31st May 2024
প্রতিবেদন
জাহির রায়হান
ময়ূরকণ্ঠী নীল জমিন আর তার সোনালি পাড়। কিংবা রানি রঙের ঢালে নিপুণ কালোর ছোঁয়া। আর তার আঁচল বেয়ে নেমে এসেছে রঙিন ঝুমকো, অথবা নির্ঝরা লতাপাতার আলঙ্কারিক রূপটান। কটনের মাঝেই রেশমি সুতোর স্বভাবসিদ্ধ নিবিড় বুনন। কোনওটায় আবার রেশম সুতোর ভিড়ে সোনালি জরির ফুল পাখি। আঁচল বেয়ে ঢালাও স্বর্ণালি জরির কারুকাজ। কিংবা অফ হোয়াইট শাড়িতে লাল-নীল-বাহার আর আঁচলের ধার বরাবর লতিয়ে উঠেছে হরেক ফুলের নকশা। এসবই চিরন্তন মুর্শিদাবাদ সিল্ক সম্পর্কিত বর্ণনা যে সিল্ক 'বুনোটের রাণী' বা 'রাণীর বুনোট' নামে খ্যাত, জগদ্বিখ্যাত।
মুর্শিদাবাদ সিল্কের খ্যাতি ভুবনময়, জগৎজোড়া। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চীনে প্রথম। রেশম আবিষ্কৃত হয়। আবিস্কারের প্রায় দুই বছর বছর পর্যন্ত চীন রেশম চাষ ও উৎপাদনে গোপনীয়তা বজায় রাখে সন্তর্পণে। পরবর্তীকালে সিল্ক রোড-এর মাধ্যমে চীনের বেইজিং থেকে ভূমধ্য সাগরের উপকূল বেয়ে প্রথমে গ্রিস ও পরে রোমান সাম্রাজ্যে রেশম ব্যবসা প্রসার লাভ করে। তারও পরে দক্ষিণে ইয়েমেন, বার্মা ও ভারতবর্ষে সম্প্রসারিত হয় সিল্ক রুট। উপমহাদেশে প্রথম তিন্দত থেকে ভারতবর্ষের হিমালয়ের পাদদেশে রেশম চাষের বিস্তার ঘটে।
মুর্শিদকুলি খাঁর হাত ধরে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করে বালুচরী। সে সময় নবাবী জীবনযাত্রা রঙবেরঙ সুতোর বুনানিতে ফুটিয়ে তোলা হতো বালুচরীর মসৃণ আঁচলে। অচিরেই এই শিল্প দিল্লীর মোঘল শাসকদের হৃদয় হরণ করে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মোঘল সম্রাটদের সর্বাঙ্গীন পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় রেশম শিল্প ব্যাপকতায় উন্নীত হয়। অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা ও ভারতের মালদা ও মুর্শিদাবাদ বেঙ্গল সিল্কের প্রধান উৎপাদনস্থল হিসেবে হয় পরিগণিত। রাজশাহী ও মালদা, সিল্ক ইতিহাসের সেই নজিরই বহন করে এখনও। রাজশাহীর রেশম ও রেশম শাড়ি তৈরির কারখানা ইতিহাসের সিল্ক যুগের কথা মনে করিয়ে দেয়। বেঙ্গল সিল্ক বলতে মূলত রাজশাহী, মালদা ও মুর্শিদাবাদের সিল্ককেই বোঝানো হতো সেকালে। কথিত আছে, বেশশা চাষের পদ্ধতি সিল্পের কার্যক্রম ও ব্যবসায় হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য টিপু সুলতান সুদূর মহীশুর থেকে শিক্ষানবিশ হিসেবে স্থানীয় তাঁতিদের পাঠিয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলায়। বেঙ্গল সিক্সের টানে ভারতবাদের অন্যান্য রাজা মরারা জারা ও বাংলায় পাইক-পেয়াদা-পন্ডিত পাঠিয়ে রেশম চাষোর দীক্ষা
