19th Jan 2025
প্রতিবেদন
নিজস্ব প্রতিনিধি
তাও সেবার, এক বাংলা ব্যান্ডের একটি অ্যালবাম রিলিজ করল, নাম সংবিয় পাখিকুল এবং কলকাতা বিষয়ক, এটা ১৯৭৭ সালের কথা আলোচনা করছি। এই অ্যালবামের একটি গান বিখ্যাত হল ভীষণ, এখনও গানটি সমান ভাবে জনপ্রিয়। গানটির প্রথম লাইনটিই ছিল, পৃথিবীটা নাকি ছোটো হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রয়িং রুমে রাখা বোকাবাক্সতে বন্দী...হুম আমি মহীনের ঘোড়াগুলির এই জনপ্রিয় গানটির উল্লেখ দিয়েই এই লেখাটি শুরু করব, কারণ এই সময়রেখা এবং এই গানটি দুটো জেনারেশনকে এখনও এক সুতোয় বন্দী করে রেখেছে। মনে রাখা প্রয়োজন ১৯৭৬ সলে প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষের ড্রয়িং রুমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, এরপর স্যাটেলাইট টিভি ইন্ডাস্ট্রি এক একসময় এক একটি পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে গেছে। আমরা যারা ৯০-এর দশকের শেষের দিকে শহরতলি অঞ্চলে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছি তারা বাড়ির ছাদের টি.ভি-এর অ্যান্টেনাও দেখেছি আবার কদিন পর থেকেই দেখলাম টেলিভিশন ব্রডকাস্টের ডিজিটালাইজেশন। এই একই সময়ে বিশ্ব ইতিহাসের সর্ব নতুন আর্ট ফর্মের একশো বছর পূর্তি ঘটছে। ১৮৯৬ সালে চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনীর পর বিশ্ব চলচ্চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক আলোড়ণের দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করেছে। জন এলিস তার ভিসিবেল ফিক্সন: সিনেমা টিভি ভিডিও-এ ব্রডকাস্ট টিভি অ্যাজ কালচারাল ফর্ম- অধ্যায়ে টেলিভিশন ও সিনেমার বিষয়ভিত্তিক কয়েকটি তুলনা করেছেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করছেন, এই ব্রডকাস্ট টিভি বিষয়টি অনেক বেশি ডমেস্টিক। অর্থাৎ একটি সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা পাব্লিক, যেখানে একটি ব্রডকাস্ট টিভির সম্প্রচার ব্যক্তিভিত্তিক এবং ব্যক্তিগত। দ্বিতীয়ত, ব্রডকাস্ট টিভি-এর ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট সম্প্রচারিত একটি সিগন্যাল বহু টেলিভিশন সেটে গৃহীত এবং সম্প্রচারিত হয় বিপরীতে সিনেমা একটি সিঙ্গেল ফিল্ম টেক্সট। তৃতীয়ত সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে একটি বড় পর্দায় তা দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, ব্রডকাস্ট টিভির ক্ষেত্রে স্ক্রিনটি অনেক ছোট, যা মানুষের ড্রয়িং রুমের কথা মাথাতে রেখেই বানানো হচ্ছে। তিনি এও উল্লেখ করেন ব্রডকাস্ট টিভি-এ সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান একটি ডমেস্টিক কন্টেন্ট দেখাচ্ছে। তাদের টার্গেট অডিয়েন্স হচ্ছে একটি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, যে পরিবারে একজন ওয়ার্কিং ফাদার, সন্তান এবং একজন হোমমেকার মাদার রয়েছে। এবং অনুষ্ঠানে দৃশ্যায়িত কন্টেন্টেও এরম একজন ওয়ার্কিং ফাদার যে ডিসিশন মেকার, সন্তান ও হোমমেকার মাদারকে দেখানো হচ্ছে, মায়ের দায়িত্ব সন্তান লালন এবং গৃহস্থালির কাজ করা। টেলিভিশন একটি হোমলি এবং একটি ডমেস্টিক অনুভূতি তৈরি করছে, যা