোমারই।
বইয়ের মধ্যে আমার ছবি থাকে সে-তথ্য ঠিক, কিন্তু সেই ছবি দেখে আমাকে চিনে রেখেছে এতটুকু মেয়ে! তা হলে তো তার সঙ্গে একটু আলাপ জমাতেই হয়, জিজ্ঞাসা করি, কী নাম তোর? -বাড়িতে সবাই আমাকে সোনু বলে ডকে। আমার একটা ভালো নাম আছে, অভিদত্তা। -বেশ অন্যরকম নাম তো! অভিদত্তা।
-আসলে কী জানো, আমার বাবার নাম অভীক, মায়ের নাম সোমদত্তা। দুটো নমের অর্ধেক অর্ধেক নিয়ে অভিদত্তা।
-চমৎকার। আমি তার পিঠে হাত রেখে বলি, বেশ, তুই আজ থেকে আমার একটা ছোট্ট বন্ধু। সোনুর সঙ্গে ভাব পাতিয়ে, তার সঙ্গে করমর্দন করে ফিরে আসি ঘরে। মনের আয়নায় বারবার ভেসে ওঠে হাসি-হাসি ছোট্ট মুখখানা। তার কথাগুলো বাজতে থাকে টুংটাং শব্দের মতো।
তার পরদিন আবার ফিরছি, পার্কের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখি, কালকের মতোই সোনু হাসি- হাসি মুখে দাঁড়িয়ে, গুড মর্নিং।
-ইয়েস, গুড মর্নিং, বলে জিজ্ঞাসা করি, তুই কি রোজই আসিস?
-আসিই তো রোজ। এম্মার সঙ্গে আসি তো।
সোনুর এম্মা কে তা জানা নেই, নিশ্চয় সোনুর অভিভাবক, তিনি না হয় শরীর সুস্থ রাখতে রোজ পার্কে হাঁটতে আসেন, কিন্তু এই ছোট্ট বালিকা রোজ মর্নিং ওয়াক করতে আসে-এ বড়ো বিস্ময়ের কথা। হাসি-হাসি মুখে বলল, এম্মাকে তোমার কথা বলেছি। এম্মা বলছিল তোর সঙ্গে তা হলে লেখকবাবুর বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল!
অতএব এক অদ্ভুত কাকতালের মধ্যে কয়েকদিনের মধ্যে গাঢ় হয়ে ওঠে বন্ধুত্বটা। প্রতিদিন সকালে ঘরে ফেরার পথে দেখি পার্কের গেটে একই রকম হাসকুটি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনু, আমাকে দেখেই একটা লাফ দিয়ে উঠে ছুটে আসে, দুই হাতে আমার হাতদুটো ধরে একনাগাড়ে বলে যাবে গতকাল সারাদিনে তার কী কী অভিজ্ঞতা হয়েছে, কে কী বলেছে, কোথাও গিয়ে থাকলে তার ধারাবিবরণী।
কোনও দিন পার্কের সামনে গিয়ে দেখি সোনু অপোয় নেই, পার্কে তার নানা বয়সি বন্ধু আছে, তাদের কারও না কারও হাত ধরে পার্কের চারপাশে ঘুরছে বড়ো বড়ো পা ফেলে। হঠাৎ দূর থেকে আমাকে দেখে সেই বন্ধুর হাত ছেড়ে একছুট্টে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাজির, বলে, তুমি আজ পাঁচ মিনিট আগে এসে পড়েছ।
কব্জিতে চোখ বুলিয়ে দেখি, সত্যিই তাই, বলি, কী করে বুঝলি?
-এখানে এক চল্লিশ মিনিট দাদু আছেন। তিনি পার্ক ছেড়ে চলে গেলে বুঝি তোমার আসার সময় হয়ে গেছে।
-চল্লিশ মিনিট দাদু?
