21st Nov 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

মহাকাব্যের এক অন্যরূপ বিশ্লেষণ..

20th Jul 2024

সাহিত্য

শুভদীপ চক্রবর্তী


শতাব্দী প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার দুটি অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে রামায়ণ এবং মহাভারতকে বিবেচনা করা অতিকথন নয় একদমই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরিবর্তন এবং ভাষান্তরগত পরিবর্ধনের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির গাথা লিখে চলেছে এই দু'টি মহাকাব্য। এমনকি বর্তমান শতকে এসে ভীষণ ভাবে দেখতে পাচ্ছি এর প্রবল ব্রাহ্মশাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী মুখ। ক্রমাগত প্রান্তিক সংস্কৃতি ও মানুষদের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে এই দু'টি মূল মহাকাব্য। অথচ সারা ভারতের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দিকে মুখ তুলে তাকালে যথার্থই দেখতে পাওয়া যায় স্থানভেদে কিংবা অবস্থানভেদে এই রামায়ণ বা মহাভারতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাই বিস্ময় জাগে না, যখন জানতে পারি আদি-কবি বাল্মিকী স্বয়ং 'কিরাত' নামক এক উপজাতির মানুষ ছিলেন। কিন্তু নিজ গুণে জ্ঞান এবং মানবিক শুদ্ধতার পথে চলে তিনি অর্জন করেন ব্রাহ্মণত্ব; শেখেন সংস্কৃত। এমনকি তাঁর রচিত রামায়ণেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পাই দেশের বিভিন্ন অংশে, যেখানে রাম তথাকথিত নায়কের পর্যায়ে উন্নীত হননি বরং সেখানে অনেক বেশি নায়কোচিত অবতারে ধরা দিয়েছেন দশানন রাবণ, ভ্রাতা লক্ষ্মণ কিংবা সীতা।

বিভিন্ন রকম পারফর্মিং আর্ট, যেমন কথক ভারতনাট্যম মনিপুরী কথাকলি ওড়িশি সেখানে নিজস্ব রূপে ধরা দিয়েছে রামায়ণের জয়গাথা। কিন্তু এছাড়াও প্রায় একশোরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণের রূপে ভারতীয় সমাজ জুড়ে প্রতীত হয়েছে রামায়ণ। আর এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী ঘরানার শিল্পকলা, যার মধ্যে আছে আদিবাসী নৃত্য, নাটক, পুতুল নাচ, সনাতনী মুখে মুখে ফিরে চলা গল্প, মুখোশ নৃত্য ইত্যাদি। যদিও তথাকথিত 'হাই-ক্লাস ইন্ডিয়ান কালচার' সেগুলিকে মান্যতা দেয়নি বলেই সেগুলি আলো পায়নি কখনোই সেরকম, প্রদীপের নীচে থাকা অন্ধকারের মতোই। সবথেকে কাছাকাছি উদাহরণ চাইলে বলা যায় এই বাংলারই পুরুলিয়া জেলার ছৌ (ছো) নৃতোর কথা। গভীর রাতে হ্যাজাক এবং গ্যাস বাতির সাদা আলোর মধ্যে ধুলো ওড়া মাঠে এক ভিন্নতর রামায়ণের উপস্থাপনা দেখতে দেখতে কখন যেন ভিতরে ঢুকে আসে এর আসল সুরটা, যে এটা শুধুই একটা ধর্মকথা বা বীরগাথা নয়; কোথাও যেন এর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আদিবাসী জীবনের আনন্দ দুঃখ আশা এবং নিরাশার আলো-ছায়াগুলোও। শুধু তাই নয়, আরও নানা আদিবাসী উপজাতি যেমন, কোল ভীল মুন্ডা সাঁওতাল সোরাস কর্তৃস রাভাস বোরো খাসি মিজো- এই সকল উপজাতির মধ্যেই দেখা যায় নিজস্ব ঘরানার রামায়ণের প্রকৃতি। কোনও কোনও সময় রামায়ণের মূল বিষয় বা থিমটিকে ধরে রেখে, উপজাতিদের নিজস্ব প্লট বা সাবপ্লট ঢুকে আসে মূল টেক্সটের মধ্যে।

