5th Jul 2024
সাহিত্য
নিজস্ব প্রতিনিধি
উমার বোধন
দেবযানী মুখোপাধ্যায়
উমা সেদিন খুব তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফিরে দেখল, বাড়িতে কেউ নেই। গেট খুলতে গিয়ে বুঝল মস্ত এক তালা ঝুলছে। পাশের বাড়ির কাকিমা এসে তালা খুলে উমাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। মা, বাবা, ভাই---ওঁরা সব কোথায় গেল! উমা ভাবছে। স্কুল ব্যাগটা টেবিলের উপরে রেখে দিল। যেখানে থাকে। উমার এটা স্বভাব। যতই ব্যস্ততা থাক, বাইরের থেকে ফিরে এসে জায়গার জিনিস জায়গাতে গুছিয়ে রাখতে হবে। উমা ভাবছে... কেবল ভাবছে...। এরমধ্যেই মুঠোফোন বেজে উঠল। রিসিভ করল উমা। ওপ্রান্ত থেকে ভাই ফোন করে বলছে, একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য। তুই তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আমরা আসছি। উমা কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল ভাই। উমা স্কুল ড্রেস ছেড়ে, হাত পা ধুয়ে, এবার খাওয়ার টেবিলের দিকে এগোল। ভাবছে, কী সারপ্রাইজ হতে পারে! প্লেটটা নিয়েছে সবে, এমন সময়ই ডোর বেল বেজে উঠল। উমা আস্তে আস্তে যখন গেটের দিকে এগোতে যাবে, তখন আবার ফোন বাজল। উমা ফোনটা রিসিভ করল। ভাই বলছে, তাড়াতাড়ি দরজা খোল। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে। উমা এবার তৎপর হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা যেই খুলেছে, উমার মনে হল, এক আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠল চিত্ত। এক অনাবিল আনন্দ যেন উমাকে জড়িয়ে ধরল। সঙ্গে চাপা উদ্বেগ! সারপ্রাইজটা কী! মা, বাবা, ভাই-তিনজনই উমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, এবার হাত পাত। উমা হাত পাতল। বুঝতে পারল, ওর হাতের মুঠোয় কী যেন একটা, নরম তুলতুলে গোল মতো জিনিস। উমা সেটাকে নিয়ে মুখে, বুকে খুব আদর করছে। উমার মন আনন্দে ভরে গেল। একটা ছোট্ট কুকুরছানা। সেও উমাকে আদর করছে। তার আদরে, ভালবাসায় উমার অন্ধচোখ গড়িয়ে জল পড়তে লাগল। হঠাৎ করে পাশের ক্লাবে ঢাক বেজে উঠেছে। উমার মনে হল, এই তো, মায়ের বোধন শুরু হয়ে গেল। এই হল আমাদের ছোট্ট উমার গল্প। আছে, আমার আপনার সবার বাড়িতে।
ফেরার
মানস প্রতিম দাস
'দাদার কি চাকরি না ব্যবসা?'
'হুম'
কিঞ্চিৎ নীরবতা। আবার একই প্রশ্ন, 'দাদার কি... অসীম এবার কিছু বলে না। আলতো পায়ে উঠে কফি কাউন্টারের দিকে যায়। কফি সে খাবে না। সিনেমাটাও দেখা হয়ে গিয়েছে দু' বার। লাউঞ্জে বসে থাকাটাই তার উদ্দেশ্য। কিন্তু বসতে দিলে তো!
চাকরি নিয়ে প্রশ্নটা কোনদিকে ঘুরবে সেটা জানে অসীম। সরকারি না বেসরকারি? পার্মানেন্ট? বলছিলাম... ভালো জামাকাপড়ে, মোটামুটি সুপুরুষ একটা লোককে ভরদুপুরে পাবলিক প্লেসে অলস বসে থাকতে দেখলে অনেকে অনেক কিছুই বলতে চায়। জমিবাড়ি, বিয়ে থা বা অন্তত: কিছুটা সময়ের সুখভোগ! সব কিছুই হতে পারে। অসীম চিত্রকর নয়, কবি নয়, লেখক নয়...কিচ্ছু না! নেশাভাঙেও হাতেখড়ি অবধি, তার বেশি কিছু না। ওসব শ, তার ভালো লাগে না। একইসঙ্গে দশ বছরের পুরনো অফিসটাও ভালো লাগে না। তাই সে আপাতত ফেরার। চেনা সিমকার্ড সরিয়ে নতুন সিমকার্ড নিয়েছে। বাড়িতে বলার মধ্যে কেবল বুড়ি মা। অফিস না গিয়ে শুয়েবসে থাকলে সেও যা বলবে তাও কম কিছু না। অফিস বাদ দিয়ে নিজের জন্য একটা নতুন পরিচয় খুঁজছে অসীম - এটা শুনলে হয়ত মা জিজ্ঞেস করবে আধার কার্ড হারিয়ে ফেলেছে কিনা!
কয়েক দিনের জন্য ডুয়ার্সে গিয়ে একটা সস্তা হোটেলেবসে ছিল অসীম। টাকাপয়সা মিটিয়ে দিচ্ছিল রোজই। তাতেও চারদিন পরে মালিকের কেমন সন্দেহ জাগে। দাঁত বের করে আলাপ করতে আসে সন্ধেবেলায়। তারপর ওই, চাকরি না ব্যবসা, বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব, 'ফাইনাল বিলটা দিন!'
কলকাতা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে একটা আশ্রমের খোঁজ দিয়েছিল কে যেন। সেখানেও চুঁ দিল এক সকালে। বিকেল অবধি অপেক্ষা করে গুরুজির দেখা পাওয়া গেল। ঈশ্বরের করুণা, করুণাময়ের লীলা, সত্যের পথ, জগৎ মিথ্যা এইসব আলোচনা শেষ হলে অসীমের পুরনো পরিচয়েই ফিরতে চাইলেন গুরুজি। 'কী করা হয়?' কিছুক্ষণের মধ্যে যার অর্থ দাঁড়াল কত দিতে পারবেন! একমাস পর অফিসের কোলাপসিবল গেটের সামনে আবার অসীম। ফাইল, নোট, বস, কলিগ, পিএনপিসির ইডেন উদ্যানে ফিরল ফেরার মানুষটা। দারোয়ান থাপা কিছুটা শিক্ষিত, ইংরেজি উচ্চারণ ঠিকঠাক পারে। হলুদ দাঁত বের করে একগাল হাসল। তারপর বলল, আজকেই নাকি বড়বাবু অসীমের নামের পাশে 'অ্যাবস্কণ্ডিং' লিখত। ভালোই করেছে ফিরে এসে। অফিস শুরুর অনেক আগেই এসে পড়েছে, লম্বা ঘরটা ফাঁকা। বরাদ্দ চেয়ারে ধুলো জমেছে। ধপ করে বসতেই উড়ে গেল ধুলো, চেয়ার জাপটে ধরল। অসীমের কানে বাজল মরতে দম তক!