-হ্যাঁ, উনি ঠিক ঘড়ি ধরে চল্লিশ মিনিট হাটেন। আজ তিনি এখনও বেরোননি। কী আশ্চর্য সোনুর সময়জ্ঞান। আমি ঠিক কখন আসব তা মুখস্থ হয়ে গেছে ওর।
তা যেদিনই একটু আগে আসি, সোনু কারও না কারও হাতে ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে পার্কের ভিতরের বাঁধানো রাস্তা ধরে। হাঁটে, কিন্তু খেয়াল রাখে আমি পার্কের মুখে এসে গেছি কি না! আমাকে দেখতে পেলেই অমনি লাফ দিয়ে ছুটে এসে আমার হাত ধরে তার আগডুম বাগডুম গল্প। তার গল্পের বৈচিত্র্যও অনেক। নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাস সোনুর। কখনও ভূতের গল্প, কখনও ফেয়ারি টেল, কখনও কমিক্সের গল্প। সেই আজগুবি, অলৌকিক অথচ মজার পৃথিবীতে তার অনায়াস আনাগোনা। গল্প বলার ফুরসতে তার অভিব্যত্তিতে ছায়া পড় সেই অলীক পৃথিবীর। আমিও তার রহস্যময় পৃথিবীতে পা রাখে শামিল হই তার ভাবনার সঙ্গে। সোনুর এম্মার সঙ্গে আলাপও হয়ে গেল একদিন। তিনি সোনুর ঠাকমা। টিভি সিরিয়ালের মায়া কাটিয়ে যিনি এখনও গল্পের বইয়ের পাতায় মগ্ন থাকেন নিয়ত। তাঁর হাঁটা শেষ হলে পার্কের একটি নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে থাকেন কিছু। তাঁকে দেখলেই আমি বুঝতে পারি সোনুও এসেছে।
সোনুর সঙ্গে প্রতিদিন এত গল্পগাছা দেখে একদিন সোনুর এম্মা বললেন, আপনারা দুজনে যখন নিবিষ্ট হয়ে কথা বলেন, আমার মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালার গল্পটা। কাবুলিওয়ালা ঠিক এরকমভাবেই মিনির সঙ্গে গল্প করত রোজ। তাই নাকি! বিষয়টা আমার মাথায় আসেনি এতদিন। সোনুর সঙ্গে গল্প করাটা এমনই অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে যে, একদিন সোনু কোনও কারণে পার্কে না এলে কীরকম শূন্য-শূন্য লাগে দিনটা। সোনুর এম্মা বললেন, আজ কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চাইল না। বলল, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। কাল রাতে ঘুমোতে অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল তো।
সোনু ঠিকই তো বলেছে। অতটুকু মেয়ে রোজ ঘুম ভেঙে এত পথ যে আসে সেটাই অবাক কাণ্ড! তার বয়সি ছেলেমেয়েরা কেউ আসতে চাইবে এরকম রোজ রোজ! পরদিন পার্কে দেখা হতে কাঁচুমাচু মুখে সোনু বলে, কাল আসতে পারিনি। এত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম না! তার অপরাধী-অপরাধী মুখে দেখে হেসে পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিই, বলি, ঘুম তো আর টিভির নব নয় যে, ইচ্ছেমতো খুলব বা বন্ধ করব। ঘুম কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
সোনুও হেসে উঠে বলল, ঠিক বলেছ। তারপর যথারীতি তার সারাদিনের রোজনামচা।
কদিন পরে পার্কের সামনে এসে দেখি সোনু নেই। নিশ্চয়ই আজও ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমর্ষ মুখে ফিরে আসছি, হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে লাফিয়ে এসে আমার হাত ধরে ঝুলে পড়ে। দেখি সোনুর মুখে দুষ্টুমির হাসি। বলি, কী রে তুই কোথায় ছিলি?
সোনু হেসে গড়িয়ে পড়ে, বলল, তোমার ঠিক পিছনেই লুকিয়ে ছিলাম। দেখছিলাম তুমি আমাকে খুঁজে পাও কি না!
