14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

সন্ন্যাসী ভূত

21st Sep 2024

সাহিত্য

বনানী শিকদার


এর আগে কয়েকবার অলোকা চোরের মতো মুখ চুন করে এবাড়িতে ঢুকেছে। কখনো বলেছে, জানেন কাকু, গতকাল রাতে একদম ঘুম হল না। আমার বাড়ির পাশের নয়নচূড় বেলগাছ থেকে সমানে কারও কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। কখনো বলেছে, পাশের গ্রাম থেকে আমার বোন এসেছিল, সন্ধ্যার পরে ওকে এগিয়ে দিচ্ছিলাম, দেখলাম শান্তিচূড় বেলগাছটা অশান্ত হয়ে উঠেছে, জোরে জোরে দুলছে, অথচ কোন ঝড় নেই, বাতাস নেই। কখনো বলেছে, রাতে শিবরামের বাড়িতে রান্না করে ফেরার পথে কমলচূড় বেলগাছের নীচে প্রদীপের আলো জ্বলছিল। কিন্তু সেখানে কাউকে দেখলাম না। কোন মানুষের দায় পড়েছে বলেন তো যে বেলগাছের পুজো করবে?

     কোন লাভ হয়নি। অলোকার ভূতদর্শন নিয়ে কাকু মোটেও বিচলিত হননি। শুনেছেন আর বলেছেন, যত্তসব গপ্প।

    একবার অলোকা বলেছিল, আজ সন্ন্যাসীটাকে দেখলাম। ধোপার দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন করছিল। আমাকে দেখেই পাশের শঙ্খচূড় বেলগাছটার দিকে হাঁটা দিল। দু পা যেতেই ফিকে হয়ে গেল তার চেহারা। চার পা যেতেই একেবারে অদৃশ্য।

     তাতেও কাকু নির্বিকার। 

     অলোকার কাকু হলেন ডাক্তার রতন বিশ্বাস।

     আজ সে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল রতন বিশ্বাসের বাড়িতে। বলল, আপনে তো ডাক্তার। বলেন তো একটা এইসা মোটা মানুষের ওজন কমে তিরিশ কেজি হতে কেমন সময় লাগে?

     রতন বিশ্বাস বললেন, অনেকদিনও লাগতে পারে, আবার অল্পদিনও।

     একদিনে হয়?

     না।

     এক ঘণ্টায়?

     না রে বাবা।

     এক মিনিটে?

     মাথাটা কি খারাপ হয়েছে তোর?

     আমার মাথা ঠিক আছে। কিন্ত আজ আমি যা দেখেছি তা দেখলে আপনের মাথা নির্ঘাত খারাপ হত। সেদিনের একশ কেজি ওজনের সন্ন্যাসীটা আমার চোখের সামনে এক মিনিটে তিরিশ কেজির হয়ে গেল। আরও  আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন? তার গেরুয়া লুঙ্গিটা একটুও ঢিলে হল না। সে একটা বড় তামাক পাতা চিবোচ্ছিল আর আমার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছিল সন্ন্যাসীর দর্শনকে সত্যি প্রমাণ করতে অলোকা তার গলায় জোর ঢালল, আমি দেখেছি, দেখেছি, দেখেছি। সে বলল, কাকিমা মারা গেলে আপনে একা বাড়িতে কী করে থাকবেন কাকু? ওই ব্যাটা সন্ন্যাসী তো কাকিমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

     রতন বিশ্বাস অনেকদিন থেকে বীরভূমের বাহাদূরপুর গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে অবসরপ্রাপ্ত জীবন যাপন করছেন। বয়স বিরাশিকে অতিক্রম করে গেছে। ছেলেমেয়ে নেই। শরীরের নানাধরনের অবক্ষয় হতে হতে স্ত্রী এখন শয্যাশায়ী। লোক চেনার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। রান্নাবান্নার জন্যই অলোকার প্রতিদিন এবাড়িতে আসা। তার মতো আরেকজন আছে সাধনা। সাধনা রতন বিশ্বাসের স্ত্রীর দেখাশোনা করে। অলোকার ছুটি হয় বিকেলে সাধনার রাতে, রোগীকে খাওয়ানোর পর। ন টার সময় রতন বিশ্বাসের এক খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে, রত্নদীপ আসে। চক্ষু বিশেষজ্ঞ। বছর দেড়েক হল সে কলকাতার প্রাইভেট হসপিটালের চাকরি ছেড়ে গ্রামে এসেছে।

