13th Aug 2024
সাহিত্য
সৈকত মুখোপাধ্যায়
ঠিক সাতাশ বছর আগে জয়া বুঝতে ঠি পেরেছিল, রানিসায়রে পড়ে থাকলে সে একটা লেভেলের পরে আর উঠতে পারবে না। হয়তো এমএসসি-টা পাশ করে ফেলবে। স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও একটা পেয়ে যাবে। কিন্তু জয়া আরেকটু বেশি কিছু চাইছিল। আরও অনেকটাই বেশি।
জয়াকে স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন বাসুদা। বাসুদা ছিলেন সেই টাইপের লোক, যাদের দেখিয়ে বাপ- মা'রা ছেলে-মেয়েকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেন। জয়াদের পাড়ায় কয়েকটা বাড়ির পরেই থাকতেন। জয়া যে-বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেয়, তার দশবছর আগে বাসুদেব চক্রবর্তী রানিসায়রের মতন পিছিয়ে পড়া একটা জায়গা থেকে হায়ার সেকেন্ডারিতে সেভেনথ র্যাংক করেছিলেন। জয়া যখন সুনয়নী গার্লস স্কুলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ছে, তখন সেই বাসুদা আরামবাগ কলেজের ফিজিক্সের লেকচারার। সপ্তাহের শেষে বাড়ি ফিরে জয়াকে পড়াতে বসতেন। বহুবছর টিউশন করেই নিজের পড়াশোনার খরচ জুটিয়েছিলেন বাসুদা, তাই ভালো ছাত্র-ছাত্রী চিনতে তাঁর ভুল হত না। তখন অবশ্য পয়সার জন্যে নয়, স্রেফ একটা কীর্তি রেখে যাওয়ার জন্যেই তিনি জয়াকে নিয়ে আদা-জল খেয়ে লেগেছিলেন।
বাসুদা প্রায়ই বাবার কান বাঁচিয়ে জয়াকে বলতেন, এখানে পড়ে থাকিস না জয়া। এখানকার কলেজে ক'টা সাবজেক্টই-বা পড়ানো হয়? পাশ করার পরে কলকাতার কোনও একটা ভালো কলেজে নিজের পছন্দমতন স্ট্রিম বেছে নিয়ে পড়াশোনা করবি। জয়া ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করত, তারপর? বাসুদা বলতেন, তারপর দেখবি চারদিকে কতরকমের রাস্তা খুলে যাচ্ছে। তোকে চেষ্টা
করতে হবে না; বন্ধুবান্ধবের মুখেমুখেই কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে পৌঁছে যাবে সব খবর। কেরিয়ার তৈরি করতে চাস, কেরিয়ার তৈরি করতে পারবি। হায়ার স্টাডিজের জন্যে বিদেশে যেতে চাস, তার খোঁজখবরও ক্যম্পাসে বসেই পেয়ে যাবি। রানিগঞ্জ কলেজে সে-সব খবর কোনওদিন পৌঁছবেই না এসে।
শুনতে শুনতে জয়ার চোয়াল কঠিন হয়ে যেত। ওদের জেনারেশনে ভাই-বোনদের মধ্যে সেই বড়। তার আগে কেউ কলকাতায় পড়তে যায়নি। জয়া নিজেও ওই আঠেরো বছর বয়সের মধ্যে একবারই কলকাতায় গিয়েছিল, কার যেন বিয়ের বরযাত্রীতে। কলকাতা তখন থেকেই এক কুহক নগরীর মতন ওকে ডাকতে শুরু করেছিল। যতই সেই ডাক শুনতো, ততই জয়া আরও পড়ার বইয়ের মধ্যে ডুবে যেত। তার সুফলও পেল রেজাল্টে। ফার্স্ট ডিভিশন তো বটেই, ম্যাথে লেটারও ছিল ওর। সেই রেজাল্টের পেছনে বাসুদার অবদান কম ছিল না। বাসুদা কিছুদিন আগে মারা গেলেন। জয়া সেই খবর শুনে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এটা জয়ার স্বভাববিরুদ্ধ। মাঝের সাতাশ বছরে হস্টেল লাইফ আর কর্পোরেট ওয়র্ল্ড ওকে ভেতরের আবেগ বাইরে না-আনতে শিখিয়েছে। কিন্তু জয়া নিজেই অবাক হয়ে দেখেছিল, বাসুদার মৃত্যুসংবাদ তার চোখে অবিরল অশ্রু এনে দিল।
যাইহোক, সাতাশ বছর আগের কথাতেই আবার ফিরি। কলকাতায় পড়তে যাওয়ার ব্যাপারে জয়ার বাবাকে রাজি করানো সহজ হয়নি। ভদ্রলোক কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হলেও আসলে তো ছিলেন ছোটখাটো জোতদার। কাজেই হাড়েমজ্জায় মিশেছিল সামন্ততন্ত্র এবং তার ল্যাজ হিসেবে পুরুষতন্ত্র; সে যতই মেয়েকে বাংলা অনুবাদে রাশিয়ান গল্পের বই কিনে দিন না কেন।
জয়ার এখনও মনে পড়লে কান্না পায়। সে যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে বলেছিল দুর্লভ অ্যাকাডেমির ক্লাস টুয়েলভের একটা চ্যাংড়া ছেলে সেদিন ওকে ফলো করেছিল। কথাটা বাবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলেন এবং বেল্ট দিয়ে জয়াকে পেটান। বাবার বক্তব্য ছিল, তুমি নিশ্চয় এমন সাজপোশাক পরে এমন হাবভাব করো, যাতে ছেলেরা তোমাকে দেখে প্রলুব্ধ হয়। অতএব রাস্তার কুঞ্চুরির মতন তোমারও প্রহার প্রাপ্য।