হেসে উঠে বলি, বাহ, বেশ দুষ্টু তো তুই!
এই লুকোচুরি খেলায় সোনু এতটাই মজা পেল যে, মাঝেমধ্যেই পার্কের এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকে, আর আমাকে পার্কে ঢুকে এ-ঝোপে ও-ঝোপে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বার করতে হয় তাকে। আমিও বেশ মজা পাই তার এই দুষ্টুমির খেলায়। কোনওদিন কামিনীগাছের ঝোপের আড়ালে, কোনওদিন পামগাছের আড়ালে, কোনওদিন- তার মধ্যে হঠাৎ একদিন দেখি সোনুর এম্মা আসেননি। বেঞ্চিটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ চোখ চালিয়ে সোনুকে না-দেখে ফিরে আসি বাড়িতে। কিছুণ পরেই মোবাইলে ফোন। সুইচ অন করতেই ওদিকে নারীকণ্ঠ, আমি সোনুর এম্মা বলছি। আপনি আজ মর্নিং ওয়াকে যাননি?
-হ্যাঁ। গিয়েছিলাম তো।
-এই রে। আসার সময় আপনি সোনুর সঙ্গে দেখা না-করেই চলে এসেছেন! অবাক হয়ে বলি, সোনু কি আজ পার্কে ছিল? আমি তো চোখ চালিয়ে খুঁজলাম ওকে। কোথাও দেখতে পাইনি তো! আপনাকেও দেখতি পাইনি। ভাবলাম আজ আপনারা আসেননি!
- কিন্তু কী মুশকিল হয়েছে জানেন? আমি একটু সময়ের জন্য পাশের আশ্রমে গিয়েছিলাম। সোনু আমার সঙ্গে যায়নি। দূরের একেটা বেঞ্চে একা বসেছিল পাছে আপনি ওকে না- পেয়ে চলে যান।
-সে কী! আমি তো আপনাদের দুজনের কাউকে দেখতে না-পেয়ে ভাবলাম আজ আসেননি।
-সোনু আপনার জন্যই বসেছিল। আপনাকে ও দেখতে পেয়েছে দূর থেকে। ছুটে এসেওছিল গেট পর্যন্ত। আপনাকে অনেকবার ডেকেছে, কিন্তু আপনি শুনতে পাননি। আমি এসে দেখি বেঞ্চিতে বসে হাপুশ নয়ন কাঁদছে একা-একা।
-সে কী! আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি, নিশ্চয় গাড়ির আওয়াজে ওর কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছোয়নি আমার!
-খুব অভিমান হয়েছে ওর। বাড়িতে এসেও কেঁদে ভাসাচ্ছে, কিছুতেই শান্ত করতে পারছি মা! বলছে আর কোনও দিন আপনার সঙ্গে কথা বলবে না!
আমার উত্তরোত্তর বিস্ময়, ব্যস্ত হয়ে বলি, ফোনটা ওকে দিন। আমি দেখি ওর রাগ ভাঙাতে পারি কিনা!