শ্রী রামচন্দ্রের পায়ের কাছে হাতজোড় করে বসে আছেন বজরঙ্গবলি, এমন দৃশ্য মনে ভক্তিবাদের ঝড় তুললেও, আদিবাসী মালয়ালাম উপজাতিদের রামায়ণ অন্য কথা শোনায়। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী সেখানে আরও বেশি মানবিক রূপে পাই আমরা ভগবান শ্রী রামচন্দ্রকে। মালায়ালাম উপজাতির রামায়ণ বলে, হনুমান রামচন্দ্রের পায়ের কাছে বসে থাকার কারণ হল, যখনই রাম হাঁচি দেবেন তখনই যেন হনুমান তাঁকে দীর্ঘ জীবন কামনা করে প্রার্থনা করতে পারেন। অর্থাৎ 'হাঁচি' দিলেই ইউরোপীয় ট্রাডিশন মেনে 'গড ব্রেস ইউ' বলা আর কি! আবার আসামে উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত রামায়ণে আমরা সীতাকে দেখতে পাই অত্যন্ত গুণী এবং সেলাই ফোঁড়াই জানা একজন দক্ষ মহিদ্যা হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবেই আসামে পাহাড়ি উপজাতির মহিলারা বয়ন বা বুনন শিল্পে অত্যন্ত উন্নত। তাই এক্ষেত্রে সীতা মাইয়াকে এই রূপে ওই স্থানে কল্পনা করে নিতে খুব কষ্ট হয় না। শুধু তাই নয়, আদিবাসী আসাম উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত পাপেট শো বা পুতুল নাচের অনুষ্ঠানে কাউকে কাউকে রাবণের পূজারী হিসেবেও দেখা যায়। সেখানে দেখানো হয় যে, রাবণ অমর। কেউ তাঁকে হতর করতে পারে। না। এই পুতুল নাচের প্রচলিত কথন অনুযায়ী, রাম হত্যা করতে পারেন কেবলমাত্র রাবণের ছায়াকেই। যুগ-যুগান্ত পরে বেঁচে থাকেন আসল অসুররাজ।

এভাবেই নির্দিষ্ট অঞ্চলভেদে সমাজের গঠনগত এবং সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা ছাপ ফেলে গিয়েছে রামায়ণের 'আঞ্চলিক ভার্সন'গুলিতে। মহাকাব্য রামায়ণে সেই সকল সমাজের চরিত্রগত আত্মিকতা প্রবেশ করে সত্যি সত্যিই যেন আরও বেশি মহাকাব্যিক চেহারা দিয়েছে তাকে। মহিমান্বিত করেছে আরও।

যেমন ধরা যাক মধ্যপ্রদেশের গোও উপজাতির কথা। গোন্ড উপজাতিদের প্রচলিত রামায়ণে তাদের আঞ্চলিক মুখে মুখে ফেরা উপকথা ঢুকে পড়ে নির্দ্বিধায়। এই রামায়ণের চিত্রকল্পও আমরা দেখতে পাই মধ্যপ্রদেশের এই গোও উপজাতিদের আঁকা বিভিন্ন চিত্রে না ছবিতে। শুধু তাই নয়, বলতে গেলে সম্পূর্ণ রামায়ণ মহাকাব্যটিই ক্যানভাসে উঠিয়ে এনেছেন এই উপজাতির মানুষেরা। রামায়ণ এবং শ্রী রামচন্দ্রের উপর ভিত্তি করে সংগ্রহ করা গিয়েছে গোল্ড ভাষায় প্রায় পাঁচশোরও বেশি গান। সুখের কথা, শ্রী রামচন্দ্রের কৃপায় সরকার এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সদয়। প্রায় পাঁচশোটি আদিবাসী ভাষায় রামায়ন সম্পর্কিত গান শুধু সংরক্ষণ করাই নয়, তা অনুবাদ করা হয়েছে হিন্দি ভাষাতেও।