বাবাও একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল রানিসায়র ছেড়ে চলে যাওয়ার পেছনে। ওই একাধারে গুণী এবং অহংকারী নিষ্ঠুর লোকটার হাত থেকে প্রাণপণে মুক্তি চাইছিল জয়া। কিন্তু সাতাশবছর আগে কলকাতায় যাওয়ার কথা শুনে প্রত্যাশামতই বাবা এককথায় বলে দিলেন, ওসব হবে না। মেয়ে আমার চোখের ওপরেই থাকবে। বয়সটা ভালো নয়। ওকে রানিগঞ্জ গার্লস কলেজেই পড়তে হবে।
তখন আঠেরো বছরের মেয়ে জয়া হালদার এমন একটা তঞ্চকতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল, যার কথা মনে পড়লে এখনও তার বুকে রক্তক্ষরণ হয়।
জয়া হালদার এখনও হালদার, যদিও কল্লোল দাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে বাইশ বছর আগে। কিন্তু তাতে কী? বিয়ে হলেই স্বামীর পদবি নিতে হবে নাকি?
কল্লোল নিজেও ওসব কোনওদিনই মানতো না। একই ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিল দু'জনে, একই আদর্শে বিশ্বাসী। জাত-পাত, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, এই সবকিছুকেই ঘৃণা করে এসেছে দু'জনেই। বিয়ে হয়েছিল মন্ত্রবর্জিত, তবে পার্টি হয়েছিল জমিয়ে। বেনারসিটেনারসি পরে, নতুন বউ সেজে, জয়া দিব্যি তার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে হইহুল্লোড় করেছিল।
আচার-বিচার, মন্ত্র-তন্ত্র অপছন্দ করলেও আনন্দ- উল্লাসের সঙ্গে কোনওকালেই বিরোধ ছিল না তার। সেই বিয়েতে জয়ার বাবাও মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন। ততদিনে তাঁর জয়া একটা কর্পোরেট কোম্পানির জুনিয়ার এগজিকিউটিভ। মেয়ের স্বনির্বাচিত হাজব্যান্ড মাল্টিন্যাশনাল ব্যাঙ্কের অফিসার। কাজেই জয়ার কলকাতায় পড়তে যাওয়া নিয়ে যে- অশান্তিটা তিনি এককালে করেছিলেন, সেটা তখন তিনি ভুলতে চাইতেন।
এই আনন্দের টানেই জয়া বরাবর পুজোর সময় রানিসায়রে বাপের বাড়িতে ফেরবার চেষ্টা করেছে। কোনও বছর পেরেছে, কোনও বছর কাজের চাপে পারেনি। এ-বছরেও সে এসেছে। দু'দিন আগে ষষ্ঠীর দুপুরে মেয়ে তিয়াকে নিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে বাপের বাড়ি এসে পৌঁছেছে সে। কল্লোল এ-বছর আসতে পারেনি, ছুটি পায়নি। রানিসায়রের হালদারবাড়ি মানে প্রায় পুরো একটা পাড়াই বলা চলে। অষ্টমীর সকালে জয়া একটু আলগা-আলগাভাবে সেই বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
জয়া ছোটবেলায় ওর ঠাকুমার কাছে গল্প শুনেছে, একশোবছর আগেও তাদের অবস্থা এমন ভালো ছিল না। বেশ কয়েক বিঘে জমি ছিল বটে সাঁকতোরিয়ার ওদিকটায়, কিন্তু সে তেমন উর্বর জমি নয়। ফসল ভালো হত না।
কিন্তু মা লক্ষ্মীর কৃপার কথা কে আগে থেকে বলছে পারে? মাটির ওপরে চাষ হল না তো বয়েই গেল; মাটির নীচে বেঙ্গল কোল কোম্পানি খুঁজে পেলো দামি কয়লার পুরু স্তর। বেঙ্গল কোল কোম্পানি সেই জমি অ্যাকোয়ার করল, বদলে হালদারদের হাতে এলো কয়েক লক্ষ টাকা আর রানিসায়রে ছিও রোডের ধারে এই বিশাল বসত-জমি। সেই জমিয়ে জয়ার প্রপিতামহেরা তিন ভাই পাশাপাশি তিনটে প্যালেসিয়াল বাড়ি বানিয়েছিলেন। পরে সংসার বাড়জ সঙ্গেসঙ্গে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে আরও কতকগুলে ছোটখাটো বাড়িও গজিয়ে উঠেছে।
জয়ার আশপাশ দিয়ে কত নারী-পুরুষ এদিক থেকে ওদিক যাতায়াত করছিল। তাদের মধ্যে আত্মীয়রা ছিল, অতিথিরা ছিল, কাজের লোকেরাও ছিল। তারা জয়াকে দেখে হাসছিল। জয়াও হাসছিল।