তার পরের দশ মিনিট চলল এক খুদে অভিমানিনীর সঙ্গে কথোপকথন। তখনও হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে আর বলছে, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। তোমার সঙ্গে আমার আড়ি আড়ি আড়ি। অমি তাকে ক্রমাগত বোঝাতে চাইছি কীভাবে ঘটল এই ভুল-বোঝাবুঝি। কিন্তু একজন তরুণী বা যুবতীকে যত সহজে বোঝানো যায়, একটি বালিকাকে বোঝানো তার চেয়ে ঢের ঢের দুরূহ।
অনেক পরে ফোনের মধ্যে মুখে হাসি ফোটাতে সম হলে বলল, কাল রবিবার। একটু বেশি সময় নিয়ে আসবে। দুদিনের গল্প একদিনে শুনতে হবে।
বললাম, নিশ্চয়ই। তুই আমাকে ফাইন করে দে।
পরের দিন একটি চকোলেট পকেটে নিয়ে গিয়ে তাকে খুশি করার চেষ্টা করি। কিন্তু ভবি কি অত সহজে ভোলে! বহুণ রাগ দেখানোর পর বলল, এম্মা আমাকে আশ্রমে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তুমি আমাকে না দেখতে পেলে দুঃখ পাবে বলে আমি একা বসেছিলাম তোমার জন্য। আর তুমি আমাকে-আবার অভিমান ভরে এল তার গলায়।
-ঠিক আছে, এর পর থেকে তোকে না দেখতে পেলে আমি সারা পার্ক তন্নতন্ন করে খুঁজব। দরকার হরলে পাম গাছটা বেয়ে উপরে উঠে পাতার ঝোপের মধ্যে খুঁজব।
শেষ কথাটা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল সোনু-বিষয়টির মধ্যে যে অসম্ভব মজা লুকিয়ে আছে তাই বুঝতে পেরে। ব্যস, অমনি আমাকে মা করে দিল। তার পরদিন থেকে আর ভুল হয় না। হঠাৎ একদিন আমার পায়ে ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, আজ আমার জন্মদিন।
তাই! সোনু আজ বেশ সুন্দর করে সেজে এসেছে। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে, জংলা ছাপা নতুন একটা লং স্কার্ট পরে। হাতে একটা ছোটো ব্যাগ।
হাতের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিয়ে বলল, রিটার্ন গিফট। -তা হলে তো আজ একটা সুন্দর দিন। বাড়িতে খুব খাওয়াদাওয়া হবে নিশ্চয়! কিন্তু গিফট-ই দিলাম না। তার আগেই রিটার্ন গিফট!
-জানো, কাল রাতে আমি আর মা মিলে অনেকগুলো প্যাকেট বানিয়েছি। পার্কে আমার তো অনেক বন্ধু।
সোনুর জন্য কী গিফট দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসি। বই পড়তে ভালোবাসে, বই দেওয়াটাই শ্রেষ্ঠ উপহার। পরের দিন বইয়ের সঙ্গে নিলাম একটা ডায়েরি আর পেন। বললাম, এই ডায়েরিটায় রোজ কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করবি।
সোনু খুব সিরিয়াস হয়ে বলল, আমি কি তোমার মতো লিখতে পারি?
-তুই লিখবি তোর মতো। যা মনে আসে। এই তো সেদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে ডুয়ার্স ঘুরে এলি। সেই ভ্রমণটা লিখে ফেল। লিখে আমাকে দেখাবি।
কঠিন সমস্যায় পড়ল সোনু। দিন তিনেক পরে ডায়েরিটা নিয়ে পার্কে এল, বলল, লিখেছি।
-বাহ। গুড গার্ল। কই দেখি কী লিখেছিস।
সোনু কাঁচুমাচু মুখে বলল, আমি কিন্তু ইংরেজিতে লিখেছি। ইংরেজিতে লিখতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
-ঠিক আছে, যা লিখতে ভালো লাগে, সেটা লেখাই ভালো। দেখি কী লিখেছিস?
