11th Dec 2024
সাহিত্য
মন্দাক্রান্তা সেন
বয়েসকালে নিহিতা সুন্দরী ছিল না। বয়েসকাল মানে? মানে যৌবন। যে বয়সে নারী নারী থাকে। নিহিতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। সে সুন্দরী হয়ে উঠেছিল মেনোপজের পর থেকে। এমনিতে সে পরিবারের মধ্যে যাকে বলে আগলি ডাকলিং-ই ছিল। তার প্রধান কারণ তার উঁচু দাঁতের পাটি। ওই কারণে তাকে নিয়ে রীতিমতো হাসাহাসি হতো। সে বড় মুখচোরাও ছিল। সব কিছু নিঃশব্দে সয়ে যাওয়া তার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছিল। লোকে তাকে মানুষ বলে গণ্য করত না। সেও দলছাড়া হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখত।
ছোটবেলার কথা। মামাতো মাসতুতো ভাইবোনেরা কী একটা উপলক্ষ্যে একত্র হয়েছে। বড়রা নিজেদের মধ্যে তুমুল আড্ডায় ব্যস্ত। ছোটরাও ইচ্ছেমতো খেলায় স্বাধীন। তার মধ্যে আচারঅলার ঘন্টি বাজল। ওরা হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। পকেটে দিলদার সেজো মেসোমসাইয়ের দেওয়া টাকা । যা ইচ্ছে কেনার জন্য। ওরা আপাতত আচার কিনবে। কাগজের টুকরোর ওপর মাখিয়ে দেওয়া কুলের আচার। সবাই হইহই করতে করতে খাচ্ছে। বিক্রিবাটা শেষ করে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে আচারঅলা চলে গেছে। ওরা ঠিক করল হাঁটতে হাঁটতে আচারের কাগজ চাটতে চাটতে সামনের মোড় অবধি যাবে। মোড় অবধি তাদের সীমানা। মোড় পেরনো বারণ। যদিও পেরোলে আর কে দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্যের জেরে বিশ্বাসঘাতকতার ভয় তো আছে! তাহলে বড়মাসি আস্ত রাখবে না। ওর দঙ্গল বেঁধে এগোচ্ছিল। নিহিতার দাদা মোহিত হঠাৎ পিছিয়ে পড়া বোনের কাছ ঘেঁষে এল। এমনিতে সে বোনকে বিশেষ পছন্দ করে বলে মনে হয় না। ঝাঁকের কই হয়ে বোনকে হেনস্থাই করে। আজ কী এক টানে সে হাঁটতে হাঁটতেই বোনের পাশটিতে চলে এলো। কী রে গাধা, আচারটা হেব্বি, না?নিহিতা চুপ করে রইল। তাকে কেউ আচার দেয়নি। তার খুব লোভ হয়েছে । আচার খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু সে একা বাদ পড়েও কারও কাছে চাইতে যায়নি। তবে দেখতে খারাপ বলে কি আর মন খারাপ হয় না? তার মন খারাপও হয়েছে বৈকি, খুবই মন খারাপ হয়েছে।
---কী রে, তোর আচার শেষ? কাগজসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়ে ফেললি নাকি, ছাগল একটা?
বলবে না বলবে না করেও নিহিতা বলে ফেলল--একটু দিবি? খেয়ে দেখতাম? এই একটুখানি?
মোহিত অবাক হয়ে তাকালো, বলল-সে কি, ওরা তোকে দেয়নি?
---নাঃ
মোহিত চুপ করে থাকল, তারপর বলল---দাঁড়া ওদের বলি। সবাই পাবে তুই পাবি না কেন! তার স্বরে ক্ষোভ। বোনকে নিয়ে সদলবলে টিটিকরি দিতে তার কিছু মনে হয় না, কিন্তু এখন সে রীতিমতো আহত বোধ করল । তার বোন। সে কেন অবহেলিত হবে? সে ভুলে গেল একটু আগেই মামাবাড়ির ছাদে তারা পালা করে নিহিতার মাথায় যথেচ্ছ চাঁটি মেরেছিল। এখন সে চুপ করে থাকল। তার কাগজের আচারও প্রায় শেষ। সে বোনকে ইতস্তত করে বলল---এটা খাবি?
