10th Apr 2024
প্রতিবেদন
কমলেন্দু সরকার
'জয়বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে মহাদেব।' চৈত্র মাসের শুরু থেকেই গ্রামগঞ্জে তো বটেই কলকাতা-সহ মফসসল শহরের অলিগলিতে ভেসে আসত অদ্ভুত সুরে এই কয়েকটি বাক্য। এখন কদাচিত শোনা যায়। পুরুষ- মহিলা নির্বিশেষে, এমনকী বালক, যুবকেরাও দলবেঁধে ঘুরে বেড়ান। বাড়ির বাইরের দরজায় কড়ার নাড়ার শব্দের সঙ্গে ভেসে আসত মিলিত কণ্ঠে, 'জয়বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে মহাদেব।' প্রত্যেকের পরনে সন্ন্যাসী বেশ। কারওর কারওর হাতে ত্রিশূল থাকত। কোনও কোনও দলে আবার শিব-পার্বতী সেজে ঘুরতেন কেউ কেউ।
এঁরা হলেন সবাই চড়কের সন্ন্যাসী। সারা চৈত্র মাস সন্ন্যাসজীবন পালন করতেন। সারাদিন ভিক্ষা করে চাল, ডাল, শাক-সবজি যা পেতেন বেলাশেষে সবকিছু একসঙ্গে করে মাটির মালসায় ফুটিয়ে খেতেন। এটি হল একধরনের খিচুড়ি। একমাসের সন্ন্যাসজীবনে এঁরা ছিলেন একাহারী। অনেকেই চৈত্র মাসের শেষ দু'চার দিন সন্ন্যাসীজীবন পালন করেন। খাওয়াদাওয়া শেষে অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিতেন মাটিতে। না, কোনও বিছানায় শোয়া যায় না। কোনওরকম আয়েস-আরাম চলবে না এই একমাস। ভয়ংকর কষ্টকর জীবন কাটাতে হয় চৈত্রের চড়ক-সন্ন্যাসীদের। আরও ভয়ংকর হয় চৈত্র সংক্রান্তির বিকালে বা সন্ধ্যায়। সারাদিনের পর চড়কের ঝাঁপ হয় মহাদেবের সামনে। দু'তিনতলা বাড়ি সমান বাঁশের ভারার ওপর থেকে ঝাঁপ দেন সন্ন্যাসীরা। তাঁদের ঝাঁপ দিতে হয় বটি, কাটারি ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র কিংবা আগুনের ওপর। আবার অনেকে জ্বলন্ত কোনও কিছুর ওপর দিয়ে হাঁটেন। কোথাও তৈরি হয় দশতলা সমান চড়ক গাছ তার ওপর চড়ক-সন্ন্যাসীরা পিঠে বাণ বিঁধিয়ে বনবন করে ঘোরেন। চড়ক পুজোর আগের দিন চড়ক গাছকে পরিষ্কার করা হয়। জলভরা একটি পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়। এই শিবলিঙ্গটির পরিচয় বুড়ো শিব। আজও এই দৃশ্য কলকাতা শহরে দৃশ্যমান ছাতুবাবুর বাজারের চড়কপুজোয়। কলেজ স্কোয়ারের মেলা এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে।
চড়কপুজোর প্রচলন নিয়ে নানারকম কথা শোনা যায়। তবে চড়ক হল মূলত বাংলার এক অন্যতম সেরা লোকউৎসব। চৈত্রসংক্রান্তির দিন দুই বাংলাতেই হয়ে থাকে চড়কপুজো। চৈত্র মাসে শিবভক্তেরা মহাদেবের উপাসনা করে থাকেন। গ্রামগঞ্জে চালু আছে এক লোককথা, বাণরাজা ছিলেন প্রচণ্ড শিবভক্ত। তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ হয় দ্বারকা অধিপতি কৃষ্ণের। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত বাণরাজা অমরত্ব লাভের আশায় চৈত্রসংক্রান্তির দিন অনেক লোকজন নিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। উৎসবে আত্মহারা বাণরাজা নিজের শরীরের রক্তপাত করেন শিবের উদ্দেশে। এইদিনটির স্মরণে প্রতি বছরই চড়ক উৎসব পালন করা শুরু হয়।
অনেকেই মনে করেন, পাশুপত সম্প্রদায় এই উৎসব পালন করত প্রাচীনকালে। পাশুপত শৈবধর্ম হল প্রাচীনতম প্রধান শৈব হিন্দু বিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি। মনে করা হয়, খ্রিস্টীয় প্রথমশতক থেকেই বিদ্যমান ছিল। আবার অন্য মতে, পনেরো শতকের প্রায় শেষলগ্নে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামে এক রাজা চড়কপুজোর প্রচলন করেন। তবে, চড়কপুজো কোনওমতেইই রাজা, জমিদার, ধনীব্যক্তিদের উৎসব নয়। মনে করা হয়, হিন্দু সমাজের প্রান্তিক মানুষেরাই এটি পালন করেন। সেইকারণে চড়কপুজোয় পুরোহিত বা ব্রাহ্মণদের কোনও ভূমিকা থাকে না।
