24th Oct 2024
রান্নাঘর
সুস্মিতা মিত্র
ইতিহাস গাঁথা এখানের প্রতিটি জনপদে, শিক্ষাঙ্গনে, স্থাপত্যে। মনসামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে বর্ণিত বেহুলা। ২ লখিন্দরের সেই কাহিনি এই জেলাতেই বহমান। ভাগীরথীর তীরের এই এলাকায় প্রচুর হোগলা গাছ ছিল, সেই থেকেই এর নাম হুগলি। যদিও ব্রিটিশ-ফরাসি এবং পতুর্গিজদের বহু লেখায় এই হুগলির ওগোলি, ওগলি, গোলিন, হিউগলি, গোলি নাম রয়েছে।
জলভরা সন্দেশ
প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেলে ১৮১০ সালের আগের কথা, মানকুন্ডুর বিখ্যাত জমিদার গৌর খাঁর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে তখন। জামাইষষ্ঠীতে জামাই আসবেন, তাই সাজ সাজ রব। জামাইরা চিরকালই শ্বশুরবাড়িতে সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস উপভোগ করে থাকেন। কিন্তু, বাঙালিদের দুষ্টু বুদ্ধিও কম নয়। খাঁ বাড়ির রানিমা জামাইয়ের সঙ্গে খানিক মজা করবেন বলে মনস্থির করলেন। ডাক পড়ল সূর্যকুমার মোদকের, যার দোকান ছিল ভদ্রেশ্বর বাবুরবাজারে। তার আগের সময়টায় মুন্ডা সন্দেশ তৈরি হত, গুলির (গুলি খেলার রঙিন গুলি) আকৃতির। হাতে করে গুলি পাকিয়ে বানাতে হত। তারপর ছাঁচ আবিষ্কার হল। তালশাঁসকে খানিকটা কপি করে ওই আকৃতির সন্দেশ বানানো হল ছাঁচ ব্যাবহার করে। তখনকার দিনে জমিদার গিন্নীদের অদ্ভুত সব খেয়াল চাপত মাথায়। তিনি দুরু দুরু বুকে দণ্ডায়মান সূর্য মোদককে বললেন নতুন এক ধরনের সন্দেশ বানাতে হবে। তোরা যে তালশাঁস সন্দেশ বানাস, তার মধ্যে জল ভরে দিতে হবে। রানিমার আদেশ পেয়ে সূর্য মোদক পড়লেন মহা ঝামেলায়, সন্দেশের মধ্যে জল। সারা রাত চিন্তায় ঘুম হল না। যাই হোক, সকাল হতেই ছুতোর মিস্ত্রিকে দিয়ে নতুন ছাঁচ বানিয়ে হুকুম তামিল করতে নেমে পড়লেন মোদকমশাই। কিন্তু, নতুন কিছু আবিষ্কারের পথ কখনওই মসৃণ হয়না।
নতুন বানানো ছাঁচে তৈরি সন্দেশের ভিতরে জল কিছুতেই ভরা যাচ্ছে না, লিক হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ দপ দপ করার পর মোদকবাবুর মগজের বাতি জ্বলল। উনি বানালেন কড়া পাকের তালশাঁস সন্দেশ এবং তার ভিতরে সফলভাবে ভরে দিলেন রস। এসে গেল জামাই ষষ্ঠী, এবং জামাই। বিশাল জমিদারবাড়িতে জামাইকে ঘিরে জমে উঠেছে আসর, শ্যালিকাদের কৌতুক-কলতানে মুখরিত চারিপাশ। এবার জামাইবাবাজির সামনে আত্মপ্রকাশ করলেন জলভরা সন্দেশ। জামাইবাবাজি খানিক অবাক তার অবয়ব দেখে। জামাই দেরি না করে প্রথম কামড় দিলেন জলভরায়, তারপর দ্বিতীয় কামড়, তৃতীয় কামড়ে ঘটল অঘটন। সন্দেশ ফেটে ছড়ছড় করে রস পড়তে লাগল, তার গরদের পাঞ্জাবিতে। শ্যালিকাদের সামনে বেচারা জামাইয়ের দর্প চূর্ণ। রানিমার প্ল্যান সফল। এভাবেই এমন এক মজার দুষ্টুমি থেকে জন্ম নিল, জলভরা সন্দেশ।
কী কী লাগবে
ছানা, ঘি, নলেন গুড়, চিনি, গোলাপ জল
কীভাবে বানাবেন
ছানা আর চিনি ভালো করে মেখে অল্প আঁচে পাক দিন। কড়া পাক হবে। গোলাপ জল মিশিয়ে নামিয়ে নিন। এবার ঘি মাখানো ছাঁচের সাহায্যে মাঝে নলেন গুড় দিয়ে সন্দেশগুলো বানিয়ে ফেলুন।
মনোহরা
ব্রিটিশ আমলে জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তি কলকাতা থেকে জনাই বেড়াতে যান। তখনও ভীমচন্দ্র নাগের বংশের একটি শাখা জনাইয়ের ষষ্ঠীতলায় বসবাস করত। জনৈক ব্রিটিশ ব্যক্তি সেই ময়রাদের হুকুম করেন যে এমন এক মিষ্টি তৈরি করতে হবে যা পাঁচদিন রেখে দেওয়া যাবে। সেইসময় ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু জনাইয়ের তৎকালীন দুই বিখ্যাত মিষ্টি শুকনো বোঁদে এবং নিখুঁতি এমনভাবে তৈরি করা হত যাতে তা বেশ কিছু দিন রেখে দেওয়া যায়। ভীমচন্দ্র নাগের বংশের শাখাটি তখন বুদ্ধি খাটিয়ে মূল মিষ্টির উপর পুরু চিনির আস্তরণ তৈরি করেন যাতে তার মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ না-হয়, এবং মিষ্টিটি অনায়াসে তিন থেকে পাঁচ দিন রেখে দেওয়া যায়।
কী কী লাগবে
ছানা, চিনি, ঘি, জায়ফলগুঁড়ো, পেস্তাকুচি
কীভাবে বানাবেন
ছানা আর চিনি মেখে নরম পাক দিতে হবে। এবার এতে জায়ফলগুঁড়ো আর ঘি মিশিয়ে লেচি কেটে ছোট ছোট বলের মতো বানিয়ে নিন। যতটা চিনি তার অর্ধেক জল ফুটিয়ে গজার রসের মতো ঘন রস বানিয়ে তাতে ছানার বল ডুবিয়ে তুলে নিন। ওপরে পেস্তাকুচি ছড়িয়ে ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন।