1st Aug 2024
সাহিত্য
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আমাদের মাদারিপুর হাইস্কুলে যখন টিচার হিসেবে যোগ দিলেন সন্ন্যাসীস্যর, আমি ক্লাস সিক্স। নতুন টিচার এলে সবাই কৌতূহলে চুরচুর থাকি। কী জানি কীরকম হবেন মাস্টারমশাই। খুব কি রাগী, রেগে গেলে কি লক্ষ্মণস্যরের মতো চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকবেন বহুক্ষণ নাকি রতনসারের মতো তাড়া করবেন ডাস্টার হাতে নিয়ে। সন্ন্যাসীস্যারের মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, চুলের রং ঠিক কালো নয়, সামান্য লালচে, চোখে হালকা বাদামি রঙের চশমা, মুখে সর্বদাই হাসির ছোঁয়া। উঁহু, দেখে মনে হল সার তেমন খেপচুরিয়াস নন। প্রথমদিকে তিনি আমাদের ক্লাসে আসতেন বাংলা পড়াতে। ছোটরা সাধারণত গম্ভীর মুখের টিচারদের পছন্দ করে না, একটু ভয়ে-ভয়ে থাকে, আর ভয়ে থাকা মানে ব্রেন কাজ করে না। সন্ন্যাসীসার ছিলেন ঠিক তার উল্টোটা। তাঁর পড়ানোর ধরনটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। গল্প করতে করতে পড়াতেন, তার ফলে সেই বয়সে আমরা বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছিলাম বাংলার ক্লাসে। হাসিখুশি মুখের সন্ন্যাসীস্যর খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদের মধ্যে। একদিন তিনি হঠাৎ এসে গেলেন আমাদের ভূগোল ক্লাসে নিতে। আমরা যারপরনাই খুশি হলাম কেন না ভূগোলের অনাদিস্যর শুধু গম্ভীর হয়ে পড়ান তাই নয়, হঠাৎ কোনও অমনোযোগী ছাত্রের দিকে চোখ পড়লে তার কাছে গিয়ে বলেন, 'বল তো, কোন পর্যন্ত পড়িয়েছি।' ছেলেটি হয়তো সেই মুহূর্তে চোখ রেখেছিল জানালার বাইরে উড়তে থাকা অ্যারোপ্লেনের মতো দেখতে একটা ঘুড়ির দিকে। উঠে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল বোকা- বোকা চোখে। তাতে ভূগোল স্যর ভীষণ খেপে গিয়ে চেঁচাতে থাকেন, 'স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চ। এক পায়ে দাঁড়াবি। ব্যস, বাকি পিরিয়ড তার তাল গাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা। সন্ন্যাসীস্যর ভূগোল পড়োবেন দেখে আমরা উল্লসিত, কিন্তু তিনি বললেন, 'আমি এসেছি প্রক্সি দিতে। প্রক্সি শব্দটা ততদিনে জানা হয়ে গেছে আমাদের। কলেজে নাকি একজন ছাত্র না এলে তার কোনও বন্ধু তার মতো গলা করে রোলকলের সময় বলে, 'ইয়েস স্যর।' সার নাকি বুঝতে না পেরে সেই অনুপস্থিত ছাত্রের নামের পাশে প্রেজেন্ট লিখে দেন কলেজের হাজার হাজার ছাত্রের ভিড়ে স্যররা নাকি ধরতেই পারেন না এই কারচুপি। আমরা শঙ্কিত হয়ে ভাবি স্কুলে এরকম করলে তাকে হয়তো ক্লাস থেকে ঘাড় ধরে বার করে দেবেন সাররা। কিংবা হয়তো রাসটিকেটই করে দেবেন তাকে। এখানে সব ছাত্রকেই চেনেন সাররা। রাসটিকেট শব্দটা তখন নতুন শিখেছি।
রাসটিকেট হওয়া মানে বাকি জীবনের জন্য সেই স্কুলে পড়তেই পারবে না সে। কিন্তু সন্ন্যাসীসার জানালেন ভূগোলস্যর অনাদিবাবু আজ স্কুলে আসেননি কোনও কারণে, তাঁর ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে, তাই তিনি এসেছেন যাতে এই ক্লাসের ছাত্ররা চেঁচামেচি করে অন্য ক্লাসের ছাত্রদের ডিস্টার্ব না করে। তারপর বললেন, 'তা হলে এখন কী করা অমনি আমরা সমস্বরে বলি, 'তা হলে একটা গল্প বলুন।