সিনেমার মত অডিও ভিসুয়াল হলেও তা দেখার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। একটি প্রাইভেট এবং অন্যটি পাবলিক। অশ্বিন পুনাখাম্বেকরের রিয়েলিটি টিভি অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি কালচার- এ তিনি ইন্ডিয়ান টেলিভিশনের পার্টিসিপেটরি কালচার নিয়ে আলোচনা করছেন। অর্থাৎ ৮০-এর দশক থেকে একটি ট্রেন্ড দেখা যায় যেখানে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি তাদের দর্শকদের তাদের অনুষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করে। যে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হচ্ছে তাতে দর্শকেরও একটি অংশগ্রহন রয়েছে। তিনি উল্লেখ করছেন যে টেলিভিশন একটি ব্যক্তিগত পারিবারিক পরিসরে পাব্লিকনেস তৈরি করছে। প্রথমত তিনি ক্রিকেটের লাইভটেলিকাস্টের উল্লেখ করছেন। সেই সময়ে, প্রত্যেকের বাড়িতে টি.ভি না থাকায় পাড়ার একটি টি.ভি-কে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ একত্রিত হতেন যা একটি গৃহস্থেও পাব্লিকনেস তৈরি করত। এছাড়াও আরও একটি উল্লেখ তিনি করেন, ব্যক্তিভিত্তিক টেলিভিশন সম্প্রচার হলেও একটি লাইভ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঐ প্রত্যেকটি দর্শক একে অপরের সাথে সংযুক্ত। ১৯৯১ সালে বেসরকারি চ্যানেল আসার পূর্বে দূরদর্শন প্রচুর দর্শকের কথা ভাবেনি, এবং প্রতিযোগিতারও কোনো জায়গা ছিল না। ১৯৯১ সালে বেসরকারি চ্যানেল আসার পর সেই সময়ে প্রতিযোগিতার স্বার্থে দূরদর্শন সুপারহিট মুকাল্লা-এর মত অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে ১৯৯২ সালে। যে অনুষ্ঠানে হিন্দীগান সম্প্রচারিত হত, দর্শকেরা চিঠির মাধ্যমে তাদের পছন্দ জানাত এবং সবচেয়ে বেশি নির্বাচিত গানগুলি সম্প্রচারিত হত।
এর আগে দূরদর্শনের ৮০-এর দশকের শেষভাগে অনুষ্ঠান জাতীয়তাবাদী কন্টেন্ট সম্প্রচার করে, তখন দুইপ্রকার বিষয়বস্তু জাতীয় দর্শক তৈরি করেছিল, ১) মেলোড্রামাটিক ২) মিথোলজিকাল। বেসরকারি চ্যানেলগুলি এই একই ধরণের বিষয় বস্তু সম্প্রচার করে, যেখানে সাধারণ মানুষের এক অংশ গ্রহণ থাকত। শিক্ষামূলক কিছু বিষয়বস্তু সম্প্রচার হত, ক্যুইজ টাইম-এর মত অনুষ্ঠানও জনপ্রিয় ছিল। ইন্ডিয়ান টেলিভিশনে হাম লোগ- এর মত সোপ অপেরা একসময় জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, একইভাবে বেসরকারি চ্যানেলের কিউকি শাস ভি কভি বাহু থি-এর মত মেগা সিরিয়ালও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এক্ষেত্রে, উল্লেখ করা প্রয়োজন যে দূরদর্শন এবং স্টার প্লাস-এ সম্প্রচারিত যাবতীয় মেগাসিরিয়ালের প্রধান বিষয়বস্তু মেলোড্রামা। ভারতীয় পারিবারিক ঐতিহ্য, অর্থাৎ উচ্চবিত্ত জয়েন্ট ফ্যামিলি তাদের বসার ঘর এবং তাদের বসার ঘরে উপস্থাপিত যাবতীয় নাটকীয়তাই বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে মেগাসিরিয়ালের। এই ট্রেন্ডটিই এখনও চলে আসছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, হিন্দি এবং রিজিওনাল ভাষায় সম্প্রচারিত মেগাসিরিয়ালগুলির বিষয় সেই একটি যৌথ পরিবার। তারা বিবাহ উদযাপন করে, একবিংশ শতকের কাপেলরা যেখানে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি স্বাধীন সংসার এবং জীবনযাপনে বিশ্বাসী, তাদের জীবনশৈলী ৮০-এর দশকের থেকে অনেকটাই পাল্টে গেছে সেসব বাস্তবসম্মত বিষয়বস্তুকে ব্যতিরেকে ভারতীয় টেলিভিশনের মেগা সিরিয়াল সম্প্রচার করে চলেছে একটি অতীতকে, যে অতীতের সূত্রপাত অন্তত আজ থেকে ৩৫ বছর আগে হয়েছিল। সিনেমা থেকে ভ্যাম্প ক্যারেক্টারের অস্তিত্ব মুছে গেলেও মেগাসিরিয়ালগুলি এখনও ভ্যাম্প এবং হিরোইনকে আলাদা ভাবে উপস্থাপন করে। শাড়ি পরা পরাধীন গৃহবধূ একজন ভালো নারী এর দৃষ্টান্ত এবং ওয়েস্টার্নাইসড স্বাধীন শিক্ষিত মেয়েটি একটি খারাপ নারী এর উদাহরণ হিসেবে সম্প্রচারিত হয়। এখনও উচ্চবিত্ত যৌথ পরিবার এবং তাদের স্বপ্নের মত সাজানো ড্রয়িংরুম তাদের আনরিয়ালিস্টিক সাজপোশাক একইভাবে জনপ্রিয়। কারণ, এই ধরণের কন্টেন্ট ভারতের তথাকথিত পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলে। একটি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে ভালোবাসে একটি পরাধীন নারীচরিত্রকে যে স্বামী এবং শ্বশুরগৃহ দ্বারা নিপীড়িত হয়েও তা দিনের পর দিন মেনে নেয়, এই দৃষ্টিসুখা প্রাপ্তি হয় এক গোষ্ঠীর দর্শকের, সেই দর্শক গোষ্ঠীই যারা সাস ভি কাভি বহু থি-এর টার্গেট অডিয়েন্স ছিলেন। মোটামুটি গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত, হোমমেকার স্বল্পবয়সী থেকে বৃদ্ধ বয়সী মহিলারাই কিন্তু এই মেগাসিরিয়ালের টার্গেট অডিয়েন্স যাদের কাছে এই পিতৃতান্ত্রিক নিয়মাবলী সাধারণ ঘটনা মনে হয়,
যারা সাংসারিক শোষণের স্বীকার হয়ে এসেছেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সেই নিয়মের মধ্যেই রাখতে চান কারণ তারা মনে করেন যে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। মেগাসিরিয়ালের কন্টেন্টেও সেই একই ছবি দৃশ্যায়িত হয়, তাতে কোনো হেরফের নেই। ব্রডকাস্ট টেলিভিশন এখনও অবধি তাদের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ডমেস্টিক অনুভূতিটি বজায় রাখতে চাইছেন। জি বাংলায় সম্প্রচারিত একটি মেগাসিরিয়াল বকুল কথা-এর কথা উল্লেখ করি, এই মেগাসিরিয়ালের প্রধান চরিত্র বকুল একজন ছাত্রী যে বিবাহিত এবং আপাতত পেশায় সে পুলিশ, তাঁকে বাড়ির বাইরে অন্য পোশাকে দেখানো হলেও শ্বশুর বাড়ির বসার ঘরে শাড়ি পরেই দেখানো হয়, কারণ এইসব বিষয়বস্তু বাস্তবসম্মত জ্ঞান, শিক্ষা ইত্যাদি ব্যতিরেখে পিতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সাংসারিক শোষণের স্মৃতিকে বয়ে বেড়াচ্ছে যেখানে বাড়ির বউ এখনও শ্বশুরবাড়ির নিয়ম পালন করে, শাড়ি পরে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলা মেন্সট্রিন চলচ্চিত্রও মেকআপ করা আন রিয়েলিস্টিক হিরো নির্ভর নায়িকার কমেন্ট। থেকে এখনও স্বাধীন হতে পারেনি কারণ এই ধরণের বিষয়গুলিই তাদের টার্গেট অডিয়েন্সকে দৃষ্টিসুখ দিতে পারে।