সতেরোবছর অবধি এই বাড়িতে, এদের মধ্যেই তো বেড়ে উঠেছিল জয়া। তার পরেও যাতায়াত বন্ধ হয়নি কখনওই। তাই সকলকেই সে খুব ভালোবাসে। শুধু মানুষদেরই নয়- সে ভালোবাসে রান্নাঘরের পেছনের গন্ধরাজ ফুলের গাছটাকে, যেটাকে সে এক রথযাত্রার দিনে নিজের হাতে মাটিতে বসিয়েছিল। সে ভালোবাসে ঠাকুরদালানের একপাশে ছোট দেয়াল আলমারির মতন খুপরিটাকে, যেখানে তার পুতুলের ঘর ছিল। প্রতিবারের মতই সে একফাঁকে সিঁড়ির ঘরের মাকড়সার জাল সরিয়ে মরচে- ধরা, ভাঙা লেডিস সাইকেলটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে এসেছে। ওই সাইকেলটার সঙ্গে তার পুরো কিশোরীবেলার স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে।
জয়া পুজোবাড়ির সব আনন্দটাই মনের মধ্যে শুষে নেয়, কিন্তু নিজে খুব-একটা হইহুল্লোড়ে যোগ দিতে পারে না। বহুবছর ধরে সে নিজেকে রুক্ষ করে তৈরি করেছে যাতে কর্পোরেট জগতের নেকড়ে-কুমির অধ্যুষিত জঙ্গলেও কেউ চট করে তার দিকে হাত বাড়াতে সাহস না পায়। সে নিজেকে শক্ত করে তৈরি করেছে, যাতে তাকে কোনও কাজেই কোনও পুরুষ মানুষের সাহায্য নিতে না-হয়। জীবনে এরকম বেশকিছু জেদ আছে তার। এত
ব্যস্ততার মধ্যেও সে নিজের জন্যে প্রতি সন্ধেবেলায় কিছুটা সময় বরাদ্দ করে রেখেছে, যে-সময়টায় সে গান শোনে কিংবা বই পড়ে। এমনকী তিয়াও জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই জানে, ওই সময়টায় খুব খিদে পেলেও মাকে গিয়ে বলা যাবে না। তখন কাজেরমাসির কাছে খাবার চাইতে হবে। জয়া জিনস এবং কুর্তায় স্বচ্ছন্দ। আঙুলে কল্লোলের দেওয়া ওয়েডিং রিংটা ছাড়া গায়ে এক কুচিও গয়না পরে না। চুল ছোট করে ছাঁটা।
জয়া মেয়েলি গসিপ করতে পারে না। শাড়ি গয়না নিয়ে গল্প করতে পারে না। কিন্তু সে যেগুলো পারে সেগুলোও তার বাপের বাড়ির লোকেরা খুব ভালো করে জানে। যে-কোনও বিপদেআপদে একটা খবর পেলে সে শুধু ফোনে-ফোনেই নিজের কলকাতার পাওয়ারফুল বন্ধুদের ধরে তার সমাধান করে দিতে পারে-- সে গুরুতর রুগিকে হাসপাতালে ভর্তি করানোই হোক কিংবা পাড়ার কোনোও পলিটিক্যাল গুন্ডাকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে কড়কানোর ব্যবস্থা। জয়া একবার ঘুরতে ঘুরতে ঠাকুরদালানের দিকে গেল। অষ্টমীর আরতি হয়ে গেছে। এরপর দুপুর আড়াইটেয় সন্ধিপুজো আছে। এখন বাড়ির মেয়েরা মহাউৎসাহে তারই জোগাড়যন্ত্র করছে। একজায়গায় গোল হয়ে বসে সবাই বেলপাতা ছাড়াচ্ছে, চন্দন বাটছে, নৈবেদ্যর ফল কুচোচ্ছে। ওদের মধ্যে নিজের মেয়ে তিয়াকেও দেখতে পেল জয়া- ছোটমাসির গা-ঘেঁষে বসে একটা-একটা করে একশো আট পদ্মকুঁড়ির পাপড়িগুলোকে খুলে দিচ্ছিল।
জ্যাঠতুতো ভাই তাপাইয়ের বউ ঋতা ওকে দেখতে পেয়ে ডাকলো, ও বড়দি এসো, বসো এখানে। একটা মোড়া এগিয়ে দিল ঋতা।
সবাই জানে, ও বঁাঁট ধরে ফল কুটতে পারে না। এমনকী এই জিনস পরে মাটিতে বসেও স্বস্তি পায় না। জয়া কিছুক্ষণ মোড়াটায় বসে ওদের কারকর্ম দেখলো, গল্পগাছা শুনলো। তারপর উঠে পড়ল। ওর ছোট বোন কেয়া মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, চলে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ যাই, এইসময় বাথরুমটা ফাঁকা আছে। চান করে নিই।
যা। আর শোন। আমার অসভ্য বরটা বোধহয় দোতলাটা ফাঁকা পেয়ে ঘুমোচ্ছে। যাওয়ার সময় ওর কান ধরে একটু নীচে পাঠিয়ে দিস। এখনও জলখাবার খাননি বাবু।
ঠাকুর দালানের এক কোনা দিয়ে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। সেদিকে যেতে যেতে জয়া আরেকবার আড়চোখে তিয়ার দিকে তাকালো। একটা হলুদ- পাড় গাঢ় সবুজ তাঁতের শাড়ি পরেছে। হলুদ ব্লাউজ। ভিজে চুলগুলো পিঠের ওপরে খোলা। ছোট্ট
কপালটায় একটা ততোধিক ছোট লাল চন্দনের ফোঁটা। ছোটমাসি কেয়াই আদরের বোনঝিকে সাজিয়ে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জয়া নিজে ওসব পারে না। মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল জয়া। শাড়ি পরে কত বড় লাগছে মেয়েটাকে। ও এইবার ক্লাস টুয়েলভের পরীক্ষা দেবে। প্রায় ওই-বয়সেই জয়া একটা ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার কাজ করেছিল।
তখন কি ওর মুখটাও তিয়ার মতন অমনই নিষ্পাপ ছিল? অমনই স্নিগ্ধ?
