14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

হলুদ পদ্ম

5th Apr 2024

সাহিত্য

অদিতি বসু রায়


হলুদ রঙের পদ্মফুলের কথা আমি প্রথম জানতে পারি, প্রণবকাকার কাছ থেকে।  আমাদের আধা-শহুরে টাউনে হাতেগোনা লোক বেড়াতে যেত তখন।। আমাদের মতো নিম্ন মধবিত্তদের দৌড় ছিল তারাপীঠ, দিঘা খুব বেশি হলে পুরী। প্রণবকাকা যেত লাদাখ, ধর্মশালা, উটি, কিন্নর, আরও কত দূরের জায়গায়। বস্তুত প্রণবকাকার নেশা ছিল ঘুরে বেড়ানো। বিড়ি, চা, সিগারেট, মদ কিছুই ছুঁতো না। ইস্কুলের মাস্টারমশাই ছিল। একা থাকতো। নিজেই রান্না করে খেত। বিয়ে করেনি। মা বলতো, প্রণবকাকা নাকি তার মাসতুতো বোনকে ভালবেসেছিল কলেজে পড়ার সময়। জানতে পেরে, মাসি বাড়ি বয়ে এসে খুব গালিগালাজ করে যাওয়ায় গ্লানিতে প্রণবকাকার মা আত্মহত্যা করে। তারপর থেকেই প্রণবকাকার বাইরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ইস্কুলে পড়াতো বলে ছুটি-ছাটাও পেত। বিশেষ করে গরমের ছুটি এবং পুজোর ছুটিতে। প্রতিবার প্রণবকাকা বাইরে থেকে ফিরে এলে, আমাদের বাড়িতে গল্পের আসর বসতো। অধিকাংশ সময়ে সেটা হত, ইস্কুল খোলার আগের দিন। প্রণবকাকা এসেই হইচই শুরু করে দিত 'বউঠান, আজ রান্নাবান্না রাখুন। সুবীরকে বলে দিন, আজ মোগলাই পরোঠা রাতে। আমি অর্ডার দিয়ে এসেছি বুবু কেবিনে।' আমাদের মফঃস্বলে কোন সেলেব্রেশনই সম্পূর্ণ হতো না মোগলাই পরোঠা ছাড়া। তখন এতো বিরিয়ানির চল ছিল না। রাতের খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যাওয়ায় মা নিশ্চিন্ত হত। আমাদের বাড়িতে অসময়ে আসা অতিথিকে খাওয়ার পাতে কী দিয়ে বসাবেন এই ছিল আমার মায়ের অন্যতম আমার ডাক পড়তো অ্যাই, টুকি, এখানে এসে বস। বইপত্তর বন্ধ করে দে। মানালিতে এবার যা হল উফফ ভাবলে এখনও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে'। আমিও ওমনি লাফিয়ে বই বাক্সে তুলে দিয়ে এসে বসতাম বাইরের ঘরের চৌকিতে।

মা চা বসাতো। বাবাও এসে দ্রুত পোশাক পাল্টে সামনের ঘরে চা নিয়ে এসে বসত। মা সর্ষের তেল, পেঁয়াজকুচি, চানাচুর দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে ঢুকলে, প্রণবকাকা বলে উঠত-  বউঠান, কাঁচালঙ্কা দাও একটা।' জমিয়ে গল্প শুনতাম আমরা। মানালিতে কীভাবে দুই কুলির মারামারির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল কিংবা রাজস্থানে ডাকু মাধো সিংয়ের খপ্পর থেকে কেমন করে রেহাই পেল এইসব আমরা তিন ছাপোষা প্রাণী অবাক হয়ে শুনতাম। কোথায় বালির ওপর উট চলা রাজস্থান কোথায়-বা হিমাচলের চুড়োর মানালি!

আমার 'পথের পাঁচালি'র কথা মনে পড়ে যেত বারবার। সেই যেখানে আছে, সান্যাল মশাই তীর্থ করে ফিরে এসে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় গল্প করতে আসছেন - সেই জায়গাটা আমার প্রতিবারই চোখের সামনে ভেসে উঠতো। আর খুব ইচ্ছে হত - এই বাড়ি, চেনা পাড়া, পরিচিত জনপদ ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে যেতে। আর দূর বলতেই যার কথা মনে আসতো সে হল, পাহাড়। আহা সেই কোন শিশুকাল থেকে পাহাড় আমাকে চুম্বকের মতো টান দিত- একটু বড় হতে, এই পাহাড় যেন হয়ে উঠল এক রহস্যময় পুরুষ, যার প্রতিটি বাঁকে নানা অজানা রং। অবশ্য এই ঘোর থাকেনি খুব বেশিদিন। আমি তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। ভূগোলে অনার্স। প্রণবকাকা খুব উৎসাহ দিয়েছিল ভূগোল পড়ার জন্যে। আমার তখন উত্তরমেরু থেকে দক্ষিণমেরুর স্বপ্ন বাবা, মাও খুব আগ্রহ নিয়ে আমার স্বপ্নের সঙ্গে নিজেদের যোগ করেছিল। দিব্যি চলছিল আমাদের ছোট্ট ইউনিট। তবে
সুখেরও এক্সপায়ারি ডেট থাকে। বাবা এক হেমন্তের রাতে বাড়ি ফিরছিল বাজার করে। দুই হাতে দুটো বড় বড় থলি। তাতে সদ্য ওঠা ফুলকপি, গাজর, কড়াইশুঁটি, নতুন আলু এবং দেশি মুরগি। বাবার তাড়া ছিল- অতো ভারী জিনিস নিয়ে হাঁটা- এর মধ্যেই কখন যে শীতঘুমের অভিসারী সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছে, বুঝতেও পারেনি। সাপও জমে থাকা বিষ উজাড় করে ঘুমাতে ছুটেছে। তারও সময় ছিল না। ফলে বাবা থলি ছুড়ে ফেলে বাড়িতে ঢুকে চিৎকার করে মাকে যখন ডেকেছে, 'শান্তি, কোথায় গেলে? শিগগিরি এসো। আমাকে বোধহয় সাপে কামড় দিয়েছে।' মা ডিম সেদ্ধ বসিয়েছিল সবে। রাতে ডিমের ঝোল আর রুটি করবে। ঠান্ডা পড়লে আমরা সবাই রাতে রুটি খেতে পছন্দ করতাম। বাবার আর্তনাদ শুনে মা কী মনে করে ডিমের পাত্রটা নামিয়ে রেখে ছুটে গেল। আমি টেলিভিশনের ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল খুলে বসেছিলাম। ছুটলাম আমিও। গিয়ে দেখি, বাবার মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরচ্ছে। মা, বাবার মাথাটা কোলে নিয়ে অবিকল সিনেমার মতো বলে চলেছে, 'এ আমার কী সর্বনাশ হল? 'টুকি লোক ডাক।' মায়ের আঁচল মাটিতে লোটাচ্ছে।

বাবার শেষ কাজের আগের দিন, বাবার আপিস থেকে সহকর্মীরা এসে মাকে বাবার
প্রভিডেন্ড ফান্ড ইত্যাদি সব বুঝিয়ে দিয়ে যায়। এছাড়াও মোটা টাকার জীবনবিমা ছিল বাবার। অর্থের অসুবিধা আমাদের সেভাবে হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পরের গরমের ছুটিতে, আমি প্রথম হ্রদ পদ্মের কথা শুনি। প্রণবকাকা সেবার কালিম্পং ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে ইচ্ছেগাঁও বলে একটা পাহাড়ি নিরালা গ্রামে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে বনের মধ্যে, একদিন ট্রেক করতে করতে পথ হারিয়ে, প্রায় বারো ঘণ্টা পায়ে হেঁটে একটা আশ্চর্য সুন্দর হ্রদের কাছে পৌঁছয়। সেখানেই দেখে, হ্রদের জলে হলুদ রঙের পদ্মফুল ফুটে আছে। অনেক কষ্টে লোকালয়ে ফিরে এসে, যখন স্থানীয় বাসিন্দাদের ওই ফুলের কথা জানায়, তারা নাকি প্রণবকাকাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে, বাইরে ওই ফুলের কথা, প্রকাশ না-করতে। কারণ, ওই ফুলই নাকি এই পাহাড়ের দেবী। বাইরের লোকের সামনে ওরা দেবীকে আনতে চায় না। তাছাড়া যারাই ওই ফুলকে স্পর্শ করে, তাদের জীবন পালটে যায় বলে, ওদের বিশ্বাস। প্রণবকাকার ক্যামেরায় আমি সেই হলুদ রঙের পদ্মের ছবি দেখতে গিয়ে দেখি, আসলে তা একটা কুঁড়ি। রঙও ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। অনেকদূর থেকে তোলা বলে হয়তো ছবিটি খুব পরিষ্কার হয়নি। সময় দ্রুত ছুটতে লাগল। আমার কলেজ শেষ হল। যাদবপুরে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে করতে একটা প্রেম হল। ভেঙেও গেল। মা অসুস্থ হয়ে পড়াতে, আমার এক দূর-সম্পর্কের বিধবা পিসি এসে মায়ের সঙ্গে থাকতে লাগল। মায়ের খুব দুরারোগ্য কিছু নয়, ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছিল। 