নিহিতা আনন্দিত বোধ করল। আচারের জন্য নয়, দাদার আদর কাড়তে পারার জন্য। সে আহ্লাদিত স্বরে বলল---দে একটু চেখে দেখি। মোহিত তার সামনে থেকে সরে গেল। তার বোন পাতা চাটছে, এটা সে দেখতে পারছে না।
তো, নিহিতার ছোটবেলাটা কেটেছে এইরকম। আর কিছু নয়, শুধু চেহারার জন্য সে বারবার অপমানিত হয়ে এসেছে। অথচ সে পড়াশোনায় ভালো। ভালো ছবি আঁকতে পারে। তবুও নিজের ওই এক না-পারায় সে সর্বদা সঙ্কুচিত, সর্বদা বিপন্ন।
এই সময়টা একরকম। কিন্তু সে আরও বিপন্ন হয়ে উঠল কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে। কী ছিল তার চেহারায় কে জানে, লোকে তাকে বলতে শুরু করল, সে নাকি ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না। একজন দুজন নয়, সবাই। তাসে জিন্সই পরুক কিংবা সালোয়ার কামিজ। সে বাড়ি এসে মাকে জিজ্ঞেস করত ---মা, আমি কি হিজড়ে?
---সে আবর কী! মা খানিকটা বিরক্ত।
---তবে লোকে আমাকে বলে কেন আমায় ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না?
---ও যে বলেছে সে বলেছে। যা মনে হয় বলেছে। বাজে লোক। তাতে মাথা ঘামানোর কী আছে এত!
---না মা। সবাই বলে। আমাকে যে-ই দেখে সে-ই বলে। কেন!
---সে হয়তো তুমি জিন্স পরো বলে, চুল ছোট বলে।
---জিন্স তো অনেকেই পরে, চুলও তো কত মেয়ের ছোট। তাদের তো বলে না!
---বলে কি না তুমি জানতে যাচ্ছ? সরো, আমার কাজ আছে।
মা চলে যান। নিহিতা দাঁড়িয়েই থাকে। না, সে জানে, শুধু ছোট চুল আর জিন্স তার হয়রানির কারণ নয়। তার চেহারা খারাপ। তাও, খারাপ দেখতে তো কত মেয়েই হয়। তাদের মধ্যেও সে আলাদা। তার চেহারায় কিছু একটা আছে। কী আছে? কোমলতার, লালিত্যের চূড়ান্ত অভাব? অথচ তার গলার স্বর অসম্ভব মিষ্টি আর সুরেলা। এটাও সে অন্যদের কাছে শুনেছ একদিন সে বাসে চেপে যাচ্ছে, উঠেই লেডিস সিট ফাঁকা পেয়ে গেছে। বসেও পড়েছে। একটু পরেই শুনল---এই যে ভাই, লেডিস সিটটা ছেড়ে দাও। সামনে একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে কন্ডাকটরও হাঁক দিলো---সিটটা ছাড়বেন দাদা। লেডিসকে বসতে দিন। তখন প্রথম প্রথম। নিহিতা অবাক হয়েই বলেছিল---আমাকে বলছেন? তার গলা শুনে ভদ্রমহিলা কেমন থতিয়ে গেলেন।
---বাবা, এ তো ছেলে না মেয়ে বোঝাই যায় না! নিহিতার ভেতরটা পুড়ে গেল। এ কী বিড়ম্বনা! সে সিটটা ছেড়ে দিলো,
বলল---বসুন আপনি, বসুন।
---না ঠিক আছে, বোসো।সে সিটটা ছেড়েই দিলো। তাকে দেখে ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না এই অপরাধে তাকে তো ক্লাসে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে। সে কান ধরতে হোক চাই না হোক।
আরেকদিনের ঘটনা। সে সেদিন জিন্স আর টপ পরেছিল। মেয়েদের সাধারণ পোশাক। মিনিবাসে একটা সিটে বসে ছিল। এক ভদ্রমহিলা ছোট বাচ্চা নিয়ে উঠলেন। নিহিতা টলোমলো বাচ্চাটাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল এসো এখানে এসো।
বাচ্চাটির মাও বললেন---হ্যাঁ, যাও, কাকুর কাছে যাও।
নিহিতার হাসিই পেল। অ্যাদ্দিনে এই ব্যাপারে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সে
হেসে সুললিত স্বরে বলল---আসুন আপনি বসুন। আমি দাঁড়াচ্ছি।
ওই গুঁতোগুঁতি ভিড়ের মধ্যেই ভদ্রমহিলা হাঁ করে তাকালেন, বললেন---ও! আমি বুঝতে পারিনি
---যে আমি ছেলে না মেয়ে---নিহিতা হাসল, বলল---অনেকেই এই ভুল করে।
---স্যরি!
