26th Sep 2024
প্রতিবেদন
অমৃতা ভট্টাচার্য
শেষ রাত্রে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি উঠে। জেলে-নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছে আঁধ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।…
গরম ভাতের থালার বাইরে সেই আমার ইলিশের সঙ্গে নিবিড় সখ্য। রুই কাতলা মৃগেলের মতো প্রতিদিনের জীবন তো নয়! রুপালি শস্যের ঘ্রাণে বর্ষার যে বাতাস ভরে থাকে! যে ঘ্রাণ মানুষকে দিয়ে দুগরাস বেশি ভাত খাইয়ে নিতে পারে সে কী সামান্য! তার এই সমস্ত অসামান্যতা নিয়ে আমার কাছে সে দেখা দিল আবার। সমরেশ বসুর গঙ্গায়। বর্ষার মাটি ধোয়া জলে মাছ ধরা জেলে নৌকার সে ছবি বহুদিন মনে মনে ভেবেছি। আমার ছেলেবেলার গ্রাম, বাংলাদেশের সীমানা পেরোনো দরমার বাড়ি, কালোজিরায় মরিচের বাগাড়… এই সব নিয়ে ইলিশ যেন আস্ত একখানা বর্ষার দিন। ছায়া ঘেরা পুকুরের ধারে ধারে দুধ কচুর জঙ্গল, মানুষেরা উনোনে কড়াই চাপিয়ে দিয়েও দুটো পাতা ছিঁড়ে আনে একেকদিন। নরম কচুপাতার পেলব নরম শরীরে এক ফালি মাছ ফেলে দিয়ে রান্না করে খোকারমা পিসি। বলে, পাগলি রে সেই আমাদের গেরামে এমন দিনে খাল ভরে ডিঙি নৌকা কত! খোল ভরা মাছ। আমার দিদিমায় সেই কাঁচা ইলিশা দিয়ে কেমন ঝোল রানতো, জানিস! আমি আসলে সেসব ডিঙি নৌকা দেখিনি কোনোদিন কিন্তু শুনে শুনে এইটুকু বুঝেছি বর্ষায় রূপকথা লেখা হয়। হাড়ি পাতিলে তার গন্ধ লেগে থাকে। সে যেন নিজেই একখানা উপন্যাস। নিজেই একখানা পুরাণপ্রতিমা। আর কী আশ্চর্য দেখুন, এই খোকারমা পিসি, মানিকবাবু অথবা সমরেশ বসুর গড়ে দেওয়া শৈশব কৈশোরে আমি জেনেছিলাম, ইলিশ কী নিবিড় ভাবে বাংলার। বাঙালির। সেই জানাটুকু নিয়েই আমার পথ চলার শুরু। সে পথ যে একদিন মহাসমুদ্র থেকে নদীর মোহনাকে বেছে নেবে কে জানতো! গঙ্গা, পদ্মা ছাড়াও কত কত নদী নিজের মতো করে তাই ইলিশ পুরাণ লিখেছে সেই কবে থেকে। খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে ইলিশ হেরিং পরিবারভুক্ত। আমরা যাকে ইলিশ বলে চিনি তার রূপভেদ আছে বটে কিন্তু কমবেশি তার একটা পরিচিত গড়ন আমাদের জানা। সেই চেনা ইলিশের নিবাস যতই সমুদ্দুরের গভীরে থাক না কেন, সে সময়ে সময়ে নদীতে আসে। ডিম পাড়তে তো আসেই, অন্য সময়েও আসে। এই নদীর ইলিশকে নিয়েই আমাদের মাথাব্যথা। তাকেই তো আমরা সোনা-রুপার মূল্যে চিনেছি। নদী, মোহনা আর সমুদ্দুরের গল্পে এই ইলিশের বিস্তার কিন্তু দীর্ঘ। সেই ইরান ইরাক থেকে শুরু করে পাকিস্তান হয়ে গুজরাতের নর্মদা পেরিয়েও গোদাবরী হয়ে কেরালাকে ছুঁয়ে ওডিশা, বাংলা পেরিয়ে থাইল্যান্ড, মালেশিয়া এমনকী ভিয়েতনাম থেকে মায়ানমার পর্যন্ত ইলিশের দেখা মেলে। এই বিস্তারকে তাই আমার বলতে ইচ্ছে করে উপন্যাসোপম।