সন্ন্যাসীসারের মুখে একগাল হাসি। তাঁর মুখ দেখে মনে হল তিনি এরকম একটি প্রস্তাবের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, তৎক্ষণাৎ বললেন, 'তবে তাই হোক। তার আগে পর্যন্ত সন্ন্যাসীস্যরের কাছে আমরা কখনও গল্প শুনিনি, যদিও বাংলা ক্লাস নেওয়ার সময় তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি কিছুটা গল্প বলার মতোই। একটু সময় নিয়ে সন্ন্যাসীসার বললেন, 'কী গল্প শুনবে? ভূতের গল্প?' -হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা হলে তো খুব ভালো হয়, সকলের সমবেত স্বর।
-বেশ তা হলে শোনো, বলে সন্ন্যাসীস্যর চেয়ারের উপর জুতজাত হয়ে বসলেন, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে, চশমাটা ঠিকঠাক চোখে লাগিয়ে বলতে শুরু করলেন, 'আসলে কী জানো? ভূতের গল্প আমারও খুব পছন্দের। যা ঠিক পুরোপুরি বুঝি না, অথচ ছোট থেকেই ভূতের একটা অস্তিত্ব কীভাবে যেন ঢুকে যায় মনের ভিতরে, তা নিয়ে চর্চা করা মনের পক্ষে একটা ভালো ব্যায়াম।'
সঙ্গেসঙ্গে জিজ্ঞাসা করি, সার, আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন?
সন্ন্যাসীসার হাসলেন, 'জীবনে কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায় যার কোনও ব্যাখ্যা করা যায় না, তখন মনে হয় এ ঘটনাটা যেন অলৌকিক। এরকমই একটা ঘটনা দিয়েই শুরু করি আজ। ঘটনাটা কিন্তু আমাদের স্কুলের।'
-সে কী, সার? আমাদের স্কুলের? আমাদের বিস্ময় তখন চরমে। -হ্যাঁ, তোমরা হয়তো না, আমিও একদা এই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। সেই ছাত্র বয়সেরই একটা ঘটনা বলি। তখন আমার বয়স চোদ্দো কি পনেরো। ক্লাস টেনে পড়ি। সেদিন আমি আর আমার এক সহপাঠী রবিন্দর ঠিক করলাম একটা অ্যাডভেঞ্চার করব।
-স্যার, রবিন্দর আবার কীরকম নাম? -সে এক বেশ মজার ঘটনা। ওর নাম ছিল রবীন্দ্রনাথ ঘটক। কিন্তু মা-বাবার দেওয়া নাম ওর পছন্দ হয়নি, বলত, ধুস, অত বড়ো একটা মানুষের নামের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে থাকাটা ঠিক নয়। বরং ফিল্মস্টার ধর্মেন্দ্র নামটা যেমন পরিচিত ধর্মেন্দর নামে, আমার নামটা রবিন্দর হলেই মানায়।
বলে হাসি-হাসি মুখ করে তাকালেন সন্ন্যাসীস্যর, বললেন, সেই রবিন্দর ছিল খুব সাহসী। কোথাও ভূতের গল্প শুনলেই সেখানে গিয়ে হাজির হত ভূত দেখবে বলে। বহুবার একা একা শ্মশানে গিয়েছে ভূত দেখতে। তার নানা অভিজ্ঞতা। একবার আমাকে বলল, 'সন্ন্যাসী, অনেক তো এমনি ভূত দেখলাম, একদিন ঘোড়াভূত দেখি দু'জনে।' তো আমি বললাম, 'ঘোড়াভূত আবার কী?' তখন যা বলল তাতে আমি হতবাক। বলল, 'আমাদের স্কুলের মাঠের এক কোণে দুটো কবর আছে তা খেয়াল করেছিস?' বললাম, 'হ্যাঁ, সে তো রোজই দেখি। রবিন্দর বলল, ওই দুটো কবরের একটা মানুষের কবর, অন্যটা একটা ঘোড়ার। আজ রাতে তোতে আমাতে স্কুলের মাঠে আসব। দেখবি কী মজা হয়।
সন্ন্যাসীসার এই পর্যন্ত গল্পটা বলার পর আমি উঠে দাঁড়াই, বলি, সার, বললেন তো আমাদের স্কুলের কথা তা হলে কোন কবরের কথা বলছেন?