---ঠিক আছে। বসুন।
হ্যাঁ, তার অভ্যাস হয়ে গেছে। এমনিতে সে একটুও সাজে না। না মুখে একটু ক্রিম-পাউডার, কাজল-লিপস্টিক তো নয়ই। কিন্তু পুজোর মধ্যে সে একদিন সেজেছিল। কানে দুল পরেছিল। তবুও তাকে ধাক্কা দিয়ে একটা ছেলে বলে গেল--শালা এটা ছেলে না মেয়ে বে?
নিহিতার হাসিও পায়, কষ্টও হয়। সে সালোয়ার কামিজ ওড়না নিয়েছে, কানে দুল পরেছে, তবু এই মন্তব্য। ব্যাপারটা প্রায় মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে না! সে আবার বাড়ি ফিরে মাকে বলে---মা, আমি কি হিজড়ে ? ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না।
মা কেমন নিশ্চিন্তে বলে---প্রতাপকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে।
প্রতাপ, হ্যাঁ, প্রতাপ। হ্যাঁ, তার জীবনেও প্রেম এসেছে। তার জীবনে প্রতাপ এসেছে। একটা বাসেই, এই রকম একটা ঘটনার মধ্যে দিয়েই প্রতাপের সঙ্গেতার আলাপ। ঘটনাটা এই রকম। ২০৪ নাম্বার বাসে লেডিস সিটগুলো ভর্তি । কয়েকটা জেনেরাল সিট খালি। নিহিতা সেগুলোকে জেন্টস সিট বলেই ধরে। পারতপক্ষে সেখানে বসে না। কিন্তু সেদিন তার ধুম জ্বর। মাথা ঘুরছে। চোখ অন্ধকার লাগছে। ট্যাকসি করে যাওয়ার মতো টাকা পকেটে নেই। কাজেই এই বাস। তবু তো সিট পেয়ে গেল। দ্যাখা যাক কতক্ষণ বসা যায়।
বেশিক্ষণ বসা গেল না অবশ্য। একটি যুবক উঠল। আরও দুটো সিট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও নিহিতা তড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো, যেন এতক্ষণ সে কী একটা অপরাধ করছিল। ছেলেটি তার সামনেই ছিল, বলল--নামবেন? ---না, আপনি বসুন।
ছেলেটি যথারীতি অবাক হলো। তার দৃষ্টি নিহিতার মুখ হয়ে গলা বেয়ে আরেকটু নীচে এসেই আবার ওপরে উঠে এল। বলল---কেন, আরও তো সিট ফাঁকা। আমরা দুজনেই বসতে পারি। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ানোয়, এবং জ্বরের তাড়সে নিহিতার মাথাটা ঘুরে গেল। সে ধপ করে বসে পড়ল । অসম্ভব মাথা ঘুরছে। সে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে ঘাড় নিচু করল। উফ, কপালের আঁচে তার নিজের হাতই যেন পুড়ে যাচ্ছে। ছেলেটি তার বেসামাল অবস্থাটা খেয়াল করেছিল। ব্যস্ত হয়ে বলল---আপনার শরীর খারাপ? নিহিতা কোনওমতে জবাব দিলো-না না, ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ। ছেলেটি বিনা বাক্যব্যয়ে নিহিতার বাঁ কবজিটা ধরল, চমকে উঠে বলল ---এ কী! আপনার তো ভীষণ জ্বর!
---ও কিছু না।
---কতদূরে বাড়ি আপনার?