৮০ দশকের শেষভাগ থেকে ৯০ দশকের সময়টি ভারতের ক্ষেত্রে একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সময়। মনে রাখা প্রয়োজন এই সময়ই ডিজিটাইলেজশন হয়, এবং একই সময়রেখায় গ্লোবালাইজেশনের সাথেই উপস্থাপিত হয় গ্লোবাল ভিলেজ কন্সেপ্টটি। পশ্চিমী ব্যবসা এবং পশ্চিমী সংস্কৃতি, পোশাক, জীবনশৈলী ভারত সহ অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির নতুন অভ্যেসে পরিণত হয়; বিশ্বায়ণের তকমায় অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির পশ্চিমীকরণ ঘটে। এই একইসময় হিন্দী ছবির বলিউডাইজেশন হয়, ধীরে ধীরে মাল্টিপ্লেক্স কন্সেপ্টটির পরিচিতি ঘটে এবং মাল্টিপ্লেক্সের দর্শক ও তাদের লক্ষ্যে রেখে তাদের দেখার জন্য ছবি তৈরি হতে শুরু করে। মাল্টিপ্লেক্সের দর্শক অবশ্যই উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষ। এরপরআরও কয়েকটি বছর পার হয়ে যাওয়ার পর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যখন ইতিমধ্যেই একটি জনপ্রিয় জায়গা অধিগ্রহণ করেছে, সিনেমা, ব্রডকাস্ট টিভি-এর মেগাসিরিয়ালের মত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দৃশ্যায়িত হবে এরূপ বিষয় ইস্ট্রোডিউস হলো। অনলাইন স্ট্রিমিং কন্সেপ্টটি পপুলার হয়, এবং প্রচলিত হয় ওয়েব সিরিস, ধারাবাহিকের মতই এক একটি সিসন এর একাধিক এপিসোড নিয়ে রিলিস হয় এই ওয়েবসিরিসগুলি। এছাড়াও শুধুমাত্র অনলাইন স্ট্রিমিং হবে এরম ছবিও তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ সিনেমাহল বা টেলিভিশনের পর্দা না ছবিগুলি মুক্তি পাচ্ছে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, এবং এক্ষেত্রে আলোচ্য যে এই জাতীয় ছবি ও সিরিসগুলিরও টার্গেট অডিয়েন্স রয়েছে। ব্রডকাস্ট টিভি-এর ক্ষেত্রে যেমন একটি পার্টিসিপেটরি কালচার ও ডমেস্টিক ভাবনা উপস্থাপন করা হয়েছিল, ওয়েবের ক্ষেত্রে এই হিসেবটি একদম আলাদা। এক্ষেত্রে অবশ্যই একজন মানুষ, তার হাতের একটি স্মার্টফোন এর কথা মাথায় রেখেই ওয়েব সিরিসগুলি তৈরি হচ্ছে। অবশ্যই ইন্টারনেট-এর লাইভ নেটওয়ার্ক দ্বারা লক্ষাধিক মানুষ একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকলেও প্রত্যেকটা অ্যাকাউন্ট দ্বারা এক একজন টার্গেট দর্শক থাকছে ওয়েবে সম্প্রচারিত বিষয়বস্তু গুলির। এই বিষয়বস্তুর টার্গেট দর্শক কারা? বিশেষত ইয়ুথ হল এই ধরণের বিষয়বস্তুর টার্গেট অডিয়েন্স। সর্বপ্রথম ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দৃশ্যায়িত সিরিজ ও অন্যান্য সম্প্রচারগুলি টার্গেট থাকে ইয়ুথ এবং তাদের জীবনশৈলী, তাদের ভাবধারা, তাদের চোখ দিয়ে জীবনকে ক দেখা সিরিজগুলির বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রধানত যে ধরনের সিরিজের জনপ্রিয়তা বেশি তা হল, থ্রিলার... - মার্ডার, ডিস্টোপিয়ান ন্যারেটিভ, আন্ডার ওয়ার্ডের চিত্রিতকরণ অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ও করছে। নেটফ্লিক্স ইন্ডিয়া, টিভিএস, এমএক্সপ্লেয়ার সহ বাঙলায় হইচই, আড্ডা টাইমস ইত্যাদিও জনপ্রিয় অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সিরিজকে কেন্দ্র করে একাধিক অচেনা মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরের পরিচিত হয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যেমন একইভাবে বিদেশি সিরিজও দেখা যায় আবার দেখা যায় জাতীয় সিরিজও। নেটফ্লিক্স-এ সম্প্রচারিত, সেকরেড গেমস ভারতীয় সিরিজের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি ওয়েব সিরিজ। সেন্সরশিপের নজরদারি এবং নিয়মাদি ওয়েব কন্টেন্টগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় তাই এক্ষেত্রে দৃশ্যকরণের স্বাধীনতাও উদার। সেকরেড গেমস জনপ্রিয় একটি ওয়েব সিরিজ এবং মনে রাখা প্রয়োজন অবশ্যই এক্ষেত্রেও ন্যারেটিভ একটি অন্যতম ভূমিকা পালন করছে, মুম্বাই শহরের আন্ডার গ্রাউন্ড গোষ্ঠীর গল্প, থ্রিলার, ডার্ক স্টোরি টেলিং প্যাটার্ন সিরিজটির ফ্যানবেস তৈরি করেছে। একইভাবে লেয়লা (নেটফ্লিক্স) জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তার ডিস্টোপিয়ান ন্যারেটিভের কারণে যেটি বর্তমান জাতীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের একটি সময়রেখা উপস্থাপিত হয়। দিল্লী ক্রাইম, ২০১২ সালে দিল্লীতে ঘটে যাওয়া নির্ভয়া-এর কথাই হল এই সিরিজটির স্টোরিলাইন যা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক ক্ষেত্রেইই ন্যারেটিভের জনরা হল থ্রিলার। ইংরেজি ভাষায় সম্প্রচারিত ওয়েব সিরিজের মধ্যে স্ট্রেঞ্জার থিংস, হন্টিং অফ দ্য হিল হাউস, ব্ল্যাক মিরর, নার্কোস... এই প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কমন বিষয়টি হল ভয় অর্থাৎ ব্রডকাস্ট টিভি যেমন একটি পারিবারিক মেলোড্রামাকে গুরুত্ব দেয় এবং তা অবশ্যই তাদের টার্গেট অডিয়েন্সকে দৃষ্টিসুখ দেয়, একইভাবে ওয়েবসিরিজ গুরুত্ব দেয় তাদের টার্গেট অডিয়েন্সের ভালো লাগাকে। কোটা ফ্যাক্টরি-এর মত সিরিজও যেখানে ভারতবর্ষে তৈরি হচ্ছে ও তা জনপ্রিয়তা লাভ করছে, সেই একই দেশে বাঙালি দর্শকেরা কী ধরনের বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন? হইচই সম্প্রচারিত দুপুর ঠাকুরপো সিরিজটি কী ধরনের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে এসেছে? একটি সেক্সিস্ট বিষয়বস্তু, যেখানে বাঙালির সন্তা যৌন অনুভূতিকে আবেগপ্রবণ করে একজন মহিলা চরিত্রকে একটি যৌনবিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। অডিওভিসুয়াল এবং মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, হইচই সফট পর্নোগ্রাফিক বিষয়বস্তু উপস্থাপন করে দর্শককে আকর্ষণ করে, বিষয়বস্তুতে বুদ্ধিমত্তার কোনো পরিচয় নেই এবং আরও একাংশের মতে, বিষয়গুলি বোল্ড এবং সাহসী। সে যাই হোক, এক্ষেত্রেও মনে রাখা প্রয়োজন এই ধরণের কন্টেন্টও ইয়ুথের মধ্যেই বেশি জনপ্রিয়। ইয়ং জেনারেশনের প্রচুর ছেলেমেয়েকে প্রশ্ন করে এই জানা যায়, তাদের অবসর সময়ে তারা ওয়েব সিরিজগুলি দেখে নিতে পারে। ট্রেনে, বাসে বা ট্রামে... এগুলি দেখার জন্য তাদের আলাদা করে কোনো সেটিংস বা গৃহস্থালির প্রয়োজন হয় না।
এই বিষয়টি স্বচ্ছ যে টেলিভিশনের বিষয়বস্তু মধ্যবয়স্ক দর্শকের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও ওয়েবের প্রধান দর্শক হল ইমুখ বা একবিংশের যুবসম্প্রদায়। ব্রডকাস্ট টেলিভিশনের ডমেস্টিক অ্যাম্বিয়েন্স পেরিয়ে, একক অভিজ্ঞতার ভিত্তি হয়ে উঠেছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। ব্রডকাস্ট টিভি যখন ঐতিহ্যের অতীতকে উপস্থাপন করছে একই সময়ে ডিজিটালাইজেশন একবিংশের অডিওভিসুয়াল অভিজ্ঞতায় এক নতুনত্ব এবং অবশ্যই স্বতন্ত্রতা উপহার দিয়েছে।