 এই সন্ন্যাসীটি সাধারণ সন্ন্যাসী নয়। ভূত। বেলগাছে থাকে। কেউ ভূত সন্ন্যাসীর দর্শন পেয়েছে, কেউ শ্রবণ করেছে তার কথা। দর্শনের ব্যাপারটা কার কোন বেলগাছে হয়েছে তা বোঝানো রীতিমত দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিল। গ্রামে বেলগাছের সংখ্যা একশর উপর। তাই অন্ততপক্ষে কয়েকটি গাছের নামকরণ হয়েছে নয়নচূড়, শান্তিচূড়, মণিচুড়, কমলচূড়, লতিকাচূড় বলে। যাদের ভূত সন্ন্যাসীর দর্শনের দুর্ভাগ্য হয়নি সাধনা তাদের দলে। তবে আলো, কম্পন দেখার এবং কান্না বা ভৌতিক শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা সেও প্রাপ্ত করেছে।  

     রতন বিশ্বাস নিজেকে ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করেন না। তিনি কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেছেন। ইন্টার্নশিপের পর কলকাতাতেই এম এস ইন সার্জারি এবং এম সি এইচ। ডাক্তারি চর্চার সময়টাতে অনেক মানুষের জীবনকালকে দীর্ঘ করেছেন। অনেক মানুষের মৃত্যুর সাক্ষীও হয়েছেন। পেশায় নিষ্ঠা রেখে অনেক কাটাছেঁড়া করেছেন, অনেক মৃত মুখ এবং শরীর দেখেছেন। কখনো মনে হয়নি রাতের অন্ধকারে মনের আয়নাতে পর্যন্ত সেসব মুখ এবং শরীর জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। ভূত সন্ন্যাসী কথনের পরম্পরা গ্রামে চলছে বেশ কয়েক দশক ধরে। কিন্তু আজ অলোকার কথা রতন বিশ্বাসের শরীরে ভয়ের শিহরণ তুলল। এইজন্যই বুঝি বার্ধক্যকে শৈশবের পরিবর্তিত রূপ বলা হয়। তিনি অলোকাকে বললেন, এত সাহস!

     অলোকা চলে গেলে রতন বিশ্বাস পাশের ঘরে বিছানায় শায়িত স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পঞ্চান্ন বছর একসঙ্গে রইলেন কিন্তু সুখ কখনই তাঁদের সঙ্গ দিল না। অনেক টাকা এল ঘরে, সন্তান এল না। অনেক চিকিৎসা হল, দুজনার মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হল, অনেকবার অনেকদিনের জন্য মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হল কিন্তু কোনকিছুই সমস্যার অবসান ঘটাতে পারল না। শেষে যখন বয়স এগিয়ে এসে সমস্যা নিজের পায়ের নীচে চেপে দিল, সুখের জন্য উন্মুক্ত করে দিল দরজা তখন সুখের বদলে অসুখ ঢুকে পড়ল ঘরে। দৃষ্টিশক্তি প্রখর হলেও হাজার চেষ্টা করে স্ত্রী তাঁকে চিনতে পারছেন না। তিনিও স্ত্রীর মুখখানা নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারছেন না। তাঁর দৃষ্টিশক্তি একেবারেই কমে গেছে। আজ স্ত্রীকে দেখতে এসে তিনি যেন মুহূর্তের জন্য তাঁর বিছানার পাশে পাঁচ সাড়ে ফুট উচ্চতার কিছু একটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। বুঝতে পারলেন না কি। নাকি কে। কি সে? বা কে সে? বোঝার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি সাধনাকে দেখলেন। স্ত্রীকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে এসেছে। দুর্বল পা নিয়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি রতন বিশ্বাস নিজের ঘরে ফিরে এলেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলেন সে কি সাধনাই ছিল? আগেই ঢুকেছিল ঘরে? তিনি পরে দেখেছেন? নাহ, তাঁর ডাক্তারের সাহসী সত্তাটা আর সাহসী থাকছে না। 