---এই এসে গেছি। আপনি যান বসুন। নইলে আর সিট পাবেন না। আমাকে সিট ছাড়তে হবে। ছেলেটি কোনও পাত্তা না দিয়ে বলল---এই এসে গেছি মানে? কোন স্টপ? ---যাদবপুর, যাদবপুর থানা।ছেলেটি উদ্বিগ্ন স্বরে বলল---সে তো অনেকটা। নামুন বাস থেকে। একটা ট্যাকসি ধরে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।
---না না, সে কী, আমি নিজেই যেতে পারব। ভাববেন না। নিহিতা ছেলেটিকে ভাবতে বারণ করল। কিন্তু সে নিজেই ভাবনায় পড়ে যাচ্ছিল। বাইরের লোকের কাছে তো দূরস্থান, কাছের লোকের কাছ থেকেও সে জীবনেও এমন ব্যবহার পায়নি।
একটা স্টপ এল, ছেলেটি অনায়াসে তাকে হাত ধরে বলিষ্ঠ অথচ আলতো টান দিলো---চলুন আসুন, এই কনডাকটার আস্তে, অসুস্থ মানুষ আছে, বাঁধবেন।
নিহিতা হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল, সমানে বলছিল---না না না, ছেড়ে দিন, আমি একাই বাসের অন্য দুএকজন যাত্রী তখন মুখ খুলেছেন---যান ওনার সঙ্গে যান। শরীর খারাপ নিয়ে কোথায় পড়ে টড়ে যাবেন। উনি নিয়ে যাবেন বলছেন যখন তখন...
নিহিতা ছেলেটির আলতো বলিষ্ঠ টানে যন্ত্রচালিতের মতো উঠল। যন্ত্রচালিতের মতো বাস থেকে নামল। সত্যিই তার মাথা প্রবল ঘুরছে। সে কোনওদিকে তাকানোর বদলে মাথা নিচু রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, রাস্তায় যেন ঢেউ খেলছে। সে প্রকৃতপক্ষেই অন্ধের মতো ছেলেটিকে অনুসরণ করল। ছেলেটি বলল---এখানে একটু ছায়ায় দাঁড়ান। ট্যাকসি ধরছি। ট্যাকসি পেতে খুব একটা সময় লাগল না। কিন্তু ওই সময়টুকু যেন নিহিতার কাছে অনন্ত। শরীর ভেঙে আসছে জ্বরে। আর তার মধ্যেই সে ভেবে চলেছে এক অদ্ভুত যুবকের কথা, যে তাকে নিয়ে চলেছে না, বাড়ির দিকে নয়, কোন এক নিরুদ্দেশের দিকে...
ছেলেটি তাকে বাড়ি পৌছে দিলো। শুধু পৌছে দিলো না, মা-বাবাকে প্রণাম করল। বলল সন্ধেবেলা এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে! নিহিতার জ্বরের ঘোরের চেয়েও বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। ছেলেটি কি দেবদূত? নাকি শয়তান? তাকে নিয়ে কোনও খেলা খেলছে। তার আজন্ম মানসিক বিপন্নতানিয়ে খেলা, তাকে নিয়ে একটা মজা! একটা মজাই শুধু। বিকেলে সে কি আসবে সত্যি?
ওর নাম ও নিজেই বলেছিল---আমার নাম প্রতাপ, প্রতাপ গাঙ্গুলী।
---আমি নিহিতা গোস্বামী।
---ভারি সুন্দর নাম তো! কোয়াইট আনকমন।
নিহিতা ভাবছিল তার জীবনে কি আনকমন কিছু ঘটে গেল! সে হাসল। তার উচু দাঁতের পাটি ক্লিপ লাগিয়ে কিছুটা আয়ত্তে এসেছে। প্রতাপ খুব সহজেই বলল---আপনার হাসিটা বেশ। আপনার মনটা বোঝা যায়।
নিহিতার শিউরে উঠল। জ্বরের শিরশিরানি, না অন্য কিছুর? তার মনে হলো---আমার মনের তুমি কী বুঝেছ কতটা বুঝেছ, হে অচেনা যুবক!
প্রতাপ তাকে, এবং বাড়ির সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিকেলে এল। ততক্ষণে জ্বর কমানোর ওষুধ খেয়ে নিহিতা খানিকটা ধাতস্থ। প্রতাপ তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ভয়ের কিছু নয়। রোদ লেগে জ্বর এসেছে। প্রতাপ তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বলল-কদিন ভালো করে রেস্ট নিন। বাড়ি থেকে বেরোবেন না। অনেকটা করে জল খাবেন। কেমন তো? আমি আসি?