-ওই যে, বলে আঙুল নির্দেশ করে দেখালেন সন্ন্যাসীস্যর, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দুটো ইটের গাঁথনি আছে তা নিশ্চয় তোমরা লক্ষ করে থাকবে। এখন ইটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় ধ্বংসস্তূপের চেহারা। ওই দুটো কবরের কথা বলছি। রবিন্দর বলল, 'ওই দুটো কবরের যেটি বেশি লম্বা সেটি একটি ঘোড়ার কবর, আর যেটি কম লম্বা সেটি একটি যুবকের। প্রতি রাতে দু'টি কবর থেকে বেরিয়ে আসে দুটি ভূত। তারপর বলেই রবিন্দর বলল, না, এর পর কী ঘটল তা মুখে বললে তোর কোনও ইন্টারেস্ট থাকবে না। আজ অমাবস্যার রাত। এরকম রাতেই ভূতরা চরতে বেরোয়। আজ তোতে আমাতে সন্ন্যাসীস্যর গল্পটা থামিয়ে একটু হাসলেন। মিটিমিটি, বললেন, কী, তোমাদের ইন্টারেস্ট লাগছে তো?
আমরা সমস্বরে বলি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তারপর? জানো-তারপর রাত্রি ন'টা নাগাদ দুই বন্ধু রওনা দিলাম স্কুলের উদ্দেশে। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় দেড় মাইল দূরত্বে। অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুট করছে চারপাশ। রবিন্দরকে বলেছিলাম, 'একটা টর্চ নিই', কিন্তু রবিন্দর বলল, 'উর্চ নিলে আর ভূত দেখার চার্ম থাকবে না। ভূত দেখার জন্য চাই নিশুতি রাতের অন্ধকার। তো আমরা সেই নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে চলেছি। কাঁচা রাস্তায় কত খানাখন্দ, তাতে পা পড়লে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, পড়তে পড়তেও সামলে নিচ্ছি। মাঝেমধ্যে কোনও ইটের টুকরো থাকলে তাতে হোঁচট খাচ্ছি। কিন্তু রবিন্দরের কথার মধ্যে এমন চমক ছিল যে, সারা শরীর জুড়ে শিহরন। একসময় পৌঁছে গেলাম স্কুলের মাঠটার কাছে। আমি কবরটার কাছে এগোতে যাচ্ছি, রবিন্দর বলল, এত কাছে গেলে তো চলবে না। আয়, এই আমগাছটার নীচে দাঁড়াই। গল্পটা শুনতে শুনতে আমাদের শরীরেও শিহরন। আমাদের ক্লাস থেকেই দেখা যায় কবরদুটোর দাংসস্তূপ, গল্পটা শুনছি, আর একটু দূরে হলেও চোখ চলে যাচ্ছে কবরদুটোর দিকে। ক্ষয়ে-যাওয়া ইটের গাঁথনির কবরদুটো অনেকবার দেখেছি, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনও। তার মধ্যে এত যে গণ্ডগোল লুকিয়ে আছে তা তো শুনিনি এতদিন।
সন্ন্যাসীস্যর তখন বলে চলেছেন, বুঝলে, দু'জনে আমতলায় দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কেন দাঁড়িয়ে আছি তা ঠিক জানি না রবিন্দরকে ফিসফিস করে বললাম, 'কোথায় ভূত', তাতে রবিন্দর বলল, 'অত ভূত-ভূত করলে তো আর ভূত এসে বলবে না, 'এই তো এসেছি আমি' ভূত দেখতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে।' তা আমরা অপেক্ষা করছি। অনেক রাত হয়ে গেছে। একটু দূরেই বড় রাস্তা। অন্ধকারে সেই রাস্তাও যেন অদৃশ্য। মনে হচ্ছে পড়ে আছে একটা কালো ফিতে। গ্রামদেশে একটু রাত হলেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, পথে লোকজন আর চলাচল করছে না। সেই নির্জন নিশুতি রাতে আমরা দু'জন দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ। নিজেদের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি তখন। ভূত আর আসে না।