এখনও জয়া জানে না কেমন করে ও কাজটা করতে পেরেছিল। এটা ওই হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোনোর ঠিক পরের ঘটনা। তখন বাবা রানিগঞ্জ গার্লস কলেজ থেকে ফর্ম তুলে এনে বলছেন, সই কর। কারুর কথায় কর্ণপাত করছেন না। মা এবং বাসুদা একবার সাহস করে ওকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পাঠানোর কথা বলতে গিয়েছিলেন। বাবা শক্ত মুখ করে বলেছিলেন, কো-এড কলেজ? সেখানে গিয়ে তো খালি প্রেম করবে। আর কিছু হবে না। পড়তে হলে এখানেই পড়ুক।
জয়া তখনই ঠিক করেছিল, ওর ভালোবাসাকে বলি দেবে।
ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকেই ও চন্দনকে ভালোবাসতো। চন্দন বাউড়ি। ওদের পাশের পাড়ার ছেলে, বছর পঁচিশ বয়স, শক্তপোক্ত চেহারা। পড়াশোনা বেশিদূর করেনি, তবে ওর এক কাকা ইসিএল-এর লেবার অ্যাসোসিয়েশনের নেতা হওয়ার সুবাদে অমৃতনগর কোলিয়ারিতে সেই বছরই একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। চন্দনও জয়াকে ভালোবাসতো।
ওরা সেই অর্থে সেইভাবে কোনওদিন প্রেম করেনি। অমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবা থাকলে কী করেই-বা করে? ওই বয়সের প্রেম যেমন হয়, স্কুলে যাতায়াত করার পথে সাইকেল থামিয়ে দুটো কথা। হাতের ওপরে একটু হাতের চাপ। এই ছিল ওদের প্রেম। তবে, তখন অবধি জয়া জানতো, সব কিছুর শেষে সে চন্দনের কাছেই ফিরে আসবে, চন্দনকেই বিয়ে করবে। যতদিন-না মানুষ হচ্ছে, ততদিন শুধু খুব সাবধানে বুকের মধ্যে চন্দনসৌরভকে লুকিয়ে রাখাটাই কাজ- এইরকমই ভাবতো জয়া।
কিন্তু রেজাল্ট বেরোনোর পরের সঙ্কটময় দিনগুলোতে জয়া খুব ঠান্ডামাথায় হিসেব করে দেখেছিল, তাকে চন্দনের থেকে অনেক বেশি টানছে তার উচ্চাশা। হ্যাঁ, খুব ঠান্ডামাথায় ডিসিশন নিয়েই জয়া তখন একদিন সন্ধের পরে চন্দনের বাড়ি চলে গিয়েছিল। একাই গিয়েছিল। বেরোতে অসুবিধে হয়নি, কারণ, বাবার সেদিন পার্টির মিটিং ছিল। তিনি কখন কোন রাস্তা দিয়ে ফিরবেন, জয়া জানতো। সেই সন্ধেটা, কি জানি কেন, আজও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে জয়ার। প্রচণ্ড গুমোট ছিল, দরদর করে ঘাম হচ্ছিল। একটা টালির চালের একতলা বাড়ি। খোলা জানলার মধ্যে দিয়েই দেখা যাচ্ছিল দেয়ালের ক্যাটকেটে সবুজ এলা রং, শাড়ির পর্দা। ছোট ঘরটার ভেতর থেকে একযোগে বাচ্চার কান্না, মহিলাদের ঝগড়া, টেলিভিশনের তীক্ষ্ণ শব্দ সবকিছুই ভেসে আসছিল।
অন্ধকার উঠোনে একদিকে দুটো ছাগল হাঁটু মুড়ে বসে পাতা চিবোচ্ছিল। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে জয়া বুঝতে পেরেছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালোবাসাটার বদলেও এই পরিবেশে বউ হয়ে সে জীবন কাটাতে পারবে না।
সে চাপা-স্বরে ডাক দিয়েছিল, চন্দনদা।
চন্দন একটা লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এসেছিল। খালি গা। জয়াকে দেখে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে ফিরে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট পরে এলো। জয়া ওর হাত ধরে বাইরে অন্ধকার রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বলল, চন্দনদা, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?
