21st Nov 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

কলকাতায়, নেই কলকাতা

3rd Apr 2024

প্রতিবেদন

কমলেন্দু সরকার


আগে কত কি দেখা যেত কলকাতা এবং তার আশপাশে। এখন আর চোখে পড়ে না। কোথায় উধাও হল সে সব! পুজোর আগে দেখা যেত দু'জন মানুষকে। একজন সামনে হেঁটে চলেছেন। তিনি পাঁচালি পড়ার সুরে টানা বলে যাচ্ছেন, "শাড়ি নেবেন মা, শাড়ি। শান্তিপুর, ধনেখালির ভাল শাড়ি আছে।" বাড়ির অন্দর থেকে বেরিয়ে আসতেন বাড়ির কর্তা। গিন্নির কড়া নির্দেশ, শাড়িওয়ালাকে ডাকার। শাড়িওয়ালা আর সাঙাত এসে বসতেন দেউড়িতে। একটা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর রাখা গাড়িগুলো। নইলে নোংরা লেগে যেতে পারে। যেসব শাড়ি পছন্দ হত, সেগুলো রাখা হত। সেকালে ছিল একান্নবর্তী পরিবার। অনেক শাড়ি লাগত। কখনও ধারে কেনাকাটাও হত। 
আবার গরমের দুপুরে কিংবা শীতের নরম রোদ্দুর গায়ে লাগিয়ে যখন বাসনওয়ালা হেঁকে যেত, 'বাসন নেবে গো, বাসন। ভাল ভাল কাঁসার বাসন আছে।" 
কেমন একটা মায়াবী সুরের ডাক ভেসে আসত ঘরের ভিতর। বাড়ির অনেক মহিলা খেয়েদেয়ে ভাতঘুম দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, সেইসময় এমন ডাক। এই ডাক কি উপেক্ষা করা যায়, যায় না। এঁটো বাসনটা তাড়াতাড়ি ধুয়ে, মেজে, মুছে ছুট দিলেন সদর দরজার দিকে। ডাকলেন, 'অ্যাই বাসনওয়ালা।' ওই বাসনওয়ালা বাড়ির গিন্নিমার পূর্বপরিচিত। বলল, 'ভাল আছেন তো মা?' এই পুরনো থালাটা বদলে একটা বাটি নেবেন গিন্নিমা। ওঁরা পুরনো বাসন নিয়ে নতুনও দিতেন। পছন্দমতো বাটিও হল। গিন্নিমা বললেন, 'রবিবার এসো তো। একটা বড় জামবাটি আনবে।' সম্মতি জানিয়ে চলে গেলেন বাসনওয়ালা। তার আগে একটা কাঁসার থালায় ঢং ঢং করে বাজাতে বাজাতে চলেছে তার ছোট্ট শাগরেদ। সে হয়তো তার ছেলেই হবে।
ঠিক এমন নয়, ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে যেত শোনপাপড়ি আর ঝুরিভাজা বিক্রেতা। টিনের চৌকো বাক্সে একদিকে থাকত জিলিপির মতো গোল গোল পাকানো  ঝুরিভাজা।  আর অন্যদিকে থরে থরে সাজানো শোনপাপড়ি। বুড়ির চুলও ওইরকম টিনের বাক্সে বিক্রি হত। তবে এখনকার মতো মেলায় বিক্রি হওয়া বুড়ির চুল নয়। সেগুলো ছিল ছোট ছোট  গোল বলের মতো। বার করলেই চুপসে যেত। আর একজনকে দেখতাম তেল চকচকে বাঁশের ডগায় ময়দার মতো মাখানো মিষ্টি চটচটে জাতীয় কিছু একটা। সেগুলে দিয়ে লোকটি আবার হাতঘড়ি, সিলিং ফ্যান, মাছ, ব্যাং এসব করে দিত। স্কুলের সামনে বসত হজমিওলা। তার কাছে পাওয়া যেত টলগুলির মতো হজমিগুলি, কুল, বোম্বাই আমড়া আর কারেন্ট নুন। এসব আর দেখতে পাই না।
গরমকালে সন্ধে হলেই শোনা যেত 'বেল ফুল' আর 'কুলফি বরফ' হাঁক। মাটির হাঁড়ির ভিতর থেকে ছোট ছোট লম্বাটে খোল বার করে হাতের চেটোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শালপাতায় ঢেলে দিত কুলপি। দই খাওয়ার কাঠের চামচ দিয়ে কেটে কেটে খেত। আর বেলফুল বিক্রেতাটি যে-গলি বা রাস্তা দিয়ে যেত গন্ধে ভুরভুর করত। 