সন্ন্যাসীসার যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আমরা যারা শ্রোতা তারাও অস্থির হয়ে ভাবছি কখন ভূতেদের দেখা পাবেন ওঁরা। বোধ হয় এমন ঘণ্টাখানেক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, হঠাৎ কোন অলক্ষ্য থেকে শুনতে পেলাম যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে। আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, রবিন্দর আমার গায়ে ছোট্ট করে চিমটি কাটল যাতে আমি চুপ করে যাই কান খাড়া করে শুনতে থাকি কোথায় যেন একটা ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে টগবগ টগবগ টগবগ। শব্দটার উৎপত্তি যেন কাছেই, কিন্তু সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে মাঠের মধ্যে। সামনে অন্ধকার এতটাই ঘন যে, চোখে পড়ছে না কিছু। শব্দটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের চারপাশে। একসময় মনে হল আমাদের ঠিক সামনে দিয়েই ছুটে গেল শব্দটা। তখন মাঠের সেই শব্দ যেন ঢুকে পড়ল বুকের ভিতর। হৃৎপিণ্ডের মধ্যেই যেন শব্দ হচ্ছে টগবগ টগবগ টগববগ। ভয়ে, উত্তেজনায় আমার হাত- পা তখন কাঁপছে। মনে হচ্ছে কোনও একজন ঘোড়সওয়ার যেন তার বাহনের উপর আসীন হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়।
আমরাও গল্পটা শুনছিলাম হাঁ করে, জিজ্ঞাস্য করলাম, সার, এই মাঠে?
-হ্যাঁ। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই চোখে পড়ল না, তাই বুঝে উঠতে পারলাম না শব্দটার উৎপত্তি কোথায় কিছুক্ষণ পরে শব্দটা আর শুনতে না- পাওয়া যাওয়ায় রবিন্দর বলল, 'চল, আজকের অধিবেশন শেষ।' আমি তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট হলাম না, আবার বাড়ির পথে ফিরে যেতে যেতে বললাম, 'কিন্তু ভূত কোথায়? এ তো শুধু শব্দ।' তখন রবিন্দর বলল, 'তুই এতে একটুও ভয় পাসনি?' বললাম, 'শুধু শব্দ শুনে গায়ের মধ্যে শিরশির করছিল ঠিকই, কিন্তু ভূত দেখে চমকে ওঠা যাকে বলে তা হল না।' রবিন্দর বলল, ঠিক আছে, তা হলে তোর সাহস আছে। তোকে আসল দৃশ্য দেখাই। আর ঠিক দশদিন পরে দশমী তিথি। একটু রাত হলেই কানাভাঙা চাঁদ উঠবে মাথার উপর। তখন একটু একটু জ্যোৎস্না ছড়াবে মাঠের সবুজ ঘাসে। সেসময় দেখবি ঘোড়াভূতের আসল রহস্য। আমরাও উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছি সেই আসল রহস্যের উৎসের, জিজ্ঞাসা করলাম, আবার এলেন এই মাঠে?
-হ্যাঁ, ঠিক যেরকম বলেছিল রবিন্দর, সেই দশমী তিথি আসতেই বলল, চল, আজ রাতে আর একবার হানা দিই ঘোড়াভূতের সন্ধানে। তবে হাতে একটা কালো চাদর নিয়ে আসবি। কালো চাদর কেন লাগবে তা বুঝে উঠতে পারলাম না আমি তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। রবিন্দর এসে ডাকতেই বেরিয়ে পড়লাম কালো চাদর হাতে নিয়ে। দেখি রবিন্দরের হাতেও কালো চাদর। হাঁটতে হাঁটতে দু'জনে পৌঁছে গেলাম এই মাঠের এক কোণে। ঠিক আগের দিন যেমন কবরের কাছে গিয়েছিলাম, আজ তার থেকে একটু দূরে। তখন অল্প অল্প জ্যোৎস্না উঠেছে, মাঠের সবুজের উপর ছড়িয়ে পড়ছে সেই জ্যোৎস্নার গুঁড়ো। একটু দূরে স্কুলটা দেখা যাচ্ছে, স্কুলবিল্ডিংটা ভিজছে জ্যোৎস্নার আলোয়। দূর থেকে সেই কবরদুটোর অস্পষ্ট ছায়া চোখে পড়ছে আজ। রবিন্দর আমাকে বলল, 'এবার কালো চাদরটা গায়ে দিয়ে নে।' বলে সে নিজেও তার চাদরটা দিয়ে ঢেকে নিল শরীর। সেই সঙ্গে চাদরের একটা খুঁট তুলে নিয়ে ঢেকে নিল তার নাকটাও। আমাকেও ইঙ্গিতে বলল সেরকমভাবে নাক পর্যন্ত ঢেকে নিতে। সন্ন্যাসীসার বলছেন, আর ইঙ্গিতে দেখাচ্ছেন কীভাবে চাদর দিয়ে ঢেকে নিতে হয়েছিল নাকসুদ্ধ শরীরটায়।
তাঁর সেই মূকাভিনয় দেখে হেসে ফেলল আমাদের বন্ধু বীরেন। আমরা ভেবেছিলাম সারের কথায় বীরেন হেসে ফেলেছে, সার নিশ্চয় রেগে একশা হবেন, কিন্তু স্যর তখন গল্প বলার মেজাজে, তাঁর মুখে ফুটে উঠল সামান্য হাসির রেখা, পরের মুহূর্তে আবার নিবিষ্ট হলেন তাঁর গল্প বলায়। বললেন, ঠিক আগের দিনের মতোই। অপেক্ষা করছি দু'জনে, কিন্তু মুহূর্তগুলো যেন আর কাটে না, তবে সেদিন জ্যোৎস্না থাকায় তেমন অস্থির হচ্ছিলাম না আগের দিনের মতো। সেই জ্যোৎস্না-ভেজা রাতে দেখছিলাম চাঁদের আলোর রং কীরকম বদলে যায় প্রতি মুহূর্তে। এই মনে হচ্ছে রুপো রং, পরক্ষণে যেন তাতে মিশে যাচ্ছে একটুকরো বেগুনি রং। আবার কখনও যেন সেই রঙের সঙ্গে মিশছে লালচে রং। কখনও এক টুকরো মেঘ এসে চাঁদের মুখটা ঢেকে দিচ্ছে, তখন আরও আঁধার হয়ে উঠছে পৃথিবী, আবার যেই না সরে যাচ্ছে মেঘ, অমনি কী চমৎকার হেসে উঠছে চারপাশ যেন মেঘের এই আলোছায়া ভারী উপভোগ করছে প্রকৃতি। সেই দৃশ্যের মধ্যে যখন নিমগ্ন হয়ে আছি, হঠাৎ সেই আগের দিনের মতো ঘোড়ার খুরের টগবগ শব্দ। চকিতে সতর্ক হয়ে চোখ রাখি মাঠের চারপাশে, কিন্তু রবিন্দর আমাকে আঙুল দিয়ে দেখাল সেই কবরদুটোর দিকে। সেদিকে চোখ রাখতেই নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসে দেখি কি, লম্বা কববরটার ভিতরে থেকে কিছু একটা যেন বেরিয়ে এল, ধোঁয়ার মতো আবছা অবয়ব তার, ভালো করে চোখ পাতলে মনে হবে একটা দশাসই ঘোড়া। সেই অবয়বটা গিয়ে দাঁড়াল চৌকো কবরটার সামনে। সেখান থেকে বেরিয়ে এল আর একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া অবয়ব। সেটি দেখতে যেন একজন মানুষের মতো, লম্বা-চওড়ায় সেও ইয়া বড়। বলতে বলতে হঠাৎ একটু ঘামলেন সন্ন্যাসীস্যার।
শুনতে শুনতে আমরা বড় বড় করে ফেলছি চোখ, সন্ন্যাসীস্যরের চোখমুখণ্ড তখন বেশ ত্রস্ত দেখাচ্ছে। তাঁর গল্পে যতিচিহ্ণ দেওয়া সহ্য হচ্ছে না আমাদের, অস্থির হয়ে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করছি, সার, তারপর?
