14th Oct 2024

Highlights :

www.rojkarananya.com news

শ্যামলী ত্রিপুরার রূপসুধা

18th May 2024

ভ্রমণ

রঞ্জনা দত্ত


ত্রিপুরা আমায় টানে৷ ত্রিপুরা আমার হৃদয়জুড়ে৷ এ টান আমার রক্তের৷ কারণ আমার বাবা বহুদিন ত্রিপুরায় ছিলেন চাকরিসূত্রে৷ তাই আমার জন্ম ত্রিপুরায় না হলেও বেড়ে ওঠা আমার ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাতেই৷ আর এই বেড়ে ওঠার সুবাদেই শ্যামলী ত্রিপুরার প্রতি টান আমার অন্তরের৷ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই টান আমি অনুভব করতে পারি৷

তাই পাঠকেরা একবার আসুন ত্রিপুরায়৷ আপনারা সৌন্দর্য্যের পূজারী৷ সবার অনাদরে ত্রিপুরার বুকে আত্মগোপন করে থাকা সৌন্দর্য্য আপনারা চোখ মেলে হৃদয় খুলে এসে দেখে যান....৷ শ্যামলী ত্রিপুরার রূপসুধা পান করে যেতে অসুবিধাটা কোথায়? হলফ করে বলতে পারি আনন্দ পাবেন আর হৃদয়জুড়ে থাকবে এই অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি৷

ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব কোণে ২ লক্ষ ৬২ হাজার ২৩০ বর্গকিমি এলাকা নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্বাঞ্চল৷ অরুণাচল, আসাম, সিকিম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা--- এই আটটি রাজ্য হিমালয়ের কোল ঘেঁষে অবস্থিত৷ প্রকৃতির এই অচেনা ভূমি এখনো পর্যটকদের আবিস্কারের অপেক্ষায়৷

উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের নাম ত্রিপুরা৷ মৈত্রীর সংসৃকতির জন্য এর তুলনা হয় না৷ নানা জাতি-জনজাতি গোষ্ঠীর সংশ্লেষণে তৈরি হয়েছে সম্প্রীতি ঐতিহ্যের এক নিজস্ব সংস্কৃতি৷ এক সময়ের রাজন্য ত্রিপুরা আজ গণতন্ত্রের পীঠভূমি৷ দেশ বিভাগের যন্ত্রণা সবচাইতে বেশি সইতে হয়েছে এই রাজ্যকে৷ আর তাই দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়েছে ত্রিপুরা৷

প্রকৃতি অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে ত্রিপুরাকে৷ বর্ষায় এর অপূর্ব সৌন্দর্য, সবুজের স্নিগ্দ ক্যানভাস, আর বৃষ্টির ছন্দে মুগ্ধ হতে হয়৷ প্রত্নতত্ত্ব, লুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণীর সমাহার, পূর্ব ভারতের সেরা স্থাপত্য উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ, জলের বুকে ভেসে থাকা নীরমহল, পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যাস রিলিফ ঊনকোটি, নদী দিয়ে যেতে পাহাড়ের গায়ে খোদাই ছবিমুড়া ও পাখির কলতানে মুখরিত রূপসুধায় উদ্বেল হয়ে উঠে মন৷

রিয়াং জনজাতিদের পৃথিবীখ্যাত হজাগিরি নৃত্য, চাকমাদের বিঝু নৃত্য, রবীন্দ্র-স্মৃতিধন্য ত্রিপুরা পর্যটকদের কাছে টানছে৷