---ওমা! আসবে কী ---নিহিতার মা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, আপনি এত করলেন, সকালে তো কিছুই করতে পারলাম না, এখন একটু মিষ্টিমুখ করে যান!
প্রতাপ হা হা করে হাসল,---বলল, মাসিমা, আমাকে আপনি না বলে তুমি বলুন, ওটাই বেশি মিষ্টি লাগবে।
নিহিতার বাবা জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, সে কী চাকরি করে, বাড়িতে কে কে আছেন। নিহিতার বিরক্ত লাগছিল। এত কৌতূহলের কী আছে? এসব জেনে লাভই বা কী! সে কথা অন্যদিকে ঘোরালো। যেন কথা চালানোর জন্যই আবার বলল--সত্যি, আপনি আমার জন্যে যা করলেন...
---আমরাও কিন্তু দুজনে দুজনকে তুমি বলতে পারি। নিহিতা একটা ঢোক গিলে বলল-না না, আপনিই থাক।
---আচ্ছা থাক, প্রতাপ হাসল, বলল-ওটা আপনা-আপনিই হবে। নিহিতা চুপ করে থাকল। একদিনের পরিচয়, একদিনেই শেষ। কবে আর হবে! প্রতাপ চলে গেল। নিহিতার রাত্রে আবার জ্বর এল খুব। মাথার পাশে জ্বরের ওষুধ থাকলেও সে খেল না। জ্বর কমলে যদি স্বপ্নটা চলে যায় ! সবকিছু আগের মতো হয়ে যায়! জ্বরের আচ্ছন্নতায় সে অনেক কিছু অনুভব করছে যা সুস্থ মস্তিষ্কে কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু সেই অসম্ভব কিছুই ঘটল তার জীবনে। জীবনে অনেক কিছু এল তার । সবকিছু এল। কেননা, তার জীবনে এল প্রতাপ। তার সকাল বিকেল ফোন এল, হোয়াটস্অ্যাপ এল, দেখা করা এল। তারপর এল সেই মুহূর্ত। সেদিন তারা সাউথ সিটি মলে ঘুরছিল। কোনওকিছু কেনার নেই, এমনিই ঠান্ডা আমেজে গা জুড়িয়ে গল্প করা। প্রতাপ হঠাৎ তাকে বলল---নেহা! ---হ্যাঁ, সে নিহিতা নামটিকে ছোট করে যেন আরও আপন করে নিয়েছে। তার স্বরে কিছু ছিল, নিহিতা বুকে রক্ত সামান্য ছলাৎ করল ?
---তুমি জানো?
---কী?
---আমি জানি তুমি জানো।
---কী জানি?
---যে আমরা পরস্পরের প্রেমে পড়েছি।
নিহিতার মনে হলো তার আবার জ্বর আসছে। নাক-চোখ-কান-মাথা গরম। সারা শরীর ভেতরে ভেতরে কাঁপছে। তার বাক্যস্ফূর্তি হলো না। প্রতাপ তার হাত ধরে বলল---সেই প্রথম দিন থেকেই, তুমি বোঝোনি? নিহিতা চুপ। প্রতাপ যেন খানিকটা নিজের মনেই বলে চলল---সেদিন বাসে ... তুমি এমনভাবে উঠে দাঁড়ালে, সিট ছেড়ে দিয়ে, অথচ তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল তুমি অসুস্থ। আমি কীরকম হঠাৎ তোমার হাত ধরে ফেলেছিলাম, না? খারাপ করেছিলাম? তুমি কি আমায় খারাপ ভেবেছিলে? কী, নেহা ?
---তোমায় খারাপ ভাবব না না, তা কেন?
---কী ভেবেছিলে তবে?নিহিতা চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল---আমি ভাবতেই পারিনি ওভাবে কেউ আমাকে... আসলে.....
---কী আসলে?
নিহিতা মুখ তুলে তাকালো, বলল---ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি আমি কুৎসিত। কুচ্ছিৎ, অচ্ছুৎ। তার হাত কি কেউ ওভাবে ধরতে পারে? কোনও যুবক?
---তুমি কুৎসিত! নেহা! তুমি সুন্দর।
---কেউ বলে না, কেউ বলেনি।
---আমি বলছি। তোমার মতো চোখ, এরকম সরল পবিত্র হাসি.....