কোথায়? ও অবাক হয়ে বলেছিল।
এখন বলতে পারব না। চলো, দেখতেই পাবে। মসজিদের পাশের গলিটা দিয়ে যখন ওরা যাচ্ছে তখন জয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎ একটা কষ্টে মুচড়ে উঠল। সে সেই নির্জন অন্ধকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুখটা চন্দনের মুখের দিকে তুলে ধরেছিল। চন্দন দু'হাতের মধ্যে ওর মুখটা ধরে ঠোঁটে আলতো করে একটা চুম খেয়েছিল। দু'জনেরই জীবনের প্রথম চুমু ছিল সেটা- কাজেই যেরকম হয়- ক্লামজি, এলোমেলো। তবু খুবই মধুর।
তার পরেও চন্দন ওর মুখের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। জয়াও ওর জামার বুকের কাছটা খামচে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিল, তবে একইসঙ্গে জয়া চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল, গলির ওই মাথায় পার্টি অফিসের দিক থেকে
চার-পাঁচজন লোক এগিয়ে আসছে। মাঝখানের সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে জোরে কথা বলা লোকটা তার বাবা। আরেকটু এগিয়ে আসার পরে বাবার কথা হঠাৎই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জয়াও চন্দনের হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলেছিল, চলো। কিছুটা রাস্তা প্রায় দৌড়ে পার হওয়ার পরে ওরা যে যার বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল সেদিন।
এরপর জয়ার বাবা ওকে কলকাতার কলেজে পাঠাতে আর আপত্তি করেননি।
কলকাতায় বসেই স্কুলের এক প্রিয়সখীর চিঠিতে জয়া জেনেছিল, বাবার পোষা ক্যাডারদের হাতে প্রবল মার খেয়েছে চন্দন বাউড়ি। বাপি ওর বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন, হালদারবাড়িতে পা দিলে এরপর ওর চাকরিটা খাবেন।
বহুবছর পরে, এই কিছুদিন আগে, চন্দন বাউড়িকে পেয়েছে জয়া- ফেসবুকে।
খুঁজে মাঝের এই বছরগুলো ঝড়ের মতন কেটে গিয়েছে। কেরিয়ার গড়ে তোলা, চাকরির ইঁদুর দৌড়, নানান মেট্রো সিটিতে পরের পর বদলি এবং শেষ অবধি বেঙ্গালুরুতে ফ্ল্যাট কিনে স্থিতু হওয়া- এইসব নিয়ে জয়া এত ব্যস্ত ছিল যে, চন্দনের কথা ভাববার সময়ই পায়নি। তার মধ্যে মেয়ে হয়েছে। কল্লোলের সঙ্গে সম্পর্কটা মাঝখানে দ্বিতীয় এক নারীকে নিয়ে এমনই তিক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, ডিভোর্সের কথাও ভেবেছিল। সেই সম্পর্ক আবার কোনওরকমে মেরামত করা গেছে।
এখন তার বয়স পঁয়তাল্লিশ। জীবন হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে এসেছে। অফিসে আর নিজেকে প্রমাণ করার দায় নেই। মেয়ে আর ছোট নেই; যখন-তখন ওর অভিমান ভোলাতে হয় না। কল্লোলকে তো অন্য গ্রহের বাসিন্দা মনে হয়, দেখাই হয় না কতদিন ওর সঙ্গে। এইরকম এক শান্ত সন্ধেবেলাতেই সে ফেসবুকে ইসিএল-এর সুপারভাইজার, রানিগঞ্জ নিবাসী চন্দন বাউড়িকে খুঁজে পেয়েছিল। অনেকক্ষণ ধরে চন্দনের প্রোফাইলটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল জয়া। শাঁখা-সিঁদুর পরা, আটপৌরে কিন্তু ভারী ভালোমানুষ দেখতে একটা বউ- নাম কল্পনা।
ড্রইংরুমটা বড় কিন্তু ওদিকে যেমন হয়- সেই জেলুসিল রঙের দেয়াল, জানলায় কালো রং করা লোহার পাল্লা, লিন্টেলের কাছে সিমেন্টের চওড়া তাক। একটা মেয়ে- বেশ মিষ্টি দেখতে। ক্লাস নাইনেপড়ে। নাম চৈতালি।
চন্দনদার সেই মাথাভর্তি ঘন চুলগুলো একেবারেই গেছে। চোখে মোটা কাচের চশমা। একটু মোটাও হয়েছে। তবু সবমিলিয়ে খুব একটা বদলায়নি। জয়া ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। চার দিনেও যখন অ্যাকসেপ্টেড হয়নি, তখন জয়া ধরেই নিয়েছিল, আর হবে না। চন্দন যদি ওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট না-করত, তাহলেও কি ওকে দোষ দিতে পারত জয়া? না। পারত না। কারণ, সাতাশবছর আগে সেই রাতে ও যখন চন্দনের আলিঙ্গন থেকে বিযুক্ত হয়ে ওর হাতে টান দিয়ে বলেছিল, পালাও- তখনই ও চন্দনদার চোখ দেখে বুঝতে পেরেছিল ও সব বুঝতে পেরেছে।
তার পরেও ও ক্যাডারদের হাতে মার খেয়েছে। জয়া শুনেছিল, বাবার হুমকির জেরেই ও রানিসায়র ছেড়ে রানিগঞ্জে চলে গিয়েছিল।
যে-মেয়েটা ওকে পুতুলের মতন ব্যবহার করেছিল একদিন, তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ও কেন অ্যাকসেপ্ট
করবে?