     কয়েকদিন ধরে পরিচিত ঘরগুলোতে অপরিচিতির রঙ লাগছে। কখনো তিনি চোখের সামনে দিয়ে পাখিকে উড়ে যেতে দেখছেন, কখনো কালো জানোয়ারকে সামনে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখছেন। তিনি নিজেকে বলছেন, আমি জানি কেন এমন হয়.. নিজেকে প্রশ্ন করছেন, কেন? নিজেই পরে উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, আমি জানতাম কেন এমন হয়। আবার নিজেকে প্রশ্ন করছেন, জানতাম বলছ কেন? এখন কী হল সে জানার? নিজেকেই উত্তর দিচ্ছেন, ভুলে গেছি। আমার এখন অন্য কথা মনে পড়ছে।

     রতন বিশ্বাসের মনে পড়ছে বাইপাস সার্জারি করছিলেন... পেশেন্টটাকে বাঁচাতে পারেননি। একটা ছেলের হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র ছিল, তাকেও তিনি...। একজন মহিলার স্টেন্টিং এর সময় কি হল কে জানে, সে দম ছেড়ে দিল...। আরও অনেক ঘটনা। কখনো স্পষ্ট, কখনো ঝাপসা। বাড়ি অপরিচিত হয়ে যেতে থাকলেও তিনি সেই বাড়িকেই বেশি করে আঁকরে ধরে থাকতে চাইছেন। হয়ে যাচ্ছেন এক ভীষণ ভীতসন্তস্ত্র ঘরকুনো। এতটাই ঘরকুনো যে বাইরে বেরনো একপ্রকার বন্ধ করে দিয়েছেন। কমিয়ে দিয়েছেন স্ত্রীর কাছে যাওয়া।  

     রতন বিশ্বাস মনের শক্ত আবরণের মধ্যের শিলা যে গলতে শুরু করেছে তা কাউকে বুঝতে দিতে চাইছেন না। তবু বুঝি গলিত শিলার আঁচ বাইরে বেরিয়েই পড়েছে। অলোকা এটুকু অন্তত বুঝেছে তিনি একা থাকতে চাইছেন। সে আসে, কাজ করে, চলে যায়, কাকুকে আর বিরক্ত না করে। সাধনা একইরকম। চুপচাপ। না অন্যকে বিরক্ত করার অভ্যেস তার কখনো ছিল, না এখন তৈরি হয়েছে। এক রাতে টয়লেটে যাবেন বলে রতন বিশ্বাস বিছানা থেকে মেঝেতে পা রাখতে গিয়ে একটি সাদা কাপড়ে আবৃত শরীরের অনাবৃত মুখ দেখলেন। মুখটি পরিচিত। তিনি ভয়ে তাড়াতাড়ি পা-টাকে উঠিয়ে নিলেন। মুখটাও শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর মুখের সামনে হাওয়ায় ভাসতে লাগল। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। কয়েক সেকেন্ড বাদে যখন চোখ খুললেন দেখলেন মুখটা পালটে গেছে। কিন্তু পালটে যাওয়া মুখটিও পরিচিত। আবার চোখ বন্ধ করলেন, আবার খুললেন। কয়েকবার চোখ বন্ধ হওয়া এবং খোলার মাঝে কয়েকটি ভিন্ন পরিচিত মুখ সামনে এল। সবশেষের মুখটি থেকে হঠাৎ মাংস চামড়া সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল তার কঙ্কাল। রতন বিশ্বাস চিৎকার করে উঠলেন, কে তুমি? কে? চলে যাও এখান থেকে।

     রত্নদীপ শুরু শুরুতে এসেই জ্যাঠার ঘরে ঢুকত। তাঁর সঙ্গে দু-চারটে কথা বলত। তাদের কথাবার্তা ডাক্তারি বিষয়েই হত। তার নার্সিং হোম নিয়ে হত। ইভেস্টমেন্ট নিয়ে হত। কিন্তু পরে সে জেঠার সঙ্গে কথা কমিয়ে দিল। আসে, রাতে থাকে, সকালে চলে যায়। আজ চিৎকার শুনে রত্নদীপ জেঠার ঘরে ছুটে এল। জিজ্ঞেস করল, কাকে চলে যেতে বলছ?

     ওকে। ওকে। ওকে চলে যেতে বলছি আমি।

     কে?

     দেখতে পাচ্ছ না?

     না তো! রত্নদীপ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। সে জেঠার চোখের দিকে চোখ রাখল। জেঠাও তার দিকে সন্ধিগ্ধ চোখে তাকালেন। মুহূর্তে তিনি নিজেকে সামনে নিলেন। লজ্জা প্রকাশ পেল তাঁর মুখে। একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম। তুমি যাও।

     রত্নদীপ তবু গেল না। ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল। তুমি কি ভূত দেখেছিলে?

     ধ্যুস!

     হাসল রত্নদীপ, নার্সিং হোমটা হয়ে গেলে সবার আগে তোমার চোখের সার্জারি করব। 

     রতন বিশ্বাস বললেন, সেই আশাতেই বসে আছি। উত্তর দেবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না, কিন্তু দিতে হল। কারণ তিনি রত্নদীপকে বোঝাতে চেয়েছেন যে তিনি মূল স্রোতেই আছেন।   

     সন্ন্যাসীটা বড়ই উপদ্রব শুরু করেছে আজকাল। তোমার বাগানের বেল গাছটাতে আবার বাসা বাঁধেনি তো? যদিও প্রাচীর আছে... ভূত একবার মনস্থির করলে টপকাতে কতক্ষণ লাগে!

     বাড়িটি বিশাল। পৌনে দু বিঘে জমির উপর। জমির এক চতুর্থাংশ নিয়েছে কয়েকটি পাকা ঘর। পাকা ঘরকে বেষ্টিত করে রেখেছে ন ফুট উঁচু প্রাচীর। পাকা ঘরগুলোর পেছনের প্রাচীরের পরে বাগান। বাগানের পরে আবার প্রাচীর। 

     ভূতের আবার মন! ভূত কোন গরু, ঘোড়া নয় যে প্রাচীর টপকাবে!

     কি বলেন জ্যাঠা, ভূতের মন নেই! ভূতের মনও আছে, প্রাণও আছে।

      জীবন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রতন বিশ্বাস এক জায়গায় পড়েছিলেন, জীবন হল জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমন এক অবস্থা যা শুধুমাত্র জীবন্ত কোষের মধ্যে দেখা যায়। হেসেছিলেন তিনি। জীবনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ঘুরে ফিরে জীবন শব্দটাকেই ব্যবহার করতে হচ্ছে। জীবন এবং জীবন্ত একই শব্দের দুটো রূপ জীবন হল বিশেষ্য এবং জীবন্ত বিশেষণ। রতন বিশ্বাস রত্নদীপকেই বলেছিলেন, জীবন্ত কোষ না বলে প্রাণযুক্ত জিনিস বলা উচিত। 


     রত্নদীপ বলল, কলেজে একদিন আমরাও ভূত নিয়ে অনেক গবেষণা করছিলাম...

     যেমন?

     ওই, ভূতের প্রাণ আছি কিনা। যেমন, বলছিলাম শরীরে হাড় তো থাকেই, যখন মানুষের রূপে আসে তখন মাংসও থাকে সুতরাং নিশ্চয় কোষ আছে। ভূত স্বাধীনভাবে নিজের ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারে, অন্যের শরীরে প্রবেশ করলে পরজীবীর মতো আচরণ করে। ভূত খাদ্য গ্রহণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঁচা খাবার খায়, কাঁচা মাংসও। শ্বসন করে, খাবার হজম তো শ্বসন ছাড়া হবে না, তাছাড়া তার চোখের গর্তের নীচে ওই গর্তটা তো নাকই। শ্বাস নেবে না তো নাক আছে কেন! চলন-গমন তো করেই, মানুষের চেয়েও দ্রুত করে, এই আছে তো এই নেই। এত গতীতে স্থান পরিবর্তন করে যে দেখাই যায় না। প্রজনন করে, একটা মানুষ থেকে যদি একটাই ভূত তৈরি হত তাহলে এত ভূত থাকত না। তাছাড়া খচ্চরও তো প্রজনন করে না। তাই বলে কি বলব যে খচ্চের অস্তিত্ব নেই! ভূতের চেহারাগত বৃদ্ধি আছে, এক সেকেন্ডে হাতকে এক কিলোমিটার লম্বা করে ফেলে। মিউটেশন আছে; মিউটেশন হয়ে হয়েই তো এত ধরনের ভূতের সৃষ্টি হল। ব্রহ্মদৈত্য, মামদো ভূত, গেছো ভূত, মেছো ভূত, শাঁকচুন্নি। এখন বেরিয়েছে নিউ ভেরিয়েশন সন্ন্যাসী ভূত। ভূত উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের রোগ সৃষ্টি করে গেছো ভূত যে গাছে থাকে সে গাছই রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মানুষকে তো ভূতের রোগে পায়ই পায়, অন্যান্য প্রাণীদেরও পায়। তারা অকারণ লাফালাফি এবং ছোটাছুটি করে। একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে ফেলে রত্নদীপ লক্ষ করে রতন বিশ্বাস সামনের দেওয়ালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সে জিজ্ঞেস করে, কি ভাবছ?

