24th Sep 2024
প্রতিবেদন
নিজস্ব প্রতিনিধি
এবার লর্ড ক্লাইভ পুজোর সময় আমার বাড়িতে প্রতিমা দর্শন করতে আসছেন। তোমার এবার আসা চাই-ই। রাজা নবকৃষ্ণ দেব-এর এই চিঠি পৌঁছে গেছিল তাঁর বন্ধুদের কাছে। সেই শুরু দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাঙালি- বাড়িতে সাহেবদের আসা। বাবুদের আসল উদ্দেশ্যে ছিল সাহেবদের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে নেওয়া।
রাজা নবকৃষ্ণের দেখাদেখি কলকাতার অন্য বাবুরাও দুর্গাপুজোয় আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করলেন সাহেবদের। তাই ১৭৯২-এর ক্যালকাটা ক্রনিকল-এ দেখা গেল বেশকিছু বাবুর নাম। সেই তালিকায় ছিলেন- - দর্পনারায়ণ ঠাকুর, বারাণসী ঘোষ, রামহরি ঠাকুর, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচাঁদ মিত্র, নারায়ণ মিত্র। ওরা ছাড়াও সেইসময় রাজা সুখময় রায়, রমাকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও দুর্গাপুজো করতেন।
সেকালের কলকাতায় বাবুদের বাড়ির পুজোয় ছিল খুব জাঁকজমক। খরচ হত পাঁচ-ছয় লক্ষ টাকা। তাই বাবুদের বাড়ির পুজোকে বলা হত জাঁকের পুজো। বাবুরা সাহেবদের বিনোদনের জন্য বসাতেন বাঈগানের আসর। শুধু গান নয়, নাচ হত। সঙ্গে চলত খানা-পিনা। পিনার আসরে চল ছিল বিদেশি তরলের। বাঈজিদের মধ্যে কদর ছিল খুব হিঙ্গন বাঈয়ের। সাহেবরা এঁর গান খুব পছন্দ করতেন। নিকির নাম ছিল নাচের জন্য।
নিকি ছিল ভীষণ সুন্দরী। এছাড়াও বেগমজানেরও নামডাক ছিল। পুজোর। জাঁকজমক আর বাঈগানের আসর নিয়ে প্রবল প্রতিযোগিতা ছিল বাবুদের মধ্যে। তবে দশমীর দিন সকলেই হাজির হতেন বালাখানার মাঠে। এখান। থেকেই শুরু হত প্রতিমা বিসর্জনের পালা।
কলকাতার আদি পরিবার বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীরা। এই বাড়ির পুজো ৪১৩ বছরের পুরনো। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালায় পুজো হত বলে, এর পরিচিতি ছিল আটচালার পুজো। এর সামনেই ছিল নাটমন্দির। যেখানে বসে জোব চার্নকের সঙ্গে সাবর্ণ চৌধুরীদের চুক্তি হয়েছিল কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুরের লিজ নিয়ে। ওই নাটমন্দিরের কয়েকটি থাম আজও টিকে রয়েছে অতীতের গরিমায়।
দর্জিপাড়ার দুর্গাচরণ মিত্রের বাড়ির পুজো ২৬৭ বছরের। দুর্গাচরণের ভাইপো ছিলেন নীলমণি মিত্র। তাঁর পৌত্র রাধাকৃষ্ণ মিত্রের আমলে এই বাড়িতে পুজোর শুরু। সেই ২১০ বছর আগে। এখানে পুরনো কাঠের সিংহাসনে অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই পাড়াতেই রামনারায়ণ দাঁ-এর বাড়ি দুর্গা হলেন অভয়া। দ্বিভুজা দুর্গার অসুর নেই। নেই অস্ত্র। তবে মায়ের সঙ্গে সন্তানেরা আছে- লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। ২৬০ বছরের পুরনো দুর্গার চুল বাঁধা রঙিন ফিতেয়। জানা যায়, কন্যার অকালপ্রয়াণের শোকভুলতে পুজো শুরু করেছিলেন রামনারায়ণ।
ছাতুবাবু-লাটুবাবু বাড়ির পুজো দুশো পেরিয়েছে। পুজো শুরু করেছিলেন রামদুলাল দে। বছরের কিশোরীর আদলে। লক্ষ্মী-সরস্বতী এখানে জয়া- বিজয়া রূপে বিরাজা। তাই ওঁদের বাহন পেঁচা আর হাঁস থাকে না। দেবীকে দোলায় চাপিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়। জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজোরও দুশো পেরিয়েছে। শুরু করেছিলেন প্রীতরাম দাশ। তবে জাঁকজমক বাড়ে রাজচন্দ্র দাশের আমলে। বিবেকানন্দ রোডের দাঁ-বাড়ির পুজো ১৬৫ হল। রথের দিন থেকেই এই বাড়িতে পুজোর আচার-অনুষ্ঠান শুরু। ঠনঠনের দত্তবাড়ির আদিপুরুষ দ্বারকানাথ দত্ত ছিলেন বানিয়া এবং জার্ডিনার স্কিনার অ্যান্ড কোম্পানির এজেন্ট। বিদেশ থেকে সুতির এ-বাড়ির দুর্গা বারো কাপড় আমদানি করতেন। ১৮৫৫-তে এ-বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রচলন। এখানে মা ঘরোয়া। তাই এখানে মহাদেবের কোলে দুর্গা। ওঁদের ঘিরে আছেন চার সন্তান। দত্তবাড়িতে পুজো হয় নান্দিকেশর পুরাণ মতে। কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রের বাড়ি দুর্গাপুজোয় মায়ের ভোগে দেওয়া হত গরুর গাড়ির চাকার মাপের জিলিপি। গজা ছিল বারকোশ মাপের। মতিচুর ছিল কামানের গোলা যেন। দুর্গাদালানে প্রতিমার পাশে থরেথরে সাজানো থাকত মিষ্টিগুলো। সেইসব মিষ্টি ঠেকত কড়িকাঠে। তাই সেকালের কলকাতায় বলা হত- দেবী দুর্গা খেতে আসতেন অভয়চরণ মিত্রের বাড়ি। দুর্গাপুজো নিয়ে কলকাতার বাবুদের। বাবুয়ানি আজ কিংবদন্তি। কোনও কোনও বাড়িতে পুজোর জৌলুশ আজও বর্তমান। আবার কোনও কোনও বাড়িতে অস্তমিত। যাইহোক, কলকাতার বাবুর বাড়ির পুজোয় উপস্থিত থাকলে বেশ লাগে। ইতিহাসটা জানা থাকলে আরও ভাল লাগে। ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় সেই পুরনো কলকাতায়। যেখানে আরেকটি কলকাতা।