চড়ক পুজোর কিছু প্রচলিত লোকসংস্কৃতির রীতি আছে, যা পূর্বে একটা ধারণা দিয়েছি। ভয়ংকর সে রীতি। যা রীতিমতো শিহরন জাগায়। কুমিরের পুজো, জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটা, কাঁটা, বর্শার ফলা বা ধারালো কোনও অস্ত্রের ওপর লাফানো, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য বা শবদেহ নিয়ে নৃত্য ইত্যাদি চড়কপুজোর বিশেষ অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। তবে, বর্তমানে এইসব রীতির অনেকটাই এখন নেই। ইংরেজ আমল থেকেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
গ্রামবাংলায় চড়কপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে থাকে ভূতপ্রেত বা পুনর্জন্ম। চড়কপুজোর সন্ন্যাসীরা মনে করেন, নানাবিধ শারীরিক যন্ত্রণা হল ধর্মের অঙ্গবিশেষ। সবচেয়ে ভয়ংকর হল চড়ক-সন্ন্যাসীরা যখন পিঠে লোহার শলাকা বা বাণ বিঁধিয়ে চড়কগাছের সঙ্গে ঘোরেন! অনেকে আবার পিঠে, হাতে, পায়ে, কানে, জিভে এফোঁড়-ওফোঁড় করে শরীরের লোহার শলাকা গেঁথে ঝাঁপ দেন কিংবা নৃত্য করেন!
চড়কপুজোর বীভৎসতা ১৮৬৫-তে ব্রিটিশ সরকার আইন করে বন্ধ করে দেয়। তবে আজও গ্রামবাংলার বহু জায়গায় এইভাবে চড়ক পুজো পালিত হয়ে থাকে। চড়কপুজো মূলত দেখা যায় বা পালিত হয় কৃষিপ্রধান অঞ্চলে। কলকাতা শহরেও দেখা গেছে এমন চড়কপুজো।
সারা বাংলা জুড়েই পালিত হয় চড়কপুজো। হাওড়া জেলার বালিগ্রামের কল্যাণেশ্বরতলায় বহুকাল ধরে পালিত হয়ে আসছে চড়কপুজো বা চড়কের ঝাঁপ। কল্যাণেশ্বর শিবমন্দির বহু পুরনো। শোনা যায়, এই মন্দিরে নাকি পুজো করতে আসতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব। এছাড়া কাছেই পঞ্চাননতলায় বাবা পঞ্চাননমন্দিরের সামনে চড়কের ঝাঁপ আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। নদীয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবের গাজন উপলক্ষে মেলা বসে। সেই মেলা শতাধিক বছরের পুরনো। তারকেশ্বর ধামেও গাজনের মেলা বসে। বাঁকুড়ার খামারবেড়ে অঞ্চলে শিবের গাজন এবং মেলা হয়। হুগলির চণ্ডীপুর গ্রাম ছাড়াও আরও বেশকিছু জায়গায় শিবের গাজন উপলক্ষে চড়কপুজোর মেলা বসে। প্রচুর লোক সমাগমও হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন বাড়ির মহিলারা সংসার এবং সন্তানের মঙ্গলকামনায় পালন করেন নীলষষ্ঠী। এটি বাঙালি গৃহিণীদের ব্রত। নীল বা নীলকণ্ঠ হল শিবের আর এক নাম। কোথাও কোথাও নীলসন্ন্যাসী এবং শিব-দুর্গার সঙ সেজে নীলের মূর্তি নিয়ে গান গাইতে গাইতে তাঁরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘোরেন। গ্রামের মানুষেরা তাঁদের ভিক্ষা দান করেন।
কিছু কিছু জায়গায় চৈত্রসংক্রান্তির দিন চড়কপুজো বা উৎসব হলেও তা চলে বৈশাখ মাসের প্রথম কয়েক দিনও। প্রকাণ্ড একটি গাছের কাণ্ডকে ‘চড়ক গাছ’ বলে অভিহিত করা হয়। গচড়ক গাছটি সারাবছর জলে ডোবানো থাকে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে শিবের নাম জয়ধ্বনি দিয়ে জল থেকে তোলা হয় গাছটি।। কিছু জায়গায় তোলা হয় আগের দিন। চড়ক গাছ পুজো করে মাটিতে সোজা করে পুঁতে দেওয়া হয়। আগায় বাঁধা হয় কাঠ। গাছটি হল শিবের প্রতীক, আর পার্বতীর প্রতীক জমি। চড়ক হল শিব-পার্বতীর মিলনের উৎসব। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির কামনা নিয়ে কৃষকেরা মাতেন চড়ক উৎসবে। বোঝা যাচ্ছে, চড়কপুজো হল কৃষিকাজের উন্নয়নের উৎসব।