নিতেন। পরবর্তী সময়ে অনবাস আবহাওয়ার কারণে সারা দক্ষিণ ভারত জুড়ে রেশম চাষ প্রসার লাভ করে এবং এই শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়। বাংলা থেকেই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে গুটিপোকা তার জাল বিস্তার করে, রেশম চাষ বিস্তৃত হয় আসমুদ্র হিমাচল। বলা যায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে আসে রেশমের টানে। রেশম বাণিজ্যে দখলদারিত্ব থেকেই পরে তারা ঔপনিবেশিক দখলদারিত্ব কায়েম করে। যদিও বাংলায় রেশমের ইতিহাস আরো দীর্ঘ। ১৬৬০-এর দশকে মুর্শিদাবাদ একটি পরগনা সদর দফতর হিসেবে গণ্য হয়। এসময়েই মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে ইউরোপীয়রা কুঠি স্থাপন করে। কেননা সেসময় ইউরোপের বাজারে বেঙ্গল সিল্কের চাহিদা ছিল দুর্নিবার এবং এ অঞ্চল থেকে তখন প্রচুর পরিমাণে রেশম ও রেশমজাত দ্রব্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ প্রদেশে হতো নিয়মিত রপ্তানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটেনে প্রচুর পরিমাণ বেঙ্গল সিল্ক রপ্তানি করে সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।
রেশম কাপড়ের সোনালী দিন আজ আর নেই সত্যিই। নেই মসলিন, জামদানি, বালুচরী বা বুটিদারের রমরমা। কালের কঠোর নিয়মে হারিয়ে গেছে বাংলার নবাব দিল্লীর সমাজ, ইংরেজ বণিক অথবা কাশিমবাজার কুঠি কিন্তু চারশ' বছরে সব কিছুই কি একেবারেই হয়েছে বিলীন?
হয়তো বা না। তাই মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে আজও চাষ হয় তুঁত গাছ, চাষ হয় রেশমগুটি। খোসবাগ থেকে রোশনি বাগ যাওয়ার পথে এরকম অনেক তুতক্ষেত এখনও চোখে পড়ে। সচরাচর তুর্তগাছের সাথে আমাদের পরিচয় নেই। তাই রাস্তার দুই ধারে তুঁত গাছ দৃষ্টি আকর্ষণ করে স্বাভাবিক কৌতুহলে। খবর নিয়ে জানা যায়, কেজি প্রতি ৩১০-৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয় তুঁতপাতা। খরচ বাদে লাভ মন্দ নয়। ব্যবসায়ীদের কাছে সরাসরি বিক্রি করার সুবিধা আছে বলে দামও ভালো। জেলা মুর্শিদাবাদে এরকম ছোটবড় বেশকিছু তুঁতক্ষেত্র রয়েছে এখনও।
জিয়াগঞ্জ মুর্শিদাবাদ জেলার আরেকটি শহর। শহর জিয়াগঞ্জ পার হয়ে একটু এগোলেই রয়েছে তাঁতিপাড়া। এখানে তৈরি হয় সিল্কের শাড়ি। লোকে একে সিল্ক সিটিও বলে। নামে যদিও তাঁতিপাড়া, কিন্তু এখানে তাঁতি পরিবার রয়েছে হাতে গোনা, মাত্র ঘনছয়েক কারখানার মালিকরাই এগুলো পরিচালনা করেন। মালিক-পরিবারের সদস্যরাই এখানে সর্বক্ষণের কর্মচারি। আলাদা করে কর্মচারি নিয়োগে লাভ থাকে না। ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি কোনো সহায়তা নেই, তাই হতাশা সর্বত্রই। সরকার খদির জন্দা অনুদান। দেয়, সিন্ধের জন্য মা। শাড়ি ভেদে আটশো টাকা থেকে বারোশো ঢাকা পর্যন্ত কারখানা মালিকরা মজুরি পান। বর্তমান অধ্যায়। রেশম শিল্পের আদানপ্রদানের কল্যাণে এ পাড়ার অধিকাংশেরই কোনো না কোনো যোগসূত্র রয়েছে বাংলাদেশের সাথে। কারো বাপ-ঠাকুরদাদার ভিটামাটি বাংলাদেশে, কেউ হয়তো শৈশবে এসেছেন। তারপর কেটে গেছে বহুযুগ, কালের নিয়মে জীবনযাত্রার বাধ্যবাধকতায় তারাও থিতু হয়েছেন এখানেই।
