30th Jul 2024
প্রতিবেদন
অভীক চট্টোপাধ্যায়
১৯৩০/৪০ দশকের ঢাকুরিয়ায় কলকাতা নগরীর ছিটেফোঁটা ছবিও ছিল না। একেবারে গ্রামীণ পরিবেশ। পুকুর, গাছগাছালির সবুজ বিন্যাস, পাখির ডাক। সবমিলিয়ে বাংলার প্রকৃতির উপছে পড়া চিত্র। এখানেই জন্ম (১৯৩১) ও বেড়ে ওঠা বাংলা গানের অন্যতম যুগরচনাকারী শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। ছোটো থেকেই গলায় সুরের অধিষ্ঠান। সেই দেখে তাঁর দাদা নিয়ে গেলেন সন্তোষ বসুমল্লিকের কাছে। শুরু হল গান শেখা। এর কিছুদিন পরেই সন্ধ্যা গিয়ে পড়লেন সংগীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। এই সংগীতগুরুর তালিমেই বলা যায় কুঁড়ি সন্ধ্যা ফুল হয়ে ফুটলেন। এতদিন যে হৃদয়ভরা সংগীত ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে চাইছিল, তা এবার বেরিয়ে এল। খুঁজে পেলো তার সুর-ভ্রমণের পথ।
সন্ধ্যার সাংগীতিক শিক্ষা বরাবরই শাস্ত্রীয় মুহুর্মুহু। সংগীতে। কিন্তু তাঁর রাজত্ব আধুনিক ও ছায়াছবির গানের দুনিয়ায়। যদিও তিনিই সম্ভবত আধুনিক বাংলা গানের জগতে একমাত্র শিল্পী, যিনি এই গানের পাহাড়প্রমাণ জনপ্রিয়তার চাপ নিয়েও নিয়মিত বিভিন্ন আসরে, রেডিয়ো বা টেলিভিশনে পরিবেশন করে গেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত। বাংলা ও বাংলার বাইরের প্রায় অধিকাংশ শাস্ত্রীয় গানের কনফারেন্সে গান করেছেন। অথচ, ওই একইসময়ে আধুনিক গানে বা প্লে ব্যাকের আঙিনায় একের পর এক সুপার হিটের বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছেন তিনি। গাইছেন বিভিন্ন জলসায়। শ্রোতারা পাগল হয়ে উঠছেন। এ বড়ো কম কথা নয়। চিরকাল দু'ধরনের গানকে নিয়ে চলার জন্যে শুধু সাংগীতিক ক্ষমতা থাকলেই চলে না। তার সঙ্গে মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হয় এই ভাবেই গানের প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবেশনে ঘটে মেজাজের তফাৎ। আধুনিক গানের সেইসময়ের প্রায় প্রত্যেক শিল্পীরই শাস্ত্রীয় গানের ভিত যথেষ্ট পাকাপোক্ত ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ছাড়া আর কাউকে বোধহয় এতটা নিয়মিত ভাবে লঘু সংগীতের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় গান পরিবেশনকে বজায় রেখে চলতে দেখা যায়নি। যখন সন্ধ্যা আধুনিক ও ছবির গানে অসম্ভব জনপ্রিয় কণ্ঠ, গানগুলি তখন তিনি তালিম নিয়েছেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ-এর মতো সংগীত-ঈশ্বরের কাছে। তারপর, তাঁর প্রয়াণের পর, উস্তাদজীর সুযোগ্য পুত্র উস্তাদ মুনাব্বর আলি খাঁ-র কাছেও তালিমের ধারা অব্যাহত ছিল তাঁর। এটাই লক্ষনীয়।
