10th May 2024
প্রতিবেদন
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রেমের গল্প বলতে বসলে রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি- সব মিলিয়েও কুলিয়ে ওঠা যাবে না। কারণ প্রেম বলতে আপনারা কে কী বোঝেন জানি না, কিন্তু একটা সময় প্রেম বলতে, সে ছিল সেই ওপরে দোতলার জানলায় গরাদে মুখ ঠেকিয়ে আনমনে পথের পানে চেয়ে, আর আমি নিচের রাস্তায় হেঁটে যাওয়া অগুন্তি উটকো লোকের একজন। শুধু মনে হতো, মুখ তুলে তাকালে সেও বোধহয় একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখত। ব্যাস, শুধু সেই ফুর্তিতেই যেদিকে কলেজ, তার সম্পূর্ণ উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে কলেজ যাওয়া। অবশ্য শুধু কলেজ কেন, তখন জগৎ সংসারের যে কোনও জায়গায় যাওয়ার ওই একটাই ছিল রাস্তা। গ্রীষ্মের ঠা ঠা রোদে, জল থইথই বর্ষায়, শরৎ, হেমন্ত, শীতে..... না, বসন্ত নয়, কারণ বসন্ত আসার আগেই সে অন্য কারও প্রেমিকা হয়ে গিয়েছিল।
সেই ছেলেটি নিশ্চিত একটু বেশি সাহসী ছিল। ব্যাপারটাকে ওই দোতলার জানলাতেই আটকে রাখেনি। নির্ঘাত স্কুল কিংবা গানের ক্লাসে যাতায়াতের মাঝপথে একদিন সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, এই দুটো কারণেই মেয়েটি বাড়ি থেকে বেরোত। একলা। আমিও সেই দিনক্ষণের হিসেব রাখতাম। বহুবার পিছু নিয়ে স্কুলের গেট অথবা গানের স্কুলের গলি অবধি পৌঁছেও দিয়েছি। কখনও সখনও ফিরতি পথেও। এবং মনে আছে, একবার বিপুল বীরত্বের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম এগিয়ে গিয়ে কথা বলার। উল্টো ফুটপাথ ধরে সে হেটে চলেছে। আমি স্রেফ রাস্তাটা পার করে তার পাশেপাশে হাঁটতে থাকব। সে অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালে, তাকে বলব... কী বলব, তার অন্তত দশ রকম ভাষ্ণ তৈরি ছিল।
কীভাবে বলব, ফাঁকা ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার
অসংখ্য মহড়াও দেওয়া ছিল। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেল মাঝের ওই ফুট বিশেক চওড়া রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যাওয়াটা। কারণ কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। নিজের হৃদপিন্ডের ভয়ঙ্কর জোর লাবডুব ছাড়া। মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। পেটের মধ্যে প্রজাপতি নয়, অজস্র বাদুড় কিংবা চামচিকে ওড়াউড়ি করছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে দেখতে পেয়েছিলাম হর্ন বাসটিকে। ড্রাইভার জানলা দিয়ে মুখ বের করে খিস্তিও দিয়েছিল। কিন্তু মরিনি সে যাত্রা। প্রেমেও পড়িনি। মানে পড়েছিলাম, কিন্তু শেষপর্যন্ত আর বলে ওঠা হয়নি। আর একতরফা প্রেম, হাতলভাঙা কাপ,একপাটি চটির যে কোনও গুরুত্বই নেই জীবনে, তা কে না জানে। কিন্তু এবার একটু থামুন। ওপরের লেখাটা সামান্য মন দিয়ে আরেকবার নজর করুন। কত পুরনো একটা গল্প যে আপনাদের বললাম, দুটি ইঙ্গিতেই সেটা স্পষ্ট। কলকাতার রাস্তায় লাল রঙের ডবল ডেকার বাস এবং মেয়েদের গান শিখতে যাওয়ার ইস্কুল। ডবল ডেকার শহরে শেষ দেখা গেছে দ্বাপর যুগের শেষে। তার পরেই কলি যুগ শুরু হল, কারণ মিনিবাসের দাপট বাড়ল। আর মেয়েদের গানের