কিন্তু অবাক কাণ্ড... করেছিল। পঞ্চম দিনে জয়ার মেসেঞ্জারে খুব ক্রোধহীন, অভিমানহীন একটা মেসেজ ঢুকেছিল- কেমন আছ? তোমার মেয়েকে তো একদম তোমার মতনই দেখতে হয়েছে।
জয়া লিখেছিল, তোমার মেয়েকেও দেখতে খুব সুন্দর।
জয়া বা চন্দন কেউই ফেসবুকে খুব-একটা অ্যাকটিভ নয়। কাজেই ন'মাসে-ছ'মাসে একটা গুডমর্নিং।
এখানে খুব গরম। বেঙ্গালুরুতে একবার মাকে নিয়ে যাব ভাবছি। ওখানে ডক্টর রামানুজন আছেন, অ্যাজমা স্পেশালিস্ট। এইসব আরকি।
এইবার রানিসায়র আসার আগে হঠাৎই জয়ার মনে হল একবার চন্দনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। ভীষণ দরকার। আর মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ নয়; সে সরাসরি একদিন অফিস থেকে চন্দনকে ফোন করে বলল, আমি ষষ্ঠীর দিন রানিসায়রে যাচ্ছি। একাদশীর দিন ফিরব। তুমি এর মধ্যে একদিন দেখা করবে? চন্দনের মতন লোকেরা কোনওদিনই সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। চন্দনদা সোজাসুজি বলল, হ্যাঁ, আমারও তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
জয়া অবাক হয়ে দেখল তার পঁয়তাল্লিশ বছরের প্রবীণ শিরাতেও এই কথায় রক্তস্রোত দ্রুত বইলো।
তার পরেই চন্দন বলল- হালদারবাড়িতে আমি পা রাখব না। আর আমার এখন রানিসায়রে বাড়ি বলে। কিছু নেই। কাজেই আমাদের দেখা করতে গেলে বাইরেই করতে হবে।
জয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ালো। এইটা তার আন্দাজ করা উচিত ছিল। বাবা ওকে বলেছিলেন হালদারবাড়িতে পা দিলে চাকরি খাব। সেই অপমান ওর পক্ষে ভোলা কঠিন, বিশেষত বাবা এখনও রীতিমতন বাড়ির সামনেই চেয়ার পেতে বসে থাকেন। কে যাচ্ছে, কে আসছে সবই খেয়াল করেন। কাজেই চন্দনের দ্বিতীয়বার অপমানিত হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু।
জয়া অসহায় গলায় বলল, বাইরে কেমন করে যাব চন্দন? এই পুজোবাড়ি থেকে বেরোলে কেউ না কেউ তো সঙ্গে থাকবেই।
চন্দন বলেছিল, যদি রাতে যাই, খুব রাতে? জয়া অবাক হয়ে বলেছিল, খুব রাতে? চন্দন বলল, হ্যাঁ। তোমাকে বলিনি কখনও, আমি বরাবর তোমাদের বাড়ির ঠাকুর দেখতাম ভোররাতে। সারা রাত ধরে দুর্গাপুর আসানসোল, কাজোরা, উখড়ার ঠাকুর দেখে রাত তিনটে সাড়ে-তিনটের সময় রানিসায়রের মোড়ে ট্রেকার থেকে নামতাম। তারপর বাড়ি যাওয়ার আগে একবার তোমাদের ঠাকুরদালানে গিয়ে দাঁড়াতাম। তখন চারিদিক নিস্তব্ধ। আলোও প্রায় সবই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্টোদিকের বারান্দায় দু'চারজন ঢাকি আর কাজের লোক জড়োসড়ো হয়ে ঘুমোচ্ছে আর একজন কেউ ঘুমচোখে জাগ প্রদীপ পাহারা দিচ্ছে। এছাড়া আর জনমানব থাকত না কোথাও। আমি হাজার ঠাকুর দেখে এসেও, প্রার্থনা যা করার করতাম শুধু তোমাদের বাড়ির ঠাকুরের কাছে। বলতাম, যেন পরীক্ষায় পাশ করি, চাকরি পাই। তোমাকে যখন ভালোবাসলাম, তোমাকে বলার আগেও তোমাদের ঠাকুরকে বলেছিলাম সে-কথা। বলেছিলাম, যেন জয়ার মন পাই।
চন্দন চুপ করে যাওয়ার পরেও জয়া অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেনি। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, এসো চন্দন। আমি থাকব। কবে আসবে একটু জানিয়ে দিও শুধু।
চন্দন বলল, দেখি, আমি তোমাকে পুজোর মধ্যেই জানিয়ে দেবো।
আজ সকালেই চন্দন ফোন করেছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, শুধু তোমার জন্যেই এই বুড়োবয়সে আবার অফিস-কোলিগদের সঙ্গে হোল নাইট ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছি, কোলিয়ারির জিপ নিয়ে। আসানসোল বার্নপুর ঘুরে, রানিগঞ্জে ফেরার পথে রানিসায়রে একবার ঢুকব- এই ধরো রাত তিনটে নাগাদ।
পারবে বেরোতে?"।