এই পারদর্শিতার প্রয়োগ সন্ধ্যা রেখেছিলেন লঘু সংগীতের ক্ষেত্রে। এইসব গানের মধ্যে যেখানে শাস্ত্রীয় সংগীতের ছোঁয়া ছিল, সেখানে তাঁর ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছিলেন অসামান্যভাবে। কিন্তু সেখানে একটা মাপ বজায় রেখেছিলেন। দিয়েছিলেন ভাবকে প্রাধান্য। সেইজন্যেই বোধহয় তিনি যখন সুচিত্রা সেন সহ অন্যান্য বহু নায়িকার লিপে রোমান্টিক গান করছেন, তা যেমন আমাদের হৃদয় ফুঁড়ে প্রবেশ করছে, তেমনি একইসঙ্গে বাংলা ঠুংরি রেকর্ড করছেন কোনও এক বছরের পুজোর সময় বা "বসন্ত বাহার", "যদুভট্ট" ইত্যাদি ছবিতে শাস্ত্রীয় গান নির্ভর গানগুলিকে ফুটিয়ে তুলছেন অনায়াস দক্ষতায়। যাতে কিন্তু কালোয়াতির প্রকাশ প্রধান না হয়ে, তা ভাবমাধুর্যে অপরূপ হয়ে উঠছে। এখানেই সন্ধ্যা অনন্যা।
সেই ১৯৪০-এর দশকে আগমন সন্ধ্যা মুখোপাধধ্যায়ের। ১৯৪৫ সালে গিরিন চক্রবর্তীর কথায় সুরে একটি রেকর্ডে দুটো বেসিক গান গাইলেন। এরপর, প্রথমবার প্লে ব্যাক করলেন, রাইচাঁদ বড়ালের সুরে "অঞ্জনগড়" ছবিতে। যা মুক্তি পেলো ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তখনও আলাদা করে সন্ধ্যাকে চেনা যায়নি। যা চেনা গেল এর তিনমাস পরে মুক্তি পাওয়া "সমাপিকা" পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়ের। শৈলেন রায়ের কথায় যে চারটি গান সন্ধ্যা গাইলেন এই ছবিতে, তাতে সাধারণ মানুষের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলেন তিনি। "মানুষের মনে ভোর হলো আজ..." বা "সূর্য ওঠার স্বপ্ন নিয়ে কে জাগে..."-র মতো যেভাবে ছড়িয়ে পড়লো সন্ধ্যা-কণ্ঠ থেকে, তা যেন সদ্য স্বাধীন দেশে আশার বার্তা ছড়ালো।
আগের থেকে কণ্ঠ-প্রক্ষেপণে সম্পূর্ণ এক নতুন আধুনিক ধরন নিয়ে এলেন তিনি। এ ব্যাপারে রবীন চট্টোপাধ্যায়ের অবশ্যই অবদান ছিল। কারণ, এরপর থেকে আমরা দেখলাম সন্ধ্যা-রবীন সংযোগে একের পর এক মাইলস্টোন সৃষ্টি হতে। তবে যাই হোক, কণ্ঠ ব্যবহারে এই নবধারার ক্ষেত্রে শিল্পীর নিজস্ব ভাবনাচিন্তা তো থাকতেই হবে। ১৯৫৪ সালে "অগ্নিপরীক্ষা" ছবিতে সন্ধ্যা আবার ঘটালেন বিস্ফোরণ। প্রথম গাইলেন সুচিত্রা সেনের ঠোঁটে। এই ছবি থেকে উত্তম- সুচিত্রা রোমান্টিক জুটি হিসেবে বলিউডি ধাঁচে যে নতুন ধারা নিয়ে এলেন, তার সঙ্গে অনবদ্যভাবে নিজের গায়নভঙ্গিকে খাপ খাইয়ে নিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। প্রবাদপ্রতিম সুরকার অনুপম ঘটকের অবিস্মরণীয় সুরচলনে গড়া "গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু...", "কে তুমি আমারে ডাকো..." জাতীয় গান অনায়াসে বেরিয়ে এসেছে সন্ধ্যার গলা থেকে। এরকম জটিল স্ক্যানিং-এ তৈরি গান থেকে যে এভাবে প্রেম ঝরে পড়তে পারে, তা না শুনলে বোঝা অসম্ভব। যা অনুপম ঘটক-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অপূর্ব মেলবন্ধনের ফসল। এই সংযোগেও তৈরি হয়েছে অনেক কালজয়ী গান।