স্কুল, আছে কি এখনও। মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়ির খুকিরা কি এখনও দু-দিকে দুই বিনুনি বেঁধে, বুকের কাছে গানের খাতাটি ধরে গান শিখতে যায়? তখন যেত। আমাদের পাড়াতেই ছিল একটি এলাকা-প্রসিদ্ধ গানের স্কুল। কিন্তু আমরা, পাড়ার ছেলে-ছোকরারা চোখ তুলে সেই স্কুলের খুকিদের দিকে তাকাতে পারতাম না। তাকানোর সাহস ছিল না। কারণ, পাড়ার বড়রা। শ্যেন দৃষ্টিতে এবং সিংহ বিক্রমে পাড়ার সুনাম এবং নৈতিকতা পাহারা দিত তারা। এটা সেই সময়, যখন নতুন সিগারেট ফুঁকতে শিখে যেতে হতো পাশের কিংবা তারও পাশের পাড়ায় কোনও কানাগলি বা পার্কের অন্ধকারে। এবং যথাসম্ভব লুকিয়ে, কারণ বেপাড়ার দাদারা দেখতে পেলেও কান পাকড়ে ধরে দু'গালে দু'খানি থামড় অবশ্যম্ভাবী। ফলে গানের স্কুলের মেয়েদের আড়চোখে দেখার কাজটাও করতে হতো যথাসম্ভব সতর্কতা, সাবধানতার সঙ্গে। ধরা পড়লে বিষয়টা যে কতদূর চলে যেতে পারে, বেপাড়ার ঘোলা জল গড়িয়ে যে বাড়ির দরজায় চলে আসতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বিস্তর পেয়েছি। বিচিত্র সব শাস্তি ছিল এ ধরনের অপরাধের। এমন শাস্তি, যা পরের অন্তত একমাস লোকের সামনে মুখ দেখানোর উপায় রাখত না। ধরা যাক খামচা খামচা করে চুল কেটে দেওয়া। তেমন দয়া-মায়াহীন বাপ-জ্যাঠা হলে একেবারে মাথা
মুড়িয়ে ন্যাড়াও করে দিতে পারত। যাতে অপরাধের গুরুত্ব এবং পরিণতি দীর্ঘদিন মনে থাকে। খোদ অপরাধীর এবং তার চারপাশের সবার। কিন্তু ধরা পড়লে হলই বা মানহানি, তা বলে কি প্রেম দেব না। বরং এসব বাধা-বিপত্তির মোকাবিলা করেই তো এগোতে হবে। তার জন্যে দরকার প্রভূত সাহস এবং ব্যাপক পরিকল্পনা। ভেবে দেখুন, এসব ফেসবুক মেসেঞ্জার, বা হোয়াটসআপ তখন সুদূর কল্পবিজ্ঞান, মোবাইল ফোন বোধহয় সবে দেখা গেছে জেমস বন্ডের ছবিতে, যে ছবি দেখার বয়স আমাদের হয়নি। কিন্তু তখন ছিল পাড়ার ক্লাব, লাইব্রেরি। ফেসবুক ছিল না, কিন্তু পাড়ার রক, চায়ের দোকানের জমজমাট আড্ডা ছিল। চটজলদি মেসেজ ছিল। না, কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া ছিল নিয়মিত অভ্যাসে। পর পর কয়েকদিন এ'বাড়ির বউটিকে জানলায় দেখা না গেলেই ও বাড়ির গিন্নি খোঁজ নিতেন। বাজারে রোজ যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকে দু'দিন না দেখলে বাড়ি বয়ে কুশল জেনে আশ্বস্ত হওয়া নিজের ভালো থাকারও শর্ত ছিল। আর তার মধ্যেই প্রেম হতো। পাড়ার ক্লাবের প্রভাতফেরি, অথবা রাতজাগা জলসায়, লাইব্রেরির বার্ষিক নাটকে, সরস্বতী পুজো কিংবা অষ্টমীর সকালের পুষ্পাঞ্জলিতে। প্রেম হতো কড়া মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা নিভাঁজ স্কুল ইউনিফর্মের প্রাত্যহিকতায়, প্রেম হতো ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সকালে প্রথম দেখা শাড়ির অপার মুগ্ধতায়। পাড়াভর্তি গুরুজনদের কড়া শাসনের মধ্যেই লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম পাপড়ি খুলত, ডানা মেলত। আবার কখনও সারা পাড়া সামিল হয়ে যেত চার হাত এক করতে। আমাদের পাড়াতেই ছিল এরকম একজোড়া, যাদের বাবারা চিরশত্রু। কথা বন্ধ, মুখ দেখাদেখি বন্ধ এবং দুজনেই আড়ালে অন্যজনকে গালাগালি না দিলে পেটের ভাত হজম হতো