ডায়েরি খুলে পড়ে দেখি, বেশ গুছিয়ে লিখেছে ডুয়ার্সের নানা অভিনব অভিজ্ঞতা। ময়ূরের সঙ্গে ভাব হওয়া, হাতির দলের উদ্দেশেটা টা করা, রাতে একটা ভয়ংকর আওয়াজ শোনা, সেটা বাঘের কিনা কে জানে। তার মা একটা বড়ো মাপের স্কুলে ইংরেজির শিকা। অতএব সোনুও যে ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ হবে তাতে অবাক হওয়ার কী আছে! বললাম, যখনই সময় পাবি, কিছু না কিছু লিখবি। কিছুদিনের মধ্যেই সোনুর ডায়েরি ভরে ওঠে নানা ধরনের লেখায়। একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরে এল পুরী থেকে। আসার সময় আমার জন্য একটা উপহার। স্থানীয় কারিগরদের তৈরি হস্তশিল্প। বেশ খুশি-খুশি লাগল। ছোট্ট মেয়েটা বাইরে বেড়াতে গিয়ে আমার কথা মনে রেখেছে, মা-বাবাকে বলে কিনে এনেছে সুন্দর কারুকাজ। বাড়িতে এনে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখলাম সোনুর দেওয়া উপহার।
বছর আমরাও ঘুরতে গেলাম কেরালায়। প্রচুর সমুদ্র, অজস্র ব্যাক-ওয়াটার, আর মশলাপাতির বাগান আর দোকান দেখে ফেরার পথে ভাবলাম সোনুর জন্য কিছু উপহার কিনতে হবে। কোভালাম- এর সাজানো শোরুমগুলি খুঁজে কী-কিনব কী-কিনব ভাবতে ভাবতে কিনে ফেললাম একটা সালঙ্কারা হাতি। র্যাকে রাখার মতো। তবু মনে খুঁতখুঁত, কী জানি পছন্দ হবে কি না সোনুর!
হাতিটি কিনে মোবাইলে জানিয়েও দিলাম, তোর জন্য একটা হাতি কিনেছি।
সোনু উচ্ছ্বসিত, তাই! কী মজা!
পরদিন তার এম্মার কাছ থেকে একটা প্রতিত্রিয়াও পেলাম, জানেন, আপনি হাতি আনছেন শুনে সোনু কাল সারা রাত ঘুমোয়নি। বিস্মিত হয়ে বলি, সে কী, কেন? এম্মার পরবর্তী উত্তর পেয়ে আমি স্তম্ভিত। বললেন, সোনুর এখন অনেক চিন্তা। প্রথমত, হাতিটাকে নিয়ে আপনি কীসে আসবেন! ট্রেনে, না প্লেনে! প্লেনে নিশ্চয় হাতিটাকে নেবে না, তাতে প্লেন ভেঙে পড়তে পারে। তা হলে নিশ্চয় ট্রেনে করে আনবেন। কিন্তু হাওড়া স্টেশন থেকে বেহালা পর্যন্ত কীভাবে নিয়ে আসবেন! কোনও বাসে তো ধরবেই না। তা হলে হেঁটে আসতে হবে। তারপর এ-বাড়িতে কোন ঘর হাতিটার জন্য বরাদ্দ করা হবে। সবচেয়ে বড়ো ঘরটা ছাড়তেই হবে হাতিটাকে। তার পরের প্রশ্ন, হাতি কী খায়! হাতি আস্ত আস্ত কলাগাছ খায় শুনে সোনুর আরও চিন্তা। বাজারে কি কলাগাছ কিনতে পাওয়া যায়! না পাওয়া গেলে কোথা থেকে রোজ কলাগাছ কিনে আনা হবে। ওর মা বলেছে, তা হলে বাড়ির পিছনে যে কিছুটা ফাঁকা জমি আছে সেখানে কয়েক ঝাড় কলাগাছ পুতে দেবে, তা হলে আর হাতির খাবার নিয়ে কোনও ভাবনা থাকবে না। বুঝলেন, সোনু যত প্রশ্ন করছে, ওর মা দুষ্টুমি করে আরও উসকে দিচ্ছে ওকে। ভোরে উঠে কী উত্তেজনা ওর। ওর মা বলছে, এখন ওর ভুল ভাঙিয়ে কাজ নেই।
আমি বেশ হতচকিত।
কলকাত ফিরে পরদিন পার্কের সামনে পৌঁছোতে ছুটে এল সোনু। আমার আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে হাতিটা কোথায়! আমি পার্কের একটা বেঞ্চিতে বসে যখন হাতের ব্যাগ থেকে হাতিটা বার করলাম-সোনুর মুখভঙ্গি দেখার মতো। একবার হাতিটার দিকে তাকায়, একবার আমার মুখের দিকে। তার স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর্যায়গুলি একেবারে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে রাখার মতো।
আস্তে আস্তে বাস্তবে পা রাখার মুহূর্তে সে হঠাৎ হাতিটাকে কোলে তুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল ফিক করে। আমিও তখন হাসছি। সোনু হাসি-হাসি মুখ করে বলল, কী সুন্দর দেখতে হাতিটকে। আমার পড়ার টেবিলে রেখে দেব ওকে।
ততক্ষণে সোনু বুঝতে পেরেছে তার মায়ের দুষ্টুমির কথাও। বলল, বুঝলে, মা কদিন ধরে আমার সঙ্গে এত মজা করেছে, আমি সত্যিটা বুঝতেই পারিনি!