দুপুরবেলা আর এক ধরনের ফেরিওয়ালা দেখা যেত। তারা সাইকেলের বেল ক্রিংক্রিং করে বাজাত আর বলত, 'আলতা, সিঁদুর, বাস তেল, ফিতে, চুড়ি আছে।' বাড়ির বউ বা যুবতী মেয়েরা ছিল তার ক্রেতা। অনেক ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আবার রঙ্গ-রসিকতাও হত। বাস তেল মানে ছিল গন্ধ তেল। লোকটির সাইকেলটিই ছিল পুরো একটা মনিহারি দোকান। অনেকে আবার বাঁশের ডগায় চওড়া একটা শক্ত মতন বোর্ড লাগিয়ে তার মধ্যে ফিতে, চিরুনি সব মিলিয়ে মহিলাদের ব্যবহৃত জিনিস বিক্রি করত। 
আর একটা লোককে দেখতাম সে আবার 'টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম' বলে চেচাঁতে চেঁচাতে কাগজ ফিরি করত। একটাসময় বেশকিছু ট্যাবলয়েড পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হত। তারাই পাঠকের নজর কাড়বার জন্য 'টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাম'। তবে সেইসময় বড় কেউ মারা গেল নামীদামি দৈনিকগুলো একপাতার সান্ধ্য বুলেটিন বার করত। বাল্যকালে দেখেছি।
মোল্লার চকের লালদই কাঁধে বাঁক নিয়ে বিক্রি করত অনেকেই। তারা সম্ভবত অনেক অনেক দূর দূর থেকে আসত। তারা আবার সন্দেশও আনত। সেগুলোর নাম ছিল আতা সন্দেশ।
বাচ্চাদের জন্য ছিল বায়োস্কোপ। একটা চৌকো বড় সাইজের বাক্সের মধ্যে হাতে ঘুরিয়ে সিনেমা দেখানো হত। থাকত বড় বড় শহরের ছবি। হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি। বাংলার শুধুমাত্র উত্তম-সুচিত্রা। আর ওপরে বাজত সেইসময়কার হিট হিন্দি ছবির গান, সেভেন্টিএইট আরপিএম রেকর্ডে। ছিল চলতাফিরতা কামারশাল আর তালাচাবিওয়ালা। কামারশালের লোকটি ঘাড়ে একটি শান দেওয়ার মেশিন নিয়ে ঘুরত। কাঁচি, বটি, ছুরি শান দিত। তাকে বললে ছুরি-কাঁচি বানিয়েও দিত। আর তালাচাবি যে-কোনও তালার চাবি বানিয়ে দিত। সে 'ঝনাৎ ঝনাৎ' আওয়াজ করে যেত। আর ছিল শিলকাটনেওয়ালা। সারা পাড়া 'শিল কাটাও, শিল কাটাও' বলে চেঁচাতে চেঁচাতে যেত। এদের এখন একেবারেই দেখা যায় না। গুঁড়ো মশলার জন্য আর মশলা বাটার প্রয়োজন হয় না। বা মিক্সিতেই সব হয়ে যায়।
আর কতকিছু ছিল এখন অনেককিছুই স্মৃতির বাইরে চলে গেছে। এখন অনেক মল হয়েছে, ঝাঁ-চকচকে দোকান হয়েছে বটে কিন্তু সেই মজাটা আর নেই। সেই ডাক আর শোনা যায় না। এখন কাঁসার বাসনপত্র তো দেখা যায় না। পুজোর বাসন বা গোপাল বিক্রি হয় কাঁসা-পেতলের দোকানে। কলকাতার মধ্যে আর একটা যে কলকাতা দেখতাম কিংবা পেতাম, সেসব উধাও! আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এমনটা বোধহয় দেশের আর কোনও শহর এবং শহরতলিতে ছিল না।

Archive

Most Popular

ঋতু পরিবর্তনে সুস্থ থাকুন, ঘরোয়া টোটকায় ..

21st Nov 2024

প্রতিবেদন

নিজস্ব প্রতিনিধি

Read More