জয়া বলেছিল, পারবো। তুমি এসো।
সন্ধিপুজো শেষ হওয়ার পরে জয়া যখন ঘোষণা করল যে, আজ সে জাগ প্রদীপ আগলাবে, তখন পুরো বাড়িতে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল।
জাগ প্রদীপ ব্যাপারটা হালদারবাড়ির পুজোর দু'শো বছরের ট্র্যাডিশন। পুজোর বোধন থেকে নিরঞ্জন অবধি মায়ের সামনে বিশাল পেতলের এক প্রদীপ জ্বলতে থাকে। ওই প্রদীপের শিখা জ্বলছে মানে প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রদীপ কোনওকারণে নিভে যাওয়া মানেই মা প্রতিমাকে ছেড়ে চলে গেলেন এবং সেটা ভারী অমঙ্গলের ব্যাপার। সেইজন্যেই প্রদীপে তেলের জোগান ঠিকঠাক দিয়ে যেতে হয়। দিনের বেলায় তো কোনও সমস্যাই নেই কারণ, পুজোর সময় অন্যান্য আরও দশটা কাজের মতন জাগ প্রদীপে তেল দেওয়ার কাজটাও ওখানে যারা হাজির থাকে তারাই কেউ না কেউ করে দেয়। কিন্তু রাতে তো আর পুজো হয় না। তাই শুধু জাগ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার জন্যেই কোনও এয়োস্ত্রী পুজোর ক'দিন মণ্ডপে রাত জাগে। একেক রাতে একেকজন। কাজটা কারুরই তেমন পছন্দের নয়, কারণ, সারা রাত জেগে থাকার পরে সকালে গা ঢিসডিস করে। আনন্দ করা যায় না। কমবয়সি বউগুলো তাই পারতপক্ষে কাজটা এড়িয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করে। বাকি রইল জয়ার কাকিমা, পিসিমা গোত্রের বয়স্কা মহিলারা। কিন্তু তাদের আবার সমস্যা অন্য। রাত জাগলে অম্বল হয়। মাত্র তার আগের দিনই জয়ার ছোটকাকিমা জাগ প্রদীপের পাহারায় ছিলেন এবং যথারীতি অষ্টমীর সকাল থেকেই তার এমন পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে যে, তিনি একেবারে শয্যা নিতে বাধ্য হয়েছেন।
কাজেই জয়া যখন ঘোষণা করল, আমি আজ জাগ প্রদীপ পাহারা দেবো, তখন সবাই দুটো জিনিস ধরে নিল। এক, এটা ওর বড় মনেরই একটা পরিচয়। বেচারা পুজোবাড়ির আর কোনও কাজ পারে না বলে মাথা খাটিয়ে এই কাজটা বেছে নিয়েছে, যাতে অন্যদের একটু সুরাহা হয়। আর দুই, বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অনেক পরিবর্তন হয়। হালদারবাড়ির বড়মেয়েও নাস্তিকতা থেকে আস্তিকতায় ফিরছে।
এদিক-ওদিক একটু গুনগুনানি যে উঠল, সেটা জয়া বুঝতে পারল তবে পাত্তা দিল না। রাতের খাওয়াদাওয়া মিটতে মিটতে রোজকার মতনই বারোটা বাজলো। তারপর একটা অবধি এই দালানে, ওই উঠোনে ছোটবড় দল বেঁধে যেমন আড্ডা চলে চলল। শেষ অবধি রাত দেড়টায় জয়ার মা আর ও বাড়ির বড় বউ মিলে জয়াকে ঠাকুরের সামনে বসিয়ে দিয়ে শুতে গেল।
যাওয়ার আগে মা দেখিয়ে দিল কোথায় তেলের কৌটো, কোথায় পলা আর সেই বড় বউ একবার প্রতিমার মুখের দিকে তাকায় আর একবার জয়ার মুখের দিকে আর মনে মনে ভাবে তার এই বড় ননদটিকে লালপাড় গরদের শাড়ি পরে আজ কি সুন্দরই না দেখতে লাগছে। যেন মা দুর্গাই মাটিতে নেমে এসেছেন। ওইরকমই টানা টানা চোখ, টিকোলো নাক, পাতলা ঠোঁট। তার পরেই বউটি এরকম ভাবনায় পাপ হল কিনা ভেবে প্রতিমাকে আরেকবার সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। ওরা চলে যাওয়ার পরে একদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল জয়া। সামনে প্রদীপ। নিস্তব্ধ রাত। শুধু বাগানের বড় বকুল গাছটায় ফল পেকেছে বলে ওদিক থেকে মাঝেমধ্যে বাদুড়ের হল্লা ভেসে আসছিল।
শেষ কবে জয়া এমনভাবে নিজের সঙ্গে নিজে মুখোমুখি বসার সুযোগ পেয়েছে? মনে পড়ে না তার। তবে এভাবে বসলে স্বাভাবিকভাবেই জীবনের একটা ট্রায়াল-ব্যালান্স বানাবার ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় লাভক্ষতির অঙ্ক কষে দেখতে- লাভ বেশি হল, না ক্ষতি। জয়ার চোখের সামনে দিয়ে তার পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনটা ধীরগতির চলচ্চিত্রের মতন এগিয়ে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গেই এগিয়ে চলেছিল একচালা প্রতিমার মাথার ওপরে রাখা দেয়াল ঘড়ির ঘণ্টা- মিনিটের কাঁটা।