হাতির এপিসোডটা সোনুকে এক লাফে অনেকটাই বড়ো করে দিল। এ মে বুঝতে শিখল তার ভাবনার অবাস্তবতা। তবে তার গল্পের ঝুলি রোজই উপুড় করে ঢেলে দেয় আমার কাছে।
তার মধ্যে একদিন মন-খারাপ মুখে বলল, জানো, লেখকবাবু, নতুন ক্লাসে উঠে আমার স্কুলের রুটিন বদলে গেছে। এখন আটটার মধ্যে স্কুলে ঢুকতে হবে।
-তাই নাকি!
--হ্যাঁ। আর রোজ আসতে পারব না। শুধু রবিবার-রবিবার। বলি, তা হলে আর কী করা! সপ্তাহে একদিন দেখা হবে।
--হ্যাঁ। সেদিন কিন্তু হাতে বেশি সময় রাখবে। এক সপ্তাহে অনেক গল্প জমে উঠবে। সব গল্প তোমাকে না শোনালে স্বস্তি হয় না আমার। --ঠিক আছে। তাই হবে।
সোনুর সঙ্গে অতএব সপ্তাহে একদিন। সারা সপ্তাহ ধরে কী কী করেছে, কোথায় গিয়েছে তার পাই-টু-পাই বিবরণ আমাকে শুনিয়ে তবে সে নিশ্চিন্ত।
দিন গড়াতে থাকে। একটা করে নতুন ক্লাসে ওঠে, সোনুর পড়াশুনার চাপ বেড়ে যায়, খুব ব্যস্ততা তার। অনেক সময় এমন হচ্ছে, সপ্তাহের একটা দিন- সেই রবিবারেও আসতে পারে তা নয়। স্কুলের পড়াশুনোর পাশাপাশি চলছে তার ছবি আঁকার ক্লাস, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, আরও কত কী! পার্কে না-আসতে পারলেও টেলিফোনে খবর নেয়, কেমন আছো তুমি? জানো মা-বাবার সঙ্গে ঘুরে এলাম ব্যাঙ্কক হয়ে পাটোয়া। কী যে সুন্দর জায়গা।
-তা হলে ডায়েরিতে লিখে রাখ সব। দেরি হলে ভুলে যাবি। পরে পড়ব। মে আরও উঁচু ক্লাসে উঠতে থাকে সোনু, ব্যস্ততা বেড়ে যায় আরও। কত রবিবার পার হয়ে যায়, সোনু আসে না। হঠাৎ একদিন মনে হয় অনেকদিন হয়ে গেল সোনুর সঙ্গে দেখা হয় না, তার টেলিফোনও আসে না আর। একদিন পার্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ভাবি কী জানি সোনু কতটা বড়ো হল! হয়তো অনেকদিন পরে সোনুর সঙ্গে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে ভাবব, এই কি সেই সোনু! সোনুও আমাকে দেখে, কাবুলিয়ালা গল্পের সেই মিনির মতো লজ্জা পেয়ে যাবে হঠাৎ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দেবে।