13th May 2024
প্রতিবেদন
সুস্মিতা মিত্র
অন্নই ব্রহ্ম, অন্নই ঈশ্বর
একটা সময় দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যাওয়ার পথে ছিল সারিবদ্ধ কচুরি-ছোলার ডাল কিংবা কচুরি-আলুর তরকারির দোকান। এখন কচুরি খাওয়ার জায়গা হয়েছে ফুডকোর্টে। জানেন কী, এই কচুরি ছিল ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব-এর সবচেয়ে প্রিয় খাবার। তিনি অবশ্য পছন্দ করতেন বরাহনগর বাজারে ফাগুর দোকানের কচুরি, সঙ্গে জিলিপি। বর্তমানে এই দোকানের নাম 'মুখরুচি'। তবে দোকানে ঢুকলেই চোখে পড়বে ঠাকুরের প্রিয় কচুরি আর জিলিপি খাওয়ার কথা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের পদধূলি ধন্য এই দোকানটির নাম বদল হলেও তারা ভোলেননি ঠাকুরের কথা। এখানে এলে আজও মনে পড়বে ঠাকুরের কচুরি-জিলিপি খাওয়ার প্রসঙ্গ।
কাছেই কাশীপুর উদ্যানবাটী। ঠাকুর কর্কট রোগের চিকিৎসার জন্য এখানে ছিলেন শেষদিকে। একদিন গিরিশ ঘোষ এসেছেন তাঁর পরমহংসের কাছে। ঠাকুরের কথামতো গিরিশ ঘোষের জন্য ফান্ডর দোকান থেকে এসেছিল গরম গরম কচুরি, লুচি, অন্যান্য মিষ্টি। জিলিপিও ছিল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেক প্রসাদ করে দেওয়ার পর গিরিশ খাওয়া শুরু করেন। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব বললেন, 'বেশ কচুরি।'
আবার মাস্টারের উদ্দেশে বলেন, 'কচুরি গরম আর খুব ভাল।'
মাস্টার বলেন, 'ফাগুর দোকানের কচুরি! বিখ্যাত।' ঠাকুর বলেন, 'বিখ্যাত।'
গিরিশ ঘোষও যেতে খেতেই বললেন, 'বেশ কচুরি তখন ঠাকুর গিরিশকে বললেন, লুচি থাক, কচুরি খাও
কাছেই প্রামাণিকদের বাড়ির কালীমন্দিরে যেতেন ঠাকুর। ব্রহ্মময়ী মা ছিলেন রামকৃষ্ণ দেবের মাসি। তার কারণ, দু'টি কালীমূর্তিই করেছিলেন নবীন ভাস্কর। শোনা যায়, এই মূর্তিটি পছন্দ ছিল না রানি রাসমণির। তাই এই কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় প্রামাণিক বাড়ির মন্দিরে। সেইকারণে ঠাকুরের মাসি হলেন মা ব্রহ্মময়ী আর দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী হলেন মা। কাছেই জয় মিত্রর কালীবাড়ি। এখানেও আসতেন ঠাকুর। দুই মন্দিরে পুজো করে ফেরার পথে বরাহনগর বাজারের কাছে ফাগুর দোকানের গরম কচুরি আর জিলিপি খেয়ে দক্ষিণেশ্বর ফিরতেন। এখানকার কচুরি-জিলিপি পছন্দ করতেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্তরকালের স্বামী বিবেকানন্দ), গিরিশ ঘোষও। কে ছিলেন এই ফাও? ফান্ড সাহু ছিলেন বিহারের বাসিন্দা। কাজের খোঁজে বিহার থেকে আসেন কলকাতা। আর ফিরে যাননি তিনি। এই দোকান ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত আছে বহু গল্প-কাহিনি! একবার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ঠাকুর তাঁর ভাইপো রামলাল চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে কলকাতা থেকে
ফিরছেন। ফাগুর দোকানের সামনে আসতেই ঠাকুর রামলালকে বললেন, যা তো, ওই দোকান থেকে কচুরি কিনে আন।' ফান্ড ঠাকুরকে ভীষণই যত্ন করতেন। ফান্ড ঠাকুরের জন্য জল, পানের খিলি আর কচুরি গুছিয়ে এনে দিলেন রামলালের হাতে। রামলাল সেসব নিয়ে এসে দেখলেন, রামকৃষ্ণদেব গাড়িতে নেই। গাড়ি থেকে নেমে সোজা হাঁটা দিয়েছেন। ছুটতে ছুটতে কিছুদূর গিয়ে রামলাল দেখেন, ঠাকুর হাঁটছেন আর ভাবের ঘোরে বলছেন, 'ফাগুর কচুরি খাব।'
বিখ্যাত এই কচুরির পুরে থাকে হিং, কলাই ডাল বাটা, আদা, মৌরি, কাঁচালঙ্কা বাটা, নুন, মিষ্টি। আটা ও ময়দায় ভালো করে মিয়ের ময়ান দিয়ে মেখে লেচি কেটে পুর ভরে ভাজা হয় কচুরি। সঙ্গে দেওয়া হয় হিং আর নারিকেলকুচি দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি ছোলার ডাল।