বর্ধিষ্ণু গ্রাম মির্জাপুরে সহস্রাধিক পরিবারের বাসা। এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাসিন্দারই এক সময় প্রধান জীবিকা ছিল তাঁত বোনা। শ'ছয়েক তাঁত ছিল গ্রামে। এখন যা প্রায় অর্ধেক। কেননা মির্জাপুরে যে গুণমানের গরদ সিল্ক তৈরি হয় সেই তুলনায় তার বাজার ও প্রচার প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ বাণিজ্য বাড়াতে এযুগে সিঙ্গল জাকার্ড তো কোনওটা ডাবল। তার সঙ্গে এখন যুক্ত। হয়েছে থার্ড জাকার্ডের তাঁতের ছোঁয়া। মির্জাপুরে সিল্কের কদর বাড়িয়ে শাড়ির বাজারের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে জাকার্ড ব্রোকেট অলমিনার। সঙ্গে রয়েছে স্বর্ণচরী ব্রোকেট, স্বর্ণচরী ঘিচা, স্বর্ণচরী স্ট্রাইপ, স্বর্ণচরী ট্রাডিশনাল কিংবা স্বর্ণচুরী সিল্কের উপর জাকার্ড মেসিনের ব্রোকেটের কাজ। তাতে আবার জরির নকশা করা। আগে এ কাজ বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হতো। এখন জাকার্ড মেশিনের সাহায্যে প্রায় সবটাই তৈরি হচ্ছে এই অঞ্চলেই। মূল্য পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকার মধ্যে। দামটা একটু বেশি বলে কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলেন মির্জাপুরের রমরমিয়ে বিকোচ্ছে সিন্ধের উপর সোনালি জরির নকশা। রেশম ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দুশ্চিন্তা দূর করে বাজারে
আধুনিক তাঁত শিল্পীদের মতে, গুণমানসম্পন্ন উৎকৃষ্ট মানের শাড়িতে হাতের কাজ যতটা ভালো ভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, অপেক্ষাকৃত কমদামি শাড়িতে সেটা সম্ভব হয় না। কোরিয়ালের সাদা শরীরের দুই দিকে ৫ থেকে ৭ ইপিরা পাড়। বুনতে লাগে দিন সাতেক মতো। রঙিন জাকার্ডেও দিন আষ্টেক সময় প্রয়োজন দামটা কিঞ্চিৎ বেশি পড়ে সর্বদা। তবে আশার কথা মানুষ এখন গ্রার সর্বোর শাড়ি চাইছেন না। আবার এরই মধ্যে অনেকের আক্ষেপ, বর্তমানের ই-যুগের সাথে তালমিলিয়ে অন-লাইন বিপণনে সড়গড় হতে পারলে জেলা ছাড়িয়ে দেশ বিদেশের বাজারেও সমানে টেক্কা দিত মুর্শিদাবাদি সিল্ক, অতীতের মতোই।
এক সময় মুর্শিদাবাদ খ্যাতি লাভ করেছিল পূর্ব ভারতের 'সিল্ক মক্কা' হিসেবে। মুর্শিদাবাদ সিল্কের কদর ছিল দেশ বিদেশে। এখনও ভিন্ন দেশীয় মানুষের মধ্যে সিল্কের সেই চাহিদা রয়েছে। রয়েছে ভালোবাসাও। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাজারে সেভাবে মেলে না উঁচুদরের মুর্শিদাবাদ সিক্স। সিল্ক শিল্পে জড়িত কারিগরদের আক্ষেপ, প্রশাসনিক উদাসীনতার কারণে আজ মুর্শিদাবাদ দিদের এই দৈন্যদশা। কারিগরদের জন্যও যেমন কিছু ভাবা হয়নি তেমনই বাজার ধরেরাখতেও চোখে পড়েনি সরকারি উদ্যোগ। যে সিল্কের খ্যাতি বিশ্বজনীন সেই সিল্কেরই কারিগরেরা এখন অস্তিত্বের সংকটে। অনিশ্চিত এই পেশা থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন বহু শিল্পী। কেউ কেউ অন্য পেশার সঙ্গে এখনও ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে। কিন্তু, কতদিন এই পেশায় থাকতে পারবেন তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। তাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকেই, ফলে অবশ্যম্ভাবী সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী মুর্শিদাবাদ সিল্ক আজ বিপন্ন।