---ধুৎ, তোমার মাথা খারাপ।
---আমি দেখতে খারাপ।
নিহিতা একটু সময় নিল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই বাদামি যুবক। চোখ ছোট কিন্তু ঝকঝকে, নাক চাপা নয় আবার খুব খাড়াও নয়। ঠোঁটের ভঙ্গিমা ঈষৎ কঠিন, কিন্তু হাসিটা প্রাণখোলা, দৃঢ় চিবুক। উচ্চতা মাঝারি, স্বাস্থ্য সুগঠিত। নাঃ, এই যুবককে সে ডিজার্ভ করে না। তার সে যোগ্যতাই নেই। সে বলল---তুমি তো সুন্দর। তোমার সঙ্গে আমার কীসের তুলনা !
প্রতাপ তার হাতের ওপর চাপ দিলো, বলল- নিজের কাছে সত্যি কথা বলো। বলো আমাকে ভালোবাসো। জানো যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি । বাকিটা আমি বুঝে নেব।
হ্যাঁ, বাকিটা প্রতাপ সত্যিই বুঝে নিয়েছে। প্রায় জোর করে নিহিতার মা- বাবার মত করিয়ে, নিজের মা-বাবাকে বুঝিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় নিহিতার একটা মিসক্যারেজ হয়। তার বছর দেড়েক পর আরেকটা। এরপর সন্তান ধারণে ডাক্তারের নিষেধ হয়ে যায়। নিহিতার জরায়ুতে কিছু জটিলতা ধরা পড়ে, এবং তার তেত্রিশ বছর বয়সে মেনোপজ হয়ে যায়। পরে ডাক্তারের কাছে আবার যাওয়ার কথা ছিল। নিহিতা আর যায়নি। মেনোপজ হয়ে গেছে বলে তার কোনও দুঃখবোধনেই। বরং সে স্বস্তিতেই আছে। হাত পা ঝাড়া। প্রতাপের সঙ্গে সন্তান অ্যাডপ্ট করা নিয়ে মাঝে মাঝে কথা হয়, সে কথা কথাতেই ফুরিয়ে যায়। সন্তান নিয়ে দুজনেরই কোনও আকুলতা এমনকি চাহিদাও নেই। দুজনে দুজনকে নিয়ে খুশি। তার মধ্যে এই বিপত্তি। নিহিতার হঠাৎ করে রূপসী হয়ে ওঠা।
সেদিন সে ও প্রতাপ ওই শপিং মলেই ঘুরছিল। নিহিতা অনুভব করছিল সবার দৃষ্টিপথেই সে পড়ছে এবং আটকে যাচ্ছে। অনেকে এমনকি ঘাড় ঘুরিয়েও তাকে দেখছে। নিহিতা অত্যন্ত আশঙ্কিত হয়ে প্রতাপকে বলল এই! আমার জামা ছিঁড়েটিড়ে গেছে নাকি! একটু দ্যাখো তো! সবাই যেন কীভাবে তাকাচ্ছে!
প্রতাপ প্রথমে হা হা করে হাসল। তারপর নিহিতার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল ---কিচ্ছু হয়নি। লোকে তাকাচ্ছে কারণ তোমাকে দুর্দান্ত দেখাচ্ছে। ইউ আর লুকিং রিয়েলি স্টানিং।
---ধুৎ না, তোমাকে আজকাল দারুণ সুন্দর লাগে। দেখনে কি চিজ হ্যায় হামারি দিলরুবা।
সেই শুরু। তারপর থেকে রাস্তাঘাটে সব জায়গায় লোকে হাঁ করে তার দিকে তাকায়। কেন কে জানে! মনে আছে বড় রাস্তার মোড়ে একটা রিকশা স্ট্যান্ডে একবার সে একটা ঝামেলায় পড়েছিল। রাগের মাথার সে বলেছিল ---দেখিয়ে দেবো মজা। তার উত্তরে ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একটা বলেছিল ---ওরে মজা কী দ্যাখাবে, ওরকম খেদিপেচি অনেক দেখা আছে। নিহিতার কষ্ট হলেও সে মেনে নিয়েছিল। না মেনে উপায় কী! ভাড়া নিয়ে কথাকাটাকাটি করা যায়। এ কথার উত্তরে তো কিছু বলা যায় না। এখন সে বড় রাস্তায় এলে সবাই তাকে দ্যাখে। নিহিতা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করলেও তার বিস্ময়বোধ কাটতে চায় না।
সে ভাবতে চেষ্টা করে। কী করে এমন হলো! মানুষের এমন পরিবর্তন হয় ! হৃদয়ের পরিবর্তন তো হয়। কিন্তু এই যে হঠাৎ করে সুন্দর হয়ে ওঠা। এ যেন কোনও রূপকথার গল্প! মেনে নিতে কষ্ট হয়। বিশ্বাস হতে চায়না। কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় কী! এ তো নিহিতা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে!