     হুঁশ ফিরে পান রতন বিশ্বাস। কিছু না। তুমি আজ আমার পাশে শোও। শরীরটা ঠিক লাগছে না। রাতে এক স্বপ্ন এল। তাঁর বাগানের বেলগাছটার নীচে সন্ন্যাসী ভূত দাঁড়িয়ে। তাঁকে বলছে, তামাক আমার বড় প্রিয়। আগামীকাল রাত সাড়ে সাতটায় পর ঠিক এইখানটায় তিনটে তামাকের পাতা রেখে দেবে। নইলে আগামীকালের রাতই তোমার শেষ রাত হবে। ভয়ে ভয়ে সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলেন রতন বিশ্বাস, আর যদি রেখে দিই?

     ভালো হবে।

     তুমি কখন আসবে?

     পৌনে আটটায়।

     ঘুম ভাঙতেই দেখলেন পাশে রত্নদীপ শুয়ে আছে। শোনা কথা, সন্ন্যাসী ভূতের এমন নির্দেশ গ্রামের অনেককেই দিয়েছে। এটাও শোনা কথা, তাঁর নির্দেশ মেনেই নাকি তারা ভূতের ভয় থেকে মুক্তি পেয়েছে। একটু জোর মনে। সকাল হল। আরেকটু তাজা হল মন। ভাবলেন, কিছুই না গ্রামের অশুভ প্রভাব পড়েছে মনের ওপর। বয়স হয়েছে, কষ্টকর হবে, তবু যেভাবেই হোক এই বাড়ি বিক্রি করে স্ত্রীকে নিয়েই কলকাতায় চলে যাব। বেলগাছ নেই তো সন্ন্যাসী ভূতের ভুতুড়ে কারবারও নেই। এই বয়সে কাঁপা হাতে সার্জারি করতে গিয়ে একশটা রোগী মরলেও তাদের আত্মা আমাকে তাড়া করবে না। কলকাতা কখনো ডাক্তারদের ওপর ভূতের অত্যাচার সহ্য করেনি, করবেও না সহ্য। ওই শহরটাই আমার জন্য এক বিশাল সহায়। তবু এখনকার মতো সুরক্ষা কবচটি পাওয়া যায় কিনা তা তাঁকে যাচাই করে নিতেই হবে। তাছাড়া বিদ্রোহী হওয়ারই বা কী প্রয়োজন! রতন বিশ্বাস রত্নদীপের প্রায় পেছন পেছন বাড়ি থেকে বেরোলেন। বাজারে গিয়ে তিনটে দোকান থেকে কিনলেন তিনটে তামাকের পাতা। তারপর সারাদিন ঘড়ি দেখে দেখে সময়ের প্রতীক্ষা করলেন। 

 ঠিক আটটাতেই টর্চ হাতে তিনি বেলগাছের নীচে পৌঁছে গেলেন। সযত্নে একটা কলাপাতার উপর তামাকের পাতা তিনটে রেখে বাড়ির এবং বাগানের মাঝের প্রাচীরের টিনের গেটটার কাছে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় বসে রইলেন। পৌনে আটটা বাজল। টর্চ জ্বালাতে সাহস হল না। চোখের তারাতে জোর লাগিয়েও মাংস অথবা হাড়ের কোন চেহারা দেখা গেল না। কিন্তু আটটা বাজতে না বাজতেই তামাক পোড়ার ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

Archive

Most Popular