এই কচুরি ছাড়াও লুচি, পুরি, পরোটা খেতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সারদামাকে নরেনের জন্য মোটা মোটা রুটি আর ডাল বানিয়ে দিতে বলতেন ঠাকুর। অথচ রোজকার খাবারে তিনি খেতেন ঝোল- ভাত। তিনি ছিলেন পেটরোগা মানুষ। বরাবরই হালকা পাতলা রান্না খেতেন। মন্দিরের ঘিয়ে বানানো গুরুপাক ভোজন তিনি গ্রহণ করতেন না। প্রথমে হৃদয়রাম ও পরে মা সারদার রান্না খাবারই তিনি কেবলমাত্র খেতেন। শ্রীমার রাঁধা খাবার, তা ছিল পথ্যের সমতুল্য। মন্দির থেকে আসা নিজের ভাগের খাবার সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরের ভোগ খেতেন না। তার অবশ্য অন্য কারন ছিলো। এক তো জানবাজারের রানি ছিলেন কৈবর্ত, জাতে শুদ্র। ব্রাহ্মণ হয়ে সে খাবার খাবেন না বলে নিজের হাতেই রান্না করে নিতেন। জ্যান্ত মাছের ঝোল ছিল তাঁর সবথেকে প্রিয়। আজও কোয়াল পাড়া মঠে ভক্তদের প্রসাদে থাকে মাছ। এছাড়াও ছোট মাছ, গেড়ি-গুগলি, ডিম এসবও ছিল তাঁর প্রিয় খাবারের তালিকাভুক্ত। পান করতেন গঙ্গার জল, ফলে পেটের রোগে ভুগতেন। অসুস্থ অবস্থায় যখন তরল খাবার খেতে হত, নিয়মিত খেতেন মাংসের সুরুয়া। আজকাল ধর্মের নামে আমিষ বর্জন করে নিরামিষ আহার গ্রহণ করার হিড়িক পড়েছে চারিদিকে। ঠাকুর নিজে কিন্তু কখনও আমিষ বর্জন করার কথা বলেননি আর নিজেও তা করেননি। জ্যান্ত মাছের পাতলা ঝোল বানানোর জন্য, মাছ নুন হলুদ দিয়ে ভাজুন। তেলে পাঁচফোড়ন দিয়ে আলু, নুন, হলুদ গুঁড়ো, আদা জিরা কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে কষে জল দিয়ে ফুটতে দিন। ভাজা মাছ দিয়ে ঢেকে রান্না করুন। ধনেপাতা কুচি ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। আলু ছাড়াও কাঁচকলা, পেঁপে, ফুলকপি, শিম, সজনেডাটা এসব দিয়েও মাছের পাতলা ঝোল হয়। প্রিয় মিষ্টির তালিকায় ছিল জিলিপি আর সাদা বোঁদে। কামারপুকুরের এই সাদা বোঁদে কিন্তু জগৎ বিখ্যাত,
অন্য কোথাও এটি পাবেন না। কামারপুকুরের সাদা বোঁদের প্রধান উপাদান হল রমা কলাইয়ের বেসন এবং আতপ চালের গুঁড়ো। তার সঙ্গে লাগে গাওয়া ঘি বা বনস্পতি, ঘি ও চিনির রস। রমা কলাই বা রম্ভা কলাই বলতে বরবটির বীজকে বোঝানো হয়। সেই জন্য রমা কলাইয়ের বেসনকে বরবটির বেসনও বলা হয়। রমা কলাইকে প্রথমে জলে ধুয়ে তারপর রোদে শুকিয়ে নেওয়া হত। এরপর সেই শুকনো কলাইকে পিষে বেসন তৈরি করা হত। বোঁদের প্রস্তুতিতে প্রথমে এক ভাগ রমা কলাইয়ের সঙ্গে মেশানো হয়। দুই ভাগ আতপ চালের গুঁড়ো। তারপর সেই মিশ্রণে জল দিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয়। পরদিন সেই মিশ্রণকে ফেটিয়ে খামি তৈরি করা হয়। সেই খামিকে বড় স্থানতার সাহায্যে অসংখ্য দানায় পরিণত করে গাওয়া ঘি, বনস্পতি বা ডালডার ফুটন্ত কড়াইয়ে ছাড়া হয়। ঘিতে ভাজা হয় বলে এই বোঁদে সাদা রঙের হয়, তেলে ভাজা বোঁদের মতো লালচে হয় না। কড়াইতে ভাজা হয়ে গেলে বোঁদেগুলোকে গাঢ় চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয়। তারপর চিনির রস থেকে তুলে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বোঁদের ভেতরে রস থাকলেও বাইরেটা হয় শুকনো। জনশ্রুতি রয়েছে, কামারপুকুরের সত্যকিংকর মোদকের দোকানের সাদা বোঁদে খেতে ঠাকুর খুব ভালোবাসতেন ভীম নাগের
সন্দেশও ছিল তার অন্যতম প্রিয়। এমন' ভোজনরসিক মানুষ, অথচ গলায় ঘায়ের কারণে শেষের দশমাস উদ্যানবাটীতে থাকাকালীন সময়
ঠিকমতো কিছু খেতেই পারেননি। গলা থেকে নামতো না খাবার। শেষখাওয়া ছিল মায়ের হাতের পায়েস। খেতে তিনি এত ভালোবাসতেন অথচ দেহত্যাগ করলেন প্রায় অভুক্ত পেটে। আজও ঠাকুরের নামে বিশ্বের প্রতিটি কোণে কোটি কোটি অভুক্তের পেট ভরে প্রতিদিন। অন্নই ঈশ্বর। অন্নই ব্রহ্ম।
3rd Dec 2024
প্রতিবেদন
নিজস্ব প্রতিনিধি