27th Jan 2025
প্রতিবেদন
সুস্মিতা মিত্র
কল্পতরু অর্থাৎ সেই বৃক্ষ, যার কাছে প্রার্থনা করলে সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়। স্বামী ব্রহ্মানন্দের কথায়, দেবত্ব চাইলে দেবত্ব, পশুত্ব চাইলে পশুত্ব। পুরাণ অনুযায়ী, সমুদ্র মন্থনকালে অমৃত, লক্ষ্মী দেবী, ঐরাবত এবং কৌস্তুভ মনির সঙ্গে উঠে আসে পারিজাত বৃক্ষ। যা পরবর্তীতে দেবরাজ ইন্দ্রের নন্দনকাননের শোভা বর্ধন করেছিল এবং সেখান থেকে স্ত্রী সত্যভামার আবদারে শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে নিয়ে আসেন। মতান্তরে, পাণ্ডবমাতা কুন্তীর চিতাভস্ম থেকে জন্ম নেয় পারিজাত। কল্পতরু, কল্পবৃক্ষ, কল্পদ্রুম বা কল্পপাদপ এর উল্লেখ রয়েছে হিন্দু পুরাণ, আদি সংস্কৃত সাহিত্যে, জৈন ধর্ম গ্রন্থ এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থেও। কথিত আছে, ইন্দ্রের উদ্যানে পাঁচটি কল্পতরু রয়েছে। সেগুলি হল মন্দনা, পারিজাত, সন্তান, কল্পতরু ও হরিচন্দন।
সেই কল্পতরুতে অর্থাৎ সমস্ত ইচ্ছা পূরণের রূপে পরিনত হয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ। সময়টা ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি। এই দিনটি শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর অনুগামীদের জীবনে ছিল এক বিস্ময়কর দিন। তখন ঠাকুর দুরারোগ্য গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এবং তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল খুব দ্রুত। সেই কারণে উত্তর কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলের একটি বাগানবাড়িতে চিকিৎসার সুবিধার জন্য তাঁকে নিয়ে আসা হয়। ১ জানুয়ারি একটু সুস্থ বোধ করায় তিনি বাগানে হাঁটতে বের হন। পরনে লালপেড়ে ধুতি, মাথায় টুপি। একেবারে যেন রাজবেশ! উপস্থিত প্রায় জনা ৩০ গৃহী ভক্ত গাছ থেকে ফুল তুলে এনে ঠাকুরের চরণে অঞ্জলি দিতে থাকেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর অনুগামী নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
ঠাকুর তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার কী মনে হয়, আমি কে? গিরিশচন্দ্র ঘোষ বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ঠাকুর মানবকল্যাণের জন্য মর্ত্যে অবতীর্ণ ঈশ্বরের অবতার। ঠাকুর সেই শুনে বলেন, আমি আর কী বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক। এরপর তিনি সমাধিস্থ হয়ে প্রত্যেক শিষ্যকে স্পর্শ করেন। এবং বারবার বলতে থাকেন তোমাদের চৈতন্য হোক। সেদিন ঠাকুরের স্পর্শে প্রত্যেকের অদ্ভুত এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি হয়েছিল। অর্থ নয়, নাম নয়, যশ নয়, প্রতিপত্তি নয়, ঠাকুর সে দিন চৈতন্য বিতরণ করেছিলেন সবার মাঝে। এতদিন কেবল রামচন্দ্র দত্ত আর গিরীশ ঘোষেরই ঠাকুরের অবতারত্বে বিশ্বাস ছিল। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে এ মুহূর্তে আর কারোরই সন্দেহের অবকাশ রইল না, ঠাকুর আসলে কে। সকলেই এক অপার আধ্যাত্মিকতার সাগরে ডুবে গেলেন। তখন রাম দত্তই ঠাকুরকে, হিন্দু পুরাণে বর্ণিত, কল্পতরু আখ্যা দেন।
ঠাকুর কল্পতরু হয়েছিলেন, আমাদের অন্তরস্থিত চেতনার উন্মীলনের জন্য। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৮৮৬ এ ১৬ অগাস্ট নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন তিনি। তারপর থেকে প্রতিবছর ইংরেজি নববর্ষের প্রথমদিন পালিত হয় কল্পতরু উৎসব। বেলুড় মঠ, কাশীপুর উদ্যান বাটী, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, কামারপুকুরের পাশাপাশি সমস্ত রামকৃষ্ণ মঠ এবং আশ্রমে এইদিন উৎসব পালন করা হয়। মঙ্গলারতি, বিশেষ পুজোপাঠের পাশাপাশি চলে নাম সংকীর্তন। রামকৃষ্ণ মতাদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা মনে করেন কল্পতরু বৃক্ষের মতো ঠাকুরের এই রূপটিকে স্মরণ করে ভক্তরা মনে মনে যা আশা করেন তা পূরণ হয়। মনেপ্রাণে জ্ঞানের বিকাশ হয়। চৈতন্য হয়।