না। তাদের ছেলে-মেয়েদের প্রেম দুই পরিবারের শত্রুতাকেই আরও পোক্ত করেছিল। ছেলের বাবা সর্বত্র বলে বেড়াতেন, তাঁর 'সুউপায়ী, কেঃ সঃ চাকুরে, কলিকাতায় নিজ বাটি' সুপুত্রটিকে ফোকটে হাত করতে অন্যজন নাকি নিজের মেয়েটিকে লেলিয়ে দিয়েছেন। আর মেয়ের বাবা সেই শুনে বলতেন, দরকার হলে সপরিবার গঙ্গায় ডুবে মরবেন, কিন্তু মেয়েকে হাত-পা বেঁধে ওই এঁদো ডোবার জলে ফেলবেন না। ছেলে এবং মেয়েটির যদিও এই শত্রুতায় কিছু যেত। আসত না। বরং তারা দিব্যি একে অন্যকে ভালোবেসে ভালো থাকছিল, কারণ সারা পাড়া ওদের সঙ্গে ছিল। হয়ত কোনও কথা জানানোর দরকার, বা কিছু পৌঁছে দেওয়ার, লোকের অভাব হতো না। একটু আগেই যে রাস্তার দিকে ওরা দু'জনে হেঁটে গেছে, সেদিকে যাতে ওদের বাড়ির কোনও লোক তক্ষুণি না যেতে পারে, সেজন্য খেজুরের গল্পে তাদের ব্যস্ত রাখা থেকে শুরু করে, মেয়েটির ফাঁকা বাড়িতে চকিত-চুম্বন-প্রত্যাশী ছেলেটিকে যাওয়ার সুযোগ করে থেকে শুরু করে, মেয়েটির ফাঁকা বাড়িতে চকিত-চুম্বন-প্রত্যাশী ছেলেটিকে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে দরজায় ব্যর্থ হয়েছে, এমন উদাহরণই বরং বিরল ছিল। তখন একটা চালু রসিকতা ছিল, পাড়ার সম্পদ পাড়াতেই রাখা। পাশের বাড়ির সুন্দরীটি কেন রেপাড়ার বউ হয়ে চলে যাবে, পাড়ায় যদি তার যোগ্য কোনও ছেলে থাকে। সহজ এবং সরল যুক্তি। তার পরেও কিছু সম্পর্ক পূর্ণতা পেত না। সেই কষ্টও চোখের সামনে দেখা। সুন্দরী, শিক্ষিত, লাজুক মেয়েটির সঙ্গে প্রতিদিন যখন কথা বলত স্কুলছুট, বেকার, চোয়াড়ে, বদমেজাজি মারকুটে ছেলেটি, কোথাও যে কিছু একটা ঠিক নেই, মিলমিশ যে হচ্ছে না, সুরে বাজছে না দুটো যন্ত্র- এটা বলার জন্য খুব বিচক্ষণ বা বুদ্ধিমান হতে হতো না। তবু কিছুটা ছাড় দিয়েছিল পাড়ার বড়রা। হয়ত এই ভেবেই যে, যদি ভাল কিছু হয়ে যায়। সেও তো
চোখের সামনেই দেখা। ধুন্দুমার মাস্তান বিয়ের জল গায়ে পড়তেই হয়ে গেছে শান্ত শিষ্ট, গৃহপালিত স্বামীটি। এই সেদিনও যে বখাটে ধুম নেশা করে নর্দমায় পড়ে থাকত, এখন সে কী সুন্দর বউ-বাচ্চা নিয়ে ছুটির দিনের বিকেলে বেড়াতে যায়। হতেও পারে সেরকম কিছু, ভাবত বোধহয় পাড়ার লোক। কিন্তু সব প্রেম 'অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার' দিয়ে শেষ হওয়ার জন্য শুরু হয় না। কাজেই একদিন পাড়ার লোকাকেই ছেলেটিকে বোঝাতে হল, কেন মেয়েটির ভালোর জন্যেই ওই 'ভুল' সম্পর্ক থেকে ছেলেটির সরে আসা উচিত। তাইই হল। তারপর একদিন সানাই বাজল পাড়ায়। ফুলে সাজানো গাড়িতে সুযোগ্য পাত্রটি এসে হাত ধরে নিয়ে গেল মেয়েটিকে। সবাই খুশি। শুধু ক'দিন পর মাঝারাতে ছেলেটির চিৎকারে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল গোটা পাড়া। কোনও রাগ নেই, কোনও অভিযোগ নেই, শুধু আকণ্ঠ মদ খেয়ে মেয়েটির ডাকনাম ধরে চিৎকার। সেই তুমুল নেশার ঝোঁকেও, ভুল করেও একবার বলেনি, ভালোবাসি। শুধু নাম ধরে ডেকেছিল। তবু প্রেম থাকে। অনেক ব্যর্থ প্রেমও থাকে। শেষ না হওয়া গল্পের মতো, ছন্দে ভুল হয়ে থমকে যাওয়া কবিতার মতো। কিন্তু আজও যখন চোখে পড়ে কোনও তরুণ সন্তর্পণে ধরে বান্ধবীর হাত, সলাজ চোখে ফিরে তাকায় মেয়েটি, মনে হয় আবার একটা নতুন গল্প লেখা শুরু হল বুঝি।