19th Jun 2024
ভ্রমণ
কমলেন্দু সরকার
হ্যাঁ, একেবারেই মেঘমুলুক। শিলং। শিলংয়ের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় বহুকালের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরও বেশি করে বাঙালি-জীবনের সঙ্গে শিলংকে জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর 'শেষের কবিতা' পড়েননি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। তাই শিলং চেনেন না বা জানেন না এমন বাঙালিও পাওয়া যাবে না।
যাইহোক, বৃষ্টির যে এত সুন্দর হতে পারে তা বর্ষাকালে শিলং না-গেলে বুঝতে পারতাম না। একদিন ভোরবেলা ঘরের জানালা খুলতেই মেঘ এসে নীল খামে চিঠি দিয়ে গেল। সে-চিঠি মেঘমুলুকে স্বাগত জানানোর চিঠি। মেঘ-কুয়াশার অক্ষরে লেখা, অরণ্যের সবুজ-মাখা, নিস্তব্ধতার ভাষার আমন্ত্রণপত্র! সে পত্রখানি খুলতেই দেখি, বৃষ্টি রঙের মেঘমুলুকের একটি ছবি। তার চারপাশে পাহাড়, তারই ফাঁকে উকিঝুঁকি দেয় ঝরনা। সেইসব ঝরনা যেতে যেতে নদী হয়ে ভেসে যায়, কখনওবা হ্রদ হয়ে বাঁধা পড়ে থাকে তার জলশরীরে। পাইনের অরণ্য-চেরা পথ উধাও হয় দূরে কোথাও নাগালের বাইরে! প্রজাপতি তার নকশি-কাটা ডানায় উড়ে উড়ে ঘুরে যায় এক ফুল থেকে অন্য আর এক ফুলে। বৃষ্টি-স্পর্শ কুয়াশামাখা আকাশ-মিনার। ওরা খাসি, জয়ন্তী আর গারো পাহাড়।
কুসুম আলোয় জেগেছে আকাশ। বৃষ্টি লেপটে আছে মেঘে মেঘে। অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা জড়িয়ে আছে মেঘমুলুকের এই পাহাড়ি শহরে। যে-শহরের পথে পথে এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদস্পর্শ। হয়তো রবি ঠাকুরও একদিন-প্রতিদিন বৃষ্টির দিনে গা-ভেজাতেন। মেঘমুলুকে অপার স্নেহ-বর্ষণে সিক্ত শিলং। তাই বর্ষার ঠিকানা প্রযত্নে শিলং। অন্যান্য পাহাড়ি শহর থেকে শিলং একেবারে ভিন্নরকম। রোদ, বৃষ্টি, মেঘের এমন খামখেয়ালিপনা আর কোনও শৈলশহরে দেখেছি বলে মনে পড়ে না! আকাশে আলো এখানে অনেক আগেই আসে। তবুও কী নিস্তব্ধতা, নির্জনতা চতুর্দিকে! সব মানুষই বোধহয় নিমগ্ন ঘুমে। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষকে দেখা যাচ্ছিল ইতস্তত। ঘরের জানালা দিয়ে দূরে পাহাড়ের মাথায় আলোর খেলা নজরে আসছিল। হঠাৎই
মেঘবালিকারা খেলতে খেলতে নীচে নেমে এলা জানালা দিয়ে বাঁধনহারা মেঘবালিকারা ঢুকে পড়ে ঘরের অন্দরে। সঙ্গে হিমশীতল বাতাস। সারা শরীর ভিজিয়ে আমন্ত্রণপত্র দিল তারা। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো মেঘ ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘর জুড়ে! অপূর্ব এক দৃশ্য তৈরি হয়ে ওঠে মুহূর্তে। বাইরের আকাশ তখন ঘরের ছাদ জুড়ে আটকে! অন্য মেঘেরাও উড়তে উড়তে জানালা খোলা পেয়ে শাইশাই করে ঢুকছে অবিরত। জানালা বন্ধ করতেও মন যায় না। এমনটা আর কোথায় পাব মেঘের সঙ্গে বাসা বুঝলাম শিলং এমনই! হঠাৎই উধাও হয় মেঘবালিকার দল। শুরু হল বাইরে টুপটাপ বৃষ্টি। ক্রমশ বাড়ে। এল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
আবার স্মরণে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ''এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়, এমন দিনে মন খোলা যায়