শহর আগরতলা ত্রিপুরার রাজধানী৷ হাওড়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছে এই শহর৷ আকারে অনেকটা কড়াইয়ের মতো৷ ফলে প্রবল বর্ষণে কিছু অঞ্চল বর্ষাকালে জলমগ্ন হয় আবার দ্রুত জল সরেও যায়৷ আগরতলায় দেখার জন্য রয়েছে উজ্জ্বয়ন্ত প্রাসাদ, ধর্মীয় স্থানগুলো যেমন--- দূর্গাবাড়ি, লক্ষ্মীনারায়ণ বাড়ি, জগন্নাথ মন্দির, উমা-মহেশ্বরী মন্দির, বুদ্ধ মন্দির, শিবনগরের গেদুমিয়া মসজিদ, পুষ্পবন্ত প্রাসাদ, ক্যাপিটেল কমপ্লেক্স, মালঞ্চ নিবাস, হেরিটেজ পার্ক, রবীন্দ্র কানন, নেহেরু পার্ক, খুমুলুঙ, বড়োমুড়া ইকো পার্ক, এম বি বি কলেজ, অর্কনীড়৷

একসময়ে এই শহরে অনেক আগর গাছ ছিল বলে এর নাম আগরতলা আবার অনেকের মতে রাজা আগরফার নামে হয়েছে আগরতলা৷ মহারাজা বীরবিক্রমের শাসনকালে নতুন হাভেলি নাম বদলে আগরতলার নামকরণ করা হয়৷ বীরবিক্রমের আমলেই আধুনিক রূপ পায় আগরতলা৷ তার আগে যদিও রবীন্দ্রনাথের পরম সুহৃদ মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সময় থেকেই শহর গড়ে উঠতে শুরু করেছিল৷ তবে রোমের আদলে থামওয়ালা বারান্দার ফুটপাত, সরলরেখায় গড়া সড়ক, বিজলি বাতির ব্যবহার হয় বীর বিক্রমের সময়েই৷

একসময় নগর কীর্তন, যাত্রাপালা, রাসলীলা, দোল উৎসবে মাততেন শহরবাসী৷ রবীন্দ্রধন্য আগরতলা প্রতিদিন কোনো না কোনো সাংসৃকতিক অনুষ্ঠানে মাতে৷ মহিলাদের অংশগ্রহণে সমস্ত অনুষ্ঠানই মুখরিত৷ রাজন্য আমলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পাশাপাশি রবীন্দ্র নৃত্য-সঙ্গীতে আগরতলার আকাশ বাতাস মুখরিত৷

নীরমহল

ত্রিপুরার রাজাদের অপূর্ব কীর্তি এই জলমহল৷ রাজস্থানের জলমহল থেকে অনেক বড় ও অনেক বেশি আকর্ষণীয়৷ প্রায় ৩০০ হেক্টরের প্রাকৃতিক জলাশয় রুদ্র সাগরের বুকে ভেসে আছে এই অপূর্ব কীর্তি৷ ত্রিপুরার পর্যটন ক্ষেত্রের অন্যতম স্থান এটি৷

শৈলশিখর জম্পুই

কমলার বাগানের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এই জম্পুই৷ জম্পুই পাহাড়ের ভাঙমুন-এ রয়েছে পর্যটন নিগমের টুরিস্ট লজ৷ চির বসন্তের পাহাড়ও বলে জম্পুইকে৷ শীতের মরশুমেও মেঘেদের লুকোচুরি খেলা মন ভরিয়ে দেয়৷

ঊনকোটি

রাজ্যের আরেক অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ঊনকোটি৷ কোটি থেকে এক কম মূর্তি ছিল বলে এই নাম৷ এখানে পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাথরের এত অজস্র মূর্তি আছে যে তার ইয়ত্তা নেই৷ ঊনকোটি পাহাড়ের গহিন অরণ্য লুকিয়ে আছে শিল্প সুষমামন্ডিত এই মূর্তিগুলি৷ কারা এত এত পাহাড় কেটে এই সুন্দর মূর্তি গড়েছেন, তা জানা না গেলেও কিছু মিথ চালু আছে এসব মূর্তি ঘিরে৷ যেমন -- একটি  পাহাড়ের নাম রঘুনন্দন পাহাড়৷ একদিন কৈলাসপতি শিব দেবকূলের সঙ্গে এই পথ দিয়ে বারাণসী যাচ্ছিলেন৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ঠিক হয় এই রঘুনন্দন পর্বতে হবে রাত্রিযাপন৷ কথা ছিল ভোরে আবার যাত্রা করবেন৷ কিন্তু পথশ্রমে ক্লান্ত দেবাতারা পরদিন আর উঠতে না পেরে পাহাড়েই অনন্তকাল ধরে পাথর হয়ে রইলেন৷ একা শিব যাত্রা করেছিলেন৷

ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির

উদয়পুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অনুচ্চ টিলার উপর অবস্থিত এই মন্দির৷ ৫১ সতীপীঠের অন্যতম এই মন্দির৷ এখানে সতীর দক্ষিণ চরণের অংশ পড়েছিল বলে কথিত৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দির পবিত্র তীর্থস্থান৷ ১৫০১ সালে ত্রিপুরার মহারাজা ধন্য মাণিক্য এই মন্দির নির্মাণ করেন৷ প্রতিষ্ঠা করেন কালীমূর্তি৷ সেইসময় থেকেই সব ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল এই মন্দিরে৷ বলা যায় সর্বধর্ম সমন্বয় ঘটেছিল এই মন্দির ঘিরে৷ মন্দিরের পাশেই কল্যাণ সাগরে রয়েছে ৩০০ বছরের পুরানো কচ্ছপেরা৷ শত বছরের পুরানো মাছেরাও খেলা করে৷

ছবিমুড়া

অমরপুর শহর থেকে বামপুর৷ ওখান থেকে নদীপথ৷ দুদিকের পাহাড়, জঙ্গল, সবুজ বনানী দিয়ে ঘেরা নদীপথে যেতে যেতে আমাজনের সঙ্গে তুলনা করেন পর্যটকরা৷ আসা-যাওয়ার ১০ কিমি জলপথ ভ্রমণের পর মিলবে পাহাড়ের গায়ে প্যানেল৷ বেলে পাথর কেটে কেটে বানানো হয়েছে  এই প্যানেল৷ বিষ্ণু, কার্তিক, শিব, দুর্গাসহ নানা দেবদেবীর মূর্তি৷ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা এসব মূর্তি দেখতে হবে নৌকায় চড়ে৷ পাহাড় এতোটাই খাড়া যে ওঠা দায়৷ ছবিমুড়াকে তাই অনেকেই বলেন দেবতামুড়া৷

তৃষ্ণা

রাজ্যের অন্যতম অভয়ারণ্য৷ বাইসনের জন্য বিখ্যাত এলাকাটি৷ এখানে ১৩০-১৪০ টি বাইসন রয়েছে৷ প্রচুর জলাশয়, বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের শোভা পর্যটকদের মন কেড়ে নেয়৷ ৪৫৬ প্রজাতির গাছ লতা গুল্ম রয়েছে৷ উল্লুক, চশমাবানর, হনুমান, সজারু, বন্যশূকর রয়েছে প্রচুর এখানে৷ দেড়শো প্রজাতির পাখি৷ প্রজাপতি ও কোবরাও দেখতে পাওয়া যায়৷ এখানে থাকার বাংলোর সামনে বিরাট লেক, ঘন সবুজ জঙ্গলের দ্বীপ এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয়৷ লেকের পাড়ে পাড়ে ট্রেকিং করা ও জলাশয়ে বোটিং করা যায়৷

প্রত্ন ও প্রকৃতির যুগলবন্দি ত্রিপুরার অনন্য সম্পদ৷ জনজীবনের বহুভাষিক ও বহুমাত্রিক দ্যোতনা অনুভব করতে গেলে এবং ত্রিপুরার বহুরৈখিক সংস্কৃতির জীবনরেখাকে যদি অজানা থেকে জানার পারাপারে নিয়ে আসতে হয় তবে অবশ্যই একবার আসতেই হবে শ্যামলী ত্রিপুরায়৷

Archive

Most Popular