27th Jan 2025
প্রতিবেদন
সুস্মিতা মিত্র
জগৎ কে ধারণ করেন যিনি, তিনিই জগদ্ধাত্রী। ইনি দেবী দুর্গার অপর রূপ। উপনিষদে তার নাম উমা হৈমবতী। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ যেমন মহিষের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে, জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ দাঁড়ায় হাতির উপরে। সংস্কৃতে হাতির অপর নাম করী। কথিত আছে, দেবী জগদ্ধাত্রী করী বা হস্তিরূপী অসুর করীন্দ্রাসুরকে বধ করেছিলেন, তাই তাঁকে বলা হয় করীন্দ্রাসুরনিসূদিণী। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের মিলিত তেজপুঞ্জ থেকে সিংহবাহিনী, চতুর্ভুজা এই দেবীর জন্ম। জগদ্ধাত্রীর চার হাতের উপরের দুটোয় থাকে চক্র ও শঙ্খ এবং নীচের দুটোতে পঞ্চবাণ ও ধনুক। শাস্ত্র মতে, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে হয় জগদ্ধাত্রীর পুজো। দেবীর এই মূর্তির রূপকল্পনা করেন চৈতন্য-পরবর্তী শাস্ত্রকার কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। মা কালীর মতো জগদ্ধাত্রী মূর্তিরও একটি রূপবর্ণনা তিনি তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে যান। সেই রূপ অনুসারে তৈরি মূর্তির পুজোই হয় বাংলায়।
জগদ্ধাত্রী পূজার নিয়মটি একটু স্বতন্ত্র। দুটি প্রথায় এই পূজা হয়ে থাকে। কেউ কেউ সপ্তমী থেকে নবমী অবধি দুর্গাপূজার ধাঁচে জগদ্ধাত্রী পূজা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ নবমীর দিনই তিন বার পূজার আয়োজন করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করেন। এই পূজার অনেক প্রথাই দুর্গাপূজার অনুরূপ।
চন্দননগরে কীভাবে প্রচলন হলো এই পুজোর?
জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য বিখ্যাত চন্দননগর। চন্দননগরের গঙ্গা পাড়ের প্রথম পুজো চাউলপট্টির জগদ্ধাত্রী পুজো বা আদি মায়ের পুজো। কিন্তু জানেন কি, কীভাবে শুরু হয়েছিল এই পুজো?
লোকমুখে শোনা যায়, তৎকালীন ফরাসিদের দেওয়ান ছিলেন ইন্দ্র নারায়ন চৌধুরী। তিনি ছিলেন আবার নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অক্ষম হলে নবাব রাজাকে বন্দী করে নিয়ে যান। কারাবন্দী থাকার কারণে দুর্গাপুজো করতে পারেননি রাজা। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিজয়া দশমীর দিনে নৌকায় ফেরার পথে তিনি সিংহবাহনা এক দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় পরের মাসের শুক্লা পক্ষের নবমীর তিথির সময় জগদ্ধাত্রী দেবীর পুজোর আয়োজন করার জন্য। সেই মতো চন্দননগরের গঙ্গা পাড়ের নিচুপট্টি, চাউলপট্টি এলাকায় নৌকা থামিয়ে এই পুজোর আয়োজন করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। তাকে সহযোগীতা করেন বন্ধু ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী। অল্প সময়ে মধ্যে পুজো আয়োজন করার জন্য মহিলাদের বাদ দিয়ে চাউলপট্টি এলাকার সমস্ত ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেন পুজোর জন্য। শুরু হয় প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর।প্রথম পুজো থেকেই ওই পুজো সংকল্প হয়ে আসে ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের নামে।আগে তারা এই পুজোয় যোগ দিলেও,এখন আর এই পুজো তে আসেননা তারা।এখনো ইন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি রয়েছে চন্দননগরের সরিষাপাড়ায়।তবে তা জরাজীর্ণ অবস্থায়।সেখানে তার উত্তরসূরিরা বসবাস করেন। শোনা যায় পরের বছর থেকেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেবী প্রতিমার আরাধনা শুরু করেন নিজের রাজ বাড়িতেও।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো:
১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবী প্রতিমার অলংকারসজ্জা।
শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রী পুজো:
এই কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ছিলেন গিরীশচন্দ্র রায়। তিনি নদীয়ার শান্তিপুরের কাছে ১০৮ঘর ব্রাহ্ম পরিবারকে থাকতে দিয়ে একটি গ্রামপত্তন করেন যার নাম “ব্রহ্মশাসন”। তার পর থেকে শুরু হয় শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন। কথিত আছে শান্তিপুরের সূত্রাগড় এর পীরের হাট এলাকায় প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করা হয়েছিল কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের পক্ষ থেকে, সেই কারণে এখনো সেখানে প্রতিটি পূজায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামে সংকল্প করা হয়।
মা সারদার জগদ্ধাত্রী রূপ:
তাঁর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একবার ভাগ্নে হৃদয়কে স্বয়ং শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব বলেছেন, এঁর ভিতর যে আছেন, তিনি ফোঁস করে উঠলে ত্রিভূবনে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। ও সারদা, সাক্ষাৎ স্বরস্বতী। মা নিজের মুখেই তাঁর যে জন্মবৃত্তান্তটি বলেছেন ভক্তদের, আমার মা শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছা হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান। শৌচের কিছুই হলো না, কিন্তু বোধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদরমধ্যে ঢোকায় উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল। বসেই আছেন। তখন মা দেখেন লাল চেলি পরা একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তাঁর কাছে এসে কোমল বাহু দুটি পিঠের দিক থেকে তাঁর গলায় জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমার ঘরে এলাম মা। তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে; তা থেকেই আমার জন্ম। শ্রী মা সারদার জন্মের আগে তাঁর মা শ্যামসুন্দরী দেবী স্বপ্নাদেশ পান। চতুর্ভুজা সিংহবাহিনী দেবী একটি পা তুলে বসে আছেন। শ্যামসুন্দরী দেবীকে আদেশ করেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করার জন্য।
জয়রামবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা:
বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তার জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী। কিংবদন্তি অনুসারে, প্রতি বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। ওইবছর কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুজ্যে চাল নিতে অস্বীকার করেন। নৈবেদ্যদানে অসমর্থ হয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তার স্বপ্নাদেশে ওই চালে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা বন্ধ করে দিতে চাইলে দেবী জগদ্ধাত্রী তাকে স্বপ্নাদেশে পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর প্রথম চার বছর পূজা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে; দ্বিতীয় চার বছর সারদা দেবীর নামে এবং তৃতীয় চার বছর তার কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে। বারো বছর পর সারদা দেবী পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শোনা যায়, এই বারও জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি নিরস্ত হন। বলা হয় দেবী দুর্গার পুনর্জন্ম হয়েছিল মা জগদ্ধাত্রী রূপে। মা সারদা ছিলেন যেন দেবী জগদ্ধাত্রীর পুনর্জন্ম।
তথ্য সূত্র:
Hindu Gods and Goddesses, Swami Harshananda, Sri Ramakrishna Math, Chennai, p. 123
বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সংকলিত ও সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা
প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮
কেন উপনিষদ, তৃতীয়-চতুর্থ খণ্ড
চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজোর বিবরণ ও কয়েকটি ভুল তথ্যের কথা- অধ্যাপক বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়