সন্ন্যাসীসার তখনও যেন বাস করছেন ত্রাসের মধ্যে, বললেন, হঠাৎ দেখি সেই মানুষের মতো অবয়বটা লাফিয়ে উঠল ঘোড়ার অবয়বটার উপর, তারপর শুরু করল সারা মাঠ চক্কর দিতে। বিস্ময়ভরা গলায় জিজ্ঞাসা করি, দেখলেন সেই ঘোড়সওয়ারকে? যেন একটা ছায়ার কুণ্ডলী ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠময়, আর সেই চলমান ছায়ার সঙ্গে শব্দ ডঠছে টগবগ টগবগ টগবগ। আমার শরীরের ভিতর কী এক ভয়ংকর উত্তেজনা। কীরকম যেন এক অস্থির অনুভূতি। চেপে ধরলাম রবিন্দরের একটা হাত। বুঝতে পারলাম আমার হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা। ছায়ার কুণ্ডলীটা তখন চলতে চলতে ওল্টাচ্ছে পাল্টাচ্ছে, কখনও মনে হচ্ছে কুণ্ডলীটা আর নেই, যেন চলে গেছে দূরের দিকে, শুধু শব্দটা শোনা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে, হঠাৎ দেখি কাছেই কুণ্ডলীটা। এরকম কতক্ষণ হল তার ঠিক নেই, তারপর একসময় কুণ্ডলীটা সেই কবরদুটোর কাছে গিয়ে থামল, একটু পরে মিলিয়ে গেল হাওয়ার মতো। বলতে বলতে সন্ন্যাসীস্যর থামলেন আবার। তারপর সামনে রাখা জলের গেলাস তুলে নিয়ে চোঁ চোঁ করে নিঃশেষে খেয়ে একটা বড়ো করে শ্বাস নিলেন। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি, সাব, আপনি তো বললেন অনেকদিন আগের ঘটনা। কিন্তু কী ঘটেছিল তা জানতে পেরেছিলেন।
সন্ন্যাসীসার থাড় নাড়লেন, বললেন, রবিন্দর সব খবর রাখে। বলল, ইংরেজ আমলের ঘটনা। এক ইংরেজ সৈন্য ঘোড়ায় চড়ে নাকি এই রাস্তা দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে, হঠাৎ সামনে একটা গরুর গাড়ি পড়ে যাওয়ায় আর সামলাতে পারেনি। প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়ে সেই সৈন্য আর ঘোড়া দুজনেই স্পট ডেড। গরুর গাড়ি আর তার গাড়োয়ানের কী হল তা জানা যায়নি সেই সৈন্য আর ঘোড়া দু'জনকেই কবর দেওয়া হয়েছিল এখানে। তারপর থেকেই নাকি প্রতি রাতে কবর থেকে সেই ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে আসে একইরকম ভাবে ছুটতে থাকে সেই আগের মতো কিন্তু এখনও কি সেই ঘটনা ঘটে চলেছে, স্যর?
সন্ন্যাসীস্যর এতক্ষণে হাসলেন, বললেন, 'কী জানি, তা বলতে পারব না। তারপর তো আমি কলেজ পড়তে চলে গিয়েছিলাম এখান থেকে। এতদিন পরে ফিরে এসেছি স্কুলের চাকরি পেয়ে। এখনও ঘোড়সওয়ারের অস্তিত্ব আছে কিনা কে জানে তবে তোমাদের সাহস থাকলে পরখ করে দেখতে পারো আছে কিনা।'
ব্যস, সারা ক্লাস নিস্তব্ধ। সবারই জোড়া জোড়া চোখ তখন তাকিয়ে আছে ক্লাস থেকে অনেকটা দূরে সেই কবরদুটোর দিকে। হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সার, তা হলে নিশ্চয় আপনি বিশ্বাস করেন ভূতে?
সন্ন্যাসীস্যর এবার হাসলেন হা হা করে, বললেন, ভূতকে বিশ্বাস করলে ভূত আছে, না করলে নেই। তবে ওই যে কথায় আছে না বিশ্বাসে মিলয়ে বস্তু তর্কে বহু দূর।