আসলে মাছের জীবনের গল্প আমায় ভাবায় কিন্তু তার চেয়েও বেশি অবাক করে মানুষের রান্নার গল্প। রান্নার উপকরণের বৈচিত্র। নদী, জল, মাটি সব মিলিয়েই তো মাছের শরীর। একেক নদীর মাছে তাই একেক স্বাদ। এই স্বাদের বিচার সহজ নয়। জাপানি টি-টেস্টারদের কথা মনে পড়ে আমার এসব বলতে গেলে। সুগন্ধা আর ডাকাইতা নদীর মাছে কী ফারাক? এই স্বাদ বোঝা কি সহজ? না, একেবারেই না। কিন্তু মানুষই পারে। তাই না একেক নদীর তীরে মানব সভ্যতার যে বৈচিত্র চোখে পড়ে, সেই ভিন্নতা দেখি রান্নাঘরেও। রান্নার গল্পে না হয় খানিক পরে আসব, নদীর গল্পে ডুবে যাই বরং। ধরা যাক সিন্ধু নদে ইলিশের যে চলাচল সে ভারী আশ্চর্যের। ইলিশেরা ঊর্ধ্বমুখে সাঁতরাতে পারে অসম্ভব রকমে। সিন্ধু নদের তলার যে মাটি, যে জল তাতে রূপের জেল্লা বেড়ে যায় তাদের কয়েকগুণ। তারা সেই মস্তকলন্দরের দরগা অবধি সাঁতরে যায়। যাকে আপনারা ঝুলেলাল বলেও চেনেন অনেকে। এখানে আশ্চর্য হল এই যে, ইলিশেরা পির সাহেবের দরগা অবধিই সাঁতরে যায়। সিন্ধু নদে এই তাদের দস্তুর। লোক প্রবাদ আছে, তারা (ইলিশ) নাকি পির সাহেবকে পিঠ দেখায় না। এই সুস্বাদু মাছের কদর জানতেন সিন্ধু নদের তীরবর্তী মানুষেরাও। তাঁদের হেঁশেলে পালো কোকের মতো রান্না যেমন জন্ম নিয়েছে তেমনই, গরম বালিতে মশলা মাখানো ইলিশ বেক করে খাওয়াও ছিল দস্তুর। সেসব ফুরিয়ে গেছে বোধহয় কিন্তু সিন্ধি রান্নাঘর এখনও ইলিশকে ভালোবাসে। তার ডাল চাওল বা কাড়ি চাওলের পাশে পালা (ইলিশ) মছলি হলে মন ভালো হয়ে যায়। আপনার মনে হতে পারে অমন করে মশলা মাখিয়ে ইলিশ রান্না, সে যে ভারী অন্যরকম! এমন করে কি কেউ খায়! আসলে আপনি বা আমি একা নই মুজতবা আলির মতো আরও অনেকেই অবাক হয়েছেন এমন রান্নার কথা ভেবে। কে বলতে পারে কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়নের ইলিশও অনেককেই হতাশ করে হয়তো। স্বাদের এই পক্ষপাতীত্ব বড় বালাই।
কলকাতার বাইরে জেলায় জেলায় ঘুরলে বরং তার কিছুটা সুরাহা হয় বটে। মুখি কচু দিয়ে ইলিশের ঝোল যার প্রিয় সে কি আমার ঝিঙে দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল খেয়ে সব সময় খুশিই হবে? হয়তো হবে না। এই জেলায় জেলায় ভিন্নতার পাশে আছে রাজ্যে রাজ্যে ভিন্নতার গল্প। সেসব পেরিয়ে আছে ইলিশের বর্ণময় আন্তর্জাতিক বৈচিত্র। মালেশিয়ার তেরুবক (ইলিশ) রান্না ভারী অন্য রকমের। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাটা মশলায় মেখে হলুদ পাতায় মুড়ে মাছ রান্নার কী অপূর্ব কৌশল। এই তেরুবুককে আমরা চিনি চন্দনা ইলিশ নামে। এদেশে এর দর খানিক কম। গরম গরম তেরুবুক মাছের রোস্ট কিন্তু মন্দ নয়, সে রান্না কেবল আমাদের চেনা স্বাদের নয়, এইটুকুই। স্বাদের কাছে মানুষের তাই অনেক ঋণ। ইরাবতীর ইলিশ যখন কলকাতার বাজারে বিকোয়, তখন সে বাঙালির রান্নাঘরে দেখা দেয় চেনা স্বাদের গল্প হয়েই। অথচ দেখুন, রেঙ্গুন শহরের পথ চলতি রেঁস্তরায় সে নাথালাং পঙ হয়ে শোভা পাচ্ছে। তার নরম শরীর তখন টোম্যাটো, পেঁয়াজ আর লেমনগ্রাসের গন্ধে ভরে উঠেছে। মানুষেরা নরম ভাত দিয়ে সেই মাছ খাচ্ছেন। ইরাবতীর অনন্ত জলরাশি এসব গল্পের সাক্ষী থাকে দিনেরাতে। গড়িয়াহাট থেকে রেঙ্গুনকে সে মিলিয়ে দিয়েছে ভাতের থালায়, কেবল মাছের স্বাদ কোরকটি মিলিয়ে দিতে সে অপরাগ। বার্মিজ ইলিশ নিয়ে এসব কথা উঠল যখন তখন না হয় ইরান ইরাকের গল্পও উঠে আসুক। সাবুর (ইলিশ) রান্না করার ধরন সেও তো আলাদা। তবু, সে না হয় বিদেশি। গোদাবরীর তীরে আমের আচার, মাখন আর ঢ্যাঁড়স দিয়ে যে পুলাসা (ইলিশ) রান্নার ইতিহাস সে কি একদিনের? সে কত কত প্রজন্মের স্বাদের সাক্ষী হয়ে আছে।
রান্নার ইতিহাস এইসব নিয়েই এত এতকাল ধরে তার ডালপালা মেলে দিয়েছে মানুষের রান্নাঘরে। সামান্য ইলিশের গল্পেই দেখুন– বার্মা থেকে ইরান ইরাকের রান্নায় তার কতই না বিস্তার, কতই না ফারাক। নামের বৈচিত্র কী কম! এই এত এত নামের ভিড়ে মানুষ তার স্বদটিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছে নিজের মতো করে। আজকের বাংলাদেশ, অবিভক্ত বঙ্গদেশ এবং বৃহত্তর বঙ্গ– ইলিশ রান্নায় কী পার্থক্য মানুষে মানুষে। কারওর কাছে সে কেবলই ইলিশ, কেউ বলে ইলশা, কাজল গৌরী থেকে শুরু করে জলতাপী, গাঙ্গী, মুখপ্রিয়া বাংলায় তার নাম কত! ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলার ফলাফলে যে মাছের দাম বাড়ে কমে তার নামের মালা গাঁথা হবে এতো স্বাভাবিক। আমার তাই কেবলই মনে হয়, যাকে শৈশব কৈশোরে কেবল বাংলার ধন বলে চিনেছিলাম সে যে এমন করে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে চেতনা জুড়ে এ বড় বিষ্ময়ের। চাঁদপুরে ইলিশের বাড়ি, এই না জেনেছিলাম! অথচ মানচিত্র খুলে বসে থাকলে অবাক মানি। ইলিশ কি বিশ্ব নাগরিক হতে চায়! তার অভিযোজনের যাত্রাপথ কী বর্ণিল। সে পথ কমে আসছে ক্রমে। নতুন করে দিক নির্দেশ করছে তাদের অভ্যন্তরীণ জীবনচর্যা। এও তো এক লড়াই। টিকে থাকার। পৃথিবী জুড়ে উদ্বাস্তু মানুষের চলাচল।
মাছেদের জীবনেও সে কি ছায়া ফেলে যেতে চায়! নদীর নাব্যতা কমে যায়। নদী ভরে ওঠে বর্জ্যে। জাটকা শিকার তো থামে না! যারা ফাঁসজাল বোনে তাদেরও রুটিরুজি চাই। বঙ্গোপসাগর থেকে আরব সাগর হয়ে এই ছুটে চলা। ভার্সোভার কোলিওয়াড়ায় হর্ষাদিদি শিখিয়েছিলেন পালা মাছের রান্না। ভাত অথবা চালের রুটি দিয়ে খেলে তার স্বাদ অপূর্ব। হর্ষাদিদি নিপুণ হাতে কাটারি দিয়ে মাছ কাটেন। কাটতে কাটতে বলেন, এই পালা মাছের স্বাদ তোমার চেনা ইলিশের চেয়ে অন্যরকম। ওঁর চ্যাপ্টা কড়াই, মাছের ঝোলের গন্ধ– এই সমস্তটার মধ্যে ডুবে গেলে টের পাই ইলিশের শরীর জলের গন্ধে বাঁচে। দেশে দেশে জলে জলে ওর শরীর কথারূপ পায়। ইরাকি সাবর, সে যেন বিদেশি ভাষায় লেখা রূপকথা। এই ভিন্নতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই কেবল। চেনা নদীর নাম পেরিয়ে গেলে টের পাই ইলিশ নিজেই আসলে নদী হতে চায়। জলের ধর্মই ওর জীবনের ধর্ম। আমার সরিষা বাটা, আমার কালোজিরের ঝোল ওকে বাঙালি করে রাখবে সে সাধ্য কী!