সেই সঙ্গে হাই ব্লাড প্রেসার। প্রণবকাকাও খুব দেখাশোনা করতো আমাদের। আগের মতো বছরে দু'বার আর বেড়াতেও যেত না, নিয়ম করে। পর্যটকের বয়স ও সক্ষমতা কমে গেলে, সে কিন্তু মনে মনে গ্লোব-ট্রটারই রয়ে যায়। তাই প্রণবকাকা যেখানে যত ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশিত হয়, কিনে পড়তে শুরু করে। তিনটি ট্রাভেল ম্যাগাজিনের সাবস্ক্রাইবার হয় এবং আমাকে সেইসব ম্যাগাজিন থেকে ভাল লাগা লেখাগুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে থাকে। মা'ও দেখি ধীরে ধীরে ওই সব বইয়ের ভক্ত বনে যাচ্ছে। রিসার্চ শুরু করার পর, আমি আর মায়ের পাঠানো টাকা নিতাম না। বরং মায়ের ওষুধ আরো নানা টুকিটাকি কেনার জন্যে খানিক টাকা পাঠাতে শুরু করলাম মাসে মাসে। এই সময়ই, মা একদিন ফোন করল।
-টুকি, কেমন আছিস? - ভাল মা। শুধু কাজের বড্ড চাপ। বাড়ি যাব সামনের মাসে। তোমার শরীর কেমন?

শোন, পুজোর ছুটিতে আমাকে কালিম্পং নিয়ে যাবি এবার?

আমি বেশ অবাক হলাম। বেড়াতে যাওয়ার গল্প পড়লেও, মা এমনিতে ঘরকুনো। তার ওপর এখন এবার বাংলা টিভি সিরিয়ালের নেশায় পেয়েছে। ফলে বাড়ি ছেড়ে বিশেষ নড়তে চায় না। -হঠাৎ কালিম্পং?

-যাবি কিনা বল! -যেতে পারি। তাহলে একটা ডেট জানাও। টিকিট কাটতে হবে তো।
-লক্ষ্মীপুজোর পরের পরের দিন কর। আর শোন, প্রণবদাও আমাদের সঙ্গে যাবেন। আমি বিস্মিত।
-আচ্ছা, তাই হবে। পিসি যাবে না?
না। ঠাকুরঝি, ভাইফোঁটা পর্যন্ত মেয়ের বাড়ি গিয়ে থাকবে।
প্রণবকাকা, মাকে নিয়ে যেদিন এনজেপি স্টেশনে
নামলাম, তখনও আমরা কেউই আন্দাজ করতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে। এনজেপি থেকে কালিম্পং যেতে সময় লাগে ঘণ্টা তিনেক। ধাবাতে রুটি, ডিমের ভুজিয়া আর কফি খেতে আরও মিনিট কুড়ি বেশি লেগে গেল আমাদের। একটা হোমস্টে-তে থাকার ব্যবস্থা।
এনজেপি থেকেই মাকে খুব অন্যমনস্ক লাগছিল।

চারটে কথার একটা উত্তর দিচ্ছে- বেশিরভাগটাই হুঁ-হাঁ করে সেরে ফেলছে। মা ঠিক এরকমটা নয় বলেই অবাক লাগছিল। এতদিন পরে বেড়াতে এসে, আমার নিজের এতো ভাল লাগছিল যে মাকে নিয়ে বেশি ভাবতে পারছিলাম না সেদিন। দু'দিন কালিম্পং-এ ঘুরে ফিরে- গাড়ি ঠিক করে ইচ্ছেগাঁও যাত্রা। ওখানে এখন দুটো-তিনটে হোমস্টে হয়েছে। আমিই ইন্টারনেট থেকে বুকিং করে রেখেছিলাম। এই সময়টায় পুজোর ছুটির জন্য টুরিস্টের চাপ থাকে। মুশকিল হল- প্রণবকাকা তো পথ হারিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে হলুদ পদ্মের হ্রদের কাছে পৌঁছতে পেরেছিল। এবার এসে দেখা গেল- বছর চার-পাঁচের মধ্যে এই গ্রামের ভূগোল খানিক পালটে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, প্রণবকাকা বনের দিকে গিয়েও কিছুতেই সেই পথ আর খুঁজে পেল না। মধ্যে থেকে পাহাড়ে বৃষ্টিতে ভিজে মায়ের জ্বর। সর্দি। প্রণবকাকার গলা ব্যথা। আমার কাশি- সবমিলিয়ে একেবারে ঘরবন্দি দশা! এর মধ্যে একদিন মা, বিকেলে আমাকে বলল, যা তোর প্রণবকাকাকে ডেকে আন। কথা আছে।

দু'বছর হল, আমাদের নতুন বাড়ি এই ইচ্ছেগাঁও- এর প্রান্তে। আমরা একটা হোমস্টে চালাচ্ছি। সবজির খামার করেছে প্রণবকাকা। দিব্যি চলে যাচ্ছে দিন। আমার আর থিসিসটা কমপ্লিট করা হয়নি। তাতে কিছু এসেও যায়নি। এখানে এই উদার আকাশ, নিরালা বনভূমি, সরল প্রতিবেশিদের নিয়ে আমাদের সংসার ভালই চলছে। মা হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেয় অসুস্থ মানুষদের। এইসবের ভেতর, সবচেয়ে ভাল আছে
প্রণবকাকা। সারাজীবনে ঘরগেরস্থালির স্বাদ না-পাওয়া মানুষটা, সারাক্ষণ ঘর গোছাচ্ছে- শিলিগুড়ি থেকে সুন্দর নকশাকাটা চাদর কিনে আনছে- ফুলগাছ লাগাচ্ছে- চমৎকার সব ক্রকারিতে আমরা খাওয়াদাওয়া করি- প্রণবকাকা বই দেখে দেখে নানা দেশি-বিদেশি রান্না করে- সবচেয়ে অন্যরকম হয়ে গেছে আমার মা। পা পর্যন্ত ঝুলের গাউন এবং সাদা কার্ডিগান পরা মা যখন মাথায় বাহারি স্কার্ফ বেঁধে, টুরিস্টদের দেখাশোনা করতে ছোটাছুটি করে- আমার বুকের মধ্যেটা উছলে ওঠে। আলোর মতো। আর মাঝে মাঝে খুব খুব মনখারাপ হয়ে যায় সেই অকালে চলে যাওয়া মানুষটির কথা ভেবে- যাকে আমি এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমার জন্মদাতা বলে জানতাম। মা সেই বিকেলে, প্রণবকাকার সামনে আমাকে বলে দিয়েছিল সব। কীভাবে এক ঝড়ের রাতে প্রণবকাকা ও মায়ের অতর্কিত ভালবাসায় আমি এসে গিয়েছিলাম এবং মায়ের আজীবনের
অনুতাপ, বাবাকে ঠকানোর জন্য, এমন জায়গায়
পৌঁছেছে যে মা আর ফিরে যেতে চায়নি বাড়িতে। সব শুনে আমিই প্রস্তাব দি থেকে যাওয়ার। প্রণবকাকা আর মায়ের অপরাধী মুখদু'টিতে হাসি ফুটিয়ে, বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কারণ- মুহূর্তের ভুলের জন্যে এরা দু'জনেই সারাজীবন কষ্ট পেয়ে, প্রায়শ্চিত্ত করে ফেলেছে। বাকি জীবনটা অন্তত আনন্দে কাটাক হলুদ পদ্ম নাকি জীবন পালটে দেয়! তাই আমিও রয়ে গেলাম। ভারী ভালো লাগে দুই বয়স্ক মানুষের খুনসুটি দেখতে! কাজের ফাঁকে, বনে বনে ঘুরে ট্রেক করি- যদি
কখনও সেই অলৌকিক ফুলের দেখা পাই- আমার জীবনটারও একটা বদল দরকার। পরিবর্তনহীন বেঁচে- থাকা আসলে ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপ- প্রণবকাকা আর মায়ের মতো একটা বদল কতজন আর পায়! এও তো এক ধরনের সৌভাগ্য! দেখা যাক। তবে একটা কথা ঠিক, হলুদ পদ্ম কি করতে পারে জানি না। এখনো সত্যি কিন্তু অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।

Archive

Most Popular