14th Aug 2024
প্রতিবেদন
পল্লব মিত্র
৭৮ বছর পূর্ণ হল, আমাদের ঐতিহ্য ও গর্বের স্বাধীনতা। অসংখ্য মানুষের গভীর আত্মত্যাগ ও বহু মানুষের আত্মবলিদানে, অবশেষে অর্জিত এই স্বাধীনতা। পুরুষদের পাশাপাশি দেশের নানান স্থানে বিভিন্ন সময় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই স্বাধীনতার মহান কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন স্মরণীয় মহিলারা। ভারতের বিভিন্ন স্থানে একদা ঝাঁসির রানি থেকে শুরু করে লক্ষ্মী সায়গলের মত স্মরণীয় বীরাঙ্গনাদের পথ অনুসরণ করে আমাদের এই বঙ্গদেশেও শতবর্ষ আগে থেকেই দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে বহু স্মরণীয় ব্যাক্তিদের নানা কর্মে সঙ্গী হয়েছিলেন দুঃসাহসিক ও আদর্শে ব্রতী বহু স্মরণীয় মহিলারা।
১৯২২ সালে স্বামীর আদর্শে সঙ্গী হয়ে দেশবন্ধুর সহধর্মিণী সর্বজনশ্রদ্ধেয়া বাসন্তীদেবী "নারী সত্যাগ্রহ সমিতি ও কর্মমন্দির” গড়ে তুলেছিলেন। লক্ষ্য ছিল নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মহিলাদের চরকায় সুতো কেটে খাদি বস্ত্র তৈরি করে পথে ঘাটে বিক্রয় করে জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত করতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। পরে চিত্তরঞ্জনের সুযোগ্যা সহধর্মিণীহয়ে সুভাষচন্দ্র থেকে শুরু করে অসংখ্য তরুণ দেশপ্রেমিকদের পুত্রবৎ স্নেহের হয়েসে স্বাধীনতার যুদ্ধের নানান আন্দোলনে এক স্মরণীয় শ্রদ্ধেয় নাম হিসাবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিলেন বাসন্তীদেবী। স্বামীর ইচ্ছা অনুসারে ইজিরা মোড়ের বিশাল বসতবাড়িটিকেও সকলের কথা চিন্তা করে দান করে গিয়েছিলেন। সেখানেই গড়ে উঠেছে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন হাসপাতাল। সুভাষচন্দ্র সহ বহু স্বাধীনতার তরুণ যোদ্ধাদের আন্তরিক মাতৃস্নেহে সর্বদা সহায়তা করে ছিলেন বাসন্তীদেবী।
ত্রিশের ও চল্লিশের দশকে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে নানান বয়সের মহিলা বিভিন্ন সময় স্থানীয় বহু বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থেকে কঠিন পরিশ্রম ও দেশকে স্বাধীন করার স্থির লক্ষ্যে বীরবিক্রমে কঠোর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন। নেলী সেনগুপ্ত, সরোজিনী চট্টোপাধ্যায়ের মত স্মরণীয় সব বঙ্গনারীদের আত্মত্যাগের ফলে অবশেষে অর্জিত হয়েছিল গর্বের এই স্বাধীনতা।
স্বদেশী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবী মতবাদের এক সমান্তরাল ভাবনায় বহু মহিলারাই গোপনে বা বহু সময় প্রত্যক্ষ ভাবে অগ্রজ বিপ্লবীদের নানান গুপ্ত কাজে অপ্রত্যক্ষ বা বহু সময়ে প্রত্যক্ষ ভাবে অগ্রজ নেতাদের নানা ভাবে সহযোগিতা করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড এগিয়ে দিয়েছিলেন। বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের মাসিমা দুকড়িবালা দেবী গোপনে বিপ্লবীদের অস্ত্র নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রাখতেন, কিন্তু গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ তার সিউড়ির বাড়িতে হানা দিয়ে রডা কোম্পানীর ৭টি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজের ট্রাঙ্ক আটক করে। এই অপরাধে তাকে তৃতীয় শ্রেণির কয়েদী করে আড়াই বছর সশ্রম কারাদণ্ডি দন্ডিত করা হয়। সেই সময় তার সঙ্গে দেখা হয় এক বিপ্লবী নারী ননীবালা দেবীর।
বিপ্লবী অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এর পিসিমা ননীবালা দেবী বিপ্লবীদের গোপনে আস্তানা দেওয়ার অভিযোগে ভারতবর্ষের প্রথম ওএকমাত্র ১৮১৮ সালের ৩ নং রেগুলেশনে বিনা বিচারে আটক রাজবন্দিনী ছিলেন। চট্টাগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর কুমারী সুহাসিনী গাঙ্গোপাধ্যায় শাঁখা- সিঁদুর পরে যুগান্তর দলের শশধর আচার্যের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করে অনন্ত সি, গনেশ ঘোষ, জীবন ঘোষাল ও আনন্দ গুপ্তকে অনেক দিন আশ্রয় দিয়েছিলেন। মহিয়সী সেই সুহাসিনী দেবীর স্মৃতিতে ভবানীপুরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যার অভিযোগে সুনীতি চৌধুরী ও শান্তি ঘোষেকে ফাঁসির পরিবর্তে আজীবন দ্বীপান্তরের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। ১৪ ও ১৫ বছরের দুই কিশোরীর দীর্ঘ কারাবাস সে যুগে বিশাল আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৩৯ সালে গান্ধিজির সক্রিয় উদ্যোগে যখন রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়, তখন দুজনেই কারামুক্ত হন।