সেদিন সে ও প্রতাপ বেরিয়েছে, পথে তার মাসতুতো দিদির সঙ্গে দেখা। অনেকদিন পর দেখা। স্বাভাবিক। কেননা তার চেহারার কারণে ছোটবেলা থেকেই আত্মীয়স্বজনের কাছে সে ব্রাত্য। হেনস্থার ভয়ে সে কোথাও যেতে চাইত না, কেউ তা নিয়ে জোরাজুরিও করত না। সাবধানে থাকিস বলে মা- ও বেরিয়ে যেত। সেই আত্মীয় দিদিটি তাকে দেখে প্রায় চিনতেই পারছে না । নিহিতাও এড়িয়ে যেতে পারত। তার দুর্বিষহ বাল্যে এই মেয়েটির হাতেও সে কম লাঞ্ছিত হয়নি। সেই শোধ তুলতেই যেন সে নিজে থেকে বলল ---কী মিমিদি! কেমন আছ?
দিদিটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিহিতা আবার বলে---আমি বুড়ি গো, চিনতে পারছ না?
মাসতুতো দিদির বিস্ময় কাটতে চায় না, বলে---বুড়ি! কী বদলে গেছিস। দিদির সঙ্গে আরেকটি ভদ্রমহিলা ছিলেন। তিনি আলাপের আগেই হাসলেন। বললেন-হ্যালো
---হাই! নিহিতা প্রত্যুত্তর দিলো। দিদি একটু অগোছালোভাবে বলল ---ও হ্যাঁ, এ আমার বোন, মাসতুতো বোন, আর এ আমার বন্ধু অলকা। অলকা তাকে হাসিমুখে দেখছিলেন, বলে উঠলেন---ক্যান আই সে সামথিং ---নিশ্চয়ই!
---আমার বাবা পেন্টার ছিলেন। পোট্রেট করতে ভালোবাসতেন। বাবা নেই আজ তিন বছর। বাবা থাকলে আপনাকে আমি বাবার কাছে নিয়ে যেতাম। হি উড হ্যাভ লাড্ডু টু মেক ইওক্স। নিহিতা একটু চুপ করে থেকে বলল---উনি নেই শুনে খারাপ লাগছে। দেখা হলে আনন্দ হতো
---নো নো, ডোন্ট লুক সো স্যাড। আমি বাবার মতো আঁকতে জানি না, কিন্তু ছবি দেখতে জানি। আপনাকে আপনার ওই হাসিতে মানায়। অসাধারণ !নিহিতা দেখছিল তার দিদির সারা মুখে কে যেন প্যালেটের সবটুকু নীল লেপটে দিয়েছে।
প্রতাপ বাড়ি এসে খুব একচোট হেসে নিল। বলল-বাপ রে, কী প্রশংসা ! আর তোমার দিদির মুখটা খেয়াল করেছিলে? এরাই ছোটবেলায় তোমার পেছনে লাগত না? দ্যাখ কেমন লাগে!
---কী করে হচ্ছে এসব!
নিহিতার বিস্মিত জিজ্ঞাসা শুনে প্রতাপ হাসি থামিয়ে বলল---কী সব?
ইওর নিউ লুক?
---হ্যাঁ। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
---তুমি সুন্দরই ছিলে, নইলে আমি তোমার প্রেমে পড়েছি কেন! শুধু তুমি তা জানতে না।
---এটা কোনও কথা হোলো না। আমার অন্য কথা মনে হয়। উলটো কথা
---কী উলটো কথা?