একটা ছবি থেকেই সুচিত্রা-সন্ধ্যার অমোঘ সংযোগ ঘটে গেল। এটা এমনিতে হয়ে যাওয়া নয়। চরিত্র, অভিনেত্রী, সিচুয়েশন ইত্যাদি অনুযায়ী নিজের গায়নভঙ্গি কীরকম হওয়া উচিৎ, তা নিয়ে শিল্পীকে ভাবতে হয়েছিল এবং গান থেকে গানে সন্ধার এই অফুরন্ত বৈচিত্র্য এভাবেই গড়ে উঠেছে। যিনি গাইছেন "মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা...", "ঠুন ঠুন ঠুন কাঁকনে যে কী সুর..."-এর মতো চলনের আরও গান, সেই তিনিই অনায়াসে কন্ঠে তুলে নিচ্ছেন, "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা...", " আমাদের ছুটি ছুটি..." জাতীয় আনন্দে ভেসে বেড়ানোর ভঙ্গির গান। সুচিত্রা বা আরও বেশকিছু নায়িকার লিপে যে ধরনের প্রেমের গানের ডালা মেলে ধরছেন, তিনিই আবার প্রেমকে আরেক চোখভেজানো আবেগের রূপে মেলে ধরছেন, "তুহু মম মন প্রাণ হে..."-র মতো গানে। আবারও বলছি, এইসবের মধ্যে কিন্তু গেয়ে চলেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত। আর তাঁর অল্পদিনের মুম্বাইয়ের জীবনে যে বৈচিত্র্য তিনি দেখিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি হিন্দি গানে, তাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যা এখানে সেইভাবে আলোচিত হলো না। আসলে সমুদ্রপ্রমাণ বৈচিত্র্য ও প্রতিভায় আচ্ছাদিত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানের কথা নিয়ে একটি নিবন্ধে আর কতটুকুই বা বলা যায়? যেটা লক্ষনীয়, সময়, গানের ধরন, সুরকারের সুর বৈশিষ্ট, ছবির ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয় দিকগুলো ইত্যাদি আরও অনেককিছুর সঙ্গে তাল রেখে যেভাবে নিজের কণ্ঠ-প্রক্ষেপণকে প্রাসঙ্গিক করে এগিয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, তার দৃষ্টান্ত বিরল। এই জন্যই সেই রাইচাঁদ বড়াল, অনুপম ঘটক থেকে শুরু করে আজকের কবীর সুমন, সবাইকার সুরনির্মাণে তিনি উজ্জ্বল হয়ে থেকেছেন। এখানেই তাঁর সাঙ্গীতিক ক্ষমতার সঙ্গে সংগীত-মেধারও পরিচয় মেলে। অথচ সবটাই অগাধ প্রতিভায় পরিপূর্ণ আধার থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসা। আত্মজীবনী "গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু"...
তাঁর বইয়ের এক জায়গায় সন্ধ্যা বলেছিলেন, একবার তিনি কটক রেডিও স্টেশনে গাইতে গেছেন। ওখানকার স্টেশন-ডিরেক্টর তখন প্রখ্যাত সৈয়দ মুজতবা আলি। তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে যা বলেছিলেন, সেটুকুই যথেষ্ট সন্ধ্যা-কণ্ঠের সীমা-পরিসীমাহীন বৈচিত্র্য বোঝার জন্যে "মাইয়ার (মেয়ে) সকালবেলায় খেয়াল শুনতাছিলাম আমি। মনে হইতাছিল, পঞ্চাশ বছরের কেউ গাইতাছেন। অথচ মাইয়ার যখন লাইট গান শুনি মনে হয়, একদম আলাদা মাইয়া।"