সুভাষচন্দ্রের শিক্ষক বেনীমাধব দাসের কন্যা বীনা দাশ ১৯৩২ সালে স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোঁড়ার অপরাধে নয় বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ১৯৩১ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রগার লুণ্ঠনের মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে সূর্যসেনের শিষ্যা কল্পনা দত্তর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। সুভাষচন্দ্রের পাশে থেকে জেল মুক্তির পর কল্পনা দত্ত স্বাধীনতা আন্দোলনের নানান ক্রিয়া কর্মে আবার সক্রিয় ভাবে যুক্ত হন। ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পি সি যোশীকে বিবাহ করেন। আমৃত্যু জনহিতকর নানান কাজে নেতৃত্ব দান করেসকলের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তাঁর লেখা রোমাঞ্চকর একটি স্মৃতিকাহিনী এক অনন্য গ্রন্থ। ১৯৩২ সালে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়ার পরিবর্তে নিজেই আত্মহননের দুর্জয় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনন্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তাঁর এই নজির গোটা দেশবাসীকে সেদিন চমকিত করেছিল। সূর্য সেনের অনুগামী প্রীতিলতাই প্রথম মহিলা বাঙ্গালি শহিদ, যিনি গুলি বিদ্ধ অবস্থায় বিষপান করে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালে গান্ধিজির ভারত ছাড়ো অভিযানে মেদিনীপুরের তমলুকের রাজপথে জাতীয় পতাকা হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্থানীয় এক গ্রাম্য মহিলা। বিশাল সেই শোভাযাত্রায় পুলিশের গুলি চালনায় জাতীয় পতাকা হাতে সামনে থাকা সেই মহিলা গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অহিংস সেই আন্দোলনে সেই স্মরণীয় শহিদ সারা দেশ জোড়া এক স্মরণীয় নাম মাতঙ্গিনী হাজরা। তমলুকের পাশাপাশি কলকাতা রেডরোডেও মাতঙ্গিনী হাজরার একটি মূর্তি আজও শোভা পাচ্ছে। যুগান্তর গোষ্ঠীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেত্রী কমলা দাশগুপ্ত দলের বহু বিপ্লবী অভিযানের পেছনে তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। ৬ বছর তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। তাঁর রচিতগ্রন্থ " রক্তের অক্ষরে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার নারী"।
১৯৩০ সালের ৩১ মে দর্শনা লবণ তৈরি কারখানার সামনে গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহ কর্মে সঙ্গী হয়ে ২ হাজার মহিলাকে নিয়ে সরোজিনী চট্টোপাধ্যায় (পরবর্তী কালে নাইডু) এক তীব্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘকাল কারাগারে ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে উত্তরপ্রদেশে সরোজিনী দেবী ভারতের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
দীর্ঘ সময় ধরে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে সহিংস ও অহিংস দুই ধারাতেই উপরের উল্লিখিত বরণীয়ারা ছাড়াও অসংখ্য মহিলারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করে পথে নেমেছিলেন। শুধু কারাবাসই নয়, নানান ধরনের অত্যাচার, পুলিশি নিগ্রহ, ও বহু কষ্ট করে জীবনকে চালিত করেছিলেন শুধু মাত্র দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে। উল্লিখিত সুপরিচিত মহিলারা ছাড়াও ক্ষীরদাসুন্দরীদেবী, সাবিত্রীদেবী, কমলা চট্টোপাধ্যায়, অমৃতা সেন, অনুভা সেন, পারুল মুখোপাধ্যায়, সহ জানা অজানা বহু মহীয়সি বঙ্গনারী শুধুমাত্র পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার স্থির লক্ষ্যে অবিচল থেকে জীবনপণ করে লড়াই করেছেন। পুলিশের গুলিতে অনেকের মৃত্যুর পাশাপাশি অনেকেই আত্মহনন করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সম্প্রতি চারজন বিপ্লবী শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীনা দাস ও উজ্জ্বলা রক্ষিত এর স্মৃতিতে দক্ষিণ কলকাতার মনোহর পুকুরে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে স্থানীয় একটি পার্কে একটি বৃহৎ অংশে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে চার মহীয়সীর স্মৃতিতে শ্বেত পাথরের সৌধ। বিস্তৃত ভাবে সেই পাথরের গায়ে খোদাই করা হয়েছে তাদের বীরত্বের কাহিনী। এই ধরনের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে শুধুমাত্র কিছু মহান বঙ্গনারীর জীবন ও আত্মত্যাগের ঘটনাকে শ্রদ্ধা জানাতেই লেখকের এই বিনম্র প্রয়াস। বলে রাখা ভালো উল্লিখিত নামের বাইরেও আরও বহু স্মরণীয় নাম ভবিষ্যতে জানতে পারলে সংযোজিত আকারে সামগ্রিক নামের তালিকা উল্লেখ করার বাসনা রইল।
ঋণ স্বীকারঃ সর্বাণী মুখোপাধ্যায়