মাঝে মাঝে জয়ার চোখ চলে যাচ্ছিল প্রতিমার দিকে। সে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেমনটি দেখে আসছে, ঠিক সেইরকমই। অসুরের গোঁফ থেকে চালচিত্রের মহেশ্বর অবধি কিছুই বদলায়নি। জয়ার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, বদলায়নি সেও। মাঝের সাতাশ বছরে বহু দূরে দূরে ঘুরেছে, বহু ঘাম ঝরিয়েছে, কলহ ও । জমিয়ে তুলেছে অনেক বিষয়সম্পত্তি। কিন্তু মনে হচ্ছে, এতকিছুর প্রয়োজন ছিল না। কিছু ভালো বই, গান, সিনেমা আর...
আর একজন কোনও অনাত্মীয়ের অকারণ ভালোবাসা পেলে সে বাকি জীবনটা খুব শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারত। রাত ঠিক সাড়ে তিনটের সময় জয়ার মোবাইলে মেসেজ ঢুকল, "আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি"।
জয়া জাগ প্রদীপে একপলা ভর্তি করে তেল ঢেলে দিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তার ধুলো সারা রাতের হিমে ভিজে গিয়েছিল। ভিজে ধুলোর গন্ধ ছড়াচ্ছিল। আকাশে ভোরের আলো ফোটার আগের এক অদ্ভুত নীল আভা। বাবা শিখিয়েছিলেন, ওই আভার নাম অহনা। রাস্তার উল্টোদিকে মেজো তরফের বাড়ি। সেই বাড়ির দরজার দু'পাশে লাল সিমেন্টের বেদি। একটা বেদির ওপরে বসেছিল চন্দন। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ক্লান্ত খুব। জয়া পাশে গিয়ে বসল।
অনেকক্ষণ ওরা দু'জনে পাশাপাশি বসে রইল। শেষকালে যখন পাকুড়গাছের পাতার আড়াল থেকে নবমীর সকালের প্রথম কাক ডেকে উঠল, তখন জয়া বলল, আমি সারা জীবন কষ্ট পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি।
চন্দন বলল, না, কেন কষ্ট পাবে? আমি পরে অনেকবার ভেবে দেখেছি, তুমি আমাদের দু'জনের জীবনকেই বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছিলে। আমরা সংসার করতে পারতাম না। মানসিকতায় মিলতো না, অশান্তি হত। তার চেয়ে এই ভালো হয়েছে। দু'জনেই সুখে আছি।
জয়া এই কথার উত্তরে কিছু বলল না। জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়ি কোথায়?
চন্দন বলল, বড় রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। এবার যাই। গাড়িতে যারা আছে তারাও ক্লান্ত।
জয়া একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, এসো। চন্দন উঠে দাঁড়াল। জয়ার চোখে চোখ রেখে বললো, একদিন তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে। আমার মন বলে, সেই ভালোবাসায় কোনও মিথ্যে ছিল না। জয়া আকুল হয়ে বলল, না। ছিল না। বিশ্বাস করো ছিল না। আমি ভেবেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি না। সেইজন্যেই অত সহজে তোমাকে ঠকিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম। আমি তোমাকেই ভালোবাসতাম, চন্দন। তীব্রভাবে ভালোবাসতাম। এখনো বাসি। চন্দন বলল, জানি। সেইজন্যেই আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
কিছুক্ষণ জয়ার ডানহাতের পাতাটা নিজের দু'মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে থাকল চন্দন। তারপর হঠাৎই ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে, আর একবারও পেছনের দিকে না-তাকিয়ে, চলে গেল বড় রাস্তার দিকে। জয়া ফিরে এসে জাগ প্রদীপের সামনে ওর আসনে বসলো। ওর ঠোঁটে সুখের হাসি খেলা করছিল। প্রদীপটা বেশ জ্বলছিল। তবু জয়া একপলা তেল ঢেলে দিতেই তেলটা উপচে পড়ল মেঝেতে।
জয়া ভাবলো সমস্ত পূর্ণতার পরেও এই একপলা তেল লাগে- উপচে পড়ার জন্যে।