আবার মধ্যপ্রদেশ থেকে আমরা যদি ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মনিপুর বা মিজোরামে চলে আসি, তবে সেখানে দেখতে পাওয়া যাবে রামায়ণের অন্যরকম রূপ। মণিপুরে রামায়ণের উপকথা বা মিথ সেখানে জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক শিল্পের যাদের কোনটার নাম ওয়ারি-লিবা, পেনা-সাকপা, খোনজম-পর্ব বা যাত্রা। প্রচলিত 'স্টোরি টেলিং' বা গল্পকথার মাধ্যমে রামায়ণ মহাকাব্যের পাঠ বা প্রচার, সেটিকেই নাম দেওয়া হয়েছে 'ওয়ারি-লিবা'। আবার 'পেনা-সাকপা' হচ্ছে অনেকটাই ব্যালাড সঙ্গীতের মতো। ঢোলক সহযোগে গানের মাধ্যমে রামায়ণ কথা প্রচার করা, তাকে বলা হয় 'খোনজম-পর্ব' এবং পরিচিত নাটক বা থিয়েটারকে নাম দেওয়া হয়েছে 'যাত্রা'। এছাড়াও আশ্চর্যজনকভাবে আদিবাসী রামায়ণে ছায়া পড়েছে বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেরও। উত্তর পূর্বাঞ্চলের 'তাই-ফাকে' সম্প্রদায় শ্রী রামচন্দ্রকে কল্পনা করে নিয়েছে বোধিসত্ত্ব রূপে।

আবার কোনও কোনও অঞ্চলের রামায়ণে রামকে একজন নায়ক তথা অবতার বা রাজা অথবা যাযাবর দলের সর্বাধিনায়ক মনে করে নেওয়া হলেও, সেখানে আসল নায়ক বা সুপার হিরোর মর্যাদা পেয়েছেন তাঁর ভাই লক্ষণ। 'সেগুন কাঠের মতো শক্তিশালী' লক্ষণকে বলা হয়েছেএই আখ্যানের সবথেকে শক্তিশালী চরিত্র। এখানে লক্ষণ ধরা দিয়েছেন শান্তশিষ্ট নী প্রবৃত্তির জ্ঞানী একজন যুবক হিসেবে, যাঁর মধ্যে তেমন কোনও মারমুখী ব্যাপার-স্যাপার নেই।

রামায়ণের বহুল আলোচিত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি হলো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে দিয়ে সীতার হেঁটে আসা। সতীত্বের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আগুনের উপর দিয়ে সীতার হেঁটে চলা, যুগ যুগ ধরে বহু বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসলেও মধ্য ভারতেরই 'বাইগা' উপজাতিৰ তামায়ণে একটি বিশেষ অধ্যায়ে দেখা যায় নিজের শুদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য আগুনের উপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে শ্রী রামচন্দ্রের ভাই লক্ষণকে। আবার কোনও কোনও আদিবাসী রামায়ণে আমরা সীতাকে দেখতে পাই দেবী কালীর অবতারে এবং তিনিই এক্ষেত্রে রাবণ বা অন্যান্য অসুরদের হত্যা করেন। প্রেম বা মন নিয়ে টানাটানির খেলাও বড় মায়াবী ভাবে ধরা দিয়েছে এইসব প্রত্যন্ত উপজাতিদের কোনও কোনও রামায়ণের ক্ষেত্রে। কেরালার একটি নির্দিষ্ট আদিবাসী উপজাতিদের রামায়ণ আশ্রিত একটি বিশেষ ধরনের নৃত্যে দেখা যায় যে মারিচ-রূপী সোনার হরিণের প্রেমে শুধু মুগ্ধই নয়, পাগলপারা অবস্থা হয়েছে সীতার। তাই 'তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই- এই আর্তি এক্ষেত্রে অন্যরকম। শুনতে লাগে বৈকি।

Archive

Most Popular

ঋতু পরিবর্তনে সুস্থ থাকুন, ঘরোয়া টোটকায় ..

21st Nov 2024

প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিনিধি

Read More