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায় এমন দিনে তারে বলা যায়
সে কথা শুনিবে না কেহ না, আর ঘরে বসে থাকা যায় না।''
অগত্যা বেরিয়ে পড়ি। ভরা বর্ষায় যদি শিলংই না-ঘুরলাম তাহলে এই মেঘমুলুকে আসবার কোনও অর্থই নেই। বৃষ্টি মাথায় হাঁটতে লাগলাম উদ্দেশ্যহীন কোনও উদ্দেশ্যে। পৌঁছলাম যে-পথে, তার নাম ক্যামেল ব্যাক অর্থাৎ উটের পিঠ। ওপরে উঠলে তেমনই বোধ হয়। বেশ ফাঁকা রাস্তা। বহু গাছগাছালির সঙ্গে পাইনও আছে। গাছের পাতা চুইয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। দূরে পাহাড়। রাস্তা দিয়ে পা-ভিজিয়ে বৃষ্টির জলে স্রোত হু হু করে নামছে নদীর মতো। আকাশ জুড়ে জলভরা মেঘ উড়ে চলেছে আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। কোনও পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরছে। অনবরত আসা-যাওয়া মেঘের খেলা! দারুণ লাগছে। বর্ষায় শিলং কেন যে সুন্দর বুঝতে আর বাকি থাকে না।
শিলংয়ে বর্ষা কখনও ক্লান্ত করে না। বরং মন আরও বেশি উড় উড় হয়ে ওঠে। এক রাস্তা ছেড়ে অন্য আর এক পথে হেঁটে যেতে মন চাই। নিশির ডাকের মতো বৃষ্টির শব্দে চড়াই-উতরাই ভেঙে চলে যাই দূরে কোথাও, অন্য কোথাও। বৃষ্টির পর শিলং সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষক লাগে শিলং পিক থেকে। এর উচ্চতা প্রায় ছ'হাজার ফুট। শহর থেকে দশ কিমি দূরে শিলং পিক যাওয়ার পথটি ভীষণই মনোরম। কত রকমের, কত রঙের ফুল ফুটে থাকে। সবুজের মাঝে রঙের খেলা চোখের আরাম! আর আছে পথচলতি বহু ঝরনা। ঝরনাগুলো নদী হয়ে হারিয়ে যায় চোখের আড়ালে। গার্নাস জলধারা থেকে সৃষ্টি উমিয়ম নদী। শিলং শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে নদীতে বাঁধ দেওয়ায় তৈরি হয়েছে উমিয়ম লেক। তবে লোকমুখে এর পরিচিতি বরাপানি নামে। রডোড্রেনডন, পাইন আর নাম না- জানা গাছের অরণ্য উমিয়মের চারিপাশ জুড়ে। গাছের ছায়ায় লেকের জল সবুজ হয়ে আছে। বর্ষায় আরও সবুজ। বৃষ্টির স্পর্শে উমিয়মের সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অবর্ণনীয়!
সারাদিনই বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা চলে মেঘমুলুকে। কখনও ইলশেগুঁড়ি, কখনও বড় বড় ফোঁটা, আবার কখনওঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। আবার কখনওবা মেঘেরএক চিলতে আলোর ঝিলিক! রোদ উঠলেই শুরু হয় ঘাসফড়িংয়ের ওড়াউড়ি। প্রজাপতি উড়ে উড়ে বনফুলে বসে। সবুজ উপত্যকার রং বদলে যায় বৃষ্টি-স্পর্শ আলো-ছায়ার মাঝে। শিলং-চেরাপুঞ্জির প্রাকৃতিক রূপ-মাধুর্যে মুগ্ধ হতেই হবে বর্ষায়। বর্ষার মেঘলা আকাশ। সূর্যের মুখ কখনওসখনও দেখা যায়। তাই আলো-আঁধারির মায়াজালে মেঘের দেশকে অন্যরকম লাগে! বর্ষায় অন্তহীন নয়ন- জুড়নো রূপ মেঘমুলুকের! বর্ষায় না-ভিজলে শিলংয়ের রূপমাধুরী উপলব্ধি করা যায় না। তাই এবার বর্ষায় মেঘমুলুকে।
কীভাবে যাবেন: হাওড়া কিংবা শিয়ালদা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার ট্রেন আছে। তারপর সেখান থেকে গাড়িতে শিলং। দমদম বিমানবন্দর থেকে শিলং আছে।
কোথায় থাকবেন: শিলং পুলিশ বাজারে বহু ভাল হোটেল আছে। যোগাযোগ করতে পারেন ডাব্বু চক্রবর্তীর সঙ্গে