---তুমি আমায় ভালোবেসেছ তাই আমি সুন্দর হয়ে গেছি। ভেবে দ্যাখো, আমার পিরিয়ড হয় না আজ কতদিন। তা নিয়ে শারীরিক বা মানসিক কোনও অসুবিধে নেই যদিও। কিন্তু পূর্ণ অর্থে নারী তো আমি আর নই! আমি মা নই। হতে পারব না কোনও দিন। আমার বয়েসও বাড়ছে। লোকে যাকে বয়েসকাল বলে, তখন আমি কুৎসিত ছিলাম, বয়স হয়ে সুন্দর হয়ে গেলাম। হয় নাকি এরকম! এ সবই তোমার প্রেমের জন্য, প্রতাপ! মানি চাই না-ই মানি, তুমি তোমার ছোঁয়ায় আমাকে পাল্টে দিয়েছ। আমার রূপ পাল্টে দিয়েছ। আমার জীবন পাল্টে দিয়েছ।
প্রতাপ তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল--ও সোনাটা আমার! হয়তো তাই হবে। কিন্তু সত্যি কথাটা কী জানো?
---কী গো?
---তোমার এই বাইরের চেহারায় আমার কিচ্ছু যায় আসে না। তুমি বাইরে সুন্দর হও কিংবা অসুন্দর, তুমি তুমিই, যাকে আমি ২০৪ নম্বর বাসে প্রথম দেখেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম। বুঝলে?
নিহিতার চোখে জল এল, ধরা গলায় বলল---বুঝলাম।
---আজ বুঝলে?
নিহিতা এবার হাসল, বলল---না, যেদিন আমার স্বপ্নের মতো সুন্দর একটা জ্বর এসেছিল, সেইদিন....
নিহিতার ঊনচল্লিশ বছর বয়েস। এখনও তাকে পঁচিশের কম বলে অনায়াসে চালিয়ে দেওয়া যায়। এই অবধি তার ও প্রতাপের বারো বছরের বিবাহিত জীবন। এরই মধ্যে তাদের দুজনের মধ্যে স্মার্টফোন ও ফেসবুকের অনুপ্রবেশ। এই অনু আণবিন নয়, পারমাণবিক। কিংবা কিছুটা অমানবিকও.. ছেলেটির সঙ্গে ফেসবুকেই আলাপ। তমাল সিংহরায়। দিল্লিতে পড়ে, জে এন ইউ তে। তার চাইতে বয়সে অনেকটাই ছোট। ছেলেটির সঙ্গে নিহিতার মনের বেশ মেলে। অনেক রাত অবধি চ্যাট চলে। ফোনের আলোয় প্রতাপের ঘুমে অসুবিধে হয়। তাই আজকাল নিহিতা ফোন নিয়ে অন্য ঘরে চলে আসে । মাঝরাতে ঘুম ভেঙে বাথরুমে যেতে যেতে ঘরে উকি দিয়ে প্রতাপ ঈষৎবিরক্ত সুরে বলে ---উফ এখনও! ঘুমোবে না? নিহিতাও ঈষৎ বিরক্ত স্বরে বলে---তোমার অসুবিধে হবে বলেই তো এখানে চলে এসেছি। তুমি ঘুমোও না।
তমাল কলকাতায় এল। যেন নিহিতার সঙ্গে দেখা করতেই। সেই শপিং মলেরই একটা রেস্তোরাঁতে তারা মিলিত হলো। লোকজন যে তাকে খুব দ্যাখে, এটায় আজকাল নিহিতা খুব মজা পায়। আজ তাকে কেউ দেখছিল না।
খেতে খেতে তমাল হঠাৎ খুব অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে---তোমার ছবিগুলো কার তোলা?
---সেলফি। কেন?
---তোমার ডান প্রোফাইলটা ভালো আসে।
---তাই? বাঁ দিকটা বাজে?
--না, তা বলছি না, আমি বলছি অনেককে অনেক অ্যাঙ্গেল থেকে ছবিতে ভালো আসে, সামনাসামনি মুখটা হয়তো ভালো নয়। এনিওয়ে, চলো উঠি। নিহিতা একটু আকুল স্বরে বলল---কাল দেখা হবে?
---নাঃ, কালই ফিরতে হবে। একটা কাজ ফেলে এসেছি। ওকে, গুড নাইট!
বিশ্বস্ত নিহিতা বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করল, ---এটা ছেলে না মেয়ে?
বিশ্বস্ত নিহিতা প্রতাপের সামনে দাঁড়ালো। বলল,---আমাকে আবার সুন্দর করে দাও।